মৃত্যুদণ্ডের ক্লান্তি by শাহ্নাজ মুন্নী
কোনো কোনো রাত আসে এমনই, রতিক্লান্ত নারীর
মতো শিথিলা শরীর, অর্ধমুদিত চক্ষু, এলায়িত কালো চুল আর চাপা ঠোঁটে মোহময়
নীরবতা নিয়ে; আসে—আপাদমস্তক জড়িয়ে ধরে আর অবসন্ন চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে দেয়।
চাঁদের প্রাচীন ঘোলাটে আলো জানালার মলিন কাচ চুইয়ে যখন আমার শক্ত বিছানায়,
আমার নিদ্রাহীন লম্বা রুক্ষ চুলে এসে বিলি কাটতে থাকে, তখন কিছুক্ষণ
অস্থির ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ করে হঠাৎ মমতার কথা মনে হয় আমার। ও কি ঘুমিয়ে
পড়েছে, নাকি শ্বাসকষ্টের ধকল সামলাতে গিয়ে আজকের রাতটাও নির্ঘুম কাটাচ্ছে?
বালিশের নিচ থেকে ফোনটা মুঠোতে তুলে নিই। ফোনের স্ক্রিনে এখন রাত দুইটা
সতেরো। অনেক রাত। হোক রাত। গভীর রাতেই তো আমাদের পরিচয়। রাতের নীরবতাই তো
আমাদের কথা বলার উপযুক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। আস্তে করে বোতাম টিপে দিই।
অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওই প্রান্ত থেকে মমতার ঘুমজড়ানো গলা।
‘এই, তুমি ঘুমাওনি?’
‘নাহ্, তুমি?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘আমি ঘুমায়া ঘুমায়া আজব একটা স্বপ্ন দেখতেছিলাম, কী স্বপ্ন জানো?...যেন বৃষ্টিতে ভিজতেছি...যেন আকাশ কালো করা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একটা নীল পুকুরে সাঁতার কাটতেছি। জলকন্যার মতো পাতলা স্বচ্ছ শরীর নিয়া একবার ডুব দিয়ে পানির নিচে যাই, আরেকবার ভুশ করে পানির ওপরে উঠি...হি হি হি...’
মমতা দুর্বল ভঙ্গিতে হাসে, ‘এমনিতে আমি কিন্তু সাঁতারই জানি না।’
মমতা আরও কী সব যেন বলতে থাকে। হয়তো তার সন্তরণশীল স্বপ্নের কথাই, আমি যার কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না; তবু কানে ফোন লাগিয়ে শুয়ে থাকি। মনে হয়, কানের কাছে নাম না-জানা কোনো পাখি গান গাইছে। কখনো মনে হয়, দূর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ কানের মধ্যে আছড়ে পড়ছে। কখনো মনে হয়, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কখনো সুর তুলে শিস দিচ্ছে বাতাস। আমার খুব ভালো লাগে। এক অন্য রকম জাদুময় ভূমিতে বিচরণ করি, শান্তি আর মুক্তির স্নিগ্ধ আনন্দে বিভোর হয়ে যাই। রাত তার ক্লান্তি কাটিয়ে আবারও উদ্দীপ্ত হয়। আমার চোখে ঘুম আঁকিবুঁকি কাটে।
‘এই, তুমি শুনছ তো আমার কথা? নাকি ঘুমিয়ে পড়লে?’ মমতা বলে।
‘ঘুমাই নাই, শুনতেছি। বলো...’
‘শোনো, আমি না একটু বাথরুমে যাব। ফিরে এসে আবার তোমারে ফোন করি?’
