‘এ যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ...’ by মুহম্মদ শফিকুর রহমান
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাস ৫ ফেব্রুয়ারি
মঙ্গলবার। একাত্তরে মিরপুরের কসাই কাদের নামে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার
এবং জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধ মামলার
রায় হবে।
এরই মধ্যে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় হয়েছে।
কাদের মোল্লারও ফাঁসির রায় হবে। কেননা বাচ্চু রাজাকারের চেয়ে কাদের মোল্লার
যুদ্ধাপরাধ আরও গুরুতর। আমরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আনিসুজ্জামানের
নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করছিলাম। সব্যসাচী কবি সৈয়দ
শামসুল হক, কবি ড. সামাদ, প্রগতিশীল রাজনীতিক অজয় রায়, নাট্যজন আতাউর
রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুস আমাদের সবার বুকে
পোস্টারÑ‘কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই দিতে হবে।’ এটি এই মানববন্ধনে
অংশগ্রহণকারীরেই কেবল দাবি নয়, এ দাবি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়
বিশ্বাসী দেশবাসীর, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের। তারা এই দুর্বৃত্তদের এই
পাপীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার, ৬ লাখ বীরাঙ্গনা ও
তাদের পরিবারের কাছে জাতির দায় থেকে মুক্তি দিতে চায়। কারণ এই দুর্বৃত্তরা
যেভাবে হানাদার পাক-সামরিক জান্তার সঙ্গে মিশে হত্যা, গণহত্যা চালিয়েছে।
নারীদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ধর্ষণ
করেছে, রুগ্ন হয়ে পড়লে তাকে হত্যা করে কোন ডোবা বা জঙ্গলে বা টানেলে ফেলে
দিয়েছে। বা বধ্যভূমিতে নিয়ে খুনীরা খুুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। যেমন করে
হত্যা করেছে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ঐ মিরপুর এবং রায়ের বাজার
বদ্ধভূমিতে। কাদের মোল্লা অনেককে জবাই করে হত্যা করেছে বলে তার নাম হয়েছে
‘কসাই কাদের।’ মিরপুরের মানুষ তো বটেই এমন কোন আইনজ্ঞ এমন কোন বুদ্ধিজীবী
এমন কোন সংবাদকর্মী এমন কোন গবেষক নেই। যাদের বিশ্বাস ছিল এই কসাইয়ের ফাঁসি
তো হবেই। মিরপুরের একজন তো বলেই ফেললেন কসাই কাদের যত হত্যা, ধর্ষণ করেছে
তাকে দশবার ফাঁসি দিলেও বিচার সম্পন্ন হবে না। (টিভি চ্যানেলের
সাক্ষাতকার)।
কেবল আমরা বা শহরাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবীরাই গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ ও অপেক্ষার প্রহর গুনছিল কখন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হবে। বিশেষ করে শহীদ পরিবার ও ধর্ষিতা মা-ও তাদের পরিবারের কাছে এই চাওয়াটা মোটেই বেশি কিছু চাওয়া ছিল না। তারা যা হারিয়েছে তা তো আর ফিরে পাবেন না। ঐ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হলে হয়ত মর্মবেদনা কিছুুটা লাঘব হবে। এই আশায় ৪টি দশক অপেক্ষা করছিল। অবশেষে সেই অপেক্ষার ক্ষণটি। কিন্তু না, এসেই ক্ষণ নয়, বরং এ ক্ষণ আরও নতুন করে যাতনা নিয়ে এলÑ কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো না, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল-২ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় দিলেন। এই খবর আমাদের মানববন্ধনে এলে আনিসুজ্জামান স্যার সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে ঝুলানো পোস্টারটি খুলে ফেললেন এবং মানববন্ধনও ওখানেই সমাপ্ত করলেন।
সবাই চলে গেছে। আমিও ক্লাবের অভ্যন্তরে যাব বলে কয়েক পা এগিয়ে আবার পেছনে ফিরলাম এবং সোজা বাসায় ফিরে বাকহীন বসে রইলাম। অনেকক্ষণ কারও সঙ্গে কোন কথা বলিনি। একে একে অতীত স্মৃতিগুলো সামনে ভাসতে লাগল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বাঙালী জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন পুরুষ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং ৩ নবেম্বর কারাভ্যন্তরীণ অবস্থা ৪ জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও আবু হেনা মুহাম্মদ কামরুজ্জামানকে হত্যা করে প্রতিবিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ৩০ লাখ শহীদ ও ৬০ লাখ বীরাঙ্গনা মা-বোনের সঙ্গে বেইমানী করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী পশ্চাৎপদ কূপম-ূক ধারা নিয়ে যেতে শুরু করে। মিলিটারি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এই প্রতিবিপ্লবী শক্তি মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সাংবিধান ক্ষতবিক্ষত করে। সেই থেকে শুরু করে কখনও সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকার পাতায় কখনও সিভিল সোসাইটি রাজনৈতিক কর্মী বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাজপথ বা সভা-সমাবেশ-মিছিল বা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছি। জাতির পিতা ও জাতীয় ৪ নেতার হত্যার বিচার চেয়েছি। শত শত নিবন্ধ-পোস্ট লিখেছি। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাসে যে রায়টি আমাদের উপহার দিলেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক তা প্রত্যাখ্যান তো করছিই এর বেশি আর কি বলব? মনে পড়ে মিলিটারি জিয়া কুখ্যাত রাজাকার ও আলবদর নেতা গোলাম আযমকে পাকিস্তানী পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসতে দিলেন এবং যেদিন হাইকোর্টের রায়ে তার নাগরিকত্ব (যা বঙ্গবন্ধু বাতিল করে দিয়েছিলেন) ফিরিয়ে দেয়া হলো সে সময় এক কলামে লিখেছিলাম বিচারালয়ের এই বিচার মানি না। ঐ বিচারককেও মানি না। ঝুঁকি নিয়েই বলেছিলাম আজও কনটেম্পট অব কোর্ট-এর ঝুঁকি নিয়েই বলছি ‘এ রায় মানি না, কসাই কাদেরকে ফাঁসি দিতে হবে।’ প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন প্রশ্ন তুলেছেন। ‘কতজনকে হত্যা করলে মৃত্যুদ- দেয়া যায় (?)’ প্রফেসর মামুন দৈনিক জনকণ্ঠে এক নিবন্ধে লিখেছেন :
