যুদ্ধাপরাধের বিচার- একুশ বছরের অপেক্ষার অবসান by শাহরিয়ার কবির
১৯৭১ সালের গণহত্যার একুশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশের ১০১ জন বরেণ্য নাগরিক একটি ঐতিহাসিক ঘোষণায় স্বাক্ষর করে গণ-আদালতে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী জামায়াতপ্রধান গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের কর্মসূচি ঘোষণা করে যে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সেই দাবি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে একুশ বছর পর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, ২১ জানুয়ারি (২০১৩) আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিচারের রায় ঘোষণার ভেতর আমাদের ২১ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। এই রায় ঘোষণাকে আমরা বলেছি শহীদজননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের বিজয়ের প্রথম পদক্ষেপ।
মুক্তিযুদ্ধের ২১ বছর পর কেন ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আমরা নির্মূল কমিটি গঠন করেছিলাম, এর উত্তর আমাদের বহু লেখায় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ঘাতক দালালদের বিচার শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে ৭৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করে এই বিচার হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সংবিধান পরিবর্তন করে জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে ১৯৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচার বন্ধ করা যেত না, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির তথাকথিত ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়ার অশুভ সূচনা সম্ভব হতো না। বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদের ভয়াবহ উত্থান ও নৃশংসতা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হতো না।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক বেন কিরনান আমার প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধাপরাধ ’৭১-এ বলেছেন, ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি জেনারেলরা এবং বাংলাদেশে তাদের প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। এরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আবার রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। পাকিস্তানে গণহত্যাকারী জেনারেলরা ক্ষমতায় গিয়ে আল-কায়েদার জন্ম দিয়েছে আর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতার শরিক হয়ে জঙ্গি মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। আল-কায়েদাকে যাবতীয় হত্যা ও সন্ত্রাসের প্রেরণা দিয়েছে তাদের আদর্শিক ও সামরিক প্রভুদের গণহত্যার বিচার থেকে অব্যাহতি। অধ্যাপক কিরনান জঙ্গি মৌলবাদের বিশ্বব্যাপী উত্থানের অন্যতম কারণ খুঁজে বের করেছেন ’৭১-এ গণহত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে।
বাংলাদেশে সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণ ও সামরিকীকরণ করতে গিয়ে, রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া অপরাধের বিচার থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু করেছেন এবং সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে অস্ত্র ও সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি করেছেন। ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার-প্রক্রিয়া বাংলাদেশকে অপরাধের দায়মুক্তির অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে এবং আইনের শাসন ও সভ্যতার বোধ সুদৃঢ় করবে।
বাচ্চু রাজাকারের অপরাধ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় একাধিক কারণে জাতীয় জীবনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনুকরণযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এই রায় বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-নির্ধারিত পথে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। এই রায় মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিমদের ৪১ বছরের বিচারবঞ্চনার ক্ষোভ ও জ্বালার অবসান ঘটাবে, তাদের হূদয়ের বিরামহীন রক্তক্ষরণ প্রশমন করবে। এই বিচার ও রায় প্রমাণ করেছে, কোনো দেশে জনগণ ও সরকার চাইলে যেকোনো ধরনের অপরাধ যত অতীতেই ঘটুক না কেন, তার বিচার সম্ভব। গত শতাব্দীতে বিশ্বের বহু দেশে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে অথচ গণহত্যাকারীদের বিচার হয়নি। আর্মেনিয়া ও কঙ্গোর মানুষ ১০০ বছর ধরে গণহত্যার স্বীকৃতি ও বিচারের জন্য বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বাংলাদেশের এই বিচার কঙ্গো, মেক্সিকো ও আর্মেনিয়া থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার মতো দেশকে অনুপ্রাণিত করবে নিজ নিজ বিচারব্যবস্থার ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতায় নিজস্ব আইন প্রণয়ন করে নিজস্ব আদালতে এসব অপরাধের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
