নির্বাচনী রাজনীতির বাজেট by আবুল কাশেম ও রাজীব আহমেদ
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী
আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের যে বাজেট পেশ করেছেন, তাতে অনেক
ক্ষেত্রেই আছে নির্বাচনী চিন্তার প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট
সরকারের এটি শেষ বাজেট।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল
মুহিতের জীবনেও সম্ভবত শেষ বাজেট উপস্থাপন এটি। এ বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য
দিক হলো, বাড়তি অর্থ চেয়ে কাউকে আঘাত করতে চাননি অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে জনকল্যাণের সমন্বয় সাধনের একটি চেষ্টা লক্ষণীয়। সবাইকে খুশি করতে গিয়ে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা ব্যয়ের অনেক পথ দেখিয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এই বিপুল ব্যয়ের অর্থ জোগাড় করা কতটা বাস্তবসম্মত হবে সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্যে আছে বৈপরীত্য। একদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন, নির্বাচনের বছর উৎপাদনের গতি কমে যায়। অন্যদিকে গতিহীন উৎপাদনের বছরে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন তিনি। তিনটি সরকারের বাস্তবায়নের বাজেটে তিনি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছেন।
এত বড় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও করহার বেড়েছে খুব কম ক্ষেত্রে। মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বেড়েছে শুধু খুচরা দোকান পর্যায়ে বছরে ৩০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। করপোরেট কর মোটা দাগে অপরিবর্তিত আছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যের শিরোণাম দিয়েছেন 'উন্নয়নের চার বছর : স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ'। বাজেট বক্তৃতায় বিদায়ের সুর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আবার জনগণের ভোটে জিতে সরকার গঠনের প্রত্যাশাও।
বর্তমান সরকারের দুর্বলতার বড় জায়গা শেয়ারবাজার। বাজেটে শেয়ারবাজারে বিশেষ প্রণোদনা থাকছে। সাধারণ মানুষের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়া ও পরিবহন ভাতার করমুক্ত সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশীয় শিল্পে দেওয়া হয়েছে বড় ধরনের সুবিধা। পাশাপাশি কিছু পণ্যের কর ছাড় সুবিধা অব্যাহত রেখে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছে।
শেষ বছরে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকেই নজর ছিল অর্থমন্ত্রীর। এ জন্য বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে মন্দার মধ্যেও সুদের হার কমানোর বিষয়ে কোনো কথা বা ইঙ্গিত নেই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। বরং আছে মূল্যস্ফীতি কম রাখার আশাবাদ। আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি মধ্যমেয়াদে অর্থাৎ ডিসেম্বরের দিকে যখন নির্বাচনের হাওয়া বইবে দেশজুড়ে, তখন মূল্যস্ফীতি কমে ৫.৫ শতাংশে নামতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বেশিসংখ্যক অসহায় মানুষের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। হাওর উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। চরজীবিকায়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬৮ হাজার পরিবারের তিন লাখ সদস্যের কর্মসংস্থানের জন্য বরাদ্দ থাকছে বাজেটে। প্রথমবারের মতো শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের বিত্তবানদের ন্যূনতম আয় করে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
আমদানি করহার কমানোর প্রস্তাব : আমদানি করহার কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে দাতাদের শর্তের কারণে, কিছুটা উৎপাদনে উৎসাহ বাড়াতে, আর কিছুটা নিত্যব্যবহার্য ভোগ্যপণ্যের বাজারদর কমাতে। ভোটের আগে এটা বেশ জনপ্রিয় হবে। তবে দেশীয় উৎস থেকে কর সংগ্রহ করে রাজস্ব কিভাবে বাড়ানো যায়, সেটা পরবর্তী সরকারের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রেখে গেলেন অর্থমন্ত্রী। ফলে নির্বাচনমুখী এ বাজেটের দায় পড়বে নতুন সরকারের ঘাড়ে।
আগের কথা, এখনকার কথা : গত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বাজেটটি (২০০৬-০৭ অর্থবছরের) দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের চার মাস আগে। তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান তখনো এভাবেই ভোটার আকৃষ্ট করার চেষ্টায় শুল্ক করে ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি জনপ্রিয় নানা উদ্যোগ নেন। তাঁর ওই বাজেট সম্পর্কে তখনকার আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, 'ভেবেছিলাম, এটি মানুষের বাজেট হবে। হয়েছে নির্বাচনের বাজেট। থোক বরাদ্দের সবই লুটপাট হবে।'
এম সাইফুর রহমান জীবিত থাকলে মুহিতের এ বাজেট নিয়ে কী বলতেন, তা জানা সম্ভব নয়। তবে তাঁর এ বাজেটকেও যে মানুষ 'নির্বাচনী বাজেট' বলে অভিহিত করবে, সে ধারণাও রয়েছে তাঁর। বাজেট বক্তব্যে তাই আগেই বলেছেন, 'বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ পরিস্থিতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজনীয় বিপুল সম্পদের চাহিদার বিষয়টি নির্মোহভাবে ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করেছি। নির্বাচনকেন্দ্রিক চিন্তার পরিবর্তে প্রাধান্য দিয়েছি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার নিরিখে যে বাজেট কাঠামো আগামী অর্থবছর বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি, তা যেমন প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে, তেমনি তা মূল্যস্ফীতিকে সংযত রাখবে। জনগণ এতে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখবে।'