‘বাচ্চু রাজাকারের রায়ে আমরা খুশি হয়েছিলাম ইতিহাসের সত্য প্রতিফলিত হতে দেখে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা ছিল তার থেকেও বেশি। অভিযোগগুলো একবার বিবেচনা করে দেখুন। ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে কলেজছাত্র পল্লবকে দুদিন গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল কাদের, তারপর হত্যা করা হয়েছিল। এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে ২ মার্চ ১৯৭১ কাদের ও তার বিহারী সহযোগীরা কবি মেছেরুন নেছার বাড়িতে মাথা কেটে ঝুলিয়ে রাখে- এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ২৯ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পয়গামের সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের জল্লাদখানায়। আবু তালেবের মেয়ে জানিয়েছেন, কোরবানির গরুর মতো তালেবকে জবাই করে মাংস টুকরো টুকরো করে উল্লাসে তারা মেতে ওঠেÑ এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় কাদের মিরপুরের হযরত আলী লস্কর ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করে এবং ১১ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করেÑএই অভিযোগও প্রমাণিত। ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ মিরপুরের আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে নির্যাতন করে খুন করে। মামা বাহিনীর শহীদুল হক মামা জানিয়েছেন, আজলা ভরে মানুষের চোখ তিনি সমাহিত করেছেনÑ এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। প্রমাণিত হয়নি কেবল ঘাটের চরের গণহত্যায় কাদেরের ইনভলমেন্ট।’
প্রফেসর মামুনও এ তথ্য নিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের রায়ের ফাইন্ডিং থেকেই। অথচ দেয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদ- অর্থাৎ তার ৩০ বছর সাজা হলো। কারাগারে সে ভাল ব্যবহার করলে এ সাজা কমে হবে ২৩ বছরের মতো। কিংবা ভাল ব্যবহার না করেও কারারক্ষী বা পুলিশকে টু-পাইস গুঁজে দিলে ভাল ব্যবহারের সার্টিফিকেট নেয়াকে আজকাল কোন ব্যাপারই নয়। তাই তো কাদের মোল্লা রায় শোনার পর ভি-চিহ্ন দেখিয়ে মুখে একটা ১০ নম্বরী মুচকি হাসি দিয়েছে। সে মনে করে আর তো মাত্র ১০ মাস। তারপর পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে এবং তাদের নেত্রী মিলিটারি জিয়া-পতœী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আবারও কোন এক ইয়াজদ্দিনকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাবেন এবং সেই রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করবেন। কাদের জেল থেকে বেরিয়ে মন্ত্রী হবেন এবং শহীদের রক্তরঞ্জিত পতাকা আবারও রাজাকারদের গাড়ি-বাড়িতে উড়বে। মজার ব্যাপার না? কিন্তু প্রশ্নটি হলো, একটি পত্রিকা দেখলাম কাদের মোল্লার সাজার চেয়ে ভি-চিহ্নটি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিরাট ছবিসহ লিড নিউজ করেছে। একজন বললেন (সংবাদকর্মী) ভালই হয়েছে। মানুষের মধ্যে ঘৃণা জন্মাবে। বললাম এতে ঘৃণা জন্মায় না, বরং সিমপ্যাথি জন্মায়। পত্রিকাটির লক্ষ্যও আমি মনে করি তা-ই। এসব নিয়ে বহু তর্ক করেছি। এই যেমন বিএনপি নেত্রী তথা জামায়াত-বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি অন্তত তিনটি আপত্তিকর বিষয়ের অবতারণার করেছেন। যেমন: (১) ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামকালে আমেরিকা না-কি তিনি অন্য কয়েকটি দেশের মতো আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছMy Country of 150 million people, located between india and Myanmar, has been indepentent since 1971, When he United states was our of the first Nations to recogise our right to self detsmination. লক্ষ্য করুন, কত বড় সত্যের অপলাপ! বরং প্রতিটি দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং এর ভিত্তিতে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাঙালী ভাল করেই জানে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূমিকা কি ছিল! আমেরিকা কেবল হানাদার পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সরকারকে অর্থ-অস্ত্র-রসদ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণ এবং বাঙালী জাতিকে হত্যা করার জন্যে ৭ম নৌবহর পাঠিয়েছিল। কে না জানে এসব কথা? বরং সেদিন পাকি-মার্কিন অস্ত্র