বাংলাদেশে আমরা ২১ বছর ধরে ক্রমাগত বলছি, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করতে হবে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যখন ১৯৭১-এ সংঘটিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তির অভিযোগ উত্থাপন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়, তখন আমরা যাবতীয় যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম, এসব ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে ‘শান্তি কমিটি’, ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ এবং এসব ঘাতক বাহিনীর প্রধান জন্মদাতা জামায়াতে ইসলামীকেও উপর্যুক্ত অপরাধের জন্য বিচার করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেননি। আইনমন্ত্রী, যিনি ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ-আদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, তিনি আমাদের দাবির উত্তরে একাধিকবার বলেছেন, তাঁরা শুধু ব্যক্তির বিচার করবেন, সংগঠনের বিচার করবেন না।
বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামী এবং সহযোগী বাহিনী সম্পর্কে বলা হয়েছে,
‘নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে নৃশংস ও ভয়ংকর অপরাধ সংঘটন করা হয়েছিল। এ যুদ্ধের ফলেই এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। বাঙালি জাতির নয় মাসের যুদ্ধ ও সংগ্রামকালে প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়, প্রায় পাঁচ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় এবং এক কোটিরও বেশি লোক দেশে পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এসব অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার করা যায়নি এবং এটি দেশের রাজনৈতিক মানসিকতা ও সমগ্র জাতির মনে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়। তারা বিচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ অবরুদ্ধ হয়, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে এবং জাতির সংবিধান ধ্বংস হয়।... ‘৩. “অপারেশন সার্চলাইট” নামে অভিহিত ধ্বংসযজ্ঞ (pogrom) দিয়ে গণহত্যা শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি পুলিশ, সেনা ও সামরিক অফিসারদের নিরস্ত্র ও হত্যা করা, জাতীয়তাবাদী বাঙালি রাজনীতিক, সেনা ও সামরিক অফিসারদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করা এবং পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার, হত্যা ও আটক করা।
‘৪. সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) পাকিস্তান রক্ষার নামে নিরস্ত্র বাঙালি বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আধা-সামরিক বাহিনী (সহযোগী বাহিনী) গঠনে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দান করে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার পথ ছিল কষ্টসাধ্যকর ও বন্ধুর এবং তা ছিল রক্তাক্ত, শ্রমসাধ্য ও আত্মত্যাগময়। সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত কোনো জাতিই তাদের মুক্তির জন্য বাঙালিদের মতো এত চড়া মূল্য দেয়নি।...
‘১৯. এই মামলা অনুসারে দেখা যায়, বর্ণিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মে থেকে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মধ্যে। ১৯৭১ সালের এই স্বাধীনতাযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, শান্তি কমিটি গঠন করা হয় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে, যারা নৈতিক সমর্থন, সহায়তা এবং বস্তুগত সমর্থন দিয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের ওপর ভয়ংকর নৃশংস হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছে।
‘২০. সাধারণ বিচারবুদ্ধি থেকেই এটা স্পষ্ট যে সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে আক্রমণ পরিচালনার অংশ হিসেবে দেশজুড়ে হাজার হাজার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। আক্রমণের টার্গেট ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি বেসামরিক জনতা, হিন্দু সম্প্রদায়, স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক গ্রুপ, মুক্তিযোদ্ধা এবং “বুদ্ধিজীবীরা”।’
(সূত্র: জনকণ্ঠ, ২২ জানুয়ারি ২০১৩)
’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে বাচ্চু রাজাকার বা বিচারাধীন আসামিরা যাদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে, তাদের সঙ্গে আসামিদের কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শত্রুতা ছিল না। ৩০ লাখ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল দলীয় ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট আদর্শিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে।
ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ পরবর্তী মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন সহায়ক হবে, ব্যক্তির পাশাপাশি দল ও বাহিনীর বিচারের পথও সুগম করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ’৭১-এ জামায়াত কীভাবে ইসলামের কথা বলে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধকে বৈধতা দিয়েছে এবং দলের কর্মীদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও গৃহ-জনপদে অগ্নিসংযোগে প্ররোচিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ফতোয়া দিয়েছিল পাকিস্তান ও ইসলাম সমার্থক, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম ও নিশানা থাকবে না, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধারণ করেছে তারা ইসলামের শত্রু, ভারতের চর, দুষ্কৃতকারী ইত্যাদি।
