ঋণের নামে জালিয়াতি করে ৫শ’ কোটি টাকা আত্মসাত- সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আসামি শতাধিক by মহিউদ্দিন আহমেদ
সকালে আবেদন, দুপুরে অনুমোদন, বিকেলে টাকা প্রদান। বিলুপ্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে এ রকম বিভিন্ন কায়দায় জালিয়াতি করে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাত করে নিয়েছে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তাসহ শতাধিক ব্যক্তি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তদন্তে এই জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এসব ঘটনায় সংস্থাটি ৩৫টি মামলা দায়ের করেছে। ১৩টি মামলার চার্জশীট অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ৮টির চার্জশীট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া তিনটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।অস্তিত্বহীন ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ দুদকে আসে ২০০৬ সালের দিকে। অভিযোগে উল্লেখ থাকে ২০০৩-২০০৫ সালের মধ্যে তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্যক্তির যোগসাজশে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা আত্মসাত করে নেয়। অভিযোগটি আমলে নিয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে ভয়াবহ জালিয়াতি ধরা পড়ে। এর প্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় আটটি মামলা দায়ের করে। আটটি মামলার মধ্যে মেসার্স আবুল হোসেন নামের প্রতিষ্ঠান ১ কোটি, মেসার্স মডার্ন বিল্ডার্স লিমিটেড ৯৫ লাখ, মেসার্স লতিফ ইঞ্জিনিয়ারিং ৯৫ লাখ, মেসার্স মমতাজ ৯৫ লাখ, মেসার্স নূর মেশিনারিজ ৯৫ লাখ, মেসার্স বক্কর হোসেন ১ কোটি, মেসার্স আব্দুস সালাম ১ কোটি, মেসার্স সিটি কম ১ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাত করে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পায়নি দুদক। দুদক এ আটটি মামলার চার্জশীট আদালতে পেশ করেছে। এভাবে একই প্রক্রিয়ায় আরও ৪৮০ কোটি টাকা আত্মাসত করা হয়েছে। এর বিপরীতে আরও ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন থানায়। এর মধ্যে ৫টি মামলা অনুমোদন দিয়েছে দুদক। যে কোন কার্যদিবসে চার্জশীট আদালতে জমা দেয়া হবে। আরও ২২টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। নতুন করে দায়ের করা হবে আরও তিনটি মামলা। এ তিনটি অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সব মামালার আসামি সংখ্যা হবে শতাধিক। এর মধ্যে বেশিরভাগ আসামি হবে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা। তাছাড়া ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজানো হয়েছে এমন ব্যক্তি আছে ৪০ জনের মতো। এছাড়া ২০০৭ সালে ব্যাংকটির সাবেক এক কর্মকর্তার প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হয়। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংক হিসাব, ব্যক্তি, লেনদেন, ঘটনাস্থল সব কিছুই আলাদা। যার কারণে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা একটিমাত্র মামলা দিয়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। যে কারণে প্রতিটি হিসাবের বিপরীতে পৃথক মামলার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন ওই মামলায় ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার ৭ জন, বংশাল শাখার ৪ জন, নবাবপুর শাখায় ৩ জন, কাওরানবাজার শাখার ৩ জন, মিরপুর শাখার ৩ জন ও প্রধান কার্যালয়ের ৩ জনসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এখন আসামি সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মামলা সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হতে পারে।
মঙ্গলবার যে আটটি মামলায় চার্জশীট প্রদান করা হয়েছে সেসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মোঃ হারুন, সিনিয়র এ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল কাশেম মাহমুদ উল্লাহ, এ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ ফজলুর রহমান, এক্সিকিউটিভ অফিসার তরিকুল আলম, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এসইভিপি মাহমুদ হোসেন, ইভিপি কামরুল ইসলাম এবং ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা (ডিজিএম) পরিচালক ইমামুল হক। এদের প্রতিজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
আটটি মামলার চার্জশীট দাখিলপরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করে দুদক। এ সময় আট মামলার তিন বাদী দুদকের উপ-পরিচালক আবুল হোসেন গোলাম মোস্তফা, শফিকুল ইসলাম এবং গণসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। উপ-পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের (বর্তমানে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক) এসব কর্মকর্তা মিথ্যা সিআইবি রিপোর্ট, মিথ্যা অঙ্গীকারনামা তৈরি, ভুয়া পোস্টডেটেড চেক দাখিল করেন। ব্যাংক ব্যবস্থাপকের নির্দেশনাবলী না মেনেই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এ ঋণ উত্তোলন করে মোট ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাত করেন।
উল্লেখ্য, জেদ্দাভিত্তিক শিল্পপতি আমানুল্লাহ মিয়া ও বাংলাদেশের শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটুর মালিকানায় ১৯৮৭ সালে আল-বারাকা ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু করে এ ব্যাংকটি। আমানুল্লাহ মিয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয় হংকংভিত্তিক আল-বারাকা কোম্পানির কাছে। তখন আল-বারাকা কোম্পানির পরামর্শে নামকরণ করা হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। ২০০৪ সালে এসে আবারও এ ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন হয়। সে বছরের নবেম্বর মাসে ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ার কিনে নেয় ওরিয়ন গ্রুপ।
অর্থ লুটপাটের কারণে সৃষ্ট চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে ২০০৬ সালের জুনে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করে ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ব্যাংকটির অর্ধেক শেয়ার ৩৫০ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় কিনে নেয় সুইজারল্যান্ডে নিবন্ধিত মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি ফিনান্সিয়াল হোল্ডিংস এজি। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের বদলে নতুন নামকরণ করা হয় আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।
No comments