ফোন কেটে দিয়ে শুয়ে থাকি, অপেক্ষা করি, এলোমেলো চিন্তা আসে। রাত তার লম্বা পা মেলে নিঃশব্দে হাঁটাহাঁটি করে। হাঁটতে হাঁটতে রাত আমাকে বিছানায় ফেলে রেখে ভোরের দিকে যায়, দিনের দিকে যায়, আলোর দিকে যায়। মমতা আর ফোন করে না। হয়তো ভুলে গেছে ফোন করার কথা। হয়তো ও আগের মতো ঘুমিয়ে গেছে। হয়তো স্বপ্নে সাঁতার কাটছে কোনো বিশাল পদ্মদিঘিতে। আমি সেই প্রাচীন দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর আনন্দময় ঝাঁপাঝাঁপি দেখছি। পদ্ম ফুলের পাঁপড়ির মধ্যে ওর ডুবে যাওয়া আর ভেসে ওঠা দেখছি। দেখতে দেখতে একসময় আমিও মুরব্বিদের মতো উচ্চ স্বরে ডাকতে থাকি, ‘মমতা, এবার উঠে এসো। এতক্ষণ পানিতে থাকলে শরীর খারাপ করবে...উঠে এসো, মমতা।’
মমতা তখন ভেজা শরীর নিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় দিঘির পাড়ে উঠে আসে। নিজের অনাবৃত হাত-পা দেখিয়ে বলে,
‘এই দ্যাখো, পানিতে থাকতে থাকতে আমার শরীরে কেমন পানি এসে গেছে। দ্যাখো কত পানি আমার গায়ে, আমার চামড়ার নিচে...’
আমি দেখি, সত্যি সত্যি ওর হাত-পা খুব ফোলা দেখাচ্ছে। চোখ-মুখও ভীষণ ফুলে গেছে। আর মমতার পাতলা চেহারাটা বদলে গিয়ে কেমন অদ্ভুত লাগছে, যেন আসলেই দিঘির পানি ঢুকে রসে টসটস করছে ওর সারা শরীর। আস্তে করে ওর হাতটা ধরি। হাতের পিঠের চামড়ার ওপর আঙুল দিয়ে চাপ দিই। তারপর আঙুল সরিয়ে নিলে দেখি জায়গাটা দেবে গেছে। মমতাও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। করুণভাবে বলে,
‘দেখছ, কত পানি। শরীরে কেমন পচা মাছের মতো গর্ত হয়ে গেল...’
‘পানি তো হবেই, মমতা।’ আমি সান্ত্বনার সুরে বলি, ‘যার দুটো কিডনিই নষ্ট, তার গায়ে পানি আসা তো খুব স্বাভাবিক, তাই না?’
মমতা কেমন অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দেয়। ম্লান কণ্ঠে বলে,
‘হুঁ, বোধ হয় ডায়ালাইসিস করার সময় হয়ে গেছে...’
‘তোমার বাবাকে বলো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ডায়ালাইসিস করাবে।’
‘বাবা? বাবা কোথায়?’
মমতা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকায়। হয়তো ওর বাবাকেই খোঁজে। আমি ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করি। দেখি, অনেক দূর থেকে কেউ একজন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হেঁটে আসছেন। পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। রোদ সামলানোর জন্য মাথায় একটা কালো ছাতা ধরে আছেন। কে উনি? মমতার বাবা নাকি? যদিও আমি কোনো দিন মমতার বাবাকে দেখিনি। তাঁকে চিনিও না; তবু এগিয়ে আসা লোকটাকে ভালো করে দেখার জন্য একটু সামনে যাই। চেহারা দেখার চেষ্টা করি। তারপর মানুষটা যখন আরও কাছে এগিয়ে আসেন, তখন তাঁকে ভালোভাবে চিনতে পারি। না, উনি মমতার বাবা নন। আমি অবাক হই আমার বাবাকে দেখে।
‘আব্বা, আপনে এইখানে?’
‘হ্যাঁ, তোরে খুঁজতে আসলাম। সেই কখন স্কুল ছুটি হইছে। সবাই বাড়ি গেছে, তুই যাস নাই কেন? চল, চল, বাড়ি চল...কত বেলা হইছে...তোর এই দেরি করার অভ্যাস আর গেল না...’
