সাভারের বার্তা ভারতে by গৌতম লাহিড়ী
সাভারের বহুতল ভবনধস ভারতের মেট্রোপলিটন
শহরগুলোর অবৈধ গৃহনির্মাণের নগ্ন চিত্রটা পরোক্ষে প্রকাশ করে দিল। ঢাকার
অদূরে বহুতল ভবন ধসের ঘটনার দু'দিন পরই মধ্যপ্রদেশের ভুপালে একটি
নির্মীয়মাণ হাসপাতাল ভেঙে পড়ল।
মৃত্যুর সংখ্যা কম বলে
হয়তো স্থানীয় সরকার কিঞ্চিৎ স্বস্তিবোধ করেছে; কিন্তু তার আগে মহারাষ্ট্রের
থানেতে সাততলা বহুতল ভেঙে ৭৫ জনের অকালমৃত্যু বেআইনি গৃহনির্মাণের গোপন
কাহিনী উদ্ভাসিত করেছে। ঢাকার মতোই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে স্থান করে
নিতে পেরেছে। লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ঢাকা-দিলি্ল কিংবা মুম্বাইয়ের শহরগুলোর
অবৈধ গৃহনির্মাণের চিত্রনাট্যটি একই রকম। প্রত্যেকটির নেপথ্যে রয়েছে অসাধু
প্রমোটার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের গোপন যোগসূত্র। একই সঙ্গে
নগরায়নের এক অসম বিকাশের চিত্র সভ্যতার সংকটের অশুভ সংকেত হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন উঠেছে_ সার্বিকভাবে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গার্মেন্ট শিল্পে
জড়িত শ্রমিক তথা নারী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কাহিনী।
থানের ঘটনায় যে নয়জনকে গ্রেফতার করা হয় তার মধ্যে স্থানীয় পৌরসভার কাউন্সিলর এবং পৌরকর্মী রয়েছেন। যাদের প্রত্যক্ষ মদদে এ গৃহনির্মাণ হয়। ইদানীং ভারতের প্রধান শহরের মধ্যে দিলি্ল, কলকাতা বা মুম্বাইতে ভবন ধসের ঘটনা প্রায়ই হয়ে থাকে। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে শহরে মানুষ আসছে নিয়মিত। ফলে নিম্নমানের রসদে দ্রুত গৃহনির্মাণের তাগিদে গরিব মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অবৈধ বাসস্থান বেছে নিয়েছেন। বছর দুই আগে দিলি্লতেই এক ভবন ধসে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়। এরা সবাই ভিনরাজ্য থেকে আসা গরিব পরিবার। এ বছরেই দিলি্লতে আর একটি ভবনের ধস ঘটে। শহরের পৌরসভার অন্যতম দায়িত্ব পুরনো ভবনগুলো সম্পর্কে সতর্কবাণী দেওয়া। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পৌরসভার দিলি্ল এবং মুম্বাই শহরে সব মিলিয়ে সরকারিভাবেই তিন হাজারের বেশি ভবন বাসের অযোগ্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে বসবাসকারী ২০ হাজারের বেশি পরিবারের বিকল্প বাসস্থান হয়নি বলে ভবনগুলোকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে না। এসব শহরে ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। অথচ সুসংহত গৃহনির্মাণ পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে না। নিরাপদ নয় জেনেও বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ শুধু জীবিকার স্বার্থে।
১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে মোট ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ শহরে বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। ২০১১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩৭ কোটি ৭০ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ। ভারতের নগর বিশেষজ্ঞ কে লক্ষ্মীনারায়ণের মতে, ২০২৫ সালে শহরের জনসংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ। কিন্তু নগর পরিকল্পনায় সেই গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে অস্বাস্থ্যকর বিপজ্জনক গৃহনির্মাণ বেড়েই চলেছে। সবক'টি একেকটি জীবন্ত কবর। এর সঙ্গে সরাসরি আর্থিক অনটনের যোগাযোগ নেই। আদতে শহর থেকে বস্তি, যতই অপসারিত হচ্ছে ততই পাকা অট্টালিকার নামে অবৈধ গৃহনির্মাণ বাড়ছে। মুম্বাইয়ে মাথাপিছু আয় ভারতের অন্য শহর থেকে বেশি; কিন্তু সেখানকার জনতার ৫০ শতাংশই বাস করে অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে। এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাবি এখানেই। কলকাতায় ৩২ শতাংশ মানুষ বাস করেন বস্তিতে। ঝুগ্গি-ঝুপড়িতে। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের শহরে যত মানুষ বাস করেন তার ১৭ শতাংশ বাস করছে বস্তিতে।
