অসময়ে বর্ষাকাল, হরিণী চাটে বাঘের গাল by মোফাজ্জল করিম
সিভিল সার্ভিসের দুরবস্থার কথা প্রায়ই
শুনি, দেখিও কিছু কিছু। যদিও আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে সারা জনমের মত খোদা
হাফিয হয়ে গেছে সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে, তবুও নিজের ঘরানা বলে কথা।
এখন যারা সার্ভিসের কেষ্ট-বিষ্টু, আমাদের সময়ে তারা ছিল নিতান্তই বালক।
কথাটা কিন্তু তুচ্ছার্থে নয় মোটেই। এই আমরা যারা এখন বৃদ্ধ, তারাও একদিন
বালক ছিলাম। আমাদের মুরব্বিরা তখন আমাদের বালকই মনে করতেন। এটাই স্বাভাবিক,
এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ইংরেজ কবি টেনিসনের কথায় : দ্য ওল্ড অর্ডার চেঞ্জেথ
ইল্ডিং প্লেস টু নিউ।
চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর দেখতে দেখতে প্রায় পনেরটি বছর পার হয়ে গেল। আমাদের প্রজন্মের সবাই আমরা কেউ বত্রিশ, কেউ পঁয়ত্রিশ, কেউ চল্লিশ বছর চাকরির জোয়াল বয়েছি কাঁধে। কেউ আরো বেশি। তারপর যখন একদিন বাড়ি যাওয়ার সময় হল, তখন আল্লাহপাককে লাখ লাখ শুকরিয়া জানিয়েছি মান-ইজ্জত নিয়ে যেতে পেরেছি বলে। আমি আরেকটু বাড়তি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি রাব্বুল আলামিনকে এই জন্য যে চাকরিতে সারাজীবন ঢুঁশ খেয়েছি অনেক, তবু আল্লাহর মেহেরবানিতে হুঁশ হারাইনি কখনো। আর, সে কী ঢুঁশ একেকটা! মারনেওয়ালাদের চেহারা-সুরৎ দেখে আটপাড়া-বারহাট্টা এলাকার ষাঁড়ের লড়াইয়ের উন্মত্ত বলীবর্দরাও লজ্জা পাবে। সেই জন্যই ছিল আমার এডিশনাল শুকরিয়া আদায়।
কিন্তু সেদিন অনুজপ্রতিম দু'জন 'এডিশনাল' সহকর্মীর খুবই মর্যাদাপূর্ণ পদপ্রাপ্তির সংবাদ শুনে এডিশনাল তো দূরের কথা, আবশ্যিক ধন্যবাদটাও দিতে পারলাম না কাউকে। তবে, সরকারি চাকরির এই পৌনঃপুনিক ডিভ্যালুয়েশনের জমানায় চাকরি করতে হচ্ছে না বলে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম। হুঁ, বুঝতে পারছি আরেকটু ঝেড়ে না কাশলে আপনারা বিষয়টা ধরতে পারছেন না। শুনুন তা হলে।
তবে, আগে এই 'এডিশনাল'-এর মাজেজাটা খোলাসা করি। ইংরেজি 'এডিশনাল' কথার অর্থ যে অতিরিক্ত, তা আমরা সবাই জানি। জানত না শুধু আদালতপাড়ার এক 'স্টক উইটনেস'। 'স্টক উইটনেস' আবার কী বস্তু জানতে চান, না? বলছি। বাজার, মাজার আর সাজার জায়গা আদালতে টাউট-বাটপাড়রা সবসময় গিসগিস্ করে, এটা তো নিশ্চয়ই জানেন। আদালত চত্বরে আবার এক শ্রেণীর ধুরন্ধর কিসিমের মানুষ আছে, যারা আপনার সবরকমের মুশকিল আসানের জন্য এক পায়ে খাড়া। এরা সারাক্ষণ আদালতপাড়ায় ঘুরঘুর করে। যে কোন মামলায়- তা খুনের মামলা, গুমের মামলা, চুরি-ডাকাতি যাই হোক না কেন- সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এদের বললেই হল। কিছুটা মামলার বিষয়ে শুনে নিয়ে, বাকিটা পুরোপুরি বানিয়ে বানিয়ে তোফা সাক্ষ্য দিয়ে দেবে এরা। এরা আদালতের চেনামুখ। আদালতের ভাষায়, আগে এদের বলত স্টক উইটনেস। এখন কী বলে জানি না। এদের বাড়াবাড়ি রকম উপস্থিতি বন্ধ করার জন্য বেঙ্গল টাউট এ্যাক্ট বলে একটা আইন ছিল, যার আওতায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টাউটদের তালিকা বানিয়ে আদালত চত্বরে লটকিয়ে দিতেন আদালতের ত্রিসীমানায় এদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে। অনেক ভাল জিনিসের মত এই আইনটির প্রয়োগও সেই ব্রিটিশ আমলেই ধীরে ধীরে উঠে গিয়েছিল।
যা হোক, পুরানো আমলের এসব টাউটকে নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী আছে। তবে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, না অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, কার যেন একটা দারুণ জম-জমাট গল্প আছে, নাম বোধ হয় সাক্ষী, এসব চিড়িয়াকে নিয়ে। এ বিষয়ে ওই গল্পটাই বোধ করি বাংলা সাহিত্যের মাস্টারপিস।
তা এমনি এক স্টক উইটনেস গেছে এক গরুচুরির মামলায় সাক্ষ্য দিতে। এক লোকের হালচাষের দু'টি বলদ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এক চোর। সেই চোরের পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিতে গেছে সে। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে পাঁচটি টাকা পকেটে গুঁজে দিয়ে মোখতার বাবু তাকে তুলে দিয়েছেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়। তার আগে সে শুনেছে বিচারক একজন এডিশনাল বিচারক, যিনি ওই শহরে নতুন এসেছেন। এর আগে কোন এডিশনাল বিচারকের পদ ছিল না ওই জেলায়। 'মোখতার বাবু, এডিশনাল মানে কী,' সাক্ষী তার জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য জানতে চাইল। 'এডিশনাল মানে অতিরিক্ত। তা ওসব জানার দরকার কী তোর। যা দুগ্গা বলে উঠে পড়। ঠিকমত বলবি কিন্তু সব কিছু।' 'ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি সব গুছিয়ে-গাছিয়ে ঠিক মেরে দেব দেখবেন,' সে বলল।