আমি চোখ খুলে দেখি, আসলেই বেশ বেলা হয়ে গেছে। যে জানালা দিয়ে রাতে চাঁদের আলো আসছিল, সেই জানালা এখন সূর্যের আলোয় প্লাবিত। আমি হাই তুলে উঠে বসি। বাসাটা মনে হচ্ছে নিঝুম, চুপচাপ। তার মানে আপা স্কুলে চলে গেছে, দুলাভাই হয়তো আমার মতোই ঘুমিয়ে। উনি দোকানে যাবেন বারোটার পর। মোবাইল ফোনটা হাতে নিই। একটা মেসেজ। বখতিয়ার ভাইয়ের। তাঁর অফিসে যেতে বলেছেন। হয়তো কোনো নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে বলবেন। এমন বই, যে বইয়ের নামই হয়তো এখনো ঠিক হয়নি। কবে ঠিক হবে, তা কেউ জানে না। বখতিয়ার ভাই বলবেন, ‘আরে, আঁকো ব্রাদার, বিমূর্ত কিছু আঁকো। এমন কিছু, যেটা সব নামের সঙ্গে চালিয়ে দেওয়া যায়।’
‘এ রকম উদ্দেশ্যবিহীন প্রচ্ছদ আঁকা আমার ভালো লাগে না, বখতিয়ার ভাই।’
আমি বলব। বখতিয়ার ভাই ভীষণ রেগে যাবেন, ‘উদ্দেশ্য আবার কী? শিল্পের কোনো উদ্দেশ্য থাকে নাকি? উদ্দেশ্যহীনতাই তো প্রকৃত শিল্প। কি ঘোড়ার ডিমের শিল্পী হইছ, আমি জানি না...’
বখতিয়ার ভাই তাঁর স্বভাবমতো গালিগালাজ শুরু করবেন। খিস্তিখেউড় করবেন। লোকে যে বলে, বখতিয়ার ভাইয়ের মুখ আর ডাস্টবিন সমার্থক, তা আবারও প্রমাণিত হবে।
আমার যেহেতু অহেতুক তর্ক করতে একদমই ভালো লাগে না, তাই আমি কিছু না বলেই থেমে যাব, হাঁটতে থাকব ধুলার শহরে। ধূলিকণারা উড়তে থাকবে আমাকে ঘিরে। শহরজুড়ে জমতে থাকবে কুয়াশা। শহরজুড়ে চলতে থাকবে হুলুস্থুল চিৎকার। আবছা অন্ধকারে ধূলির উদ্দেশ্যবিহীন ওড়াউড়ি থামবেই না।
দিনের শেষে অর্থপূর্ণ কিছুই করতে না পারার গ্লানি নিয়ে ফিরে আসবে আরও একটি প্রথাবদ্ধ রাত।
সারা দিন কি আমি তবে চোখ বুজে ছিলাম? আমি কি তাহলে কোনো কিছুই দেখিনি, কোনো কিছুই শুনিনি, কোনো কিছুই বুঝিনি? আমি কি নিষ্ক্রিয়, নিঃসাড় কাঠের পুতুল?
মমতা জানতে চাইবে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
‘কী, কথা বলছ না কেন। আমার টিনের সেপাই, মাটির পুতুল...’
‘তুমি কথা বলো, আমার কোনো কথা নাই...’
‘কথা তো আমারও নাই।’
বলে মমতা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। হয়তো কিছু একটা ভাবে। তারপর খাপছাড়াভাবে বলে,
‘এই, আমার খালার সঙ্গে কথা বলবা? খালার কথা আগে বলছি না তোমাকে। তার জীবনের ট্র্যাজেডির গল্প? বলি নাই? আচ্ছা দাঁড়াও, সেই গল্পটা তোমাকে বলি। খালার নাম ধরে নাও সুদীপা। ঠিক আছে?
এখন তাহলে সুদীপার গল্প শুরু করি...’
মমতা অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে। আমার হঠাৎ মনে হয়, মমতা কি তবে আরব্য রজনীর রাজকুমারী শাহারজাদি, যে নিকটবর্তী মৃত্যুদণ্ড ঠেকিয়ে রাখতে রাতের পর রাত গল্পকে ব্যবহার করে? একটানা গল্প বলে যায় ভোর পর্যন্ত। শাহারজাদির মতো একই কৌশলে মমতা তবে কার মৃত্যু ঠেকাচ্ছে। আমার, নাকি তার নিজের? অথবা আমাদের দুজনেরই। এভাবে কত দিন আর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। আদৌ কি পারা যাবে সেটা?