বাংলাদেশে যদি ’৭১-এর মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার পুনরাবৃত্তি দেখতে না চাই, তাহলে গণহত্যার রাজনীতি ও দর্শনকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে।
শাহরিয়ার কবির: লেখক, কার্যনির্বাহী সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
মুক্তিযুদ্ধের ২১ বছর পর কেন ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আমরা নির্মূল কমিটি গঠন করেছিলাম, এর উত্তর আমাদের বহু লেখায় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ঘাতক দালালদের বিচার শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে ৭৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করে এই বিচার হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সংবিধান পরিবর্তন করে জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে ১৯৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচার বন্ধ করা যেত না, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির তথাকথিত ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়ার অশুভ সূচনা সম্ভব হতো না। বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদের ভয়াবহ উত্থান ও নৃশংসতা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হতো না।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক বেন কিরনান আমার প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধাপরাধ ’৭১-এ বলেছেন, ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি জেনারেলরা এবং বাংলাদেশে তাদের প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। এরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আবার রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। পাকিস্তানে গণহত্যাকারী জেনারেলরা ক্ষমতায় গিয়ে আল-কায়েদার জন্ম দিয়েছে আর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতার শরিক হয়ে জঙ্গি মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। আল-কায়েদাকে যাবতীয় হত্যা ও সন্ত্রাসের প্রেরণা দিয়েছে তাদের আদর্শিক ও সামরিক প্রভুদের গণহত্যার বিচার থেকে অব্যাহতি। অধ্যাপক কিরনান জঙ্গি মৌলবাদের বিশ্বব্যাপী উত্থানের অন্যতম কারণ খুঁজে বের করেছেন ’৭১-এ গণহত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে।
বাংলাদেশে সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণ ও সামরিকীকরণ করতে গিয়ে, রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া অপরাধের বিচার থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু করেছেন এবং সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে অস্ত্র ও সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি করেছেন। ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার-প্রক্রিয়া বাংলাদেশকে অপরাধের দায়মুক্তির অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে এবং আইনের শাসন ও সভ্যতার বোধ সুদৃঢ় করবে।
বাচ্চু রাজাকারের অপরাধ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় একাধিক কারণে জাতীয় জীবনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনুকরণযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এই রায় বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-নির্ধারিত পথে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। এই রায় মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিমদের ৪১ বছরের বিচারবঞ্চনার ক্ষোভ ও জ্বালার অবসান ঘটাবে, তাদের হূদয়ের বিরামহীন রক্তক্ষরণ প্রশমন করবে। এই বিচার ও রায় প্রমাণ করেছে, কোনো দেশে জনগণ ও সরকার চাইলে যেকোনো ধরনের অপরাধ যত অতীতেই ঘটুক না কেন, তার বিচার সম্ভব। গত শতাব্দীতে বিশ্বের বহু দেশে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে অথচ গণহত্যাকারীদের বিচার হয়নি। আর্মেনিয়া ও কঙ্গোর মানুষ ১০০ বছর ধরে গণহত্যার স্বীকৃতি ও বিচারের জন্য বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বাংলাদেশের এই বিচার কঙ্গো, মেক্সিকো ও আর্মেনিয়া থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার মতো দেশকে অনুপ্রাণিত করবে নিজ নিজ বিচারব্যবস্থার ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতায় নিজস্ব আইন প্রণয়ন করে নিজস্ব আদালতে এসব অপরাধের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
বাংলাদেশে আমরা ২১ বছর ধরে ক্রমাগত বলছি, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করতে হবে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যখন ১৯৭১-এ সংঘটিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তির অভিযোগ উত্থাপন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়, তখন আমরা যাবতীয় যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম, এসব ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে ‘শান্তি কমিটি’, ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ এবং এসব ঘাতক বাহিনীর প্রধান জন্মদাতা জামায়াতে ইসলামীকেও উপর্যুক্ত অপরাধের জন্য বিচার করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেননি। আইনমন্ত্রী, যিনি ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ-আদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, তিনি আমাদের দাবির উত্তরে একাধিকবার বলেছেন, তাঁরা শুধু ব্যক্তির বিচার করবেন, সংগঠনের বিচার করবেন না।
বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামী এবং সহযোগী বাহিনী সম্পর্কে বলা হয়েছে,
‘নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে নৃশংস ও ভয়ংকর অপরাধ সংঘটন করা হয়েছিল। এ যুদ্ধের ফলেই এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। বাঙালি জাতির নয় মাসের যুদ্ধ ও সংগ্রামকালে প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়, প্রায় পাঁচ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় এবং এক কোটিরও বেশি লোক দেশে পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এসব অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার করা যায়নি এবং এটি দেশের রাজনৈতিক মানসিকতা ও সমগ্র জাতির মনে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়। তারা বিচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ অবরুদ্ধ হয়, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে এবং জাতির সংবিধান ধ্বংস হয়।... ‘৩. “অপারেশন সার্চলাইট” নামে অভিহিত ধ্বংসযজ্ঞ (pogrom) দিয়ে গণহত্যা শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি পুলিশ, সেনা ও সামরিক অফিসারদের নিরস্ত্র ও হত্যা করা, জাতীয়তাবাদী বাঙালি রাজনীতিক, সেনা ও সামরিক অফিসারদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করা এবং পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার, হত্যা ও আটক করা।
‘৪. সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) পাকিস্তান রক্ষার নামে নিরস্ত্র বাঙালি বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আধা-সামরিক বাহিনী (সহযোগী বাহিনী) গঠনে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দান করে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার পথ ছিল কষ্টসাধ্যকর ও বন্ধুর এবং তা ছিল রক্তাক্ত, শ্রমসাধ্য ও আত্মত্যাগময়। সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত কোনো জাতিই তাদের মুক্তির জন্য বাঙালিদের মতো এত চড়া মূল্য দেয়নি।...
‘১৯. এই মামলা অনুসারে দেখা যায়, বর্ণিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মে থেকে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মধ্যে। ১৯৭১ সালের এই স্বাধীনতাযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, শান্তি কমিটি গঠন করা হয় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে, যারা নৈতিক সমর্থন, সহায়তা এবং বস্তুগত সমর্থন দিয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের ওপর ভয়ংকর নৃশংস হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছে।
‘২০. সাধারণ বিচারবুদ্ধি থেকেই এটা স্পষ্ট যে সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে আক্রমণ পরিচালনার অংশ হিসেবে দেশজুড়ে হাজার হাজার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। আক্রমণের টার্গেট ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি বেসামরিক জনতা, হিন্দু সম্প্রদায়, স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক গ্রুপ, মুক্তিযোদ্ধা এবং “বুদ্ধিজীবীরা”।’
(সূত্র: জনকণ্ঠ, ২২ জানুয়ারি ২০১৩)
’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে বাচ্চু রাজাকার বা বিচারাধীন আসামিরা যাদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে, তাদের সঙ্গে আসামিদের কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শত্রুতা ছিল না। ৩০ লাখ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল দলীয় ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট আদর্শিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে।
ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ পরবর্তী মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন সহায়ক হবে, ব্যক্তির পাশাপাশি দল ও বাহিনীর বিচারের পথও সুগম করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ’৭১-এ জামায়াত কীভাবে ইসলামের কথা বলে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধকে বৈধতা দিয়েছে এবং দলের কর্মীদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও গৃহ-জনপদে অগ্নিসংযোগে প্ররোচিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ফতোয়া দিয়েছিল পাকিস্তান ও ইসলাম সমার্থক, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম ও নিশানা থাকবে না, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধারণ করেছে তারা ইসলামের শত্রু, ভারতের চর, দুষ্কৃতকারী ইত্যাদি।
বাংলাদেশে যদি ’৭১-এর মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার পুনরাবৃত্তি দেখতে না চাই, তাহলে গণহত্যার রাজনীতি ও দর্শনকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে।
শাহরিয়ার কবির: লেখক, কার্যনির্বাহী সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
No comments