খোলা চোখে রোহিঙ্গা: কারও কোনো মাথাব্যথা নেই by হাসান ফেরদৌস
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আমরা জানতাম শান্তিপ্রিয়,
নির্বিরোধী। তারা গৌতম বুদ্ধের অনুসারী, তিনি বলে গেছেন, জীব হত্যা
মহাপাপ। সে কারণে একটা মশাও তারা টিপে মারবে না বা মাছ-মাংস খাবে না।
কিন্তু নিজের দেশের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বেলায় এ নীতিকথার প্রয়োগ নিয়ে
তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ‘আমরা ফরসা ও সভ্য। ওরা কালো কালো, দেখতে
রাক্ষসের মতো, ওদের সঙ্গে আমাদের বিন্দুমাত্র মিল নেই।’ অতএব, নীতিবাগীশেরা
যখন রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণের পক্ষে সনদ দিয়ে রেখেছেন, ওদের গলা টিপে
ধরতে, রোহিঙ্গা মেয়েদের হাত-পা চেপে ধরে ধর্ষণ করতে, ওদের ঘরবাড়ি, মসজিদ ও
স্কুলঘর পুড়িয়ে দিতে আর কোনো বাধা নেই। সেটাই ঠিক কাজ হবে, কারণ ধর্মগুরু
বলে দিয়েছেন, ওরা বেঁচে থাকলে আমাদের নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপদাপন্ন
হবে।
ওপরের এ কথাগুলো আমার বানানো নয়, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রচারিত বিভিন্ন প্রচারপত্র ও সংবাদপত্রের বিবরণ থেকে নেওয়া। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিনিধনের যে সুপরিকল্পিত চেষ্টা চলছে, রাজনীতিকদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও তার পেছনে রয়েছেন। হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়, গত অর্ধ শতক ধরেই এ নির্বিচার গণহত্যা চলছে, যার প্রামাণিক বিবরণের একাধিক সচিত্র প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’ও নানা সময় সে ঘটনা নথিবদ্ধ করে বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। রোহিঙ্গাদের নির্বিচার নিধনের সর্বশেষ বিবরণ পেয়েছি গত সপ্তাহের নিউইয়র্ক টাইমস থেকে। পত্রিকাটি এক সম্পাদকীয় মন্তব্যেও এ প্রশ্নে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে।
কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, থাইল্যান্ড বা বাংলাদেশেরও নয়।
গত সপ্তাহের ঘটনার কথাই ধরুন। রাখাইন প্রদেশের লাসাও জেলায় এক নারী তেলবিক্রেতার সঙ্গে এক রোহিঙ্গা যুবকের সামান্য কথা-কাটাকাটি, তা থেকে প্রবল দাঙ্গা। বাড়িঘর পোড়ানো হলো, স্কুলঘর জ্বলল, এমনকি মসজিদ পর্যন্ত রক্ষা পেল না। এক বৌদ্ধমন্দিরে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানেও হামলা। নিউইয়র্ক টাইমস এক ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, হাতে খোলা তলোয়ার ও রড নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে বার্মিজ যুবকেরা শহরজুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। ফিনল্যান্ড থেকে যাওয়া এক পর্যটক ছাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, পুলিশ এসেছিল, কিন্তু তারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করেনি। বড়জোর কয়েক মিনিট সেখানে ছিল, কিন্তু কুটোটিও নেড়ে দেখেনি।
বস্তুত, আমাদের বাড়ির পাশে মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা এক সুপরিকল্পিত জাতি হত্যা, যার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে হয় ধ্বংস করা, নয় তাদের যেভাবে হোক সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। হিউম্যান রাইটস একে বলেছে ‘এথনিক ক্লেনজিং’। মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর কোনো স্বীকৃতি নেই, ফলে তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারেরও কোনো স্বীকৃতি নেই। নিজ এলাকার বাইরে রোহিঙ্গা পরিচয় নিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ নেই, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এমনকি বিয়ে পর্যন্ত করা যাবে না। তার পরও কেউ যদি অন্য কোনো সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করে বসে, তার ওপর বসানো হবে বিবাহ কর, যা দিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দেউলিয়া হওয়া ছাড়া অন্য পথ নেই। বিয়ের পর দুটির বেশি সন্তান জন্মানো যাবে না, তাহলে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। বার্মিজদের চোখে রোহিঙ্গারা ব্রাত্য, ফলে তাদের নিরাপত্তা প্রদানের কোনো আগ্রহও নেই সে দেশের সরকারের। এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার রোহিঙ্গা সমুদ্র পেরিয়ে ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের অনেকেই সমুদ্রে ডুবে মরে। নিজেদের সমুদ্রসীমার কাছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ডিঙি নৌকা চোখে পড়লে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। উদ্বাস্তু হিসেবে থাইল্যান্ডে যারা মুরগির খাঁচার মতো ছোট ছোট ঘরে আশ্রয় পায়, তাদেরও বেয়নেটের আগায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাড়ানো হয়। কিন্তু যাবে কোথায়? কেউ তাদের চায় না। কোথাও পালানোর কোনো পথ নেই তাদের। বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই, কেউ এ নিয়ে ভাবেও না।