গ্রেফতার আতঙ্কঃ বিরোধী জোটের অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে by মান্নান মারুফ
গ্রেফতারের ভয়ে বিরোধীদলীয় জোটের মধ্যম সারির নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে গেছেন। বেশ কিছু দিন ধরে সভা-সমাবেশে দেখা যাচ্ছে না তাদের। এমনকি আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও রয়েছেন।
১৮ দলীয় জোটে বিএনপির শরিক দলগুলোর নেতারাও ভুগছেন গ্রেফতার আতঙ্কে।গ্রেফতার এড়াতে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে টানা দু’সপ্তাহ পার করছেন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত ৮ ডিসেম্বর পার্টি অফিসে অবস্থান নেওয়ার পর আর বেরই হননি তিনি।
১৮ দলীয় জোট, বিশেষ করে জামায়াত ও বিএনপি’র অধিকাংশ যুব নেতার মোবাইল ফোনও বন্ধ। ঘন ঘন মোবাইল সিমও পাল্টাচ্ছেন কেউ কেউ। খুব ঘনিষ্ঠজন ছাড়া এসব নাম্বার অন্য কাউকেই দিচ্ছেন না তারা।
সক্রিয় কর্মীরাও দিন পার করছেন পালিয়ে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় গ্রেফতারের ভয় তো পাচ্ছেনই। নতুন মামলার জুজুও তাড়া করে ফিরছে তাদের।
জামায়াতসহ আত্মগোপনে থাকা ১৮ দলীয় জোটের এসব নেতা-কর্মী তাদের সহকর্মী ও বিশেষ ব্যক্তি এবং শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এসএমএম ও ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বিএনপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গ্রেফতার হওয়ার পর যেমন বিএনপি অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়তে শুরু করে, তেমনি প্রচার সম্পাদক অধ্যাপক তাসনিম আলম ও সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রীসহ কয়েকজন নারীকর্মীকে গ্রেপ্তারের পর চুপসে গেছে জামায়াত।
পালিয়ে বেড়ানো জামায়াত নেতারা কোথায় রাত কাটাচ্ছেন, কি খাচ্ছেন, কি করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরাও তা জানতে পারছে না।
দলীয় কার্যক্রমেও তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। স্তিমিত হয়ে পড়েছে বিরোধী জোটের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় হয়ে পড়েছে নেতাকর্মী শূন্য। জামায়াত অফিসের পরিস্থিতি তো আরো খারাপ।
১৮ দলীয় জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে মগবাজারস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও পল্টনস্থ মহানগর আর শিবিরের কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। এক সময়ের জমজমাট এসব অফিসে এখন মানুষ বলতে কেবল সিকিউরিটি গার্ড।
দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি সেলিমউদ্দিন, ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, কর্মপরিষদ সদস্য, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, আব্দুল হালিম, শিবির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, সেক্রেটারি আব্দুল জব্বার, কেন্দ্রীয় সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক নিজামুল হক নাঈমসহ সহস্রাধিক নেতা গ্রেফতারের ভয়ে তাদের সেলফোন বন্ধ করে দিয়েছেন।
এদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তারের হওয়ার পর বিএনপির অনেক যুব নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
দলীয় সূত্রমতে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, ছাত্রদল সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবসহ ঢাকা মহানগরের বেশ কয়েকজন সাবেক বিএনপি সমর্থক ওয়ার্ড কশিনার গণগ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা উপজেলা ও মহানগরের অনেক নেতাই গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানান বিএনপির এক দায়িত্বশীল নেতা।
গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা নিজেদের মোবাইল সিমও পরিবর্তন করেছেন বলে জানা গেছে।
বিরোধী জোটের নাম নামসর্বস্ব বাকী দলগুলোর খবর নেই তেমন একটা। চালচুলোহীন এসব রাজনৈতিক দলের অবস্থা কি তা জানারও কোন উপায় নেই এখন। তাদের অধিকাংশের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাংলানিউজকে বলেন, “মিথ্যা মামলা ও গ্রেপ্তার এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই মামলা হচ্ছে। আদালতেও পাচ্ছে না সুবিচার, উপরের নিদের্শে সবকিছু হচ্ছে। জামিন দেওয়া হচ্ছে না বিরোধী নেতা-কর্মীদের।”
তিনি বলেন, “সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা দোষ করলেও তাদের বিরুদ্ধে না হচ্ছে মামলা, তাদের না ধরছে পুলিশ। কিন্তু বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের মহোৎসব চলছে। এ কারণেই হয়তো অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলছেন।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলানিউজকে বলেন, “যাকে যেখানে পাচ্ছে সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদেও অপরাধ একটাই তারা বিএনপি করে।”
তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার করে রিমান্ডের নির্যাতন আর একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। অনেক নিরাপরাধ নেতা-কর্মী দিনের পর দিন জেল খাটছেন, রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার এড়িয়ে চলছেন।”
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “জামায়াত নেতা কর্মীদের উপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন।”
দলটির নেতা-কর্মীরা স্বাভাবিক চলাচল করতেও পারছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মজিবুর রহমান আরো বলেন, “নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পর্যন্ত তাদের করতে দেওয়া হচ্ছে না। কোন অযুহাত ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে মামলা, করা হচ্ছে গ্রেপ্তার। ঘরে ঘরে তল্লাশি করা হচ্ছে। নিজের ঘরেও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা থাকতে পারছে না। তাদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে।”
No comments