প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম
পাকিস্তানের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত এমএ
জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পরলোকগমনের পরে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী
খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানর গবর্নর জেনারেল পদ লাভ করেন এবং পরবর্তী
মুখ্যমন্ত্রী হন নুরুল আমীন।
১৯৫১ সালের ১৬ আগস্ট
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার সময়
আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে নাজিমুদ্দিন গবর্নর জেনারেল পদ থেকে সরে এসে
প্রধানমন্ত্রী হন। গবর্নর জেনারেল পদ লাভ করেন ব্যুরোক্রাট গোলাম মোহাম্মদ।
১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল গোলাম মোহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করে
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা
হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পূর্ববাংলার গবর্নর হন স্যার ফেডারিক বোর্ন।
১৯৫০ সালে মালিক ফিরোজ খান নুন, ১৯৫৩ সালে চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং ১৯৫৪ সালের ৩০ মে মেজর জেনারেল এসকান্দার মির্জাকে পূর্ববঙ্গের গবর্নর নিয়োগ করা হয়। তথাকথিত বাঙালী খাজা নাজিমুদ্দিন ও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় পূর্ববঙ্গের স্বার্থবিরোধী কাজ বেশি হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খাদ্য সঙ্কট, বাংলা ভাষার ওপর ষড়যন্ত্র ছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে পূর্ব বাংলা ছিল মুখর। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে জেলে। শাসক গোষ্ঠীত অভ্যন্তরে কোন্দলের ফলশ্রুতিতে হামিদুল চৌধুরী অপসারিত এবং তার অনুসারী বরিশাল জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক মহীউদ্দিন আহম্মদের মতো নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। মুসলিম লীগের প্রতিটি জেলায় কর্মীরা বিক্ষুব্ধ এবং দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদান, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগ সে সময় ভাষার দাবির পাশাপাশি রাজবন্দী মুক্তির আন্দোলন করছিল।
১৯৫২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গবর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন এবং ২০ জানুয়ারি করাচী ফিরে যান। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন ২৫ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি ঢাকা পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেন। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সভাপতি। এই সফর সময়ে ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষণ দেন (যা রেডিও সরাসরি সম্প্রচার করে)। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার ভাষণে খাজা নাজিমুদ্দিন অন্যান্য প্রসঙ্গের মধ্যে ভাষা প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যে লিখিত অঙ্গীকার করেছিলেন তা ভুলে গিয়ে বরং ১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার পল্টনে ময়দানে যে বক্তব্য রাখেন তার অংশ বিশেষ পুনরাবৃত্তি করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর ভাষণের যে অংশ বিশেষ পাঠ করেন তা হচ্ছে, “এ কথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করে তা বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু।”
খাজা নাজিমুদ্দিন তার ভাষণে প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এছাড়া আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা শিক্ষা দানের পক্ষে বক্তব্য রেখে বলেন “ইতিমধ্যে সরকারী তত্ত্বাবধানে ২১টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্র সাফল্যের সঙ্গে আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এই ধরনের অসংখ্য শিক্ষা কেন্দ্র জনসাধারণ কর্তৃক খোলা হয়েছে।”
ঢাকার পল্টনে বক্তৃতার পরে প্রদেশের বিভিন্ন স্থান সফর করে করাচী ফেরার আগের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষা প্রশ্নে বলেন যে, তিনি পল্টনে যে বক্তব্য রাখেন তা তার নিজস্ব মতামত নয় বরং জিন্নাহর মতামত এবং প্রতিধ্বনি। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে গণপরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। খাজা নাজিমুদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, “রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত তার বক্তৃতাকে এমনভাবে মোড় দেওয়া হয়েছে যাতে মনে হয়েছে যে সেটা আমার নিজের মতের অভিব্যক্তি। এটা ঘটনার বিকৃতি বলেই আমার মনে হয়।”
খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টনের ২৭ জানুয়ারির সভার ভাষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভার আয়োজন এবং পোস্টারিং করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেল কলেজে ও ইনঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রতীক ধর্মঘট পালন করে এবং মুসলিম ছাত্রলীগ সম্পাদক খালেক নেওয়াজের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নাজিমুদ্দিন গদি ছাড়’ ধ্বনি দিয়ে ফুলার রোড হয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস পর্যন্ত গিয়ে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে। মিছিল শেষে ৪ ফেব্রুয়ারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মোসাফিরের কলামে ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ শিরোনামে সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা এবং বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ভাষা তথা দেশের মৌলিক সমস্যার সঠিক সমাধানের আহ্বান জানান। ওই পত্রিকায় কারাগারে আটক অসুস্থ জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে তার আশু জেল মুক্তি কামনা করা হয়।