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বাস করছে শত শত বছর ধরে। আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত চট্টগ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে তারা রাখাইন ও মিয়ানমারের অন্যান্য প্রদেশে আশ্রয় নেয়। থাইল্যান্ড, ভারত ও বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আসা বণিক ও নাবিকের বংশধরেরাও রোহিঙ্গা বলে পরিচিত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা ও আরকানিন-মিশ্রিত একস্থানীয় উপভাষায় তারা কথা বলে। মোট সংখ্যার হিসাবে তারা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এক বাংলাদেশেই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ বা তার চেয়ে বেশি হবে। দেখতে একই রকম, কথাতেও মিল রয়েছে, ফলে সারা দেশে তারা মিশে গেছে। আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকার মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের পরামর্শে রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম এলাকায় আশ্রয় দিয়েছিল। অজ্ঞাত স্থান (!) থেকে অর্থ এসেছিল, অস্ত্রও। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ওয়াহাবি জঙ্গিবাদের প্রথম প্রকাশ। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সাঁড়াশি হামলার মুখে সেখানে ইসলামি জঙ্গিবাদ জায়গা করে নিতে পারেনি। পেরেছে বাংলাদেশে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিনিধনের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার পেছনে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বস্তুত মিয়ানমারের ‘লৌহমানব’, সামরিক শাসক নে উইনের সময় ষাটের দশক থেকে রোহিঙ্গাদের নিধন পর্ব শুরু হয়। সে সময় নে উইনের স্লোগান ছিল, মিয়ানমারের নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক পথ বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি হটাতে হবে। বিদেশি মানে রোহিঙ্গা। বছর বিশেক আগে মিয়ানমারে যে জনসংখ্যা গণনা সম্পন্ন হয়, তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এমনকি ‘বহিরাগত নাগরিক’ বলেও তাদের হিসাবে ধরা হয়নি। প্রতিবাদ উঠলে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, ১৯৪৮ সালের আগে মিয়ানমারে আশ্রয় গ্রহণের প্রমাণপত্র যাদের রয়েছে, শুধু এমন জনগোষ্ঠীকেই সে দেশের নাগরিক বা সহযোগী নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। রোহিঙ্গারা তাদের সে পরিচয় প্রমাণে সক্ষম হয়নি। অতএব তারা অবৈধ বহিরাগত ছাড়া আর কিছু নয়—এই ছিল সে দেশের সামরিক সরকারের যুক্তি। ফলে মিয়ানমারের আইনে আরও ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর স্বীকৃতি মিললেও রোহিঙ্গারা অবৈধ বহিরাগতই রয়ে গেছে।
রোহিঙ্গাদের খেদানোর ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উৎসাহ এসেছে রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করেছে স্থানীয় রাজনৈতিক দল রাখাইন ন্যাশনালিস্ট ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এ দল এখন প্রদেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে। ফেডারেল পর্যায়েও তাদের প্রভাব অপরিসীম। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিঘৃণা ছড়ানোর ব্যাপারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কোনো রাখঢাক নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ২০১২-এর জুনে ভিক্ষুদের নামে প্রচারিত এক প্রচারপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে। তাতে বার্মিজদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, বাঙালিদের (অর্থাৎ রোহিঙ্গা) সঙ্গে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না, তাদের কোনো কাজে নিজেদের যুক্ত করবে না। বাঙালিরা আমাদের দেশের জল-বাতাস-খাদ্য ভোগ করে, আমাদের গাছের ছায়ায় আশ্রয় নয়। কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য আমাদের আরকানি সভ্যতার ধ্বংস। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সরাসরি উদ্ধৃতি রয়েছে প্রতিবেদনটিতে। তিনি বলেছেন:
