তুরস্কের যুববিক্ষোভ তরুণ তুর্কি ও নতুন নায়কের আবির্ভাব by ফারুক ওয়াসিফ

কোনো সমাজ যখন মাইনফিল্ড হয়ে ওঠে, তখন কখন কোথায় পা দিলে বিস্ফোরণ ঘটবে, তা জানার উপায় থাকে না। যখন গণতন্ত্র মানে জনগণকে নিছক ভোটার বানিয়ে সরকারের যাবতীয় কীর্তিকারখানা দেখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রাখা, তখন তলেতলে তল্লাটে তৈরি হয় বিদ্রোহের পটভূমি।
তুরস্কের এরদোয়ান সরকার এত সবের খোঁজ রাখেনি। তারা ভেবেছিল, ‘উন্নয়ন’ করছে; কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখেছে, তারা অধিকার হারাচ্ছে। পার্কের গাছ কাটার বিরুদ্ধে অল্পকিছু তরুণের ‘না’কে প্রশাসন পুতুপুতু প্রতিবাদ ভেবেছিল; ভেবেছিল মিনমিনে পরিবেশবাদ। কিন্তু পুলিশ লেলিয়ে দিতেই ‘ছিল একটা রুমাল হয়ে গেল বিড়াল’। বিড়ালটা অচিরেই বাঘের বেশে দেশময় তর্জন-গর্জন শুরু করল। বিশ্ব দেখতে পেল আরেকটি যুববিদ্রোহ। কায়রো, তিউনিস, ওয়াল স্ট্রিট, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ, তেল আবিব, ম্যানিলা, দিল্লি, ঢাকা, স্টকহোমের পর বৈশ্বিক গণবিক্ষোভের মিছিল ইস্তাম্বুলে এসে গরম শ্বাস ফেলল একেবারে সরকারের ঘাড়ের ওপর।
কাপড়ের বয়ন দুর্বল হয়ে গেলে সামান্য টানেও তা ফেঁসে যেতে পারে। সরকারের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বেড়ে গেলে সামান্য ঘটনা থেকেও তুলকালাম ঘটতে পারে। কারণ যা-ই হোক, তুর্কিরা তাদের সরকারকে চরম হুঁশিয়ারি দিতে চাইছে। এই আন্দোলন এখনো সরকার পতনের দিকে ছোটেনি। তাই তুরস্কের তাকসিম চত্বরের বিক্ষোভকে তাহরির চত্বরের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না; বরং এর মিল অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের সঙ্গে। তুর্কি বসন্ত বলার সময়ও তাই আসেনি।
গেজি পার্ক ধ্বংস করে শপিং মল বানাতে নেমেছিল ইস্তাম্বুলের নগর কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রক্ষমতা জনশক্তিকে সর্বদাই খাটো করে দেখে। তাই জনচত্বরের বাণিজ্যিকায়নের বিরুদ্ধে অল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণীর বিক্ষোভকে তারা ভেবেছিল আইনশৃঙ্খলা সমস্যা। কিন্তু যেই দমনের দণ্ড জনতার পিঠে পড়ল, সেই সোনার কাঠির সঙ্গে রুপার কাঠির ঠোকাঠুকিতে ঘুমন্ত জনপুঞ্জ জেগে উঠল। গত ২৮ মে থেকে এখন পর্যন্ত লাখ লাখ তরুণ তুর্কি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে যাচ্ছে। তারা আইন ভঙ্গ করে সমাবেশ-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর আক্রান্ত হয়েছে; দেশময় চলছে অবরোধ।
তুর্কিদের এই প্রতিবাদে সে দেশের গভীর ব্যাধির খবরও দিচ্ছে। যে তুরস্ক ‘মধ্যপন্থী ইসলামি রাজনীতি’ আর নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির মডেল হিসেবে বাহবা পাচ্ছিল, যুববিদ্রোহে তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল।
তুরস্কের ইসলামপন্থী সরকার একদিকে ধ্বংসাত্মক পুঁজিবাদের সঙ্গে ধর্মাশ্রিত জাতীয়তাবাদের মিশেলের রাজনীতি চালাচ্ছিল। এই দুইয়ের চাপে স্বাধীন সামাজিক সংহতি ও সাংস্কৃতিক সহনশীলতার চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তরুণদের চালচলন, নারী-পুরুষের মেলামেশার ওপর হস্তক্ষেপ হচ্ছিল। যে বৈশ্বিক প্রতিবাদমালা বিদ্যমান ব্যবস্থার ভিত কাঁপাচ্ছে, তুরস্কের প্রতিবাদ তারই অংশ। আবারও প্রমাণিত হলো, অল্পসংখ্যক সাহসীরা অধিকাংশের মনের ভাষাকে প্রকাশ করতে পারলে ছোট্ট স্ফুলিঙ্গই দাবানাল লাগিয়ে দিতে পারে।