অর্থের মোকাবেলায় ভারত, বিশেষ করে ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও এগিয়ে এসেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে এবং আমেরিাকর যুদ্ধজাহাজ সেভেন-ফ্লিটের মোকাবেলায় রেড-ফ্লিট পাঠালে সেভেন ফ্লিট বঙ্গোপসাগর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বেগম জিয়া বরং বলতে পারতেন আমেরিকার সিভিল সমাজের বিরাট অংশ এবং জনগণ আমাদের সংগ্রাম ও যুদ্ধকে নৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। যেমন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও সঙ্গীতশিল্পী জজ হ্যারিসন যবডিলস। বেগম খালেদা জিয়া তার নিবন্ধে পুরোটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিষোদগার করেছেন। যেমন করে সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে পুরোটাই থাকে শেখ হাসিনা ও সরকারবিরোধী কথাবার্তা। অবশ্য এতে তার ব্যক্তিগত ক্ষোভও কাজ করছে। কারণ শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের আমলে তাকে কোর্টের রায়ে ক্যান্টমেন্টের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে এবং তার দুই ছেলে তারেক-কোকোকে অর্থ পাচার ও অন্যান্য অভিযোগে দেশান্তরী হতে হয়েছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনি বলবেনই কিন্তু এটা কেমন কথা যে বাংলাদেশ আমেরিকায় পণ্য রফতানির জন্য যে জিএসপি সুবিধার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে। তিনি তার বিরুদ্ধে কথা বলবেন কিংবা পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের মতো কথা বলবেন। কিংবা বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার এবং দারিদ্র্য বিমোচন শেখ হাসিনার হাতে নিরাপদ নয়, তাই তিনি আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য হস্তক্ষেপ কামনা করবেন? It is impossible to sory in good coucience that democracy, Justice and the alleviation of povesly in Bangladesh Under Sheikh Hasiua are Safe, Indeed, all are in grave dangol, In is time for the world, led lsy Amlicia, to act and eusure that democracy to saned in Bangladesh. সঙ্গত দুর্বলতার কারণেই অন্য কেউ এই কলামটি লিখে দিয়েছেন এবং ওয়াশিংটন টাইমসে ছাপার ব্যবস্থা করেছেন। এই পত্রিকাটি শুনেছি খুব বড় বা বহুল প্রচারিত না হলেও ওয়াশিংটন প্রশাসনের হাতে যায়। ধারণা করা যাচ্ছে যারা ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে, তাদের পক্ষে এ রকম একটি কলাম বা এর আগে দি ইকোনমিস্ট-এ সরকারবিরোধী রিপোর্ট করাতে পারে সহজেই। সবচে আশ্চর্যের বিষয় হলো কয়েকদিন আগে মধ্যরাতের এক গলাবাজিতে দেখলাম আমাদের সাংবাদিকতার প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবিএম মূসা এই কলামটিকে ডিফেন্ড করছেন। অবশ্য এতেও অবাক হবার কিছু নেই। এর আগেও মূসাভাই একবার বললেন,সরকারের যাকেই দেখবেন বলতে হবে ‘তুই চোর তুই চোর’ আবার বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘তৃতীয় শ্রেণীর নেতা।’ অবশ্য পরে তিনি বলেছেন,‘সরকারের সকলকে নয়, দুর্নীতিপরায়ণদের বলতে হবে ‘তুই চোর’ এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘তৃতীয় শ্রেণীর না, তৃতীয় সারির নেতা’ বলেছেন। কিন্তু মূসাভাই কথা ঘুরালে ও প্রথম অংশটিই বলেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন এবং তা করেছেন ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকেই। মূসাভাইর ব্যক্তিগত ক্ষোভের পেছনের কারণগুলো এ নিবন্ধে নাইবা বললাম।
বস্তুত একশ্রেণীর তথাকথিত সিভিল সোসাইটি সদস্য বা ড. মুুনতাসীর মামুনের ভাষায় পদাধিকারবলে বুদ্ধিজীবী বর্তমান সরকারকে প্রথমদিন থেকেই উৎখাত করার ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এদের আবার একটা ভা-ামি আছে নিরপেক্ষতার। বলেন, তারা কোন দল করেন, না তারা কোন প্রি-জুডিস থেকে কথা বলেন না। অথচ তাদের প্রতিটি লাইনই থাকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং খালেদা জিয়া ও জামায়াত-বিএনপির পক্ষে। এদের মধ্যে অন্তত দুজনের নাম করা যায়Ñড. আসিফ নজরুল ও ড. পিয়াস করিম। এরা এমনভাবে কথা বলেন মনে হয় তাদের মধ্যে কালচারের ঘাটতি আছে। আমাদের এক সাংবাদিক বলেই ফেললেন এরা মনে হয় তাদের বাপ-দাদার সঙ্গে বেয়াদবি করতে করতে বড় হয়েছে। ড. আসিফ নজরুলের একটি উদারহণ দিতে চাই, মূসাভাই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিরূপ উক্তি করায় প্রতিবাদ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। আসিফের এটা পছন্দ হয়নি। যদিও একটি অন্যায় অভিযোগের জবাব না দেয়াও অন্যায়। কিন্তু আসিফ বললেন,‘ লেনিন-মাও সেতুংয়ের সমালোচনা করা যাবে। এমন কি হযরত মুহম্মদ (স.) এর সমালোচনা করা যাবে, শেখ মুজিবের যাবে না কেন?’ অবশ্য আসিফ মহানবীর নামের পরে (স) ব্যবহার করেনি। আমার মনে হয় মহানবী (স) সম্পর্কে এমন ধৃষ্টতা কোন অমুসলিমও আজ পর্যন্ত দেখায়নি। আসিফের আবরী নাম বা মুসলিম নাম রয়েছে, যদিও তা উল্টা পাল্টা বা বাবা মার দেয়া নাম নয় বলে মনে হয়। আরেকজন আছেন আমার খুব প্রিয় ‘মানুষ তার নামটি নিতে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু সম্প্রতি তিনি যেভাবে আলোচনায় সরকার ‘জোচ্চোর’, ‘বাটপার’ ইত্যাদি অভদ্রজনোচিত শব্দাবলী দ্বারা আক্রমণ করছেন, তাতে করে তার নামটাও নিতে হয়, তিনি সম্পাদক নুরুল কবির। এই মধ্যরাতের গলাজীবীরা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছিলেন, ‘সরকার জামায়াতকে সভা- সমাবেশ করতে দিচ্ছে না বলেই তারা সহিংস হয়ে উঠেছে। আবার যখন (পুলিশের ভাষায়) ‘জামায়াত কোন সহিংসতা কার্যকলাপ করবে না। পুলিশের কাছে এই অঙ্গীকার করে মাঠে নামায় দু’দিন পুলিশ তাদের সমাবেশ-মিছিল করতে বাধা দেয়নি।’ এই অবস্থাটাকে তারা বললেন, ‘আওয়ামী লীগ- জামায়াত আঁতাত হয়েছে।’ অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনে যাবে। আবার এরাই পুলিশ এ্যাকশনে গেলে বলেছে ‘পুলিশ একটি রাজনৈতিক দলের মৌলিক- গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে দিচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে যখন এ লেখা লিখছিলাম তখন দেখলাম ‘বাংলাভিশন’ টিভিতে এবিএম মূসা ও এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন মধ্যরাতের লাইভ গলাবাজিতে বসে একইভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক (সম্ভবত নাম মোস্তফা ফিরোজ) এমনও বললেন শাহবাগের তরুণরা বিএনপির জন্য সম্পদ হতে পারে যদি তারা সঠিকভাবে আচরণ করতে পারে? মূসাভাই প্রতিটি টকশোতেই আওয়ামী লীগকে কয়েকবার হারান এবং বিএনপিকে কয়েকবার ক্ষমতায় বসান । কিন্তু মূসাভাই বা সঞ্চালক আপনারা যতই চেষ্টা করুন তরুণ প্রজন্ম রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে এবং যারা এই অপশক্তিকে সমর্থন দেয় সেই পাকিপন্থী খালেদা জিয়া বা বিএনপিরও ধারে কাছে নেই।
যাকগে, এবার শাহবাগ তারুণ্য স্কয়ারে ফিরে আসি। বয়সের কারণে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া-এরশাদ-খালেদাবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক হিসেবে ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখার। বিশেষ করে আমি দেখেছি কি ভাবে ১৯৮১ সালে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ রাজপথে নেমে শেখ হাসিনার প্রবাস জীবন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে; কিভাবে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনে এবং ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার পতনে মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল, সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যাবলী কাছ থেকে দেখেছি। তবে সেসব ছিল স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন। আর শাহবাগের আন্দোলন কোন সরকার পতনের নয়, এ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির আন্দোলন। কেননা, ট্রাইব্যুনালে কসাই কাদেরের ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন রায়ে জনতা, বিশেষ করে তরুণ সমাজ আশাহত হয়েছে এবং এই আশাহত অবস্থা থেকে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে তারই বহির্প্রকাশ ঘটছে শাহবাগ তারুণ্য স্কয়ারে।
২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অন্তত ২টি অঙ্গীকার তরুণ সমাজকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। অঙ্গীকার ২টি হলো : (১) ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ এবং (২) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুই অঙ্গীকারের পক্ষে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট দেয় এবং মহাজোট তিনশ’ আসনের পার্লামেন্টের চার-পঞ্চমাংশ আসন নিয়ে সংসদে বসে ও সরকার গঠন করে। নির্বাচনের পর অঙ্গীকার অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করে। এই ট্রাইব্যুনাল গঠনেও দেশী-বিদেশী বিরোধিতা ছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা পিছু হটার পাত্রী ননÑ তিনি সামনে এগোবার মানুষ। শিক্ষা-দীক্ষা মননে-চেতনায় বিপ্লবী এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রত্যয়ী নেত্রী। কসাই কাদেরের রায়ের ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটে গেল তা অনভিপ্রেত এবং কারও কাম্য ছিল না, শেখ হাসিনারও না। তবু ঘটেছে। এর আগেও আমরা দেখেছি স্কাইপে কথা বলায় একজন বিচারক পদত্যাগ করেছেন। ষড়যন্ত্র কি নেই? আছে? ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য চৌকস আইনজীবীম-লীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বলতে হচ্ছে প্রসিকিউশনে এমন কয়েকজন আইনজীবী আছেন যাঁদের কোন মফস্বল শহরে থাকার কথা। হাইকোর্টের প্যারালাল এবং হাইকোর্টের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ তাদের না দাঁড় করালেই ভাল হতো। আমার মনে হয় না দেশে ভাল আইনজীবীর খুব আকাল পড়েছে।
