জবাবদিহি-কার্যকর সংসদের প্রত্যাশা by হারুন হাবীব
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে আমরা যারা
সাংবাদিকতায় আসি তারা বেশিরভাগই পেশার দৈনন্দিন রুটিনে এখন যুক্ত নেই।
বেশিরভাগই 'রিটায়ার' করেছেন, 'রিপোর্টিং' বলতে যা বোঝায় _ তা করা হয় না।
কিন্তু আমার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম_ সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত।
এর মধ্যে কয়েক বছর জাতীয় সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন
করলেও 'রিপোর্টিং', যা আমার প্রিয় কাজ, আমাকে আজও ছাড়েনি। দেশ-বিদেশের নানা
গণমাধ্যমে আমি আজও লিখি, লেখালেখি করেই জীবিকা নির্বাহ করি, আনন্দ লাভ
করি।
অনেককাল জাতীয় সংসদের অধিবেশন 'কভার' করতে যাইনি। অথচ বাজেট অধিবেশন 'কভার' করা নিয়ে রিপোর্টারদের মধ্যে এক সময় কি-না প্রতিযোগিতা হতো। দিন কয়েক আগে থেকে পরিকল্পনা, সকাল থেকে রাত অবধি লেখালেখি, খাওয়াদাওয়া, হইচই_ এসব। সংবাদ সংস্থায় তখন ইংরেজিই একমাত্র ভাষা ছিল। কাজেই সে আমলের 'টাইপ রাইটারে' লিখতে হতো আমাদের। প্রথম দিকে পারতাম না, পরে শিখে গেছি।
মনে পড়ে, 'টাইপ রাইটার' নিয়ে ব্যক্তিজীবনের একটা বড় বিপদ কেটেছে আমার। এমএ পাস করেছি, বাবা-মার ইচ্ছা বিয়ে দেবেন এবং এমন একজনের সঙ্গে যাকে তখনও দেখার সুযোগ হয়নি আমার। ব্যাপারটা আরও যখন এগোয় তখন সত্যি সত্যি বিপন্ন দশা বোধ করতে থাকি আমি। না পারি অস্বীকার করতে, না মেনে নিতে। এরই মধ্যে কনেপক্ষ উদ্যোগী হয়ে পাত্রের চাকরিস্থলসহ আয়-উপার্জন সরেজমিন পরীক্ষা করতে ঢাকায় এসে উপস্থিত হলো। আমার কর্মস্থল ছিল তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউর বিপিআই বার্তা সংস্থা অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল। মীজান ভাই অর্থাৎ মীজানুর রহমান তখন আমাদের এডিটর।
সেদিনই জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাজেট পেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাশে বসা। স্বাধীনতা-উত্তর দ্বিতীয় বাজেট। টাইপ রাইটারে আঙুল চালিয়ে আমরা রিপোর্টাররা ঘর্মাক্ত হচ্ছি। একের পর এক 'নিউজ আইটেম' বানাতে হচ্ছে। এডিটিং হওয়ার পর সেগুলো টেলিপ্রিন্টারে পত্রিকার অফিস ও রেডিও-টেলিভিশনের নিউজরুমে চলে যাচ্ছে। কাজেই কে এলো কে গেল ভাবার সময় নেই আমাদের । ভালো 'আইটেম' করতে পারলে সম্পাদকের প্রশংসা পাব। এরই মধ্যে কনেপক্ষের পাত্র দেখা চলছে। কিন্তু পাত্রকে যখন মাথা গুঁজে টাইপ করতে দেখা গেল তখন স্বাভাবিকভাবেই কনেপক্ষের মোহভঙ্গ ঘটল। এ তো 'টাইপিস্ট', সাংবাদিক কোথায়! ব্যস, দিন কয়েকের মধ্যেই নানা অজুহাতে কনেপক্ষ বেঁকে বসল। আর যাই হোক বড় লোকের ইন্টারমিডিয়েট পাস সুন্দরী মেয়েকে তো 'টাইপিস্টে'র সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যায় না!