এদিকে হয়েছে কি, ওই সাক্ষী থাকত শহরের এক বস্তিতে। ওখানেই জন্ম, ওখানেই বেড়ে ওঠা। জীবনে কোনদিন শহরের বাইরে যায়নি, চাষবাসের চ-ও জানে না। দু'এক কথার পর প্রাজ্ঞ বিচারক বুঝলেন, সে মামলা সম্বন্ধে কিছু তো জানেই না, এমন কি সম্ভবত হালচাষের বিষয়েও বিশেষজ্ঞ, অর্থাৎ বিশেষভাবে অজ্ঞ। তিনি তাকে দু'একটি চোখা চোখা প্রশ্ন করে নাস্তানাবুদ করে ফেললেন। সাক্ষী দেখল এই নতুন বিচারকের হাতে আজ সে ঠিকই ধরা খেয়ে গেছে। আজ কপালে নির্ঘাত জেল-জরিমানা আছে। তবু ভাব দেখাল যেন সব ঠিক আছে। বিচারকের সওয়ালে কাত হয়েছে তো কী হয়েছে, সুযোগ পেলে সেও দেখিয়ে দেবে কত বড় ঘাগু সাক্ষী সে।
বিচারক বললেন, বুঝেছি, তুমি চাষবাসের কিছুই জান না। আচ্ছা, বল তো, জমি চাষ করতে কয়টি বলদ লাগে? সাক্ষী আসলে কোনদিন কাউকে হালচাষ করতে দেখেনি। এ ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই। সে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত করে বলল, হুজুর, তিনটা। জবাব শুনে আদালতসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। বিচারক মহোদয় বললেন, শুনলেন তো আপনারা, হালচাষ করতে যে দু'টো বলদ লাগে, এই লোকটা তাও জানে না। সাক্ষী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, হুজুর, দুইটা যে লাগে তা আমি জানি। তিন নম্বরটা এডিশনাল, মানে অতিরিক্ত।
আমি এই এডিশনাল শব্দযুক্ত পদবী পেয়েছিলাম চাকরি জীবনের প্রথমদিকে, যখন পাকিস্তান আমলে কুমিল্লায় এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার হয়ে বদলি হলাম তখন। কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (৮ ডিসেম্বর ১৯৭১) আমার অফিস চেম্বারের দরজার ওপর বাংলায় নামফলক লাগালাম : অমুক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)। বিষয়টি স্বভাবতই দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কাছে অতিরিক্ত শব্দটির একটি অভিনব ব্যাখ্যাও দিলাম আমি। 'অতিরিক্ত অর্থ হচ্ছে অতিশয় রিক্ত। যে জেলা প্রশাসকের বস্তুত কোন ক্ষমতাই নেই, যিনি একেবারেই শূন্যহস্ত, তাঁকে বলা হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। যেমন আমি। আমার কোন ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা সব জেলা প্রশাসকের হাতে। আমার পদবী তাই অতিশয় রিক্ত বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। সোজা বাংলায় বলতে পারেন ফালতু। ব্যাখ্যাটি সবার মনঃপূত না হলেও তা বোধ হয় একেবারে উড়িয়ে দেয়ার উপায় ছিল না।
তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-বুড়িগঙ্গার জল অনেক শুকিয়েছে। (বহুকাল ধরে আর গড়িয়েছে বলি না, বলতে পারি না। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে শুকিয়েছে বা দূষিত হয়েছে বলাটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে করি)। ততদিনে অতিরিক্ত শব্দটি প্রশাসনিক পরিভাষায় ভালভাবেই ঢুকে পড়েছে। এটি নিয়ে আমি আর ঠাট্টা-মস্করাও করি না। কিন্তু আমি না করলে কী হল, বিজ্ঞজনদের কাছে এই শব্দযুক্ত পদবীর যে কানাকড়ির মূল্যও নেই, তা বুঝতে পারলাম সেদিন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ পাঠ করে।
দ্বিখণ্ডিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে সরকার সম্প্রতি দু'জন নতুন প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছেন। পদগুলির গুরুত্ব বিবেচনা করে সিভিল সার্ভিসের দু'জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরা দু'জনই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অতিরিক্ত সচিব। সচিবের পরেই জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ অতিরিক্ত সচিব। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এই পদধারীদের কিছুতেই 'অতিশয় রিক্ত' বা 'ফালতু' বলা যায় না। সারাজীবন সরকারি চাকরিতে অনেক ঘাম ঝরিয়ে, রক্ত পানি করে, বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। অবসরগ্রহণের বয়সসীমা পেরিয়ে না গেলে এখান থেকে পরবর্তী ধাপে যাওয়া অনেকটা রুটিন ব্যাপার। কাজেই এই পর্যায়ের সিনিয়র দুইজন কর্মকর্তাকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যথার্থ হয়েছে মনে করা যায়। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে খটকা লাগল যখন দেখলাম অতিরিক্ত সচিবদ্বয়ের এই নিয়োগে আরেকটি 'অতিরিক্ত' যুক্ত হয়েছে : এই দুই কর্মকর্তা তাঁদের বর্তমান দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের ভার বহন করবেন। তার মানে? তা হলে কি কর্পোরেশনের দায়িত্ব কোন ব্যাপারই নয়, যে কাউকে ওখানে বসিয়ে দিলেই হল? করদাতা নাগরিকদের প্রতি কোন দায়িত্বই নেই কর্পোরেশন প্রধানের? মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে সময় পেলে ওখানে তশরিফ নেবেন, না হলে না। এমনিতেই পুরো শহরের পৌর সুবিধাদির যে ছ্যাড়াবেড়া অবস্থা, তাতে দুইজন খণ্ডকালীন সিটি ফাদার (নাকি স্টেপ ফাদার?) নিয়োগ দিয়ে সরকার কি এই শহরের সোয়া কোটি নাগরিকের সঙ্গে রসিকতা করলেন? সেই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, যে-মন্ত্রণালয়ের মগডালে এই দুই কর্মকর্তার অধিষ্ঠান, সেই মন্ত্রণালয়ে তা হলে কি এঁদের তেমন কাজকর্ম নেই, যে কারণে তাঁদের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপানো হয়েছে?
