রক্তঝরা ঐতিহাসিক ৭ জুন by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
একটি হরতাল কিভাবে জাতীয় ইতিহাসে এত
স্মরণীয় হয়ে উঠতে পারে তা এখনকার সহিংস হরতালচিত্র দেখে বোঝার কোনো উপায়
নেই। কেননা এখন কারা, কখন এবং কেন ওই সব হরতাল ডাকে তা জনসাধারণের জানার
প্রয়োজনীয়তা হরতাল আহ্বানকারী দলগুলোর কেউই বোধ করেন না।
হরতাল ডেকে দলের সন্ত্রাসীদের রাস্তায় নেমে যানবাহনে আগুন জ্বালিয়ে ত্রাস
সৃষ্টি করতে পারাটিই হলো হরতালের মূল চরিত্র। এসব হরতালের প্রতি জনগণের
কোনো সমর্থন আছে কি নেই তেমন কোনো কিছু জানার দরকারও দলের নেই, নেতাদের
নেই। শক্তি প্রয়োগ করতে পারাটাই হরতাল সফল হওয়ার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে
বিবেচিত হচ্ছে।
অথচ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন এই দেশে একটি হরতাল পালিত হয়েছিল। সেটি ডাকা হয়েছিল আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভার সিদ্ধান্তক্রমে। ৩০ মে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ওই সভায় মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেননা তখন দলের মূল সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বারবার গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন। ছয় দফা দেওয়ার কারণে গোটা দলটি এবং এর প্রধান নেতারা পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবও থামবার পাত্র ছিলেন না, উল্কার মতো ছুটে বেড়াতে শুরু করলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।
উদ্দেশ্য একটাই- ছয় দফার প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ানো। ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল পাবনা, ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ এপ্রিল যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় জনসভা করে শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরছিলেন। যশোরে ১৮ এপ্রিল ভোররাতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন ৪৭(৫) ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ২০ মার্চ ঢাকার পল্টনে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দিয়েছেন। ২৫ এপ্রিল শেখ মুজিব ময়মনসিংহ থেকে মুক্তি পেয়ে কুমিল্লায় আসেন ২৯ তারিখ। ওই দিন কুমিল্লায় একটি বড় সভা করেন, এরপর ৬ মে সিলেটে জনসভা করেন শেখ মুজিব। ৮ তারিখ নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশে তিনি ভাষণ দেন। বাসায় ফেরার পথে ৯ মের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইন ৩২(১) ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে তিন মাসের আটকাদেশ দিয়ে ৯ মে জেলখানায় পাঠানো হয়। তাঁর সঙ্গে ওই দিন আটক নেতাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), এম এস হক ও আবদুর রহমান সিদ্দিকী। শেখ মুজিবকে মামলার বেড়াজালে আটকানোর জন্য ডিএসপির এল-এর চিঠিতে ৪৭(৫) ডিপিআর ৬৫/এবং ৭(৩) ইপিপিএস ও ৫৮সহ নানা গুরুতর ধারার উল্লেখ
করা হয়। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক জটিল মামলায় আদালতপাড়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন মোনায়েম খান, কোন জেলে তাঁকে পাঠানো হবে; লুকিয়ে রাখা হবে, তা নিয়েও টানাটানি চলছিল। সেই অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত নেতারা ৩০ মে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। দল থেকে একটি কড়া বিবৃতি পত্রপত্রিকায় পাঠানো হয়। মোনায়েম খান ওই বিবৃতি দেখে ছয় দফার আন্দোলনকে 'কঠোর হস্তে দমন করার' হুমকি দেন। ২ জুন আওয়ামী লীগের আরো বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইত্তেফাক পত্রিকায় ৭ জুন হরতালের খবর প্রকাশিত হলে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই ৭ জুনের হরতালের খবর দেশব্যাপী প্রচারিত হতে থাকে। ওই দিন সকাল থেকে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হতে থাকে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীসহ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। শিল্পাঞ্চল তেজগাঁওয়ে শ্রমিকরা ছয় দফার সমর্থনে মিছিল বের করে। এর ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে মনু মিয়া, মুজিবুল হকসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। আহত ও গ্রেপ্তার হন অনেকেই। সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে বলা হয়, 'আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহূত হরতাল...অতি প্রত্যুষ হইতে পথচারী ও যানবাহনে ব্যাপক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ছোকরা ও গুণ্ডাদের লেলাইয়া দেওয়া হয়। ...'