আগেই বলেছি মূসাভাইরা যতই চেষ্টা করুন; টিভির গলাবাজিতে যতই সোচ্চার হোন বা যত কলাম লিখুন শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াত-শিবিরের সহযোগী পশ্চাৎপদ পাকিপন্থী বিএনপির দিকে ফিরেও তাকাবে না, বরং তারুণ্যের স্বাভাবিক ধর্ম অগ্রসরমান এবং তারা সামনের দিকে চলবেই। সাংবাদিক-কলামিস্ট স্বদেশ রায় খুব সুন্দরভাবে পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন : ‘...ওরা খোলা আকাশের সূর্যের নিচে ভীষণ প্রতিজ্ঞ এক একটি দৃঢ় মুখ নিয়ে বসে। ওদের হাত সেøাগানের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের লাখো মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র হয়ে যেন গর্জে উঠছে। ওদের সেøাগানগুলো যেন বারুদের গোলা হয়ে বেরিয়ে আসছে। সেখানে সারি বেঁধে বসে আছে শত শত তরুণী। রাতের শিশির আর দিনের সূর্য কোনটাই যেন তাদের ক্লান্ত করেনি। বরং করেছে আরও দৃঢ়। প্রতিটি মুখ যেন একেকটি বারুদের গোলা....শাহবাগের তরুণদের পাশে দাঁড়িয়ে। ২৪ ঘণ্টা পর (রায়ের) বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে মনে হলো বাংলাদেশ আর পরাজিত হবে না।’
গত মঙ্গলবার আমার মধ্যেও যে হতাশার জন্ম হয়েছিল মনে হয় তা মিশে গেছে। গত তিনদিন শাহবাগের তরুণদের মাঝে নীরবে দাঁড়িয়ে স্বদেশ রায়ের মতো আমারও বিশ্বাস জন্মেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হারে না, হারবে না। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয়, ‘এ যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ...।’
কেবল আমরা বা শহরাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবীরাই গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ ও অপেক্ষার প্রহর গুনছিল কখন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হবে। বিশেষ করে শহীদ পরিবার ও ধর্ষিতা মা-ও তাদের পরিবারের কাছে এই চাওয়াটা মোটেই বেশি কিছু চাওয়া ছিল না। তারা যা হারিয়েছে তা তো আর ফিরে পাবেন না। ঐ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হলে হয়ত মর্মবেদনা কিছুুটা লাঘব হবে। এই আশায় ৪টি দশক অপেক্ষা করছিল। অবশেষে সেই অপেক্ষার ক্ষণটি। কিন্তু না, এসেই ক্ষণ নয়, বরং এ ক্ষণ আরও নতুন করে যাতনা নিয়ে এলÑ কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো না, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল-২ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় দিলেন। এই খবর আমাদের মানববন্ধনে এলে আনিসুজ্জামান স্যার সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে ঝুলানো পোস্টারটি খুলে ফেললেন এবং মানববন্ধনও ওখানেই সমাপ্ত করলেন।
সবাই চলে গেছে। আমিও ক্লাবের অভ্যন্তরে যাব বলে কয়েক পা এগিয়ে আবার পেছনে ফিরলাম এবং সোজা বাসায় ফিরে বাকহীন বসে রইলাম। অনেকক্ষণ কারও সঙ্গে কোন কথা বলিনি। একে একে অতীত স্মৃতিগুলো সামনে ভাসতে লাগল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বাঙালী জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন পুরুষ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং ৩ নবেম্বর কারাভ্যন্তরীণ অবস্থা ৪ জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও আবু হেনা মুহাম্মদ কামরুজ্জামানকে হত্যা করে প্রতিবিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ৩০ লাখ শহীদ ও ৬০ লাখ বীরাঙ্গনা মা-বোনের সঙ্গে বেইমানী করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী পশ্চাৎপদ কূপম-ূক ধারা নিয়ে যেতে শুরু করে। মিলিটারি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এই প্রতিবিপ্লবী শক্তি মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সাংবিধান ক্ষতবিক্ষত করে। সেই থেকে শুরু করে কখনও সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকার পাতায় কখনও সিভিল সোসাইটি রাজনৈতিক কর্মী বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাজপথ বা সভা-সমাবেশ-মিছিল বা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছি। জাতির পিতা ও জাতীয় ৪ নেতার হত্যার বিচার চেয়েছি। শত শত নিবন্ধ-পোস্ট লিখেছি। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাসে যে রায়টি আমাদের উপহার দিলেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক তা প্রত্যাখ্যান তো করছিই এর বেশি আর কি বলব? মনে পড়ে মিলিটারি জিয়া কুখ্যাত রাজাকার ও আলবদর নেতা গোলাম আযমকে পাকিস্তানী পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসতে দিলেন এবং যেদিন হাইকোর্টের রায়ে তার নাগরিকত্ব (যা বঙ্গবন্ধু বাতিল করে দিয়েছিলেন) ফিরিয়ে দেয়া হলো সে সময় এক কলামে লিখেছিলাম বিচারালয়ের এই বিচার মানি না। ঐ বিচারককেও মানি না। ঝুঁকি নিয়েই বলেছিলাম আজও কনটেম্পট অব কোর্ট-এর ঝুঁকি নিয়েই বলছি ‘এ রায় মানি না, কসাই কাদেরকে ফাঁসি দিতে হবে।’ প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন প্রশ্ন তুলেছেন। ‘কতজনকে হত্যা করলে মৃত্যুদ- দেয়া যায় (?)’ প্রফেসর মামুন দৈনিক জনকণ্ঠে এক নিবন্ধে লিখেছেন :