একসঙ্গে দুই দপ্তরে বা পদে দায়িত্ব পালন করার একটা পুরানো ব্যাধি আছে। কোন একটি অফিসে গিয়ে তাঁকে না পাওয়া গেলে রেডিমেড জবাব পাওয়া যায়, স্যার অন্য অফিসে আছেন। এবং ভাইস ভার্সা। গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল প্রভৃতি বিভাগের নির্বাহী এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের অফিসে গেলে শোনা যায়, স্যার 'সাইটে' গেছেন, আর, 'সাইটে' গেলে শুনতে হয়, স্যার তাঁর দপ্তরে আছেন। তবে, সবাই যে এভাবে কাজে ফাঁকি দেন, তা বলা যাবে না, যদিও ফাঁকিবাজদের জন্য অবশ্যই এটা একটা ভাল ব্যবস্থা। হোক না স্বল্পসময়ের জন্য দায়িত্বপালন, তবুও পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে, উন্নততর ব্যবস্থাপনার স্বার্থে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক পদে দু'জন দক্ষ কর্মকর্তাকে পূর্ণকালীন নিয়োগ দেয়া যেত। অবশ্য, দক্ষতা নয়, সরকারের আনুগত্য এবং আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে খেদমত প্রদানই যদি প্রধান মাপকাঠি হয় যোগ্যতা বিচারের, তা হলে সরকার তাদের হাতের কাছের আস্থাভাজন কাউকে বেছে নেবেন, বাংলাদেশে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তাই বলে নিজের একান্ত সচিবের মত এত কাছের কেউ হতে হবে নাকি? এই নিয়োগসংক্রান্ত সংবাদটি পড়তে পড়তে বড়রকমের ধাক্কাটি খেলাম, যখন দেখলাম নিয়োগকৃত দুই অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই আরও একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। সেটা কী? পাঠক, এবার একটা হাই ভোল্টেজ 'শক'-এর জন্য তৈয়ার হোন। নির্বাচিত প্রশাসকদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত সচিব আবার মাননীয় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর একান্ত সচিবও বটেন। অর্থাৎ, সেই অতিরিক্ত সচিব সাহেবকে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের অতিরিক্ত দায়িত্বই শুধু দেয়া হয়নি, তিনি আরেকটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ফলে, তাঁর পদবীতে এখন তিনটি 'অতিরিক্ত' বা 'এডিশনাল'-এর তারকা শোভা পাচ্ছে। আমাদের প্রাগুক্ত 'স্টক উইটনেস' এখন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হলফ নিয়ে হয়ত বলবে, থুক্কু হুজুর, হালচাষ করতে তিনটা নয়, চারটা বলদ লাগে, যার তিনটাই এডিশনাল !