নগরায়ন বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে মানুষের পরিযায়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সে কারণে গ্রামভিত্তিক সংস্থানের উপায় সৃষ্টি করে সে প্রবণতা রাখার উদ্যোগ এখনও যে পর্যাপ্ত নয়, তার প্রমাণ এই নিম্নমানের ভবনে মানুষের মাথা গোঁজার করুণ চিত্র। যতদিন না ভেঙে পড়ছে, ততদিনই জীবন। এমনই এক পরিমণ্ডলে ভারতের প্রধান শহরগুলোতে গরিবদের, বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র গার্মেন্ট শিল্প; কিন্তু এ শিল্পে মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশা সম্ভবত আরও একটা মে দিবসের আন্দোলনের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। দৈনিক ১০০-১২০টি গার্মেন্ট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে এখানকার অধিকাংশ শ্রমিক যক্ষ্মায় আক্রান্ত।
রফতানি থেকে ভারতের যত আয় হয়, তার প্রায় ১৭ শতাংশ গার্মেন্ট থেকে। দিলি্ল, মুম্বাই, তিরুপুর, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরের গার্মেন্ট শিল্পে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এদের শ্রমে তৈরি হয় বিদেশি বহুজাতিক সংস্থান ব্র্যান্ড। অথচ এ শ্রমিকদের শ্রম আইনের কোনো বালাই নেই, তেমনি নেই প্রকৃত স্বাস্থ্যকর বাসস্থান। এরাই বাস করেন সাভারের মতো বেআইনি বহুতল ভবনে। যে কোনো দিন অলক্ষ্যে মৃত্যু এসে উপস্থিত হতে পারে। তাই স্থানীয় সরকারগুলো সতর্ক হয়ে এখন গার্মেন্ট মালিকদের-শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিতে শুরু করেছে। ২০০৫ সালে মাল্টি ফাইবার চুক্তি বিলোপের পরে অনেক ছোট ব্যবসায়ী এই গার্মেন্ট শিল্পে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যয় সংকোচন করছেন। ব্যয় সংকোচের প্রধান ক্ষেত্র দেখা গেল শ্রমিক কল্যাণ। তাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এদের বহুজাতিক সংস্থার ব্র্যান্ড তৈরি করতে হয় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। এই দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভবত এ গার্মেন্ট শিল্প নতুন করে মে দিবসের আন্দোলনের জন্ম দেবে বলে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। তাই সাভারের মৃত্যু মিছিল এক নতুন বার্তাও তৈরি করে দিচ্ছে।
স গৌতম লাহিড়ী :সমকাল
প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল
থানের ঘটনায় যে নয়জনকে গ্রেফতার করা হয় তার মধ্যে স্থানীয় পৌরসভার কাউন্সিলর এবং পৌরকর্মী রয়েছেন। যাদের প্রত্যক্ষ মদদে এ গৃহনির্মাণ হয়। ইদানীং ভারতের প্রধান শহরের মধ্যে দিলি্ল, কলকাতা বা মুম্বাইতে ভবন ধসের ঘটনা প্রায়ই হয়ে থাকে। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে শহরে মানুষ আসছে নিয়মিত। ফলে নিম্নমানের রসদে দ্রুত গৃহনির্মাণের তাগিদে গরিব মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অবৈধ বাসস্থান বেছে নিয়েছেন। বছর দুই আগে দিলি্লতেই এক ভবন ধসে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়। এরা সবাই ভিনরাজ্য থেকে আসা গরিব পরিবার। এ বছরেই দিলি্লতে আর একটি ভবনের ধস ঘটে। শহরের পৌরসভার অন্যতম দায়িত্ব পুরনো ভবনগুলো সম্পর্কে সতর্কবাণী দেওয়া। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পৌরসভার দিলি্ল এবং মুম্বাই শহরে সব মিলিয়ে সরকারিভাবেই তিন হাজারের বেশি ভবন বাসের অযোগ্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে বসবাসকারী ২০ হাজারের বেশি পরিবারের বিকল্প বাসস্থান হয়নি বলে ভবনগুলোকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে না। এসব শহরে ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। অথচ সুসংহত গৃহনির্মাণ পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে না। নিরাপদ নয় জেনেও বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ শুধু জীবিকার স্বার্থে।