‘বাচ্চু রাজাকারের রায়ে আমরা খুশি হয়েছিলাম ইতিহাসের সত্য প্রতিফলিত হতে দেখে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা ছিল তার থেকেও বেশি। অভিযোগগুলো একবার বিবেচনা করে দেখুন। ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে কলেজছাত্র পল্লবকে দুদিন গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল কাদের, তারপর হত্যা করা হয়েছিল। এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে ২ মার্চ ১৯৭১ কাদের ও তার বিহারী সহযোগীরা কবি মেছেরুন নেছার বাড়িতে মাথা কেটে ঝুলিয়ে রাখে- এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ২৯ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পয়গামের সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের জল্লাদখানায়। আবু তালেবের মেয়ে জানিয়েছেন, কোরবানির গরুর মতো তালেবকে জবাই করে মাংস টুকরো টুকরো করে উল্লাসে তারা মেতে ওঠেÑ এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় কাদের মিরপুরের হযরত আলী লস্কর ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করে এবং ১১ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করেÑএই অভিযোগও প্রমাণিত। ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ মিরপুরের আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে নির্যাতন করে খুন করে। মামা বাহিনীর শহীদুল হক মামা জানিয়েছেন, আজলা ভরে মানুষের চোখ তিনি সমাহিত করেছেনÑ এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। প্রমাণিত হয়নি কেবল ঘাটের চরের গণহত্যায় কাদেরের ইনভলমেন্ট।’
প্রফেসর মামুনও এ তথ্য নিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের রায়ের ফাইন্ডিং থেকেই। অথচ দেয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদ- অর্থাৎ তার ৩০ বছর সাজা হলো। কারাগারে সে ভাল ব্যবহার করলে এ সাজা কমে হবে ২৩ বছরের মতো। কিংবা ভাল ব্যবহার না করেও কারারক্ষী বা পুলিশকে টু-পাইস গুঁজে দিলে ভাল ব্যবহারের সার্টিফিকেট নেয়াকে আজকাল কোন ব্যাপারই নয়। তাই তো কাদের মোল্লা রায় শোনার পর ভি-চিহ্ন দেখিয়ে মুখে একটা ১০ নম্বরী মুচকি হাসি দিয়েছে। সে মনে করে আর তো মাত্র ১০ মাস। তারপর পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে এবং তাদের নেত্রী মিলিটারি জিয়া-পতœী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আবারও কোন এক ইয়াজদ্দিনকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাবেন এবং সেই রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করবেন। কাদের জেল থেকে বেরিয়ে মন্ত্রী হবেন এবং শহীদের রক্তরঞ্জিত পতাকা আবারও রাজাকারদের গাড়ি-বাড়িতে উড়বে। মজার ব্যাপার না? কিন্তু প্রশ্নটি হলো, একটি পত্রিকা দেখলাম কাদের মোল্লার সাজার চেয়ে ভি-চিহ্নটি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিরাট ছবিসহ লিড নিউজ করেছে। একজন বললেন (সংবাদকর্মী) ভালই হয়েছে। মানুষের মধ্যে ঘৃণা জন্মাবে। বললাম এতে ঘৃণা জন্মায় না, বরং সিমপ্যাথি জন্মায়। পত্রিকাটির লক্ষ্যও আমি মনে করি তা-ই। এসব নিয়ে বহু তর্ক করেছি। এই যেমন বিএনপি নেত্রী তথা জামায়াত-বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি অন্তত তিনটি আপত্তিকর বিষয়ের অবতারণার করেছেন। যেমন: (১) ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামকালে আমেরিকা না-কি তিনি অন্য কয়েকটি দেশের মতো আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছMy Country of 150 million people, located between india and Myanmar, has been indepentent since 1971, When he United states was our of the first Nations to recogise our right to self detsmination. লক্ষ্য করুন, কত বড় সত্যের অপলাপ! বরং প্রতিটি দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং এর ভিত্তিতে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাঙালী ভাল করেই জানে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূমিকা কি ছিল! আমেরিকা কেবল হানাদার পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সরকারকে অর্থ-অস্ত্র-রসদ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণ এবং বাঙালী জাতিকে হত্যা করার জন্যে ৭ম নৌবহর পাঠিয়েছিল। কে না জানে এসব কথা? বরং সেদিন পাকি-মার্কিন অস্ত্র অর্থের মোকাবেলায় ভারত, বিশেষ করে ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও এগিয়ে এসেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে এবং আমেরিাকর যুদ্ধজাহাজ সেভেন-ফ্লিটের মোকাবেলায় রেড-ফ্লিট পাঠালে সেভেন ফ্লিট বঙ্গোপসাগর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বেগম জিয়া বরং বলতে পারতেন আমেরিকার সিভিল সমাজের বিরাট অংশ এবং জনগণ আমাদের সংগ্রাম ও যুদ্ধকে নৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। যেমন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও সঙ্গীতশিল্পী জজ হ্যারিসন যবডিলস। বেগম খালেদা জিয়া তার নিবন্ধে পুরোটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিষোদগার করেছেন। যেমন করে সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে পুরোটাই থাকে শেখ হাসিনা ও সরকারবিরোধী কথাবার্তা। অবশ্য এতে তার ব্যক্তিগত ক্ষোভও কাজ করছে। কারণ শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের আমলে তাকে কোর্টের রায়ে ক্যান্টমেন্টের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে এবং তার দুই ছেলে তারেক-কোকোকে অর্থ পাচার ও অন্যান্য