বাজেট- মধ্য আয়ের দেশ ও অঘোর কবিরাজের দাওয়াই by মহিউদ্দিন আহমদ

দেশে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। আমরা খুব তাড়াতাড়িই মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যাব। গত সাধারণ নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের সীমানায় পৌঁছে যাবে। আর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আরেকটু এগিয়ে বলেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চমধ্য আয়ের দেশ। দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা নেই, মধ্য আয়ের দেশ কাকে বলে। কাকেই বা বলে উচ্চমধ্য আয়ের দেশ। আগে শুনতাম, আমরা হচ্ছি উদীয়মান বাঘ। সে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। এখনো আমরা বিড়ালই রয়ে গেছি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পৃথিবীর দেশগুলোকে নানাভাবে ভাগ করে দিয়েছে। মোটাদাগে এগুলোকে বলা হয় স্বল্পোন্নত, নিম্নমধ্য আয়, উচ্চমধ্য আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের আওতাধীন সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একটি সংজ্ঞা দিয়ে থাকে। দশগুলোকে এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) নামে ডাকা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশ আছে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আছে ১৪টি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান নেপাল ও আফগানিস্তান। আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারও স্বল্পোন্নত দেশ। মালদ্বীপ কিছুদিন আগেও ছিল স্বল্পোন্নত দেশের ক্লাবে। ২০১১ সালের পর তাদের উত্তরণ ঘটেছে মধ্য আয়ের দেশে।

২০১২ সালের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছিল, মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে মাথাপিছু জাতীয় আয় কমপক্ষে এক হাজার ১৯০ ডলার হতে হবে। তবে এটাই একমাত্র নির্ণায়ক নয়। আরও দুটো নির্ণায়ক বিবেচনা করা হয়। একটি হলো হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (মানবসম্পদ সূচক) এবং অন্যটি হলো ইকোনমিক ভালনারিবিলিটি ইনডেক্স (অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক)। মানবসম্পদ সূচকে বিবেচনা করা হয়—জনসমষ্টির কত ভাগ পুষ্টিহীনতার শিকার, শিশুমৃত্যুর হার কত, মাধ্যমিক স্কুলে কতজন লেখাপড়ার সুযোগ পায় এবং বয়স্ক সাক্ষরতার হার কত। অর্থনৈতিক সূচকে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, তার মধ্যে আছে মোট জনসংখ্যা, জনসমষ্টির বিচ্ছিন্নতা, রপ্তানিপণ্যের বহুমুখিতা আছে কি না, জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অংশ কতটুকু, জনসংখ্যার কত অংশ নিচু অঞ্চলে বসবাস করে, রপ্তানিপণ্যের স্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার যে জনসংখ্যার কত অংশ এবং কৃষি উৎপাদন কতটুকু স্থিতিশীল। এসব কিছু বিবেচনা করে এবং তার সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের ন্যূনতম ধাপটি মিলিয়ে তারপর দেখা হয় একটি দেশকে স্বল্পোন্নত বলা যায় কি যায় না। শুধু মাথাপিছু আয় দিয়েই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে না। উদাহরণস্বরূপ মিয়ানমার এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর মাথাপিছু আয় অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচকে উত্তীর্ণ না হওয়ার কারণে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেই রয়ে গেছে।
আরেকটি বিষয়, ১৯৭১ সালে যখন এই বিভাজনের শুরু, তখন বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশ হতে হলে জনসংখ্যা ৭৫ মিলিয়ন বা সাড়ে সাত কোটির কম হতে হবে। বাংলাদেশ এই হিসাবে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের বিশেষ অনুরোধে তাকে স্বল্পোন্নত দেশের ‘মর্যাদা’ দেওয়া হয়। আমরা যেচেই এই ‘রাজটিকা’ কপালে লাগিয়ে রেখেছি।
নিয়ম হলো, একটি স্বল্পোন্নত দেশ সবগুলো সূচকে উত্তীর্ণ হলেই অবধারিতভাবে তার ‘গ্র্যাজুয়েশন’ হবে না। পর পর তিন বছর এটা দেখা হবে। যদি দেখা যায়, সব সূচকে উত্তীর্ণ হওয়ার অবস্থানটি টেকসই হয়েছে, তাহলে পরবর্তী পর্যালোচনা সভায় তার ‘গ্র্যাজুয়েশন’ নিশ্চিত করা হবে। তিন বছর পর পর এই পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালের পর থেকে এযাবৎ মাত্র চারটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এর মধ্যে আছে বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, মালদ্বীপ ও সামোয়া। পরবর্তী পর্যালোচনাটি হবে ২০১৫ সালে।
বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যে পর্যায়ে আছে, তাকে সবগুলো সূচকে উত্তীর্ণ হতে হলে কয়েক বছর অপেক্ষা করতেই হবে। যখন ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০২১ সালকে পরবর্তী স্টেশন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন বুঝতে হবে যে ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০০০ সালে ‘নির্ধারণ’ করা হয়েছিল, আমরা তা পুরোপুরি পূরণ করতে পারব না। এখন অবশ্য আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে, ২০১৮ সালের মধ্যেই আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হব। ২০১৮ সালে অবশ্য এ-সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা হওয়ার কথা আছে।