নির্বাচনী বছরেও উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা : ১৯৯০ সাল থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সে বছরই আগের বছরগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। এ বিষয়ে পরিসংখ্যান তুলে ধরে মুহিত বলেছেন, নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধির হার ২.৬ শতাংশ থেকে ০.৩ শতাংশ কমে যায়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনী বছরে দেশের মানুষকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করেছেন তিনি ৭.২ শতাংশ; যদিও চলতি অর্থবছরে এর থেকে ১ শতাংশ পেছনে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর হিসাবে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও স্থিতিশীল থাকবে। ফলে দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি সরকারের পদক্ষেপের ফলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে ঘাটতি কমবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হবে দুই অঙ্কের ঘরে। ফলে দেশের ভেতরে দ্রব্যমূল্যও স্থিতিশীল থাকবে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা মেলানোর চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিজীবনে হতাশা ও সাফল্যের হিসাবে। তিনি বলেছেন, 'আমি আশিতে পদার্পণ করেছি, জীবনে হতাশা ও সাফল্যের দোলাচলে বরাবর নিক্ষিপ্ত হয়েছি। তবে সর্বদাই আমি ঘনঘটার মধ্যে শান্তি দেখেছি। মেঘের আড়ালে রুপালি নয়, সোনালি রেখা দেখেছি।'
দায়িত্ব পরের কাঁধে : বড় বড় আশার বাণী আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার পরও দেখানো হয়েছে আরো অনেক স্বপ্ন। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সেসব প্রতিশ্রুতি আর অঙ্গীকার পূরণে সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব মেলানো, বাজেটের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর চেয়ে বেশি কঠিন হয়েছে অর্থমন্ত্রীর জন্য। তাঁর হিসাবে এ পর্যন্ত ৩৩৫টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে চলমান দেখানো হয়েছে ২৬০টি, এর বেশির ভাগই এখনো বৈঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর ২৮টি প্রকল্পের তালিকা দিয়ে তিনি স্বীকার করেছেন, এসব প্রকল্পে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই নিজেদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছেন পরবর্তী সরকারের কাঁধে। কোন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে সে দায়িত্বও পরের সরকারকে দিয়ে গেলেন অর্থমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'আমাদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করছি অকপটে। প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে শতভাগ সফলতার দাবি আমি করব না। তবে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। আমাদের পরে যাঁরাই ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন। তাঁদের জন্য থাকছে আমার শুভ কামনা।'
আয়-ব্যয়ের হিসাব : প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা অনুন্নয়নমূলক ব্যয় এবং ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা উন্নয়নমূলক ব্যয়। বাকি অর্থ ব্যয় হবে এডিপি-বহির্ভূত প্রকল্প ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে। এই ব্যয় মেটানো হবে এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকার রাজস্ব আয় ও ঘাটতি অর্থায়ন থেকে।
রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। এটি মোট বাজেট ব্যয়ের ৬১.২ শতাংশ। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর থেকে আদায় করা হবে ৪৯ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, যা ধনী-গরিব সবার ওপরই পড়বে সমানহারে। ব্যক্তিগত আয় ও মুনাফার ওপর কর খাত থেকে পাওয়া যাবে ৪৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক থেকে ২০ হাজার ৮৫৩ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে আয় হবে ১৪ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা আসবে আবগারী শুল্ক ও অন্যান্য শুল্ককর থেকে। আর কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। এটি মূলত সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সেবা ফি, টোল, লেভি ইত্যাদির চার্জ থেকে আসবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ফি, ভাড়া ও ইজারা, ডাক বিভাগ ও মূলধন রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ায় ঘাটতি থাকছে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা বা জিডিপির ৫ শতাংশ। নতুন বছরে ঘাটতি অর্থের মধ্যে ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা দেশীয় উৎস থেকে ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। বাকি অর্থ আসবে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে। আর বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।