‘সকল আরকানবাসীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন কোনো মুসলমানের কাছ থেকে কিছু ক্রয় বা বিক্রয় না করে। কোনো মুসলমানের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা নিষিদ্ধ হলো। মুসলমানেরা আমাদের জমি দখল করছে, আমাদের জল পান করছে, আমাদের হত্যা করছে। তারা আমাদের ধান-চাল ধ্বংস করছে, আবার আমাদের বাড়ির কাছাকাছি বাস করছে। তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। আমরা মুসলমানদের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক রাখার বিরুদ্ধে।’
একসময় জার্মানিতে এই ভাষায়, এই যুক্তিতে ইহুদিদের নিধনের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল। রুয়ান্ডায় একই যুক্তিতে প্রায় আট লাখ টুটসি সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছিল। একুশ শতাব্দীতে এসে সেই একই ভাষায় জাতিবিদ্বেষ ছড়ানো হবে, আর সারা বিশ্ব তা নীরবে মেনে নেবে, এ এক অভাবিত বাস্তবতা।
বাঙালি হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব রয়েছে। তাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যে মানবেতর অবস্থায় রোহিঙ্গাদের কালাতিপাত করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। এ কথা ঠিক, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা সহজ হবে না। খুব ধনী দেশ সে নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখালে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে কথা সে দেশের সামরিক সরকারকে বোঝাতে হবে। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সরাসরি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্য বাড়ানো খুব জরুরি। ত্রাণের প্রতিশ্রুতি পেলে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে নমনীয় হওয়া সহজ হবে। সবচেয়ে যা দরকার তা হলো, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা তোলা। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন গড়ে তোলারও উদ্যোগ নিতে হবে। একা নয়, প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষত ভারতকে সঙ্গে নিয়ে, কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত অবিলম্বে। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় এ কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে এ দুই দেশ।
এ কথা যেন ভুলে না যাই—আজ যারা ডুবে মরছে, তারাও ‘সন্তান মোর মা’র!’
৪ জুন ২০১৩, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ওপরের এ কথাগুলো আমার বানানো নয়, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রচারিত বিভিন্ন প্রচারপত্র ও সংবাদপত্রের বিবরণ থেকে নেওয়া। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিনিধনের যে সুপরিকল্পিত চেষ্টা চলছে, রাজনীতিকদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও তার পেছনে রয়েছেন। হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়, গত অর্ধ শতক ধরেই এ নির্বিচার গণহত্যা চলছে, যার প্রামাণিক বিবরণের একাধিক সচিত্র প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’ও নানা সময় সে ঘটনা নথিবদ্ধ করে বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। রোহিঙ্গাদের নির্বিচার নিধনের সর্বশেষ বিবরণ পেয়েছি গত সপ্তাহের নিউইয়র্ক টাইমস থেকে। পত্রিকাটি এক সম্পাদকীয় মন্তব্যেও এ প্রশ্নে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে।
কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, থাইল্যান্ড বা বাংলাদেশেরও নয়।
গত সপ্তাহের ঘটনার কথাই ধরুন। রাখাইন প্রদেশের লাসাও জেলায় এক নারী তেলবিক্রেতার সঙ্গে এক রোহিঙ্গা যুবকের সামান্য কথা-কাটাকাটি, তা থেকে প্রবল দাঙ্গা। বাড়িঘর পোড়ানো হলো, স্কুলঘর জ্বলল, এমনকি মসজিদ পর্যন্ত রক্ষা পেল না। এক বৌদ্ধমন্দিরে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানেও হামলা। নিউইয়র্ক টাইমস এক ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, হাতে খোলা তলোয়ার ও রড নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে বার্মিজ যুবকেরা শহরজুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। ফিনল্যান্ড থেকে যাওয়া এক পর্যটক ছাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, পুলিশ এসেছিল, কিন্তু তারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করেনি। বড়জোর কয়েক মিনিট সেখানে ছিল, কিন্তু কুটোটিও নেড়ে দেখেনি।