বাংলাদেশে যে এমন বিরল প্রতিভাধর দুর্লভ প্রজাতির কর্মকর্তা আছেন, জানতাম না। ভাগ্যিস, এঁরা ছিলেন, তাই আজও দেশের প্রশাসনের আকাশে চন্দ-সূর্য ওঠে, নির্মিত হবার আগেই পদ্মা সেতু ডোবে, হলমার্কের খলনায়করা ছলচাতুরীর বিশ্বরেকর্ড গড়ার সুযোগ পায়, রানা প্লাজার রানা প্রতাপরা বুড়ো আঙুল দেখায় সব আইন-কানুনকে।
তবে, আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময় মনে হয়েছে- এবং আমি নিশ্চিত, আমার মত আরো অনেক 'ওল্ড হ্যাগার্ড' আমলারও চোখ কপালে উঠেছে- একজন অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি করেন কী করে? তাঁকে এই পদে নিয়োগই বা দেয় কে আর তিনি কবুলই বা করেন কী করে। আপনাদের অনেকের হয়ত জানা নেই, মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি (পি.এস.) হিসেবে ডেপুটি সেক্রেটারিদের মধ্য হতে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ওপরের স্তর বা মর্যাদার কেউ নয়। অবশ্য, মন্ত্রী ইচ্ছা করলে এর নিচের স্তরের কাউকে তাঁর পি.এস. হিসেবে নিতে পারেন। ১৯৭২-এর এপ্রিলে আমার ওই সময়ের মাননীয় মন্ত্রী, 'লেইট লেমেন্টেড' জেনারেল ওসমানী আমার সুপারিশক্রমে (আমি ছিলাম তখন তাঁর মন্ত্রণালয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি) প্রাক্তন সি এস পি অফিসার, সহকারী সচিব ইফতেখার আহমদ চৌধুরী (গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা)-কে তাঁর পি.এস. পদে নিয়েছিলেন। ইফতেখার প্রায় তিন বছর জেনারেল সাহেবের পি.এস. ছিল এবং আগাগোড়া সে ছিল একজন সহকারী সচিব।
কিন্তু যখন শুনি অতিরিক্ত সচিব পি.এস.-এর দায়িত্ব পালন করছেন, তখন ইচ্ছা হয় আমার অনুজপ্রতিম জুনিয়র সহকর্মীদের উদ্দেশে বলি : হে ভ্রাতাগণ, তোমাদের অবক্ষয়ের আর দেখলে কী। এ তো কেবল শুরু। সেই যে চাকরির ইন্টারভিউতে এক ছ্যামড়া বলেছিল ...। গল্পটা মনে নেই? আচ্ছা, মনে করিয়ে দিচ্ছি। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে চেয়ারে বসেই এক প্রার্থী এমন নার্ভাস হয়ে পড়ল যে, দৃশ্যতই তার হাঁটু কাঁপছিল। তাই দেখে বোর্ডের চেয়ারম্যান তাকে সাহস দিয়ে বললেন, তুমি ভয় পেয়েছ নাকি? তোমার হাঁটু কাঁপছে কেন? রিল্যাঙ্ ইয়াংম্যান। ইয়াংম্যানটি চিঁ চিঁ করে কোনমতে বলল, হাঁটু কাঁপার আর কী দেখলেন, স্যার, আগে দু'একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন, তখন দেখবেন হাঁটু কাঁপা কাকে বলে। ... তোমাদের মধ্যে হাত কচলানোর যে অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে, দলবাজি, ল্যাং মারামারি, তেলাতেলির যে নোংরা খেলা চলছে, তাতে অনেকেরই হাতের তালুর রেখা অচিরেই যাবে মিশে, ল্যাং খেয়ে অনেকেই পড়ে থাকবে হাঁটুভাঙা দ হয়ে।
২
আর এই অপকালচার যেসব ভালচার (উইথ এপোলজি) প্রায় সিকি শতাব্দী আগে শুরু করেছিল, সেই সব 'মেন অব অল সিজনস্' নিজেদের আখের ঠিকই গুছিয়ে নিয়ে কেউ কেউ এখন বিরাট মনসবদার, কেউ দেশপ্রেমের ফার্স্ট ক্লাস কন্ট্রাক্টর। তারাই চালু করেছে সরকারি চাকরিতে দলীয়করণ নামক এক আচানক ডি এন এ টেস্ট পদ্ধতি। তোমার মজহাব কী? খালি মুমিন মুসলমান হলে চলবে না, মজহাব মিলতে হবে। কী বললে, তোমার প্রমোশন হচ্ছে না, তোমার কপালে খাগড়াছড়ি? হবেই তো। তোমার ডি এন এ টেস্টে ধরা পড়েছে বিজাতীয় ভাইরাস। তুমি কী করে আশা কর, তোমাকে পার করে দেয়ার মত এতবড় একটা অন্যায় কাজ আমি করব।
হায়, শুধু নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই তো সেদিন আমাদের কিছু তথাকথিত ব্রিলিয়ান্ট সহকর্মী জনপ্রশাসনের আবহমানকাল ধরে সযত্নে লালিত নিয়মকানুন-শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতার নীতি ভেঙে চুরমার করে কারখানার শ্রমিকদের মত ট্রেড ইউনিয়নিজম শুরু করে দেয় সরকারি চাকরিতে। মঞ্চ বানিয়ে নেতা হওয়ার সখ মেটায় তারা, লেজুড়বৃত্তি শেখায় অপেক্ষাকৃত তরুণতরদের। আর, আজ 'সেই পথ লক্ষ্য করে/স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে' তাদের হাতে গড়া কিছু কিছু তরুণ মেধা দিয়ে, সততা দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে নয়, হাত কচলিয়ে, তেল মেরে, দলবাজি করে প্রশাসনের শীর্ষপদে থেকে সেবাদাসের ভূমিকা পালন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। আর, করে না বলেই অতিরিক্ত সচিবকে বানানো হয় একান্ত সচিব। ...ধরণী দ্বিধা হও, আমরা মুখ লুকাই।
৩
চাকরিতে থাকতে মাঝে মাঝে বোরিং মিটিংয়ে বসে আপন মনে চুপচাপ 'মিটিং-কাব্য' রচনা করতাম। আমার সহকর্মী সচিব কাজী রকিবুদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার) ও আরো দু'একজন পাশে থেকে আস্তে করে কাগজ ধরিয়ে দিত। রকিব ছিল ওইসব 'মিটিং-কাব্যের' বড় সমঝদার। এমনি একটি অণুকাব্য ছিল এ রকম : হ্যালো, হ্যালো,/ শুনছ ও ভাই টি এন ও/ ঢাকা এলে স্যারের জন্য এক টিন ঘি এনো। ... ওই ছড়া এখন লিখলে হয়ত আরেকটি লাইন জুড়ে দিতাম : সেই সঙ্গে খামে পুরে/ মোটা অঙ্কের ফী এনো।
উপসংহার : যখন কলিকাল আর দুষ্কাল সমার্থক হয়ে যায়, তখন সবই সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মুখে সুন্দর একটা লোকজ ছড়া শোনা যায় যার ভেতর দিয়ে, আমার মনে হয়, বর্তমান সময়ের উল্টা-পাল্টা অসঙ্গতি-বিসঙ্গতির চিত্রটি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে : অসময়ে বর্ষাকাল/ হরিণী চাটে বাঘের গাল। ...