‘না, পারা যাবে না। মৃত্যুও বড় রহস্যময়। তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আবার ডেকেও আনা যায় না। সুদীপার গল্প শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে, মৃত্যু মাঝেমধ্যে জীবনের সঙ্গে কেমন রসিকতা করে।’
মমতা কিছুক্ষণ থেমে সুদীপার গল্প শুরু করে:
ধনীর সুন্দরী কন্যা সুদীপা ভালোবাসে দরিদ্র কৃষিজীবীর পুত্র আবদুর রশিদকে। ফলে সুদীপার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন এই ভালোবাসায় বাদ সাধে। তারা একসময় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সুদীপার প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজনের চাপে পুলিশ তাদের ধরে আনে। সুদীপার অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়।
...এসব খেলো প্রেমের গল্পে আস্থা না থাকায় আমি মমতাকে বাধা দিই। বলি, ‘থামো, থামো, শাহারজাদি। বড় বোরিং গল্প বলছ তুমি। এতে কোনো বৈচিত্র্য নেই।’
মমতা হঠাৎ থমকে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘একটু ধৈর্য ধরুন বাদশাহ নামদার; গল্পে মোচড় আসছে।’
আমি তখন ধৈর্য ধরি। শাহারজাদি আবার সুদীপার গল্প বলে—
ফলে তারা দুজন—সুদীপা ও রশিদ একসঙ্গে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। রশিদ বাজার থেকে পোকা মারার বিষ কিনে আনে। তারা ঠিক করে, মধ্যরাতে, ঠিক বারোটায় দুজন একসঙ্গে বিষপান করবে। সুদীপা তার নিজের শোয়ার ঘরে আর রশিদ তার বাড়িতে নিজের পড়ার ঘরে বসে স্বেচ্ছামৃত্যুর এই উৎসবে যোগ দেবে। তাদের মৃত্যুকালীন স্থান হবে ভিন্ন, কিন্তু সময় অভিন্ন। আমাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়—এমন কথাও লেখা থাকবে তাদের মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা অন্তিম চিরকুটে।
মৃত্যুর পর দুজনের আত্মা হয়তো বা তখন একসঙ্গে থাকবে স্বর্গ কিংবা নরকে অথবা অনিশ্চিত ঘুরে বেড়াবে পৃথিবীর বাতাসে। তখন কেউ আর তাদের পৃথক করতে পারবে না। তারা একমত হয়, মৃত্যুর পর যা ইচ্ছা তা-ই হোক, এখন এই অসহ্য জীবন আর বয়ে বেড়ানো যায় না।
অতঃপর সুদীপা ও রশিদের জীবনে বিষম কালো মৃত্যুময় রূপ নিয়ে মধ্যরাত আসে। নির্ধারিত সময়ে তারা দুজনই সবার অলক্ষ্যে বিষপান করে। কিন্তু হায়, অভাগিনী সুদীপার বাড়ির লোকেরা কীভাবে যেন টের পেয়ে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফলে, সুদীপা বাঁচতে না চাইলেও বেঁচে থাকে। তাকে বেঁচে থাকতে হয় মৃত্যুর চেয়েও কঠিন এক যন্ত্রণাময় অনুভব নিয়ে।
সুদীপার বিয়ের দিন তার বান্ধবী এসে কানে কানে জানিয়ে যায়, ওই একই সময়ে বিষপানে আবদুর রশিদ মারা গেছে, একা। সুদীপা কথা দিয়েও তার সঙ্গী হতে পারেনি। সুদীপা তার প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। রশিদের তরুণ প্রেমিক আত্মাকে সে একাকী ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর অনিশ্চিত ভুবনে। মৃত্যুর সেই বিবর্ণ অন্ধকারে এখন রশিদ নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হয়তো মৃত্যুর অজানা অন্ধকার থেকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে বিয়ের সাজে সাজা সুদীপার দিকে। তাকিয়ে আছে এই আলো ঝলমলে বিয়েবাড়ির দিকে। হয়তো সে কাঁদছে সুদীপাকে না পেয়ে। হয়তো সে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সুদীপার ঘাড়ের কাছে। বিয়েবাড়ির হইচইয়ের মধ্যে লাল কাতানের ভেতরে এসব ভেবে সুদীপার শোকবিহ্বল শীর্ণ শরীর শিউরে ওঠে। সে হঠাৎ তার খুব কাছে রশিদের বিষজর্জর নীলাভ উপস্থিতি টের পায়। রশিদ বোবা কণ্ঠে গোঙানির মতো শব্দ করে তাকে ডাকে। সুদীপা বোঝে, নিজের প্রাণের সঙ্গে যে বিষ সে মিশিয়েছে আপন হাতে, সেই বিষের দহন তাকে তিলে তিলে দগ্ধ করে যাবে, কিন্তু নিঃশেষ করবে না।
মমতা থামে।
‘তারপর?’ আমি জানতে চাই।
‘ভোর হয়ে গেছে। বাদশাহ নামদার, দিনের আলোয় আমার গল্পরা যে ঘুমিয়ে পড়ে।’ মমতা বলে।
‘হুঁ, আজকের মতো তোমার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা হলো শাহারজাদি। কাল আবার গল্প শুনব।’
‘আপনার অশেষ কৃপা জাহাঁপনা।’
এরপর একটি মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করার ক্লান্তি এবং আরেকটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ইচ্ছা বুকে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
‘এই, তুমি ঘুমাওনি?’