বস্তুত, আমাদের বাড়ির পাশে মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা এক সুপরিকল্পিত জাতি হত্যা, যার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে হয় ধ্বংস করা, নয় তাদের যেভাবে হোক সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। হিউম্যান রাইটস একে বলেছে ‘এথনিক ক্লেনজিং’। মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর কোনো স্বীকৃতি নেই, ফলে তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারেরও কোনো স্বীকৃতি নেই। নিজ এলাকার বাইরে রোহিঙ্গা পরিচয় নিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ নেই, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এমনকি বিয়ে পর্যন্ত করা যাবে না। তার পরও কেউ যদি অন্য কোনো সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করে বসে, তার ওপর বসানো হবে বিবাহ কর, যা দিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দেউলিয়া হওয়া ছাড়া অন্য পথ নেই। বিয়ের পর দুটির বেশি সন্তান জন্মানো যাবে না, তাহলে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। বার্মিজদের চোখে রোহিঙ্গারা ব্রাত্য, ফলে তাদের নিরাপত্তা প্রদানের কোনো আগ্রহও নেই সে দেশের সরকারের। এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার রোহিঙ্গা সমুদ্র পেরিয়ে ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের অনেকেই সমুদ্রে ডুবে মরে। নিজেদের সমুদ্রসীমার কাছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ডিঙি নৌকা চোখে পড়লে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। উদ্বাস্তু হিসেবে থাইল্যান্ডে যারা মুরগির খাঁচার মতো ছোট ছোট ঘরে আশ্রয় পায়, তাদেরও বেয়নেটের আগায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাড়ানো হয়। কিন্তু যাবে কোথায়? কেউ তাদের চায় না। কোথাও পালানোর কোনো পথ নেই তাদের। বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই, কেউ এ নিয়ে ভাবেও না।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বাস করছে শত শত বছর ধরে। আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত চট্টগ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে তারা রাখাইন ও মিয়ানমারের অন্যান্য প্রদেশে আশ্রয় নেয়। থাইল্যান্ড, ভারত ও বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আসা বণিক ও নাবিকের বংশধরেরাও রোহিঙ্গা বলে পরিচিত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা ও আরকানিন-মিশ্রিত একস্থানীয় উপভাষায় তারা কথা বলে। মোট সংখ্যার হিসাবে তারা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এক বাংলাদেশেই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ বা তার চেয়ে বেশি হবে। দেখতে একই রকম, কথাতেও মিল রয়েছে, ফলে সারা দেশে তারা মিশে গেছে। আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকার মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের পরামর্শে রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম এলাকায় আশ্রয় দিয়েছিল। অজ্ঞাত স্থান (!) থেকে অর্থ এসেছিল, অস্ত্রও। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ওয়াহাবি জঙ্গিবাদের প্রথম প্রকাশ। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সাঁড়াশি হামলার মুখে সেখানে ইসলামি জঙ্গিবাদ জায়গা করে নিতে পারেনি। পেরেছে বাংলাদেশে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিনিধনের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার পেছনে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বস্তুত মিয়ানমারের ‘লৌহমানব’, সামরিক শাসক নে উইনের সময় ষাটের দশক থেকে রোহিঙ্গাদের নিধন পর্ব শুরু হয়। সে সময় নে উইনের স্লোগান ছিল, মিয়ানমারের নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক পথ বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি হটাতে হবে। বিদেশি মানে রোহিঙ্গা। বছর বিশেক আগে মিয়ানমারে যে জনসংখ্যা গণনা সম্পন্ন হয়, তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এমনকি ‘বহিরাগত নাগরিক’ বলেও তাদের হিসাবে ধরা হয়নি। প্রতিবাদ উঠলে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, ১৯৪৮ সালের আগে মিয়ানমারে আশ্রয় গ্রহণের প্রমাণপত্র যাদের রয়েছে, শুধু এমন জনগোষ্ঠীকেই সে দেশের নাগরিক বা সহযোগী নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। রোহিঙ্গারা তাদের সে পরিচয় প্রমাণে সক্ষম হয়নি। অতএব তারা অবৈধ বহিরাগত ছাড়া আর কিছু নয়—এই ছিল সে দেশের সামরিক সরকারের যুক্তি। ফলে মিয়ানমারের আইনে আরও ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর স্বীকৃতি মিললেও রোহিঙ্গারা অবৈধ বহিরাগতই রয়ে গেছে।