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ছেড়েছি ১৩ বছর। সেটিও আবার বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই। প্রথমে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলো আমাকে। আমি জানি, আমি সরকারি কর্মকর্তা নই, অতএব আইনের আশ্রয় নিলাম। এরপর নানা খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করা হলো। ভাবলাম, এ অন্যায়ের প্রতিবাদ জরুরি। কাজেই হাইকোর্টে রিট দায়ের করলাম। বেতনভাতা বন্ধ থাকল বছরের পর বছর। মামলা-মোকদ্দমায় কাটল সাত বছর। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বছরের পর বছর বিনা পয়সায় মামলা পরিচালনা করে আমাকে কৃতজ্ঞ করেছেন। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আমি জিতেছি। দেশের মিডিয়া ইতিহাসে এ রকম দীর্ঘস্থায়ী মামলা আর হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু মামলা জিতলেও আমি কর্মস্থলে যোগ দিতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরির বাড়তি সুযোগ আমি গ্রহণ করিনি।
নবম সংসদের শেষ বাজেট অধিবেশন নিয়ে লেখাটি শুরু করার আগে পুরনো ঘটনা টানছি আরও একটি কারণে। এ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো দেশের ইতিহাসে যিনি প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে সভাপতিত্ব করছেন সেই ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর হাতেই আমার চাকরিচ্যুতি চ্যালেঞ্জ করা রিট আবেদনটি লেখা হয়েছিল। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিএনপি-জামায়াত জোটের অভাবিত আক্রোশের কারণে একজন সংবাদজীবী হয়েও আমি চাকরিচ্যুত হয়েছিলাম। নিশ্চিতভাবেই জানি, ওদের কাছে আমার বড় 'অপরাধ' ছিল আমি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন পর্যায়ের একজন কর্মী এবং জাতীয় জীবনের মহত্তম সেই অধ্যায় নিয়ে নিরন্তর কাজ করি, লেখি। কাজেই অপরাধ কম হতে যাবে কোন দুঃখে?
এবার আসল কথায় আসি। ৩ জুন থেকে নবম জাতীয় সংসদের শেষ বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে চলতি বছরের শেষে এই পার্লামেন্ট তার সময়সীমা পেরোবে এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। কাজেই এবারের অধিবেশনটি একদিকে যেমন সরকারের জন্য, অন্যদিকে বিরোধী দলের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অধিবেশনটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এতে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ দিয়েছে। সোয়া এক বছর, অর্থাৎ টানা ৮৩ কর্মদিবস অনুপস্থিতির পর তারা সংসদে ফিরেছেন।
নিয়মমতে, টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। কাজেই সদস্যপদ টেকাতেই যে মূলত তাদের সংসদে ফেরা_ তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এরপরও মনে করি, এই ফেরা অর্থবহ হতে পারে যদি তারা সংসদের কার্যক্রমে পরিপূর্ণভাবে অংশ নেন, জাতির কাছে দেওয়া তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখেন। আরও মনে করি, সরকার ও বিরোধী দল আন্তরিক হলে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থারও একটা সুরাহা হতে পারে চলতি অধিবেশনেই। মোটকথা, রাজনৈতিক সংঘাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে, গ্রহণয্যেগ্য একটি নির্বাচন করে সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে ছায়া সরকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতিতে কার্যকর সংসদ খুব কমই পাওয়া গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, প্রায় প্রতিটি বিরোধী দলই সরকারবিরোধী আন্দোলনের সহজ কৌশল হিসেবে পার্লামেন্ট বর্জন করেছে। কোনো না কোনো ইস্যুতে, কোনো না কোনো অজুহাতে তারা বেরিয়ে গেছেন। যারাই বিরোধী দলে থেকেছেন অব্যাহতভাবে তারাই বর্জন সংস্কৃতি লালন করেছেন।