অভিযোগে দেশান্তরী হতে হয়েছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনি বলবেনই কিন্তু এটা কেমন কথা যে বাংলাদেশ আমেরিকায় পণ্য রফতানির জন্য যে জিএসপি সুবিধার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে। তিনি তার বিরুদ্ধে কথা বলবেন কিংবা পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের মতো কথা বলবেন। কিংবা বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার এবং দারিদ্র্য বিমোচন শেখ হাসিনার হাতে নিরাপদ নয়, তাই তিনি আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য হস্তক্ষেপ কামনা করবেন? It is impossible to sory in good coucience that democracy, Justice and the alleviation of povesly in Bangladesh Under Sheikh Hasiua are Safe, Indeed, all are in grave dangol, In is time for the world, led lsy Amlicia, to act and eusure that democracy to saned in Bangladesh. সঙ্গত দুর্বলতার কারণেই অন্য কেউ এই কলামটি লিখে দিয়েছেন এবং ওয়াশিংটন টাইমসে ছাপার ব্যবস্থা করেছেন। এই পত্রিকাটি শুনেছি খুব বড় বা বহুল প্রচারিত না হলেও ওয়াশিংটন প্রশাসনের হাতে যায়। ধারণা করা যাচ্ছে যারা ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে, তাদের পক্ষে এ রকম একটি কলাম বা এর আগে দি ইকোনমিস্ট-এ সরকারবিরোধী রিপোর্ট করাতে পারে সহজেই। সবচে আশ্চর্যের বিষয় হলো কয়েকদিন আগে মধ্যরাতের এক গলাবাজিতে দেখলাম আমাদের সাংবাদিকতার প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবিএম মূসা এই কলামটিকে ডিফেন্ড করছেন। অবশ্য এতেও অবাক হবার কিছু নেই। এর আগেও মূসাভাই একবার বললেন,সরকারের যাকেই দেখবেন বলতে হবে ‘তুই চোর তুই চোর’ আবার বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘তৃতীয় শ্রেণীর নেতা।’ অবশ্য পরে তিনি বলেছেন,‘সরকারের সকলকে নয়, দুর্নীতিপরায়ণদের বলতে হবে ‘তুই চোর’ এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘তৃতীয় শ্রেণীর না, তৃতীয় সারির নেতা’ বলেছেন। কিন্তু মূসাভাই কথা ঘুরালে ও প্রথম অংশটিই বলেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন এবং তা করেছেন ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকেই। মূসাভাইর ব্যক্তিগত ক্ষোভের পেছনের কারণগুলো এ নিবন্ধে নাইবা বললাম।
বস্তুত একশ্রেণীর তথাকথিত সিভিল সোসাইটি সদস্য বা ড. মুুনতাসীর মামুনের ভাষায় পদাধিকারবলে বুদ্ধিজীবী বর্তমান সরকারকে প্রথমদিন থেকেই উৎখাত করার ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এদের আবার একটা ভা-ামি আছে নিরপেক্ষতার। বলেন, তারা কোন দল করেন, না তারা কোন প্রি-জুডিস থেকে কথা বলেন না। অথচ তাদের প্রতিটি লাইনই থাকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং খালেদা জিয়া ও জামায়াত-বিএনপির পক্ষে। এদের মধ্যে অন্তত দুজনের নাম করা যায়Ñড. আসিফ নজরুল ও ড. পিয়াস করিম। এরা এমনভাবে কথা বলেন মনে হয় তাদের মধ্যে কালচারের ঘাটতি আছে। আমাদের এক সাংবাদিক বলেই ফেললেন এরা মনে হয় তাদের বাপ-দাদার সঙ্গে বেয়াদবি করতে করতে বড় হয়েছে। ড. আসিফ নজরুলের একটি উদারহণ দিতে চাই, মূসাভাই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিরূপ উক্তি করায় প্রতিবাদ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। আসিফের এটা পছন্দ হয়নি। যদিও একটি অন্যায় অভিযোগের জবাব না দেয়াও অন্যায়। কিন্তু আসিফ বললেন,‘ লেনিন-মাও সেতুংয়ের সমালোচনা করা যাবে। এমন কি হযরত মুহম্মদ (স.) এর সমালোচনা করা যাবে, শেখ মুজিবের যাবে না কেন?’ অবশ্য আসিফ মহানবীর নামের পরে (স) ব্যবহার করেনি। আমার মনে হয় মহানবী (স) সম্পর্কে এমন ধৃষ্টতা কোন অমুসলিমও আজ পর্যন্ত দেখায়নি। আসিফের আবরী নাম বা মুসলিম নাম রয়েছে, যদিও তা উল্টা পাল্টা বা বাবা মার দেয়া নাম নয় বলে মনে হয়। আরেকজন আছেন আমার খুব প্রিয় ‘মানুষ তার নামটি নিতে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু সম্প্রতি তিনি যেভাবে আলোচনায় সরকার ‘জোচ্চোর’, ‘বাটপার’ ইত্যাদি অভদ্রজনোচিত শব্দাবলী দ্বারা আক্রমণ করছেন, তাতে করে তার নামটাও নিতে হয়, তিনি সম্পাদক নুরুল কবির। এই মধ্যরাতের গলাজীবীরা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছিলেন, ‘সরকার জামায়াতকে সভা- সমাবেশ করতে দিচ্ছে না বলেই তারা সহিংস হয়ে উঠেছে। আবার যখন (পুলিশের ভাষায়) ‘জামায়াত কোন সহিংসতা কার্যকলাপ করবে না। পুলিশের কাছে এই অঙ্গীকার করে মাঠে নামায় দু’দিন পুলিশ তাদের সমাবেশ-মিছিল করতে বাধা দেয়নি।’ এই অবস্থাটাকে তারা বললেন, ‘আওয়ামী লীগ- জামায়াত আঁতাত হয়েছে।’ অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনে যাবে। আবার এরাই পুলিশ এ্যাকশনে গেলে বলেছে ‘পুলিশ একটি রাজনৈতিক দলের মৌলিক- গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে দিচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে যখন এ লেখা লিখছিলাম তখন দেখলাম ‘বাংলাভিশন’ টিভিতে এবিএম মূসা ও এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন মধ্যরাতের লাইভ গলাবাজিতে বসে একইভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক (সম্ভবত নাম মোস্তফা ফিরোজ) এমনও বললেন শাহবাগের তরুণরা বিএনপির জন্য সম্পদ হতে পারে যদি তারা সঠিকভাবে আচরণ করতে পারে? মূসাভাই প্রতিটি টকশোতেই আওয়ামী লীগকে কয়েকবার হারান এবং বিএনপিকে কয়েকবার ক্ষমতায় বসান । কিন্তু মূসাভাই বা সঞ্চালক আপনারা যতই চেষ্টা করুন তরুণ প্রজন্ম রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে এবং যারা এই অপশক্তিকে সমর্থন দেয় সেই পাকিপন্থী খালেদা জিয়া বা বিএনপিরও ধারে কাছে নেই।