‘নাহ্, তুমি?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘আমি ঘুমায়া ঘুমায়া আজব একটা স্বপ্ন দেখতেছিলাম, কী স্বপ্ন জানো?...যেন বৃষ্টিতে ভিজতেছি...যেন আকাশ কালো করা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একটা নীল পুকুরে সাঁতার কাটতেছি। জলকন্যার মতো পাতলা স্বচ্ছ শরীর নিয়া একবার ডুব দিয়ে পানির নিচে যাই, আরেকবার ভুশ করে পানির ওপরে উঠি...হি হি হি...’
মমতা দুর্বল ভঙ্গিতে হাসে, ‘এমনিতে আমি কিন্তু সাঁতারই জানি না।’
মমতা আরও কী সব যেন বলতে থাকে। হয়তো তার সন্তরণশীল স্বপ্নের কথাই, আমি যার কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না; তবু কানে ফোন লাগিয়ে শুয়ে থাকি। মনে হয়, কানের কাছে নাম না-জানা কোনো পাখি গান গাইছে। কখনো মনে হয়, দূর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ কানের মধ্যে আছড়ে পড়ছে। কখনো মনে হয়, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কখনো সুর তুলে শিস দিচ্ছে বাতাস। আমার খুব ভালো লাগে। এক অন্য রকম জাদুময় ভূমিতে বিচরণ করি, শান্তি আর মুক্তির স্নিগ্ধ আনন্দে বিভোর হয়ে যাই। রাত তার ক্লান্তি কাটিয়ে আবারও উদ্দীপ্ত হয়। আমার চোখে ঘুম আঁকিবুঁকি কাটে।
‘এই, তুমি শুনছ তো আমার কথা? নাকি ঘুমিয়ে পড়লে?’ মমতা বলে।
‘ঘুমাই নাই, শুনতেছি। বলো...’
‘শোনো, আমি না একটু বাথরুমে যাব। ফিরে এসে আবার তোমারে ফোন করি?’
ফোন কেটে দিয়ে শুয়ে থাকি, অপেক্ষা করি, এলোমেলো চিন্তা আসে। রাত তার লম্বা পা মেলে নিঃশব্দে হাঁটাহাঁটি করে। হাঁটতে হাঁটতে রাত আমাকে বিছানায় ফেলে রেখে ভোরের দিকে যায়, দিনের দিকে যায়, আলোর দিকে যায়। মমতা আর ফোন করে না। হয়তো ভুলে গেছে ফোন করার কথা। হয়তো ও আগের মতো ঘুমিয়ে গেছে। হয়তো স্বপ্নে সাঁতার কাটছে কোনো বিশাল পদ্মদিঘিতে। আমি সেই প্রাচীন দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর আনন্দময় ঝাঁপাঝাঁপি দেখছি। পদ্ম ফুলের পাঁপড়ির মধ্যে ওর ডুবে যাওয়া আর ভেসে ওঠা দেখছি। দেখতে দেখতে একসময় আমিও মুরব্বিদের মতো উচ্চ স্বরে ডাকতে থাকি, ‘মমতা, এবার উঠে এসো। এতক্ষণ পানিতে থাকলে শরীর খারাপ করবে...উঠে এসো, মমতা।’
মমতা তখন ভেজা শরীর নিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় দিঘির পাড়ে উঠে আসে। নিজের অনাবৃত হাত-পা দেখিয়ে বলে,
‘এই দ্যাখো, পানিতে থাকতে থাকতে আমার শরীরে কেমন পানি এসে গেছে। দ্যাখো কত পানি আমার গায়ে, আমার চামড়ার নিচে...’