কিন্তু এই সিডর-সুনামি সৃষ্টিকারী অকাল বর্ষা কি শেষ হবে না? হবে। নিশ্চয়ই হবে। নইলে যে ইংরেজ কবি শেলীর অমর পংক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে : ও উইন্ড, ইফ উইন্টার কামস্, ক্যান স্প্রিং বি ফার বাহাইন্ড?।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
mkarim06@yahoo.com
চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর দেখতে দেখতে প্রায় পনেরটি বছর পার হয়ে গেল। আমাদের প্রজন্মের সবাই আমরা কেউ বত্রিশ, কেউ পঁয়ত্রিশ, কেউ চল্লিশ বছর চাকরির জোয়াল বয়েছি কাঁধে। কেউ আরো বেশি। তারপর যখন একদিন বাড়ি যাওয়ার সময় হল, তখন আল্লাহপাককে লাখ লাখ শুকরিয়া জানিয়েছি মান-ইজ্জত নিয়ে যেতে পেরেছি বলে। আমি আরেকটু বাড়তি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি রাব্বুল আলামিনকে এই জন্য যে চাকরিতে সারাজীবন ঢুঁশ খেয়েছি অনেক, তবু আল্লাহর মেহেরবানিতে হুঁশ হারাইনি কখনো। আর, সে কী ঢুঁশ একেকটা! মারনেওয়ালাদের চেহারা-সুরৎ দেখে আটপাড়া-বারহাট্টা এলাকার ষাঁড়ের লড়াইয়ের উন্মত্ত বলীবর্দরাও লজ্জা পাবে। সেই জন্যই ছিল আমার এডিশনাল শুকরিয়া আদায়।
কিন্তু সেদিন অনুজপ্রতিম দু'জন 'এডিশনাল' সহকর্মীর খুবই মর্যাদাপূর্ণ পদপ্রাপ্তির সংবাদ শুনে এডিশনাল তো দূরের কথা, আবশ্যিক ধন্যবাদটাও দিতে পারলাম না কাউকে। তবে, সরকারি চাকরির এই পৌনঃপুনিক ডিভ্যালুয়েশনের জমানায় চাকরি করতে হচ্ছে না বলে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম। হুঁ, বুঝতে পারছি আরেকটু ঝেড়ে না কাশলে আপনারা বিষয়টা ধরতে পারছেন না। শুনুন তা হলে।
তবে, আগে এই 'এডিশনাল'-এর মাজেজাটা খোলাসা করি। ইংরেজি 'এডিশনাল' কথার অর্থ যে অতিরিক্ত, তা আমরা সবাই জানি। জানত না শুধু আদালতপাড়ার এক 'স্টক উইটনেস'। 'স্টক উইটনেস' আবার কী বস্তু জানতে চান, না? বলছি। বাজার, মাজার আর সাজার জায়গা আদালতে টাউট-বাটপাড়রা সবসময় গিসগিস্ করে, এটা তো নিশ্চয়ই জানেন। আদালত চত্বরে আবার এক শ্রেণীর ধুরন্ধর কিসিমের মানুষ আছে, যারা আপনার সবরকমের মুশকিল আসানের জন্য এক পায়ে খাড়া। এরা সারাক্ষণ আদালতপাড়ায় ঘুরঘুর করে। যে কোন মামলায়- তা খুনের মামলা, গুমের মামলা, চুরি-ডাকাতি যাই হোক না কেন- সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এদের বললেই হল। কিছুটা মামলার বিষয়ে শুনে নিয়ে, বাকিটা পুরোপুরি বানিয়ে বানিয়ে তোফা সাক্ষ্য দিয়ে দেবে এরা। এরা আদালতের চেনামুখ। আদালতের ভাষায়, আগে এদের বলত স্টক উইটনেস। এখন কী বলে জানি না। এদের বাড়াবাড়ি রকম উপস্থিতি বন্ধ করার জন্য বেঙ্গল টাউট এ্যাক্ট বলে একটা আইন ছিল, যার আওতায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টাউটদের তালিকা বানিয়ে আদালত চত্বরে লটকিয়ে দিতেন আদালতের ত্রিসীমানায় এদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে। অনেক ভাল জিনিসের মত এই আইনটির প্রয়োগও সেই ব্রিটিশ আমলেই ধীরে ধীরে উঠে গিয়েছিল।
যা হোক, পুরানো আমলের এসব টাউটকে নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী আছে। তবে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, না অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, কার যেন একটা দারুণ জম-জমাট গল্প আছে, নাম বোধ হয় সাক্ষী, এসব চিড়িয়াকে নিয়ে। এ বিষয়ে ওই গল্পটাই বোধ করি বাংলা সাহিত্যের মাস্টারপিস।
তা এমনি এক স্টক উইটনেস গেছে এক গরুচুরির মামলায় সাক্ষ্য দিতে। এক লোকের হালচাষের দু'টি বলদ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এক চোর। সেই চোরের পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিতে গেছে সে। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে পাঁচটি টাকা পকেটে গুঁজে দিয়ে মোখতার বাবু তাকে তুলে দিয়েছেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়। তার আগে সে শুনেছে বিচারক একজন এডিশনাল বিচারক, যিনি ওই শহরে নতুন এসেছেন। এর আগে কোন এডিশনাল বিচারকের পদ ছিল না ওই জেলায়। 'মোখতার বাবু, এডিশনাল মানে কী,' সাক্ষী তার জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য জানতে চাইল। 'এডিশনাল মানে অতিরিক্ত। তা ওসব জানার দরকার কী তোর। যা দুগ্গা বলে উঠে পড়। ঠিকমত বলবি কিন্তু সব কিছু।' 'ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি সব গুছিয়ে-গাছিয়ে ঠিক মেরে দেব দেখবেন,' সে বলল।
এদিকে হয়েছে কি, ওই সাক্ষী থাকত শহরের এক বস্তিতে। ওখানেই জন্ম, ওখানেই বেড়ে ওঠা। জীবনে কোনদিন শহরের বাইরে যায়নি, চাষবাসের চ-ও জানে না। দু'এক কথার পর প্রাজ্ঞ বিচারক বুঝলেন, সে মামলা সম্বন্ধে কিছু তো জানেই না, এমন কি সম্ভবত হালচাষের বিষয়েও বিশেষজ্ঞ, অর্থাৎ বিশেষভাবে অজ্ঞ। তিনি তাকে দু'একটি চোখা চোখা প্রশ্ন করে নাস্তানাবুদ করে ফেললেন। সাক্ষী দেখল এই নতুন বিচারকের হাতে আজ সে ঠিকই ধরা খেয়ে গেছে। আজ কপালে নির্ঘাত জেল-জরিমানা আছে। তবু ভাব দেখাল যেন সব ঠিক আছে। বিচারকের সওয়ালে কাত হয়েছে তো কী হয়েছে, সুযোগ পেলে সেও দেখিয়ে দেবে কত বড় ঘাগু সাক্ষী সে।