বিরোধী দলহীন বাজেট অধিবেশন : চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বাজেট অধিবেশনে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদে উপস্থিত ছিল। কিন্তু গতকাল বাজেট উপস্থাপনকালে বিরোধী দলের দেখা পাননি অর্থমন্ত্রী। তাই নিজ সমর্থকদের সামনেই বিকেল ৩টা ১৪ মিনিট থেকে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে তিনি বক্তব্যের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে, কিছুটা বসে উপস্থাপন করেন। বাকিটুকু পঠিত বলে গণ্য করেন স্পিকার।
অবশ্য বসে বাজেট উপস্থাপনের বিষয়ে শুরুতেই স্পিকারের অনুমতি নেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় সংসদে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হকসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও কূটনীতিকরা নির্ধারিত গ্যালারিতে বসে বক্তব্য শোনেন। স্পিকারের চেয়ারের পেছনে দুটি এবং দুই দর্শক গ্যালারির পাশে দুটিসহ মোট চারটি বড় স্ক্রিনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বাজেট বক্তৃতার পুরো অংশ ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয়। এ ছাড়া সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের পাশে চারটি এলসিডি মনিটর বসানো হয়। বাজেট বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়।
বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে অর্থ বিল-২০১৩ সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ এবং কিছু আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিলটি ৩০ জুন পাস হবে।
সংশোধিত বাজেট উপস্থাপন : গতকাল সংসদে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বাজেটের মোট ব্যয় এক লাখ ৮৯ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রাপ্তির এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা রাজস্ব বোর্ডের করব্যবস্থা থেকে, ২২ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা কর ছাড়া রাজস্ব এবং পাঁচ হাজার ২৮০ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান প্রাপ্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় এক লাখ ১০ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ৫৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার এডিপি ও বাকিটা এডিপি-বহির্ভূত প্রকল্প এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে। সব মিলিয়ে বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি ৪৯ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৮ শতাংশ। এই ঘাটতির ৩২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা অর্থায়ন হয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, যার মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয়েছে ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ এসেছে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে। আর বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ আট হাজার ৪৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে জনকল্যাণের সমন্বয় সাধনের একটি চেষ্টা লক্ষণীয়। সবাইকে খুশি করতে গিয়ে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা ব্যয়ের অনেক পথ দেখিয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এই বিপুল ব্যয়ের অর্থ জোগাড় করা কতটা বাস্তবসম্মত হবে সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্যে আছে বৈপরীত্য। একদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন, নির্বাচনের বছর উৎপাদনের গতি কমে যায়। অন্যদিকে গতিহীন উৎপাদনের বছরে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন তিনি। তিনটি সরকারের বাস্তবায়নের বাজেটে তিনি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছেন।
এত বড় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও করহার বেড়েছে খুব কম ক্ষেত্রে। মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বেড়েছে শুধু খুচরা দোকান পর্যায়ে বছরে ৩০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। করপোরেট কর মোটা দাগে অপরিবর্তিত আছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যের শিরোণাম দিয়েছেন 'উন্নয়নের চার বছর : স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ'। বাজেট বক্তৃতায় বিদায়ের সুর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আবার জনগণের ভোটে জিতে সরকার গঠনের প্রত্যাশাও।
বর্তমান সরকারের দুর্বলতার বড় জায়গা শেয়ারবাজার। বাজেটে শেয়ারবাজারে বিশেষ প্রণোদনা থাকছে। সাধারণ মানুষের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়া ও পরিবহন ভাতার করমুক্ত সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশীয় শিল্পে দেওয়া হয়েছে বড় ধরনের সুবিধা। পাশাপাশি কিছু পণ্যের কর ছাড় সুবিধা অব্যাহত রেখে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছে।
শেষ বছরে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকেই নজর ছিল অর্থমন্ত্রীর। এ জন্য বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে মন্দার মধ্যেও সুদের হার কমানোর বিষয়ে কোনো কথা বা ইঙ্গিত নেই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। বরং আছে মূল্যস্ফীতি কম রাখার আশাবাদ। আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি মধ্যমেয়াদে অর্থাৎ ডিসেম্বরের দিকে যখন নির্বাচনের হাওয়া বইবে দেশজুড়ে, তখন মূল্যস্ফীতি কমে ৫.৫ শতাংশে নামতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বেশিসংখ্যক অসহায় মানুষের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। হাওর উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। চরজীবিকায়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬৮ হাজার পরিবারের তিন লাখ সদস্যের কর্মসংস্থানের জন্য বরাদ্দ থাকছে বাজেটে। প্রথমবারের মতো শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের বিত্তবানদের ন্যূনতম আয় করে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
আমদানি করহার কমানোর প্রস্তাব : আমদানি করহার কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে দাতাদের শর্তের কারণে, কিছুটা উৎপাদনে উৎসাহ বাড়াতে, আর কিছুটা নিত্যব্যবহার্য ভোগ্যপণ্যের বাজারদর কমাতে। ভোটের আগে এটা বেশ জনপ্রিয় হবে। তবে দেশীয় উৎস থেকে কর সংগ্রহ করে রাজস্ব কিভাবে বাড়ানো যায়, সেটা পরবর্তী সরকারের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রেখে গেলেন অর্থমন্ত্রী। ফলে নির্বাচনমুখী এ বাজেটের দায় পড়বে নতুন সরকারের ঘাড়ে।
আগের কথা, এখনকার কথা : গত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বাজেটটি (২০০৬-০৭ অর্থবছরের) দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের চার মাস আগে। তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান তখনো এভাবেই ভোটার আকৃষ্ট করার চেষ্টায় শুল্ক করে ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি জনপ্রিয় নানা উদ্যোগ নেন। তাঁর ওই বাজেট সম্পর্কে তখনকার আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, 'ভেবেছিলাম, এটি মানুষের বাজেট হবে। হয়েছে নির্বাচনের বাজেট। থোক বরাদ্দের সবই লুটপাট হবে।'
এম সাইফুর রহমান জীবিত থাকলে মুহিতের এ বাজেট নিয়ে কী বলতেন, তা জানা সম্ভব নয়। তবে তাঁর এ বাজেটকেও যে মানুষ 'নির্বাচনী বাজেট' বলে অভিহিত করবে, সে ধারণাও রয়েছে তাঁর। বাজেট বক্তব্যে তাই আগেই বলেছেন, 'বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ পরিস্থিতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজনীয় বিপুল সম্পদের চাহিদার বিষয়টি নির্মোহভাবে ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করেছি। নির্বাচনকেন্দ্রিক চিন্তার পরিবর্তে প্রাধান্য দিয়েছি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার নিরিখে যে বাজেট কাঠামো আগামী অর্থবছর বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি, তা যেমন প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে, তেমনি তা মূল্যস্ফীতিকে সংযত রাখবে। জনগণ এতে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখবে।'
নির্বাচনী বছরেও উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা : ১৯৯০ সাল থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সে বছরই আগের বছরগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। এ বিষয়ে পরিসংখ্যান তুলে ধরে মুহিত বলেছেন, নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধির হার ২.৬ শতাংশ থেকে ০.৩ শতাংশ কমে যায়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনী বছরে দেশের মানুষকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করেছেন তিনি ৭.২ শতাংশ; যদিও চলতি অর্থবছরে এর থেকে ১ শতাংশ পেছনে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর হিসাবে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও স্থিতিশীল থাকবে। ফলে দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি সরকারের পদক্ষেপের ফলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে ঘাটতি কমবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হবে দুই অঙ্কের ঘরে। ফলে দেশের ভেতরে দ্রব্যমূল্যও স্থিতিশীল থাকবে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা মেলানোর চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিজীবনে হতাশা ও সাফল্যের হিসাবে। তিনি বলেছেন, 'আমি আশিতে পদার্পণ করেছি, জীবনে হতাশা ও সাফল্যের দোলাচলে বরাবর নিক্ষিপ্ত হয়েছি। তবে সর্বদাই আমি ঘনঘটার মধ্যে শান্তি দেখেছি। মেঘের আড়ালে রুপালি নয়, সোনালি রেখা দেখেছি।'
দায়িত্ব পরের কাঁধে : বড় বড় আশার বাণী আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার পরও দেখানো হয়েছে আরো অনেক স্বপ্ন। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সেসব প্রতিশ্রুতি আর অঙ্গীকার পূরণে সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব মেলানো, বাজেটের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর চেয়ে বেশি কঠিন হয়েছে অর্থমন্ত্রীর জন্য। তাঁর হিসাবে এ পর্যন্ত ৩৩৫টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে চলমান দেখানো হয়েছে ২৬০টি, এর বেশির ভাগই এখনো বৈঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর ২৮টি প্রকল্পের তালিকা দিয়ে তিনি স্বীকার করেছেন, এসব প্রকল্পে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই নিজেদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছেন পরবর্তী সরকারের কাঁধে। কোন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে সে দায়িত্বও পরের সরকারকে দিয়ে গেলেন অর্থমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'আমাদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করছি অকপটে। প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে শতভাগ সফলতার দাবি আমি করব না। তবে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। আমাদের পরে যাঁরাই ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন। তাঁদের জন্য থাকছে আমার শুভ কামনা।'