৭ জুনের হরতাল ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সাধারণ মানুষ ওই হরতালের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল, জায়গায় জায়গায় মিছিল বের করেছিল। পাকিস্তান সরকার ওই হরতালকে দমন করার জন্য নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, নেতাদের জেলে পুরেছিল, পত্রপত্রিকার মালিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছিল। খবর প্রকাশে বাধা প্রদান করার পরও সেদিন হরতাল পালিত হয়েছিল জনগণের সমর্থনে। অধিকন্তু মনু মিয়াসহ ১১ জনের হত্যার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ব্যাপক। শহরাঞ্চলের শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকরা ওই হরতালকে নিয়েছিল রাজনৈতিক চেতনা থেকে, তারাই পরবর্তী সময়ে ছয় দফার বাণী গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতির সেই সময়ে ৭ জুনের হরতাল ছয় দফাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়, একটি গণ-অভ্যুত্থানের পথে এগিয়ে নেওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার আন্দোলনের এক অনন্য মহিমায় সিক্ত রক্তঝরা দিবস হিসেবে ৭ জুন চিরকালই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইতিহাস নির্মাণের এমন দিনে মনু মিয়া, মুজিবুলসহ সব শহীদ যেন আমাদের প্রেরণা দিয়েই যাচ্ছেন। আমরা তাঁদের নতুন করে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
অথচ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন এই দেশে একটি হরতাল পালিত হয়েছিল। সেটি ডাকা হয়েছিল আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভার সিদ্ধান্তক্রমে। ৩০ মে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ওই সভায় মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেননা তখন দলের মূল সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বারবার গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন। ছয় দফা দেওয়ার কারণে গোটা দলটি এবং এর প্রধান নেতারা পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবও থামবার পাত্র ছিলেন না, উল্কার মতো ছুটে বেড়াতে শুরু করলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।
উদ্দেশ্য একটাই- ছয় দফার প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ানো। ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল পাবনা, ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ এপ্রিল যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় জনসভা করে শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরছিলেন। যশোরে ১৮ এপ্রিল ভোররাতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন ৪৭(৫) ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ২০ মার্চ ঢাকার পল্টনে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দিয়েছেন। ২৫ এপ্রিল শেখ মুজিব ময়মনসিংহ থেকে মুক্তি পেয়ে কুমিল্লায় আসেন ২৯ তারিখ। ওই দিন কুমিল্লায় একটি বড় সভা করেন, এরপর ৬ মে সিলেটে জনসভা করেন শেখ মুজিব। ৮ তারিখ নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশে তিনি ভাষণ দেন। বাসায় ফেরার পথে ৯ মের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইন ৩২(১) ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে তিন মাসের আটকাদেশ দিয়ে ৯ মে জেলখানায় পাঠানো হয়। তাঁর সঙ্গে ওই দিন আটক নেতাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), এম এস হক ও আবদুর রহমান সিদ্দিকী। শেখ মুজিবকে মামলার বেড়াজালে আটকানোর জন্য ডিএসপির এল-এর চিঠিতে ৪৭(৫) ডিপিআর ৬৫/এবং ৭(৩) ইপিপিএস ও ৫৮সহ নানা গুরুতর ধারার উল্লেখ
করা হয়। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক জটিল মামলায় আদালতপাড়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন মোনায়েম খান, কোন জেলে তাঁকে পাঠানো হবে; লুকিয়ে রাখা হবে, তা নিয়েও টানাটানি চলছিল। সেই অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত নেতারা ৩০ মে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। দল থেকে একটি কড়া বিবৃতি পত্রপত্রিকায় পাঠানো হয়। মোনায়েম খান ওই বিবৃতি দেখে ছয় দফার আন্দোলনকে 'কঠোর হস্তে দমন করার' হুমকি দেন। ২ জুন আওয়ামী লীগের আরো বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইত্তেফাক পত্রিকায় ৭ জুন হরতালের খবর প্রকাশিত হলে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই ৭ জুনের হরতালের খবর দেশব্যাপী প্রচারিত হতে থাকে। ওই দিন সকাল থেকে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হতে থাকে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীসহ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। শিল্পাঞ্চল তেজগাঁওয়ে শ্রমিকরা ছয় দফার সমর্থনে মিছিল বের করে। এর ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে মনু মিয়া, মুজিবুল হকসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। আহত ও গ্রেপ্তার হন অনেকেই। সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে বলা হয়, 'আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহূত হরতাল...অতি প্রত্যুষ হইতে পথচারী ও যানবাহনে ব্যাপক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ছোকরা ও গুণ্ডাদের লেলাইয়া দেওয়া হয়। ...'
৭ জুনের হরতাল ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সাধারণ মানুষ ওই হরতালের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল, জায়গায় জায়গায় মিছিল বের করেছিল। পাকিস্তান সরকার ওই হরতালকে দমন করার জন্য নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, নেতাদের জেলে পুরেছিল, পত্রপত্রিকার মালিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছিল। খবর প্রকাশে বাধা প্রদান করার পরও সেদিন হরতাল পালিত হয়েছিল জনগণের সমর্থনে। অধিকন্তু মনু মিয়াসহ ১১ জনের হত্যার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ব্যাপক। শহরাঞ্চলের শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকরা ওই হরতালকে নিয়েছিল রাজনৈতিক চেতনা থেকে, তারাই পরবর্তী সময়ে ছয় দফার বাণী গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতির সেই সময়ে ৭ জুনের হরতাল ছয় দফাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়, একটি গণ-অভ্যুত্থানের পথে এগিয়ে নেওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার আন্দোলনের এক অনন্য মহিমায় সিক্ত রক্তঝরা দিবস হিসেবে ৭ জুন চিরকালই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইতিহাস নির্মাণের এমন দিনে মনু মিয়া, মুজিবুলসহ সব শহীদ যেন আমাদের প্রেরণা দিয়েই যাচ্ছেন। আমরা তাঁদের নতুন করে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
No comments