বিচারক বললেন, বুঝেছি, তুমি চাষবাসের কিছুই জান না। আচ্ছা, বল তো, জমি চাষ করতে কয়টি বলদ লাগে? সাক্ষী আসলে কোনদিন কাউকে হালচাষ করতে দেখেনি। এ ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই। সে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত করে বলল, হুজুর, তিনটা। জবাব শুনে আদালতসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। বিচারক মহোদয় বললেন, শুনলেন তো আপনারা, হালচাষ করতে যে দু'টো বলদ লাগে, এই লোকটা তাও জানে না। সাক্ষী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, হুজুর, দুইটা যে লাগে তা আমি জানি। তিন নম্বরটা এডিশনাল, মানে অতিরিক্ত।
আমি এই এডিশনাল শব্দযুক্ত পদবী পেয়েছিলাম চাকরি জীবনের প্রথমদিকে, যখন পাকিস্তান আমলে কুমিল্লায় এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার হয়ে বদলি হলাম তখন। কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (৮ ডিসেম্বর ১৯৭১) আমার অফিস চেম্বারের দরজার ওপর বাংলায় নামফলক লাগালাম : অমুক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)। বিষয়টি স্বভাবতই দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কাছে অতিরিক্ত শব্দটির একটি অভিনব ব্যাখ্যাও দিলাম আমি। 'অতিরিক্ত অর্থ হচ্ছে অতিশয় রিক্ত। যে জেলা প্রশাসকের বস্তুত কোন ক্ষমতাই নেই, যিনি একেবারেই শূন্যহস্ত, তাঁকে বলা হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। যেমন আমি। আমার কোন ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা সব জেলা প্রশাসকের হাতে। আমার পদবী তাই অতিশয় রিক্ত বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। সোজা বাংলায় বলতে পারেন ফালতু। ব্যাখ্যাটি সবার মনঃপূত না হলেও তা বোধ হয় একেবারে উড়িয়ে দেয়ার উপায় ছিল না।
তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-বুড়িগঙ্গার জল অনেক শুকিয়েছে। (বহুকাল ধরে আর গড়িয়েছে বলি না, বলতে পারি না। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে শুকিয়েছে বা দূষিত হয়েছে বলাটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে করি)। ততদিনে অতিরিক্ত শব্দটি প্রশাসনিক পরিভাষায় ভালভাবেই ঢুকে পড়েছে। এটি নিয়ে আমি আর ঠাট্টা-মস্করাও করি না। কিন্তু আমি না করলে কী হল, বিজ্ঞজনদের কাছে এই শব্দযুক্ত পদবীর যে কানাকড়ির মূল্যও নেই, তা বুঝতে পারলাম সেদিন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ পাঠ করে।
দ্বিখণ্ডিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে সরকার সম্প্রতি দু'জন নতুন প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছেন। পদগুলির গুরুত্ব বিবেচনা করে সিভিল সার্ভিসের দু'জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরা দু'জনই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অতিরিক্ত সচিব। সচিবের পরেই জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ অতিরিক্ত সচিব। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এই পদধারীদের কিছুতেই 'অতিশয় রিক্ত' বা 'ফালতু' বলা যায় না। সারাজীবন সরকারি চাকরিতে অনেক ঘাম ঝরিয়ে, রক্ত পানি করে, বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। অবসরগ্রহণের বয়সসীমা পেরিয়ে না গেলে এখান থেকে পরবর্তী ধাপে যাওয়া অনেকটা রুটিন ব্যাপার। কাজেই এই পর্যায়ের সিনিয়র দুইজন কর্মকর্তাকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যথার্থ হয়েছে মনে করা যায়। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে খটকা লাগল যখন দেখলাম অতিরিক্ত সচিবদ্বয়ের এই নিয়োগে আরেকটি 'অতিরিক্ত' যুক্ত হয়েছে : এই দুই কর্মকর্তা তাঁদের বর্তমান দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের ভার বহন করবেন। তার মানে? তা হলে কি কর্পোরেশনের দায়িত্ব কোন ব্যাপারই নয়, যে কাউকে ওখানে বসিয়ে দিলেই হল? করদাতা নাগরিকদের প্রতি কোন দায়িত্বই নেই কর্পোরেশন প্রধানের? মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে সময় পেলে ওখানে তশরিফ নেবেন, না হলে না। এমনিতেই পুরো শহরের পৌর সুবিধাদির যে ছ্যাড়াবেড়া অবস্থা, তাতে দুইজন খণ্ডকালীন সিটি ফাদার (নাকি স্টেপ ফাদার?) নিয়োগ দিয়ে সরকার কি এই শহরের সোয়া কোটি নাগরিকের সঙ্গে রসিকতা করলেন? সেই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, যে-মন্ত্রণালয়ের মগডালে এই দুই কর্মকর্তার অধিষ্ঠান, সেই মন্ত্রণালয়ে তা হলে কি এঁদের তেমন কাজকর্ম নেই, যে কারণে তাঁদের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপানো হয়েছে?