আয়-ব্যয়ের হিসাব : প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা অনুন্নয়নমূলক ব্যয় এবং ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা উন্নয়নমূলক ব্যয়। বাকি অর্থ ব্যয় হবে এডিপি-বহির্ভূত প্রকল্প ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে। এই ব্যয় মেটানো হবে এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকার রাজস্ব আয় ও ঘাটতি অর্থায়ন থেকে।
রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। এটি মোট বাজেট ব্যয়ের ৬১.২ শতাংশ। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর থেকে আদায় করা হবে ৪৯ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, যা ধনী-গরিব সবার ওপরই পড়বে সমানহারে। ব্যক্তিগত আয় ও মুনাফার ওপর কর খাত থেকে পাওয়া যাবে ৪৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক থেকে ২০ হাজার ৮৫৩ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে আয় হবে ১৪ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা আসবে আবগারী শুল্ক ও অন্যান্য শুল্ককর থেকে। আর কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। এটি মূলত সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সেবা ফি, টোল, লেভি ইত্যাদির চার্জ থেকে আসবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ফি, ভাড়া ও ইজারা, ডাক বিভাগ ও মূলধন রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ায় ঘাটতি থাকছে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা বা জিডিপির ৫ শতাংশ। নতুন বছরে ঘাটতি অর্থের মধ্যে ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা দেশীয় উৎস থেকে ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। বাকি অর্থ আসবে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে। আর বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।
বিরোধী দলহীন বাজেট অধিবেশন : চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বাজেট অধিবেশনে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদে উপস্থিত ছিল। কিন্তু গতকাল বাজেট উপস্থাপনকালে বিরোধী দলের দেখা পাননি অর্থমন্ত্রী। তাই নিজ সমর্থকদের সামনেই বিকেল ৩টা ১৪ মিনিট থেকে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে তিনি বক্তব্যের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে, কিছুটা বসে উপস্থাপন করেন। বাকিটুকু পঠিত বলে গণ্য করেন স্পিকার।
অবশ্য বসে বাজেট উপস্থাপনের বিষয়ে শুরুতেই স্পিকারের অনুমতি নেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় সংসদে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হকসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও কূটনীতিকরা নির্ধারিত গ্যালারিতে বসে বক্তব্য শোনেন। স্পিকারের চেয়ারের পেছনে দুটি এবং দুই দর্শক গ্যালারির পাশে দুটিসহ মোট চারটি বড় স্ক্রিনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বাজেট বক্তৃতার পুরো অংশ ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয়। এ ছাড়া সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের পাশে চারটি এলসিডি মনিটর বসানো হয়। বাজেট বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়।
বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে অর্থ বিল-২০১৩ সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ এবং কিছু আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিলটি ৩০ জুন পাস হবে।
সংশোধিত বাজেট উপস্থাপন : গতকাল সংসদে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বাজেটের মোট ব্যয় এক লাখ ৮৯ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রাপ্তির এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা রাজস্ব বোর্ডের করব্যবস্থা থেকে, ২২ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা কর ছাড়া রাজস্ব এবং পাঁচ হাজার ২৮০ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান প্রাপ্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় এক লাখ ১০ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ৫৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার এডিপি ও বাকিটা এডিপি-বহির্ভূত প্রকল্প এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে। সব মিলিয়ে বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি ৪৯ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৮ শতাংশ। এই ঘাটতির ৩২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা অর্থায়ন হয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, যার মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয়েছে ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ এসেছে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে। আর বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ আট হাজার ৪৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
No comments