১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে মোট ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ শহরে বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। ২০১১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩৭ কোটি ৭০ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ। ভারতের নগর বিশেষজ্ঞ কে লক্ষ্মীনারায়ণের মতে, ২০২৫ সালে শহরের জনসংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ। কিন্তু নগর পরিকল্পনায় সেই গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে অস্বাস্থ্যকর বিপজ্জনক গৃহনির্মাণ বেড়েই চলেছে। সবক'টি একেকটি জীবন্ত কবর। এর সঙ্গে সরাসরি আর্থিক অনটনের যোগাযোগ নেই। আদতে শহর থেকে বস্তি, যতই অপসারিত হচ্ছে ততই পাকা অট্টালিকার নামে অবৈধ গৃহনির্মাণ বাড়ছে। মুম্বাইয়ে মাথাপিছু আয় ভারতের অন্য শহর থেকে বেশি; কিন্তু সেখানকার জনতার ৫০ শতাংশই বাস করে অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে। এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাবি এখানেই। কলকাতায় ৩২ শতাংশ মানুষ বাস করেন বস্তিতে। ঝুগ্গি-ঝুপড়িতে। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের শহরে যত মানুষ বাস করেন তার ১৭ শতাংশ বাস করছে বস্তিতে।
নগরায়ন বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে মানুষের পরিযায়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সে কারণে গ্রামভিত্তিক সংস্থানের উপায় সৃষ্টি করে সে প্রবণতা রাখার উদ্যোগ এখনও যে পর্যাপ্ত নয়, তার প্রমাণ এই নিম্নমানের ভবনে মানুষের মাথা গোঁজার করুণ চিত্র। যতদিন না ভেঙে পড়ছে, ততদিনই জীবন। এমনই এক পরিমণ্ডলে ভারতের প্রধান শহরগুলোতে গরিবদের, বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র গার্মেন্ট শিল্প; কিন্তু এ শিল্পে মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশা সম্ভবত আরও একটা মে দিবসের আন্দোলনের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। দৈনিক ১০০-১২০টি গার্মেন্ট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে এখানকার অধিকাংশ শ্রমিক যক্ষ্মায় আক্রান্ত।
রফতানি থেকে ভারতের যত আয় হয়, তার প্রায় ১৭ শতাংশ গার্মেন্ট থেকে। দিলি্ল, মুম্বাই, তিরুপুর, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরের গার্মেন্ট শিল্পে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এদের শ্রমে তৈরি হয় বিদেশি বহুজাতিক সংস্থান ব্র্যান্ড। অথচ এ শ্রমিকদের শ্রম আইনের কোনো বালাই নেই, তেমনি নেই প্রকৃত স্বাস্থ্যকর বাসস্থান। এরাই বাস করেন সাভারের মতো বেআইনি বহুতল ভবনে। যে কোনো দিন অলক্ষ্যে মৃত্যু এসে উপস্থিত হতে পারে। তাই স্থানীয় সরকারগুলো সতর্ক হয়ে এখন গার্মেন্ট মালিকদের-শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিতে শুরু করেছে। ২০০৫ সালে মাল্টি ফাইবার চুক্তি বিলোপের পরে অনেক ছোট ব্যবসায়ী এই গার্মেন্ট শিল্পে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যয় সংকোচন করছেন। ব্যয় সংকোচের প্রধান ক্ষেত্র দেখা গেল শ্রমিক কল্যাণ। তাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এদের বহুজাতিক সংস্থার ব্র্যান্ড তৈরি করতে হয় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। এই দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভবত এ গার্মেন্ট শিল্প নতুন করে মে দিবসের আন্দোলনের জন্ম দেবে বলে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। তাই সাভারের মৃত্যু মিছিল এক নতুন বার্তাও তৈরি করে দিচ্ছে।
স গৌতম লাহিড়ী :সমকাল
প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল
No comments