আমি দেখি, সত্যি সত্যি ওর হাত-পা খুব ফোলা দেখাচ্ছে। চোখ-মুখও ভীষণ ফুলে গেছে। আর মমতার পাতলা চেহারাটা বদলে গিয়ে কেমন অদ্ভুত লাগছে, যেন আসলেই দিঘির পানি ঢুকে রসে টসটস করছে ওর সারা শরীর। আস্তে করে ওর হাতটা ধরি। হাতের পিঠের চামড়ার ওপর আঙুল দিয়ে চাপ দিই। তারপর আঙুল সরিয়ে নিলে দেখি জায়গাটা দেবে গেছে। মমতাও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। করুণভাবে বলে,
‘দেখছ, কত পানি। শরীরে কেমন পচা মাছের মতো গর্ত হয়ে গেল...’
‘পানি তো হবেই, মমতা।’ আমি সান্ত্বনার সুরে বলি, ‘যার দুটো কিডনিই নষ্ট, তার গায়ে পানি আসা তো খুব স্বাভাবিক, তাই না?’
মমতা কেমন অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দেয়। ম্লান কণ্ঠে বলে,
‘হুঁ, বোধ হয় ডায়ালাইসিস করার সময় হয়ে গেছে...’
‘তোমার বাবাকে বলো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ডায়ালাইসিস করাবে।’
‘বাবা? বাবা কোথায়?’
মমতা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকায়। হয়তো ওর বাবাকেই খোঁজে। আমি ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করি। দেখি, অনেক দূর থেকে কেউ একজন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হেঁটে আসছেন। পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। রোদ সামলানোর জন্য মাথায় একটা কালো ছাতা ধরে আছেন। কে উনি? মমতার বাবা নাকি? যদিও আমি কোনো দিন মমতার বাবাকে দেখিনি। তাঁকে চিনিও না; তবু এগিয়ে আসা লোকটাকে ভালো করে দেখার জন্য একটু সামনে যাই। চেহারা দেখার চেষ্টা করি। তারপর মানুষটা যখন আরও কাছে এগিয়ে আসেন, তখন তাঁকে ভালোভাবে চিনতে পারি। না, উনি মমতার বাবা নন। আমি অবাক হই আমার বাবাকে দেখে।
‘আব্বা, আপনে এইখানে?’
‘হ্যাঁ, তোরে খুঁজতে আসলাম। সেই কখন স্কুল ছুটি হইছে। সবাই বাড়ি গেছে, তুই যাস নাই কেন? চল, চল, বাড়ি চল...কত বেলা হইছে...তোর এই দেরি করার অভ্যাস আর গেল না...’
আমি চোখ খুলে দেখি, আসলেই বেশ বেলা হয়ে গেছে। যে জানালা দিয়ে রাতে চাঁদের আলো আসছিল, সেই জানালা এখন সূর্যের আলোয় প্লাবিত। আমি হাই তুলে উঠে বসি। বাসাটা মনে হচ্ছে নিঝুম, চুপচাপ। তার মানে আপা স্কুলে চলে গেছে, দুলাভাই হয়তো আমার মতোই ঘুমিয়ে। উনি দোকানে যাবেন বারোটার পর। মোবাইল ফোনটা হাতে নিই। একটা মেসেজ। বখতিয়ার ভাইয়ের। তাঁর অফিসে যেতে বলেছেন। হয়তো কোনো নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে বলবেন। এমন বই, যে বইয়ের নামই হয়তো এখনো ঠিক হয়নি। কবে ঠিক হবে, তা কেউ জানে না। বখতিয়ার ভাই বলবেন, ‘আরে, আঁকো ব্রাদার, বিমূর্ত কিছু আঁকো। এমন কিছু, যেটা সব নামের সঙ্গে চালিয়ে দেওয়া যায়।’
‘এ রকম উদ্দেশ্যবিহীন প্রচ্ছদ আঁকা আমার ভালো লাগে না, বখতিয়ার ভাই।’
আমি বলব। বখতিয়ার ভাই ভীষণ রেগে যাবেন, ‘উদ্দেশ্য আবার কী? শিল্পের কোনো উদ্দেশ্য থাকে নাকি? উদ্দেশ্যহীনতাই তো প্রকৃত শিল্প। কি ঘোড়ার ডিমের শিল্পী হইছ, আমি জানি না...’