একসঙ্গে দুই দপ্তরে বা পদে দায়িত্ব পালন করার একটা পুরানো ব্যাধি আছে। কোন একটি অফিসে গিয়ে তাঁকে না পাওয়া গেলে রেডিমেড জবাব পাওয়া যায়, স্যার অন্য অফিসে আছেন। এবং ভাইস ভার্সা। গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল প্রভৃতি বিভাগের নির্বাহী এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের অফিসে গেলে শোনা যায়, স্যার 'সাইটে' গেছেন, আর, 'সাইটে' গেলে শুনতে হয়, স্যার তাঁর দপ্তরে আছেন। তবে, সবাই যে এভাবে কাজে ফাঁকি দেন, তা বলা যাবে না, যদিও ফাঁকিবাজদের জন্য অবশ্যই এটা একটা ভাল ব্যবস্থা। হোক না স্বল্পসময়ের জন্য দায়িত্বপালন, তবুও পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে, উন্নততর ব্যবস্থাপনার স্বার্থে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক পদে দু'জন দক্ষ কর্মকর্তাকে পূর্ণকালীন নিয়োগ দেয়া যেত। অবশ্য, দক্ষতা নয়, সরকারের আনুগত্য এবং আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে খেদমত প্রদানই যদি প্রধান মাপকাঠি হয় যোগ্যতা বিচারের, তা হলে সরকার তাদের হাতের কাছের আস্থাভাজন কাউকে বেছে নেবেন, বাংলাদেশে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তাই বলে নিজের একান্ত সচিবের মত এত কাছের কেউ হতে হবে নাকি? এই নিয়োগসংক্রান্ত সংবাদটি পড়তে পড়তে বড়রকমের ধাক্কাটি খেলাম, যখন দেখলাম নিয়োগকৃত দুই অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই আরও একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। সেটা কী? পাঠক, এবার একটা হাই ভোল্টেজ 'শক'-এর জন্য তৈয়ার হোন। নির্বাচিত প্রশাসকদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত সচিব আবার মাননীয় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর একান্ত সচিবও বটেন। অর্থাৎ, সেই অতিরিক্ত সচিব সাহেবকে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের অতিরিক্ত দায়িত্বই শুধু দেয়া হয়নি, তিনি আরেকটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ফলে, তাঁর পদবীতে এখন তিনটি 'অতিরিক্ত' বা 'এডিশনাল'-এর তারকা শোভা পাচ্ছে। আমাদের প্রাগুক্ত 'স্টক উইটনেস' এখন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হলফ নিয়ে হয়ত বলবে, থুক্কু হুজুর, হালচাষ করতে তিনটা নয়, চারটা বলদ লাগে, যার তিনটাই এডিশনাল !
বাংলাদেশে যে এমন বিরল প্রতিভাধর দুর্লভ প্রজাতির কর্মকর্তা আছেন, জানতাম না। ভাগ্যিস, এঁরা ছিলেন, তাই আজও দেশের প্রশাসনের আকাশে চন্দ-সূর্য ওঠে, নির্মিত হবার আগেই পদ্মা সেতু ডোবে, হলমার্কের খলনায়করা ছলচাতুরীর বিশ্বরেকর্ড গড়ার সুযোগ পায়, রানা প্লাজার রানা প্রতাপরা বুড়ো আঙুল দেখায় সব আইন-কানুনকে।
তবে, আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময় মনে হয়েছে- এবং আমি নিশ্চিত, আমার মত আরো অনেক 'ওল্ড হ্যাগার্ড' আমলারও চোখ কপালে উঠেছে- একজন অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি করেন কী করে? তাঁকে এই পদে নিয়োগই বা দেয় কে আর তিনি কবুলই বা করেন কী করে। আপনাদের অনেকের হয়ত জানা নেই, মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি (পি.এস.) হিসেবে ডেপুটি সেক্রেটারিদের মধ্য হতে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ওপরের স্তর বা মর্যাদার কেউ নয়। অবশ্য, মন্ত্রী ইচ্ছা করলে এর নিচের স্তরের কাউকে তাঁর পি.এস. হিসেবে নিতে পারেন। ১৯৭২-এর এপ্রিলে আমার ওই সময়ের মাননীয় মন্ত্রী, 'লেইট লেমেন্টেড' জেনারেল ওসমানী আমার সুপারিশক্রমে (আমি ছিলাম তখন তাঁর মন্ত্রণালয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি) প্রাক্তন সি এস পি অফিসার, সহকারী সচিব ইফতেখার আহমদ চৌধুরী (গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা)-কে তাঁর পি.এস. পদে নিয়েছিলেন। ইফতেখার প্রায় তিন বছর জেনারেল সাহেবের পি.এস. ছিল এবং আগাগোড়া সে ছিল একজন সহকারী সচিব।