বর্তমান সংসদের বেলাতেও একই আশা ভঙ্গ ঘটেছে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম সংসদের উদ্বোধনী দিনে বিরোধী দলের উপস্থিতি বড় আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু আশা ভঙ্গ হতেও সময় লাগেনি। প্রথম দিনের পর থেকে টানা ৭৭ দিন অনুপস্থিতির পর সর্বশেষ বিরোধী দল গত বছরের ১৮ মার্চ সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল। এরপরও বলব, যে প্রেক্ষাপটেই বিএনপি সংসদে ফিরে আসুক না কেন তাদের এই ফিরে আসা অতীব আনন্দের। কারণ, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজপথ নয়, সহিংসতা নয়, পার্লামেন্টই একমাত্র সংবিধানসিদ্ধ স্থান, যেখানে আলোচনা করে দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। আশা করব, বিরোধী দল ও সরকার সে পথই বেছে নেবে।
বাংলাদেশের বয়স ৪২ বছর পেরোচ্ছে। রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতা আনার সময়ও পেরোচ্ছে। রাজনৈতিক কৌশল যাই থাক না কেন, বিএনপির সংসদে ফিরে আসা এবং অধিবেশনে টিকে থাকা আরও একটি কারণে জরুরি। তারা নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে আসছে। ব্যাপারটি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে এবং আলোচনার মাধ্যমেই সুরাহা হোক_ এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। রাজপথের সহিংসতা কম হয়নি। শুধু নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু কেন, জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ইস্যুই বিরোধী দল সংসদে তুলবে, তাদের দাবি ও যুক্তির কথা সরকার ও দেশবাসীকে জানাবে, এটিই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সে পথে এগোয়নি। যাদের ভোটে বিরোধী দলের সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছেন সেই ভোটারদের প্রতি সম্মান দেখাতে পারেননি তারা। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে চলতি অধিবেশনে যে মুলতবি প্রস্তাব আনা হয়েছিল, সেটিও তারা প্রথম দিনেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
সম্প্রতি দলীয়ভাবে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি আইন করে বন্ধের সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা জানিয়েছে, বর্তমান সংসদের অষ্টম থেকে পঞ্চদশ অধিবেশন পর্যন্ত বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের আর্থিক মূল্য চার কোটি টাকার বেশি। দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি এই সংস্থাটির মন্তব্য, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় গণপ্রত্যাশার কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদের কার্যকারিতার পথে সংসদ বর্জন প্রধান অন্তরায়। বিরোধীদলীয় সাংসদরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সংসদে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। যথার্থই বিরোধী দল বা জোটের সংসদ বর্জনের ধারা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। তারা নবম জাতীয় সংসদের গত দু'বছরের আট অধিবেশনের ১৬৩ কর্মদিবসের মধ্যে ১৫৩ কর্মদিবসই সংসদে যায়নি। গত সাড়ে চার বছরে বিরোধীদলীয় নেতা মোট ৮ কার্যদিবস সংসদে উপস্থিত থেকেছেন, যা নিতান্তই হতাশাজনক।
সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটের গড় ব্যয় প্রায় ৭৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের সময়ের অর্থমূল্য প্রায় ১৯ লাখ ৭ হাজার ১০০ টাকা। টিআইবি তার পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে, প্রধান বিরোধী জোটের নবম সংসদের অষ্টম থেকে পঞ্চদশ অধিবেশন পর্যন্ত সংসদ বর্জনে রাষ্ট্রের ক্ষতি চার কোটি এক লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সংসদ বর্জনের এ সংস্কৃতি সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চায় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও অদ্বিতীয়। যা একদিকে যেমন বিব্রতকর, অন্যদিকে তেমনি জনগণের ভোট ও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা।
টিআইবি এ বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশও উত্থাপিত করেছে। এর মধ্যে আছে, সংসদে অনুপস্থিতির সময়সীমা ৯০ কার্যদিবসের পরিবর্তে কমিয়ে ৩০ কার্যদিবস করা এবং অনুমোদিত ছুটি ব্যতীত একটানা ৭ কার্যদিবসের বেশি অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা। সংসদকে কার্যকর করতে তারা আরও প্রস্তাব দিয়েছে, স্বাধীন ও আত্মসমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ ও ভোটদানের স্বার্থে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, বিধি-প্রবিধান, নীতিমালার খসড়া সম্পর্কে জনমত গ্রহণে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি ওয়েবসাইট ও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা, জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে সংসদে আলোচনার বিধান ফিরিয়ে আনা এবং সংসদীয় কমিটি স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগের সুব্যবস্থা করা। আমি মনে করি, এর মধ্যে বেশ কিছু সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচিত হতে পারে।
লেখক, সাংবাদিক
hh1971@gmail.com
অনেককাল জাতীয় সংসদের অধিবেশন 'কভার' করতে যাইনি। অথচ বাজেট অধিবেশন 'কভার' করা নিয়ে রিপোর্টারদের মধ্যে এক সময় কি-না প্রতিযোগিতা হতো। দিন কয়েক আগে থেকে পরিকল্পনা, সকাল থেকে রাত অবধি লেখালেখি, খাওয়াদাওয়া, হইচই_ এসব। সংবাদ সংস্থায় তখন ইংরেজিই একমাত্র ভাষা ছিল। কাজেই সে আমলের 'টাইপ রাইটারে' লিখতে হতো আমাদের। প্রথম দিকে পারতাম না, পরে শিখে গেছি।
মনে পড়ে, 'টাইপ রাইটার' নিয়ে ব্যক্তিজীবনের একটা বড় বিপদ কেটেছে আমার। এমএ পাস করেছি, বাবা-মার ইচ্ছা বিয়ে দেবেন এবং এমন একজনের সঙ্গে যাকে তখনও দেখার সুযোগ হয়নি আমার। ব্যাপারটা আরও যখন এগোয় তখন সত্যি সত্যি বিপন্ন দশা বোধ করতে থাকি আমি। না পারি অস্বীকার করতে, না মেনে নিতে। এরই মধ্যে কনেপক্ষ উদ্যোগী হয়ে পাত্রের চাকরিস্থলসহ আয়-উপার্জন সরেজমিন পরীক্ষা করতে ঢাকায় এসে উপস্থিত হলো। আমার কর্মস্থল ছিল তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউর বিপিআই বার্তা সংস্থা অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল। মীজান ভাই অর্থাৎ মীজানুর রহমান তখন আমাদের এডিটর।
সেদিনই জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাজেট পেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাশে বসা। স্বাধীনতা-উত্তর দ্বিতীয় বাজেট। টাইপ রাইটারে আঙুল চালিয়ে আমরা রিপোর্টাররা ঘর্মাক্ত হচ্ছি। একের পর এক 'নিউজ আইটেম' বানাতে হচ্ছে। এডিটিং হওয়ার পর সেগুলো টেলিপ্রিন্টারে পত্রিকার অফিস ও রেডিও-টেলিভিশনের নিউজরুমে চলে যাচ্ছে। কাজেই কে এলো কে গেল ভাবার সময় নেই আমাদের । ভালো 'আইটেম' করতে পারলে সম্পাদকের প্রশংসা পাব। এরই মধ্যে কনেপক্ষের পাত্র দেখা চলছে। কিন্তু পাত্রকে যখন মাথা গুঁজে টাইপ করতে দেখা গেল তখন স্বাভাবিকভাবেই কনেপক্ষের মোহভঙ্গ ঘটল। এ তো 'টাইপিস্ট', সাংবাদিক কোথায়! ব্যস, দিন কয়েকের মধ্যেই নানা অজুহাতে কনেপক্ষ বেঁকে বসল। আর যাই হোক বড় লোকের ইন্টারমিডিয়েট পাস সুন্দরী মেয়েকে তো 'টাইপিস্টে'র সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যায় না!