৩১ জানুয়ারি (৫২) ঢাকা জেরাবার লাইব্রেরি হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ ছাত্রফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, তমুদ্দিন মজলিশ, নিখিল পূর্ব পাক ছাত্রলীগ (মুসলিম লীগ সমর্থিত), ইসলামী ভ্রাতৃ সংঘ, মোহাজের সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, স্কুল-কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিরা যোগ দেন। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বক্তব্য রাখেন অবিভক্ত বাংলার প্রদেশিক মুসলিম লীগ প্রাক্তন সম্পাদক আবুল হাসিম, পূর্ব বাংলার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, আওয়ামী মুসলিম লীগ সম্পাদক শামসুল হক, ছাত্রলীগ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, যুবলীগ সম্পাদক অলি আহাদ, তমুদ্দিন মজলিসের সম্পাদক আবদুল গফুর, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের সম্পাদক সৈয়দ ইসতিয়াক আহম্মদ, মোজাহের সমিতি সভাপতি সৈয়দ আবুল ফজল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন, মুসলিম লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সৈফুদ্দিন প্রমুখ। সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটের কর্মসূচীর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করা হয়। অন্যান্যের মধ্যে এর সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী, আবুল হাসিম, শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, আব্দুল গফুর, আবুল কাসেম, কামরুদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, আলমাস আলী, আব্দুল আউয়াল, সৈয়দ আবদুর রহিম, মোহাম্মদ তোয়াহ, অলি আহাদ, শামসুল হক চৌধুরী, (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছাত্রলীগ), খালেক নেওয়াজ খান (সম্পাদক ছাত্রলীগ), কাজী গোলাম মাহবুব, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মজিবুল হক, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, শামসুল আলম, আনোয়ারুল হক খান, গোলাম মাওলা, সৈয়দ নুরুল আলম, নুরুল হুদা, শওকত আলী, আব্দুল মতিন, আখতারউদ্দিন আহম্মদ প্রমুখ। ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী গোলাম মাহবুবকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়Ñ
(ক) ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ববাংলার ছাত্র-জনগণের স্বার্থে সম্পাদিত চুক্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭ জানুয়ারি পল্টনে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার যে উক্তি করেন তার তীব্র নিন্দা করে তা প্রত্যাহার দাবি করা হয়। (ক্রমশ.)
১৯৫০ সালে মালিক ফিরোজ খান নুন, ১৯৫৩ সালে চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং ১৯৫৪ সালের ৩০ মে মেজর জেনারেল এসকান্দার মির্জাকে পূর্ববঙ্গের গবর্নর নিয়োগ করা হয়। তথাকথিত বাঙালী খাজা নাজিমুদ্দিন ও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় পূর্ববঙ্গের স্বার্থবিরোধী কাজ বেশি হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খাদ্য সঙ্কট, বাংলা ভাষার ওপর ষড়যন্ত্র ছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে পূর্ব বাংলা ছিল মুখর। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে জেলে। শাসক গোষ্ঠীত অভ্যন্তরে কোন্দলের ফলশ্রুতিতে হামিদুল চৌধুরী অপসারিত এবং তার অনুসারী বরিশাল জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক মহীউদ্দিন আহম্মদের মতো নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। মুসলিম লীগের প্রতিটি জেলায় কর্মীরা বিক্ষুব্ধ এবং দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদান, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগ সে সময় ভাষার দাবির পাশাপাশি রাজবন্দী মুক্তির আন্দোলন করছিল।
১৯৫২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গবর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন এবং ২০ জানুয়ারি করাচী ফিরে যান। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন ২৫ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি ঢাকা পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেন। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সভাপতি। এই সফর সময়ে ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষণ দেন (যা রেডিও সরাসরি সম্প্রচার করে)। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার ভাষণে খাজা নাজিমুদ্দিন অন্যান্য প্রসঙ্গের মধ্যে ভাষা প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যে লিখিত অঙ্গীকার করেছিলেন তা ভুলে গিয়ে বরং ১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার পল্টনে ময়দানে যে বক্তব্য রাখেন তার অংশ বিশেষ পুনরাবৃত্তি করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর ভাষণের যে অংশ বিশেষ পাঠ করেন তা হচ্ছে, “এ কথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করে তা বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু।”