কিন্তু যখন শুনি অতিরিক্ত সচিব পি.এস.-এর দায়িত্ব পালন করছেন, তখন ইচ্ছা হয় আমার অনুজপ্রতিম জুনিয়র সহকর্মীদের উদ্দেশে বলি : হে ভ্রাতাগণ, তোমাদের অবক্ষয়ের আর দেখলে কী। এ তো কেবল শুরু। সেই যে চাকরির ইন্টারভিউতে এক ছ্যামড়া বলেছিল ...। গল্পটা মনে নেই? আচ্ছা, মনে করিয়ে দিচ্ছি। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে চেয়ারে বসেই এক প্রার্থী এমন নার্ভাস হয়ে পড়ল যে, দৃশ্যতই তার হাঁটু কাঁপছিল। তাই দেখে বোর্ডের চেয়ারম্যান তাকে সাহস দিয়ে বললেন, তুমি ভয় পেয়েছ নাকি? তোমার হাঁটু কাঁপছে কেন? রিল্যাঙ্ ইয়াংম্যান। ইয়াংম্যানটি চিঁ চিঁ করে কোনমতে বলল, হাঁটু কাঁপার আর কী দেখলেন, স্যার, আগে দু'একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন, তখন দেখবেন হাঁটু কাঁপা কাকে বলে। ... তোমাদের মধ্যে হাত কচলানোর যে অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে, দলবাজি, ল্যাং মারামারি, তেলাতেলির যে নোংরা খেলা চলছে, তাতে অনেকেরই হাতের তালুর রেখা অচিরেই যাবে মিশে, ল্যাং খেয়ে অনেকেই পড়ে থাকবে হাঁটুভাঙা দ হয়ে।
২
আর এই অপকালচার যেসব ভালচার (উইথ এপোলজি) প্রায় সিকি শতাব্দী আগে শুরু করেছিল, সেই সব 'মেন অব অল সিজনস্' নিজেদের আখের ঠিকই গুছিয়ে নিয়ে কেউ কেউ এখন বিরাট মনসবদার, কেউ দেশপ্রেমের ফার্স্ট ক্লাস কন্ট্রাক্টর। তারাই চালু করেছে সরকারি চাকরিতে দলীয়করণ নামক এক আচানক ডি এন এ টেস্ট পদ্ধতি। তোমার মজহাব কী? খালি মুমিন মুসলমান হলে চলবে না, মজহাব মিলতে হবে। কী বললে, তোমার প্রমোশন হচ্ছে না, তোমার কপালে খাগড়াছড়ি? হবেই তো। তোমার ডি এন এ টেস্টে ধরা পড়েছে বিজাতীয় ভাইরাস। তুমি কী করে আশা কর, তোমাকে পার করে দেয়ার মত এতবড় একটা অন্যায় কাজ আমি করব।
হায়, শুধু নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই তো সেদিন আমাদের কিছু তথাকথিত ব্রিলিয়ান্ট সহকর্মী জনপ্রশাসনের আবহমানকাল ধরে সযত্নে লালিত নিয়মকানুন-শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতার নীতি ভেঙে চুরমার করে কারখানার শ্রমিকদের মত ট্রেড ইউনিয়নিজম শুরু করে দেয় সরকারি চাকরিতে। মঞ্চ বানিয়ে নেতা হওয়ার সখ মেটায় তারা, লেজুড়বৃত্তি শেখায় অপেক্ষাকৃত তরুণতরদের। আর, আজ 'সেই পথ লক্ষ্য করে/স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে' তাদের হাতে গড়া কিছু কিছু তরুণ মেধা দিয়ে, সততা দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে নয়, হাত কচলিয়ে, তেল মেরে, দলবাজি করে প্রশাসনের শীর্ষপদে থেকে সেবাদাসের ভূমিকা পালন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। আর, করে না বলেই অতিরিক্ত সচিবকে বানানো হয় একান্ত সচিব। ...ধরণী দ্বিধা হও, আমরা মুখ লুকাই।
৩
চাকরিতে থাকতে মাঝে মাঝে বোরিং মিটিংয়ে বসে আপন মনে চুপচাপ 'মিটিং-কাব্য' রচনা করতাম। আমার সহকর্মী সচিব কাজী রকিবুদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার) ও আরো দু'একজন পাশে থেকে আস্তে করে কাগজ ধরিয়ে দিত। রকিব ছিল ওইসব 'মিটিং-কাব্যের' বড় সমঝদার। এমনি একটি অণুকাব্য ছিল এ রকম : হ্যালো, হ্যালো,/ শুনছ ও ভাই টি এন ও/ ঢাকা এলে স্যারের জন্য এক টিন ঘি এনো। ... ওই ছড়া এখন লিখলে হয়ত আরেকটি লাইন জুড়ে দিতাম : সেই সঙ্গে খামে পুরে/ মোটা অঙ্কের ফী এনো।
উপসংহার : যখন কলিকাল আর দুষ্কাল সমার্থক হয়ে যায়, তখন সবই সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মুখে সুন্দর একটা লোকজ ছড়া শোনা যায় যার ভেতর দিয়ে, আমার মনে হয়, বর্তমান সময়ের উল্টা-পাল্টা অসঙ্গতি-বিসঙ্গতির চিত্রটি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে : অসময়ে বর্ষাকাল/ হরিণী চাটে বাঘের গাল। ...
কিন্তু এই সিডর-সুনামি সৃষ্টিকারী অকাল বর্ষা কি শেষ হবে না? হবে। নিশ্চয়ই হবে। নইলে যে ইংরেজ কবি শেলীর অমর পংক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে : ও উইন্ড, ইফ উইন্টার কামস্, ক্যান স্প্রিং বি ফার বাহাইন্ড?।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
mkarim06@yahoo.com
No comments