বখতিয়ার ভাই তাঁর স্বভাবমতো গালিগালাজ শুরু করবেন। খিস্তিখেউড় করবেন। লোকে যে বলে, বখতিয়ার ভাইয়ের মুখ আর ডাস্টবিন সমার্থক, তা আবারও প্রমাণিত হবে।
আমার যেহেতু অহেতুক তর্ক করতে একদমই ভালো লাগে না, তাই আমি কিছু না বলেই থেমে যাব, হাঁটতে থাকব ধুলার শহরে। ধূলিকণারা উড়তে থাকবে আমাকে ঘিরে। শহরজুড়ে জমতে থাকবে কুয়াশা। শহরজুড়ে চলতে থাকবে হুলুস্থুল চিৎকার। আবছা অন্ধকারে ধূলির উদ্দেশ্যবিহীন ওড়াউড়ি থামবেই না।
দিনের শেষে অর্থপূর্ণ কিছুই করতে না পারার গ্লানি নিয়ে ফিরে আসবে আরও একটি প্রথাবদ্ধ রাত।
সারা দিন কি আমি তবে চোখ বুজে ছিলাম? আমি কি তাহলে কোনো কিছুই দেখিনি, কোনো কিছুই শুনিনি, কোনো কিছুই বুঝিনি? আমি কি নিষ্ক্রিয়, নিঃসাড় কাঠের পুতুল?
মমতা জানতে চাইবে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
‘কী, কথা বলছ না কেন। আমার টিনের সেপাই, মাটির পুতুল...’
‘তুমি কথা বলো, আমার কোনো কথা নাই...’
‘কথা তো আমারও নাই।’
বলে মমতা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। হয়তো কিছু একটা ভাবে। তারপর খাপছাড়াভাবে বলে,
‘এই, আমার খালার সঙ্গে কথা বলবা? খালার কথা আগে বলছি না তোমাকে। তার জীবনের ট্র্যাজেডির গল্প? বলি নাই? আচ্ছা দাঁড়াও, সেই গল্পটা তোমাকে বলি। খালার নাম ধরে নাও সুদীপা। ঠিক আছে?
এখন তাহলে সুদীপার গল্প শুরু করি...’
মমতা অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে। আমার হঠাৎ মনে হয়, মমতা কি তবে আরব্য রজনীর রাজকুমারী শাহারজাদি, যে নিকটবর্তী মৃত্যুদণ্ড ঠেকিয়ে রাখতে রাতের পর রাত গল্পকে ব্যবহার করে? একটানা গল্প বলে যায় ভোর পর্যন্ত। শাহারজাদির মতো একই কৌশলে মমতা তবে কার মৃত্যু ঠেকাচ্ছে। আমার, নাকি তার নিজের? অথবা আমাদের দুজনেরই। এভাবে কত দিন আর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। আদৌ কি পারা যাবে সেটা?