যাকগে, এবার শাহবাগ তারুণ্য স্কয়ারে ফিরে আসি। বয়সের কারণে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া-এরশাদ-খালেদাবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক হিসেবে ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখার। বিশেষ করে আমি দেখেছি কি ভাবে ১৯৮১ সালে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ রাজপথে নেমে শেখ হাসিনার প্রবাস জীবন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে; কিভাবে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনে এবং ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার পতনে মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল, সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যাবলী কাছ থেকে দেখেছি। তবে সেসব ছিল স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন। আর শাহবাগের আন্দোলন কোন সরকার পতনের নয়, এ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির আন্দোলন। কেননা, ট্রাইব্যুনালে কসাই কাদেরের ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন রায়ে জনতা, বিশেষ করে তরুণ সমাজ আশাহত হয়েছে এবং এই আশাহত অবস্থা থেকে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে তারই বহির্প্রকাশ ঘটছে শাহবাগ তারুণ্য স্কয়ারে।
২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অন্তত ২টি অঙ্গীকার তরুণ সমাজকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। অঙ্গীকার ২টি হলো : (১) ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ এবং (২) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুই অঙ্গীকারের পক্ষে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট দেয় এবং মহাজোট তিনশ’ আসনের পার্লামেন্টের চার-পঞ্চমাংশ আসন নিয়ে সংসদে বসে ও সরকার গঠন করে। নির্বাচনের পর অঙ্গীকার অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করে। এই ট্রাইব্যুনাল গঠনেও দেশী-বিদেশী বিরোধিতা ছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা পিছু হটার পাত্রী ননÑ তিনি সামনে এগোবার মানুষ। শিক্ষা-দীক্ষা মননে-চেতনায় বিপ্লবী এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রত্যয়ী নেত্রী। কসাই কাদেরের রায়ের ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটে গেল তা অনভিপ্রেত এবং কারও কাম্য ছিল না, শেখ হাসিনারও না। তবু ঘটেছে। এর আগেও আমরা দেখেছি স্কাইপে কথা বলায় একজন বিচারক পদত্যাগ করেছেন। ষড়যন্ত্র কি নেই? আছে? ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য চৌকস আইনজীবীম-লীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বলতে হচ্ছে প্রসিকিউশনে এমন কয়েকজন আইনজীবী আছেন যাঁদের কোন মফস্বল শহরে থাকার কথা। হাইকোর্টের প্যারালাল এবং হাইকোর্টের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ তাদের না দাঁড় করালেই ভাল হতো। আমার মনে হয় না দেশে ভাল আইনজীবীর খুব আকাল পড়েছে।
আগেই বলেছি মূসাভাইরা যতই চেষ্টা করুন; টিভির গলাবাজিতে যতই সোচ্চার হোন বা যত কলাম লিখুন শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াত-শিবিরের সহযোগী পশ্চাৎপদ পাকিপন্থী বিএনপির দিকে ফিরেও তাকাবে না, বরং তারুণ্যের স্বাভাবিক ধর্ম অগ্রসরমান এবং তারা সামনের দিকে চলবেই। সাংবাদিক-কলামিস্ট স্বদেশ রায় খুব সুন্দরভাবে পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন : ‘...ওরা খোলা আকাশের সূর্যের নিচে ভীষণ প্রতিজ্ঞ এক একটি দৃঢ় মুখ নিয়ে বসে। ওদের হাত সেøাগানের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের লাখো মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র হয়ে যেন গর্জে উঠছে। ওদের সেøাগানগুলো যেন বারুদের গোলা হয়ে বেরিয়ে আসছে। সেখানে সারি বেঁধে বসে আছে শত শত তরুণী। রাতের শিশির আর দিনের সূর্য কোনটাই যেন তাদের ক্লান্ত করেনি। বরং করেছে আরও দৃঢ়। প্রতিটি মুখ যেন একেকটি বারুদের গোলা....শাহবাগের তরুণদের পাশে দাঁড়িয়ে। ২৪ ঘণ্টা পর (রায়ের) বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে মনে হলো বাংলাদেশ আর পরাজিত হবে না।’
গত মঙ্গলবার আমার মধ্যেও যে হতাশার জন্ম হয়েছিল মনে হয় তা মিশে গেছে। গত তিনদিন শাহবাগের তরুণদের মাঝে নীরবে দাঁড়িয়ে স্বদেশ রায়ের মতো আমারও বিশ্বাস জন্মেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হারে না, হারবে না। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয়, ‘এ যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ...।’
No comments