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ছেড়েছি ১৩ বছর। সেটিও আবার বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই। প্রথমে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলো আমাকে। আমি জানি, আমি সরকারি কর্মকর্তা নই, অতএব আইনের আশ্রয় নিলাম। এরপর নানা খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করা হলো। ভাবলাম, এ অন্যায়ের প্রতিবাদ জরুরি। কাজেই হাইকোর্টে রিট দায়ের করলাম। বেতনভাতা বন্ধ থাকল বছরের পর বছর। মামলা-মোকদ্দমায় কাটল সাত বছর। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বছরের পর বছর বিনা পয়সায় মামলা পরিচালনা করে আমাকে কৃতজ্ঞ করেছেন। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আমি জিতেছি। দেশের মিডিয়া ইতিহাসে এ রকম দীর্ঘস্থায়ী মামলা আর হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু মামলা জিতলেও আমি কর্মস্থলে যোগ দিতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরির বাড়তি সুযোগ আমি গ্রহণ করিনি।
নবম সংসদের শেষ বাজেট অধিবেশন নিয়ে লেখাটি শুরু করার আগে পুরনো ঘটনা টানছি আরও একটি কারণে। এ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো দেশের ইতিহাসে যিনি প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে সভাপতিত্ব করছেন সেই ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর হাতেই আমার চাকরিচ্যুতি চ্যালেঞ্জ করা রিট আবেদনটি লেখা হয়েছিল। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিএনপি-জামায়াত জোটের অভাবিত আক্রোশের কারণে একজন সংবাদজীবী হয়েও আমি চাকরিচ্যুত হয়েছিলাম। নিশ্চিতভাবেই জানি, ওদের কাছে আমার বড় 'অপরাধ' ছিল আমি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন পর্যায়ের একজন কর্মী এবং জাতীয় জীবনের মহত্তম সেই অধ্যায় নিয়ে নিরন্তর কাজ করি, লেখি। কাজেই অপরাধ কম হতে যাবে কোন দুঃখে?
এবার আসল কথায় আসি। ৩ জুন থেকে নবম জাতীয় সংসদের শেষ বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে চলতি বছরের শেষে এই পার্লামেন্ট তার সময়সীমা পেরোবে এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। কাজেই এবারের অধিবেশনটি একদিকে যেমন সরকারের জন্য, অন্যদিকে বিরোধী দলের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অধিবেশনটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এতে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ দিয়েছে। সোয়া এক বছর, অর্থাৎ টানা ৮৩ কর্মদিবস অনুপস্থিতির পর তারা সংসদে ফিরেছেন।
নিয়মমতে, টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। কাজেই সদস্যপদ টেকাতেই যে মূলত তাদের সংসদে ফেরা_ তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এরপরও মনে করি, এই ফেরা অর্থবহ হতে পারে যদি তারা সংসদের কার্যক্রমে পরিপূর্ণভাবে অংশ নেন, জাতির কাছে দেওয়া তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখেন। আরও মনে করি, সরকার ও বিরোধী দল আন্তরিক হলে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থারও একটা সুরাহা হতে পারে চলতি অধিবেশনেই। মোটকথা, রাজনৈতিক সংঘাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে, গ্রহণয্যেগ্য একটি নির্বাচন করে সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে ছায়া সরকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতিতে কার্যকর সংসদ খুব কমই পাওয়া গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, প্রায় প্রতিটি বিরোধী দলই সরকারবিরোধী আন্দোলনের সহজ কৌশল হিসেবে পার্লামেন্ট বর্জন করেছে। কোনো না কোনো ইস্যুতে, কোনো না কোনো অজুহাতে তারা বেরিয়ে গেছেন। যারাই বিরোধী দলে থেকেছেন অব্যাহতভাবে তারাই বর্জন সংস্কৃতি লালন করেছেন।
বর্তমান সংসদের বেলাতেও একই আশা ভঙ্গ ঘটেছে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম সংসদের উদ্বোধনী দিনে বিরোধী দলের উপস্থিতি বড় আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু আশা ভঙ্গ হতেও সময় লাগেনি। প্রথম দিনের পর থেকে টানা ৭৭ দিন অনুপস্থিতির পর সর্বশেষ বিরোধী দল গত বছরের ১৮ মার্চ সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল। এরপরও বলব, যে প্রেক্ষাপটেই বিএনপি সংসদে ফিরে আসুক না কেন তাদের এই ফিরে আসা অতীব আনন্দের। কারণ, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজপথ নয়, সহিংসতা নয়, পার্লামেন্টই একমাত্র সংবিধানসিদ্ধ স্থান, যেখানে আলোচনা করে দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। আশা করব, বিরোধী দল ও সরকার সে পথই বেছে নেবে।