‘না, পারা যাবে না। মৃত্যুও বড় রহস্যময়। তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আবার ডেকেও আনা যায় না। সুদীপার গল্প শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে, মৃত্যু মাঝেমধ্যে জীবনের সঙ্গে কেমন রসিকতা করে।’
মমতা কিছুক্ষণ থেমে সুদীপার গল্প শুরু করে:
ধনীর সুন্দরী কন্যা সুদীপা ভালোবাসে দরিদ্র কৃষিজীবীর পুত্র আবদুর রশিদকে। ফলে সুদীপার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন এই ভালোবাসায় বাদ সাধে। তারা একসময় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সুদীপার প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজনের চাপে পুলিশ তাদের ধরে আনে। সুদীপার অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়।
...এসব খেলো প্রেমের গল্পে আস্থা না থাকায় আমি মমতাকে বাধা দিই। বলি, ‘থামো, থামো, শাহারজাদি। বড় বোরিং গল্প বলছ তুমি। এতে কোনো বৈচিত্র্য নেই।’
মমতা হঠাৎ থমকে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘একটু ধৈর্য ধরুন বাদশাহ নামদার; গল্পে মোচড় আসছে।’
আমি তখন ধৈর্য ধরি। শাহারজাদি আবার সুদীপার গল্প বলে—
ফলে তারা দুজন—সুদীপা ও রশিদ একসঙ্গে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। রশিদ বাজার থেকে পোকা মারার বিষ কিনে আনে। তারা ঠিক করে, মধ্যরাতে, ঠিক বারোটায় দুজন একসঙ্গে বিষপান করবে। সুদীপা তার নিজের শোয়ার ঘরে আর রশিদ তার বাড়িতে নিজের পড়ার ঘরে বসে স্বেচ্ছামৃত্যুর এই উৎসবে যোগ দেবে। তাদের মৃত্যুকালীন স্থান হবে ভিন্ন, কিন্তু সময় অভিন্ন। আমাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়—এমন কথাও লেখা থাকবে তাদের মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা অন্তিম চিরকুটে।
মৃত্যুর পর দুজনের আত্মা হয়তো বা তখন একসঙ্গে থাকবে স্বর্গ কিংবা নরকে অথবা অনিশ্চিত ঘুরে বেড়াবে পৃথিবীর বাতাসে। তখন কেউ আর তাদের পৃথক করতে পারবে না। তারা একমত হয়, মৃত্যুর পর যা ইচ্ছা তা-ই হোক, এখন এই অসহ্য জীবন আর বয়ে বেড়ানো যায় না।
অতঃপর সুদীপা ও রশিদের জীবনে বিষম কালো মৃত্যুময় রূপ নিয়ে মধ্যরাত আসে। নির্ধারিত সময়ে তারা দুজনই সবার অলক্ষ্যে বিষপান করে। কিন্তু হায়, অভাগিনী সুদীপার বাড়ির লোকেরা কীভাবে যেন টের পেয়ে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফলে, সুদীপা বাঁচতে না চাইলেও বেঁচে থাকে। তাকে বেঁচে থাকতে হয় মৃত্যুর চেয়েও কঠিন এক যন্ত্রণাময় অনুভব নিয়ে।
সুদীপার বিয়ের দিন তার বান্ধবী এসে কানে কানে জানিয়ে যায়, ওই একই সময়ে বিষপানে আবদুর রশিদ মারা গেছে, একা। সুদীপা কথা দিয়েও তার সঙ্গী হতে পারেনি। সুদীপা তার প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। রশিদের তরুণ প্রেমিক আত্মাকে সে একাকী ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর অনিশ্চিত ভুবনে। মৃত্যুর সেই বিবর্ণ অন্ধকারে এখন রশিদ নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হয়তো মৃত্যুর অজানা অন্ধকার থেকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে বিয়ের সাজে সাজা সুদীপার দিকে। তাকিয়ে আছে এই আলো ঝলমলে বিয়েবাড়ির দিকে। হয়তো সে কাঁদছে সুদীপাকে না পেয়ে। হয়তো সে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সুদীপার ঘাড়ের কাছে। বিয়েবাড়ির হইচইয়ের মধ্যে লাল কাতানের ভেতরে এসব ভেবে সুদীপার শোকবিহ্বল শীর্ণ শরীর শিউরে ওঠে। সে হঠাৎ তার খুব কাছে রশিদের বিষজর্জর নীলাভ উপস্থিতি টের পায়। রশিদ বোবা কণ্ঠে গোঙানির মতো শব্দ করে তাকে ডাকে। সুদীপা বোঝে, নিজের প্রাণের সঙ্গে যে বিষ সে মিশিয়েছে আপন হাতে, সেই বিষের দহন তাকে তিলে তিলে দগ্ধ করে যাবে, কিন্তু নিঃশেষ করবে না।
মমতা থামে।
‘তারপর?’ আমি জানতে চাই।
‘ভোর হয়ে গেছে। বাদশাহ নামদার, দিনের আলোয় আমার গল্পরা যে ঘুমিয়ে পড়ে।’ মমতা বলে।
‘হুঁ, আজকের মতো তোমার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা হলো শাহারজাদি। কাল আবার গল্প শুনব।’
‘আপনার অশেষ কৃপা জাহাঁপনা।’
এরপর একটি মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করার ক্লান্তি এবং আরেকটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ইচ্ছা বুকে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
No comments