খাজা নাজিমুদ্দিন তার ভাষণে প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এছাড়া আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা শিক্ষা দানের পক্ষে বক্তব্য রেখে বলেন “ইতিমধ্যে সরকারী তত্ত্বাবধানে ২১টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্র সাফল্যের সঙ্গে আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এই ধরনের অসংখ্য শিক্ষা কেন্দ্র জনসাধারণ কর্তৃক খোলা হয়েছে।”
ঢাকার পল্টনে বক্তৃতার পরে প্রদেশের বিভিন্ন স্থান সফর করে করাচী ফেরার আগের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষা প্রশ্নে বলেন যে, তিনি পল্টনে যে বক্তব্য রাখেন তা তার নিজস্ব মতামত নয় বরং জিন্নাহর মতামত এবং প্রতিধ্বনি। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে গণপরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। খাজা নাজিমুদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, “রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত তার বক্তৃতাকে এমনভাবে মোড় দেওয়া হয়েছে যাতে মনে হয়েছে যে সেটা আমার নিজের মতের অভিব্যক্তি। এটা ঘটনার বিকৃতি বলেই আমার মনে হয়।”
খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টনের ২৭ জানুয়ারির সভার ভাষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভার আয়োজন এবং পোস্টারিং করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেল কলেজে ও ইনঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রতীক ধর্মঘট পালন করে এবং মুসলিম ছাত্রলীগ সম্পাদক খালেক নেওয়াজের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নাজিমুদ্দিন গদি ছাড়’ ধ্বনি দিয়ে ফুলার রোড হয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস পর্যন্ত গিয়ে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে। মিছিল শেষে ৪ ফেব্রুয়ারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মোসাফিরের কলামে ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ শিরোনামে সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা এবং বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ভাষা তথা দেশের মৌলিক সমস্যার সঠিক সমাধানের আহ্বান জানান। ওই পত্রিকায় কারাগারে আটক অসুস্থ জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে তার আশু জেল মুক্তি কামনা করা হয়।
৩১ জানুয়ারি (৫২) ঢাকা জেরাবার লাইব্রেরি হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ ছাত্রফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, তমুদ্দিন মজলিশ, নিখিল পূর্ব পাক ছাত্রলীগ (মুসলিম লীগ সমর্থিত), ইসলামী ভ্রাতৃ সংঘ, মোহাজের সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, স্কুল-কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিরা যোগ দেন। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বক্তব্য রাখেন অবিভক্ত বাংলার প্রদেশিক মুসলিম লীগ প্রাক্তন সম্পাদক আবুল হাসিম, পূর্ব বাংলার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, আওয়ামী মুসলিম লীগ সম্পাদক শামসুল হক, ছাত্রলীগ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, যুবলীগ সম্পাদক অলি আহাদ, তমুদ্দিন মজলিসের সম্পাদক আবদুল গফুর, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের সম্পাদক সৈয়দ ইসতিয়াক আহম্মদ, মোজাহের সমিতি সভাপতি সৈয়দ আবুল ফজল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন, মুসলিম লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সৈফুদ্দিন প্রমুখ। সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটের কর্মসূচীর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করা হয়। অন্যান্যের মধ্যে এর সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী, আবুল হাসিম, শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, আব্দুল গফুর, আবুল কাসেম, কামরুদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, আলমাস আলী, আব্দুল আউয়াল, সৈয়দ আবদুর রহিম, মোহাম্মদ তোয়াহ, অলি আহাদ, শামসুল হক চৌধুরী, (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছাত্রলীগ), খালেক নেওয়াজ খান (সম্পাদক ছাত্রলীগ), কাজী গোলাম মাহবুব, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মজিবুল হক, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, শামসুল আলম, আনোয়ারুল হক খান, গোলাম মাওলা, সৈয়দ নুরুল আলম, নুরুল হুদা, শওকত আলী, আব্দুল মতিন, আখতারউদ্দিন আহম্মদ প্রমুখ। ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী গোলাম মাহবুবকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়Ñ
(ক) ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ববাংলার ছাত্র-জনগণের স্বার্থে সম্পাদিত চুক্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭ জানুয়ারি পল্টনে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার যে উক্তি করেন তার তীব্র নিন্দা করে তা প্রত্যাহার দাবি করা হয়। (ক্রমশ.)
No comments