বাংলাদেশের বয়স ৪২ বছর পেরোচ্ছে। রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতা আনার সময়ও পেরোচ্ছে। রাজনৈতিক কৌশল যাই থাক না কেন, বিএনপির সংসদে ফিরে আসা এবং অধিবেশনে টিকে থাকা আরও একটি কারণে জরুরি। তারা নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে আসছে। ব্যাপারটি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে এবং আলোচনার মাধ্যমেই সুরাহা হোক_ এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। রাজপথের সহিংসতা কম হয়নি। শুধু নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু কেন, জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ইস্যুই বিরোধী দল সংসদে তুলবে, তাদের দাবি ও যুক্তির কথা সরকার ও দেশবাসীকে জানাবে, এটিই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সে পথে এগোয়নি। যাদের ভোটে বিরোধী দলের সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছেন সেই ভোটারদের প্রতি সম্মান দেখাতে পারেননি তারা। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে চলতি অধিবেশনে যে মুলতবি প্রস্তাব আনা হয়েছিল, সেটিও তারা প্রথম দিনেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
সম্প্রতি দলীয়ভাবে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি আইন করে বন্ধের সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা জানিয়েছে, বর্তমান সংসদের অষ্টম থেকে পঞ্চদশ অধিবেশন পর্যন্ত বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের আর্থিক মূল্য চার কোটি টাকার বেশি। দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি এই সংস্থাটির মন্তব্য, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় গণপ্রত্যাশার কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদের কার্যকারিতার পথে সংসদ বর্জন প্রধান অন্তরায়। বিরোধীদলীয় সাংসদরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সংসদে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। যথার্থই বিরোধী দল বা জোটের সংসদ বর্জনের ধারা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। তারা নবম জাতীয় সংসদের গত দু'বছরের আট অধিবেশনের ১৬৩ কর্মদিবসের মধ্যে ১৫৩ কর্মদিবসই সংসদে যায়নি। গত সাড়ে চার বছরে বিরোধীদলীয় নেতা মোট ৮ কার্যদিবস সংসদে উপস্থিত থেকেছেন, যা নিতান্তই হতাশাজনক।
সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটের গড় ব্যয় প্রায় ৭৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের সময়ের অর্থমূল্য প্রায় ১৯ লাখ ৭ হাজার ১০০ টাকা। টিআইবি তার পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে, প্রধান বিরোধী জোটের নবম সংসদের অষ্টম থেকে পঞ্চদশ অধিবেশন পর্যন্ত সংসদ বর্জনে রাষ্ট্রের ক্ষতি চার কোটি এক লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সংসদ বর্জনের এ সংস্কৃতি সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চায় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও অদ্বিতীয়। যা একদিকে যেমন বিব্রতকর, অন্যদিকে তেমনি জনগণের ভোট ও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা।
টিআইবি এ বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশও উত্থাপিত করেছে। এর মধ্যে আছে, সংসদে অনুপস্থিতির সময়সীমা ৯০ কার্যদিবসের পরিবর্তে কমিয়ে ৩০ কার্যদিবস করা এবং অনুমোদিত ছুটি ব্যতীত একটানা ৭ কার্যদিবসের বেশি অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা। সংসদকে কার্যকর করতে তারা আরও প্রস্তাব দিয়েছে, স্বাধীন ও আত্মসমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ ও ভোটদানের স্বার্থে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, বিধি-প্রবিধান, নীতিমালার খসড়া সম্পর্কে জনমত গ্রহণে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি ওয়েবসাইট ও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা, জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে সংসদে আলোচনার বিধান ফিরিয়ে আনা এবং সংসদীয় কমিটি স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগের সুব্যবস্থা করা। আমি মনে করি, এর মধ্যে বেশ কিছু সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচিত হতে পারে।
লেখক, সাংবাদিক
hh1971@gmail.com
No comments