তার পরও কথা থাকে। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী মাথাপিছু আয় চার হাজার ৩৬ ডলার পর্যন্ত হলে ওই দেশকে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে ধরা হয়। এসব দেশের মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরান ইত্যাদি। পরবর্তী ধাপটি হলো উচ্চমধ্য আয়ের, যা অর্জন করতে হলে মাথাপিছু জাতীয় আয় চার হাজার ৩৭ থেকে ১২ হাজার ৪৭৬ ডলারের মধ্যে থাকতে হবে।
আমরা আমাদের অবস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে যত গোঁজামিলই দিই না কেন, সবগুলো সূচকে আমরা উত্তীর্ণ হতে পারছি কি না, তা দেখার জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার তদারকি আছে। এ ক্ষেত্রে শুধু মাথাপিছু জাতীয় আয় নয়, অন্য সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে আমাদের উন্নতি হচ্ছে কি না, তা ধারাবাহিকভাবে পরিবীক্ষণ করা দরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নিয়মিত জরিপ চালিয়ে আমাদের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। তবে ইদানীং এই সংস্থাটির ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি সিপিডি একটি পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এটা সমাধান নয়। আমাদের দেশে যে কয়েকটি কমিশন আছে, তার অনেকগুলোই নখদন্তহীন। বরং উচিত হবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা আরও বাড়ানো এবং তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া।
বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও ঝুঁকি আমাদের মধ্যে প্রবল। কিছু কিছু সামাজিক সূচকে আমরা তুলনামূলকভাবে একটু সফল হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা এখনো প্রবল ঝুঁকির মধ্যে। আমাদের শিশু পুষ্টিহীনতার হার সম্ভবত এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। নিম্নাঞ্চলের মানুষ যে প্রবল ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে, তার প্রমাণ ‘সিডর’ ও ‘আইলা’। আমরা এখনো ওই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি এখনো তৈরি পোশাক খাতনির্ভর। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো অঘটন ঘটে গেলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণ খুবই জরুরি।
মধ্য আয়ের দেশ হওয়া নিয়ে এত বাগাড়ম্বর না করে আমাদের উচিত হবে সবগুলো সূচকে বছরওয়ারি অর্জন বা ব্যর্থতাগুলো সঠিকভাবে দেখা, যাতে আমরা নিজেদের অবস্থান নিরন্তর চিহ্নিত করতে পারি এবং সে অনুযায়ী প্রতিবছরের বাজেটে অগ্রাধিকার অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে পারি। স্বপ্নবিলাস, লক্ষ্যবিলাস—এসব ফাঁকা বুলি না আওড়ে আমাদের উচিত হবে খাতওয়ারি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আমরা কোনো দিকনির্দেশনা পাই না। নাগরিক সংগঠনগুলো একটু পরিশ্রম করে ছায়া বাজেট দিতে পারে। কিন্তু তারাও দেখছি গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কথা বলে না। তাদের উদ্দেশ করে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ‘অঘোর কবিরাজ’ বলেছেন। মন্তব্যটি ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
বর্তমান বাজেটে যেসব প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। আমাদের দেশে করকাঠামো অনেকটাই নির্ভর করে কোন গোষ্ঠী এনবিআরকে কতটুকু খুশি করতে পারল তার ওপর। এটা ‘ওপেন সিক্রেট’। সমাজের সব অংশের মানুষের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে যৌক্তিক করকাঠামো নির্ধারণের সংস্কৃতি এ দেশে গড়ে ওঠেনি এখনো। নাগরিক সংগঠনগুলোও এ ধরনের সংলাপের পথে হাঁটে না। তারা সেমিনার কক্ষের চার দেয়ালের মধ্যে সংখ্যা ও তত্ত্ব-কণ্টকিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে দায়সারা দায়িত্ব পালন করে। আর জিডিপি নিয়ে হইচই করে বেশি। অথচ জিডিপি হলো অনেকগুলো নির্ণায়কের মধ্যে একটি এবং তা প্রধান নির্ণায়ক নয়। একটা বিষয়ে মিল দেখা যায়—সরকারের দেওয়া বাজেট এবং নাগরিক সংগঠন ও তার্কিকদের পর্যালোচনা; দুটোতেই বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের প্রবল উপস্থিতি।
অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, ঝুঁকিপূর্ণ জাতীয় পরিস্থিতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সম্মিলনে যে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার মধ্য থেকে পরিকল্পিত উন্নয়নের ছক ও কৌশল নির্ধারণ করা কঠিন। তবে এই কঠিন কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করা ছাড়া বিকল্প নেই। বর্তমান বাজেটের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশের জন্য আমরা বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করব। এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের জাতীয় সক্ষমতা তৈরি হয়েছে অনেকখানি এবং তা সম্ভব হয়েছে এ দেশের মানুষের সম্মিলিত পরিশ্রম ও মেধা প্রয়োগের মাধ্যমে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক৷
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.