রোহিঙ্গাদের খেদানোর ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উৎসাহ এসেছে রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করেছে স্থানীয় রাজনৈতিক দল রাখাইন ন্যাশনালিস্ট ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এ দল এখন প্রদেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে। ফেডারেল পর্যায়েও তাদের প্রভাব অপরিসীম। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিঘৃণা ছড়ানোর ব্যাপারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কোনো রাখঢাক নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ২০১২-এর জুনে ভিক্ষুদের নামে প্রচারিত এক প্রচারপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে। তাতে বার্মিজদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, বাঙালিদের (অর্থাৎ রোহিঙ্গা) সঙ্গে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না, তাদের কোনো কাজে নিজেদের যুক্ত করবে না। বাঙালিরা আমাদের দেশের জল-বাতাস-খাদ্য ভোগ করে, আমাদের গাছের ছায়ায় আশ্রয় নয়। কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য আমাদের আরকানি সভ্যতার ধ্বংস। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সরাসরি উদ্ধৃতি রয়েছে প্রতিবেদনটিতে। তিনি বলেছেন:
‘সকল আরকানবাসীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন কোনো মুসলমানের কাছ থেকে কিছু ক্রয় বা বিক্রয় না করে। কোনো মুসলমানের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা নিষিদ্ধ হলো। মুসলমানেরা আমাদের জমি দখল করছে, আমাদের জল পান করছে, আমাদের হত্যা করছে। তারা আমাদের ধান-চাল ধ্বংস করছে, আবার আমাদের বাড়ির কাছাকাছি বাস করছে। তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। আমরা মুসলমানদের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক রাখার বিরুদ্ধে।’
একসময় জার্মানিতে এই ভাষায়, এই যুক্তিতে ইহুদিদের নিধনের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল। রুয়ান্ডায় একই যুক্তিতে প্রায় আট লাখ টুটসি সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছিল। একুশ শতাব্দীতে এসে সেই একই ভাষায় জাতিবিদ্বেষ ছড়ানো হবে, আর সারা বিশ্ব তা নীরবে মেনে নেবে, এ এক অভাবিত বাস্তবতা।
বাঙালি হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব রয়েছে। তাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যে মানবেতর অবস্থায় রোহিঙ্গাদের কালাতিপাত করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। এ কথা ঠিক, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা সহজ হবে না। খুব ধনী দেশ সে নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখালে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে কথা সে দেশের সামরিক সরকারকে বোঝাতে হবে। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সরাসরি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্য বাড়ানো খুব জরুরি। ত্রাণের প্রতিশ্রুতি পেলে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে নমনীয় হওয়া সহজ হবে। সবচেয়ে যা দরকার তা হলো, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা তোলা। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন গড়ে তোলারও উদ্যোগ নিতে হবে। একা নয়, প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষত ভারতকে সঙ্গে নিয়ে, কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত অবিলম্বে। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় এ কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে এ দুই দেশ।
এ কথা যেন ভুলে না যাই—আজ যারা ডুবে মরছে, তারাও ‘সন্তান মোর মা’র!’
৪ জুন ২০১৩, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments