নদী রক্ষা-যোগ্য কমিশন গঠিত হোক
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের মধ্য দিয়ে দেশের নৌ প্রাণপ্রবাহগুলোর দখল, দূষণ ও অপব্যবহার রোধে এক ধাপ অগ্রগতি হলো আশা করা যায়।
যদিও ২০০৯ সালে মূলত উচ্চ আদালতের এক নির্দেশনায় নদী বিষয়ক এই স্বায়ত্তশাসিত কর্মকাঠামো গঠনের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল; কমিশনটি গঠনের উদ্যোগে সরকারের সদিচ্ছাও অস্বীকার করা যায় না। আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই নদ-নদী সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি ছিল। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর সরকার রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও সীমানা চিহ্নিতকরণ, বুড়িগঙ্গার তলদেশের আবর্জনা অপসারণ, নদী দূষণকারী ট্যানারি শিল্প সরাতে পৃথক স্থান নির্ধারণ, গড়াইসহ কয়েকটি প্রধান নদী খনন, নদী রক্ষায় জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, নদীকেন্দ্রিক ব-দ্বীপ পরিকল্পনা প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পরিবেশ অধিদফতরও নদীদূষণ রোধে আগের তুলনায় তৎপর হয়েছিল। কিন্তু নদী সুরক্ষার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদিচ্ছা ব্যবহারিক পর্যায়ে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছিল, সেই প্রশ্ন যেমন রয়েই যায়; তেমনি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও স্পষ্ট হয়েছিল। উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি, অবৈধ স্থাপনা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা যায়নি, সম্ভব হয়নি বুড়িগঙ্গার বর্জ্য অপসারণও। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, শুষ্ক মৌসুমের প্রবাহ ঘেঁষে নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণ বরং বুমেরাং হয়েছে। সাভারের বিরান ট্যানারি 'শিল্পনগরী' পরিণত হয়েছে পরিবেশ ও শিল্প সুরক্ষার প্রহসনে। নদীবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সও কেবল বৈঠক ও প্রতিশ্রুতির বেশি কিছু আমাদের উপহার দিতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সরকার বলছে, এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাজে সমন্বয় করবে এবং সরকারকে সুপারিশ করবে। নাগরিকরা অবশ্য দেখতে চাইবে কার্যকারিতা। যে নামেই গঠিত হোক না কেন, নদী রক্ষায় তা কতখানি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, সেটাই মূল বিবেচ্য। নদী ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট ১৪টি কর্তৃপক্ষ ও সংস্থা যেভাবে বছরের পর বছর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, আসন্ন কমিশনে তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইবে না কেউ। ইতিমধ্যেই এর এখতিয়ার ও কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবাদীরা। আইন প্রয়োগের বদলে কেবল সুপারিশমূলক ক্ষমতা দিয়ে নদীবৈরী প্রভাবশালী শক্তিগুলোকে কতটা মোকাবেলা সম্ভব, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তারা। যে আবেদনে সাড়া দিয়ে উচ্চ আদালত নদী সুরক্ষা কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই বেলাকে (বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি) কেন আইনটির খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখা হয়নি, আমাদের বোধগম্য নয়। উচিত ছিল আইনটি নিয়ে পরিবেশবাদীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা। তাতে করে আইনটি নিয়ে সমালোচনা যেমন কমত, তেমনই বাড়ত গ্রহণযোগ্যতা ও অন্তর্গত শক্তি। আমরা মনে করি, সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। নদী সুরক্ষা নিয়ে যারা দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন, খসড়া আইনটি সংসদে উপস্থাপনের আগে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করা যেতে পারে। কোন কোন ব্যক্তিকে কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তার ওপরও প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করবে। আমরা প্রত্যাশা করি, দলমতের ঊধর্ে্ব উঠে সরকার সঠিক ব্যক্তিদের বেছে নেবে। তাহলেই সার্থক হবে পরিবেশ কর্মীদের আন্দোলন, আবেদন এবং সরকারের উদ্যোগ।
No comments