তাই ওপর থেকে যাকে মনে হচ্ছে একটি পার্কের অস্তিত্ব নিয়ে বিবাদ, তা আসলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তুর্কি সমাজেরই বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে ৬ জুন পর্যন্ত সরকারি ভাষ্যে দুজন আর বেসরকারি সূত্রে অন্তত সাতজনের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার। অথচ তুরস্কের মিত্র ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলো ততটাই নীরব, যতটা সরব তারা সিরিয়া বা ইরানের বেলায়। পরিহাস এখানেই, তুরস্কের অধিকাংশ তরুণ যেমন আইন ও সংস্কৃতির ইসলামীকরণ সমর্থন করেনি, তেমনি মানতে পারেনি এরদোয়ান সরকারের মুনাফামুখী উন্নয়ন। একদিকে নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ায়ও তারা অসন্তুষ্ট ছিল। পানি যেমন গরম হতে হতে একপর্যায়ে বাষ্প হয়, জনমনের হতাশাও তেমনি একটা পর্যায়ে মৃদু ফোঁসফাঁস থেকে প্রকাশ্য বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। এ রকম অবস্থাতেই তুরস্কের একটি পত্রিকা সাহস করে শিরোনাম লেখে: প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান আপনি সর্বশক্তিমান নন। এই শিরোনাম যেন রাজপথের বিক্ষোভকারীদের প্ল্যাকার্ডেরই অনুবাদ, যেখানে লেখা ছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনি রাজা নন, জনগণের সেবক’।
এরদোয়ান বিপুল ভোটে নির্বাচিত, পর পর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেও গণতন্ত্রের ভাষা রপ্ত করতে পারেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিদেশি বিদ্রোহীদের যে ভাষায় গালি দেন, মার্কিন মিত্র এরদোয়ান সেই ভাষা ব্যবহার করেন নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি। তাঁর চোখে প্রতিবাদীরা ‘লুটেরা’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘বিদেশিদের চর’। পরিহাস হলো, তরুণেরাও তাঁর সরকারকে ঠিক একই অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রথম হুঁশ ফিরেছে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পুলিশি নির্মমতার জন্য ক্ষমা তো চেয়েছেনই, পাশাপাশি পার্ক রক্ষার আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও গণতান্ত্রিকতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
তুরস্কের মধ্যপন্থী ইসলামি দল ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইরাকের স্বাধীনতা আন্দোলন, ইরানের জেদ আর সিরিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে একেপি সরকার। একেপি নেতা এরদোয়ান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—দুই দিক থেকেই বড় চাল দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। একদিকে কুর্দি বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে ন্যাটোর সিরিয়া আগ্রাসনের মাঠ তৈরি, অন্যদিকে শাসনব্যবস্থাকে সংসদীয় পদ্ধতি থেকে প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতিতে রূপান্তরের জন্য সংবিধান সংস্কার ছিল তাঁর প্রধান দুই এজেন্ডা। প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতির প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছা। ২০১৫ সালে সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। তুরস্কের সংবিধানে কারও জন্য চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতিতে গিয়ে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করাই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। তুরস্কের সেক্যুলার প্রধানবিরোধী দলসহ বামপন্থী ও ইসলামি ছোট দলগুলো এরদোয়ানের যুদ্ধ আর ক্ষমতার সাধ—দুটোরই বিরুদ্ধে ছিল। যুববিদ্রোহে তাই তারাও দলেবলে নেমে পড়েছে। তবে সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা সিরিয়ার। সিরীয় বিদ্রোহীদের হাতে সাহায্য পৌঁছানোয় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের হাতিয়ার ছিল তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতেও তুরস্ক উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সময়কার দাপট ফিরে পেতে আগ্রহী। এরদোয়ান তুরস্কের এই নব্য পুঁজিবাদী রক্ষণশীল শাসকদেরই নেতা ও প্রতিনিধি। সিরিয়ার আসাদ বা লেবাননের হিজবুল্লাহ নয়, এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল স্বয়ং তাঁর দেশের মানুষ। মিসরীয় বিপ্লবের সময় হোসনি মোবারককে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘মোবারকের উচিত জনগণের কথা শোনা।’ আসাদের বিরুদ্ধেও বর্ষণ করেছিলেন একই ধরনের বাণী। কর্মফল ছাড়া আর কী, তুরস্কের জনগণই এখন রাজপথে চিৎকার করে বলছে, ‘শুনতে পাচ্ছ সরকার, আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছ?’ এরদোয়ানের সময় এসেছে নিজের জনগণের কথা শোনার।
দেশে দেশে বিদ্রোহ বিপ্লবের মিলের জায়গা একটাই যে, প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তি বা সংগঠিত শ্রেণীগুলোর নেতৃত্ব সবখানেই অনুপস্থিত। তাহরির থেকে তুরস্ক, ঢাকা থেকে ওয়াল স্ট্রিট—সবখানেই নতুন এক শ্রেণীর আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে। এদের বলা হচ্ছে প্রিক্যারিয়েত। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কালে যেমন দেখা গিয়েছিল প্রলেতারিয়েতের উত্থান। এখন তেমনি সাড়া জাগাচ্ছে এই প্রিক্যারিয়েত। এরা কারা? এরা হচ্ছে আমার-আপনার মতো সাধারণ যুবজনতা। বিশ্বের দেশে দেশে জনসংখ্যাগত দিক থেকে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যখন সমাজে হতাশা, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, রাজনীতিতে অমানবিকতা, তখন নতুন পাওয়া শিক্ষা ও ফেসবুক-টুইটারের মাধ্যমে এরা দ্রুতই জমায়েত হওয়া শিখছে। অস্থায়ী চাকরি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের মধ্যে যে ক্রোধ তৈরি করে, বৈরী সরকারের বিরুদ্ধে সেটাই তারা উগরে দেয়। এরাই তাহরির থেকে তাকসিম স্কয়ারে ঘটায় গণবিদ্রোহ। বিপ্লবের আকালে প্রিক্যারিয়েতই আজকের নায়ক। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী একে বলছেন বিপজ্জনক শ্রেণী। তবে বড় ওলটপালট তখনই ঘটে, যখন প্রিক্যারিয়েতের পাশে এসে দাঁড়ায় প্রলেতারিয়েত। তুর্কি বিদ্রোহে শ্রমিক প্রলেতারিয়েতও জড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বামপন্থী ২২টি শ্রমিক সংগঠনের ২৪ লাখ সদস্যও দেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকায় যুববিদ্রোহ আরও গণভিত্তি পেল। সুতরাং এরদোয়ানকে ক্ষমতা টেকাতে হলে পিছু হঠতেই হবে।
ইউরোপ-আমেরিকার যুববিদ্রোহের সঙ্গে এশিয়ার বিদ্রোহগুলো যুববৈশিষ্ট্যে এক হলেও একটি পার্থক্য খুব চোখে পড়ে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন বাদ দিলে পশ্চিমা দেশে বিদ্রোহ করছে সংখ্যালঘু মুসলিম অভিবাসীরা, আর আরব ও তুর্কি বিদ্রোহে জড়িত হয়ে পড়ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা। সেক্যুলার মোবারক বা ইসলামপন্থী এরদোয়ান দিনের শেষে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছেন। দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই উত্থান হয়তো বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে জনগণের হাতে নেওয়ার নতুন এক যুগেরই বার্তা বহন করছে। এসবই মহড়া, ভবিষ্যতে দেখা যাবে প্রিক্যারিয়েতের ঐতিহাসিক ভূমিকার সত্যিকার মঞ্চায়ন।
 ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.