মানুষের শত্রুমিত্রঃ পদ্মায় জেগে ওঠা ঐতিহ্য যেন লোপাট না হয় by মাহমুদ শামসুল হক
মার্কিন সেনাদের বোমায় বিনষ্ট হলো ইরাকের জাদুঘর। ভেতরে আগুন দেয়া হলো। লুট করে নেয়া হলো হাজার বছরের সংগৃহীত প্রত্নসামগ্রী—প্রাচীন পাথর, মূর্তি, ইট, মূল্যবান রত্নরাজি। পরদিন সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রে খবর বেরুল, ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী চুরি করেছে ইরাকের ইতিহাস।
সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে একজন বিদুষী মহিলা চিত্কার করে বললেন, ‘তোমরা ইরাকিদের রক্ত নাও, ইতিহাস নিও না।’এর কয়েক বছর আগের কথা। ফ্রান্স থেকে প্রায় একশ রকমের ব্রাশ নেয়া হলো মিসরে। একদল ফরাসি প্রত্নবিদ প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার আর একটি প্রত্নভূমি খুঁজে পেয়েছে। এসব ব্রাশ দিয়ে সেই পূরনো ইট-পাথর, মূর্তি এবং অন্যান্য জিনিসের গা থেকে মাটি ও ধুলো-ময়লা সরাবেন। অথচ অনায়াসে গাইতি-শাবল-কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়ে বের করা যেত এসব। প্রত্নবিদদের দলনেতা তা হতে দেননি। তার নির্দেশ, একটি ইট থেকে একটি কনাও আলগা হতে দেয়া যাবে না। প্রতিটি মূর্তির শরীর থেকে ময়লা সরাতে হবে যেরকম নববধূকে পরিচর্যা করা হয় বিউটি পার্লারে। তারপর বছরের পর বছর ব্রাশ দিয়ে সাফ করা হলো সভ্যতার সেই সব অমূল্য নিদর্শন। পত্রিকায় খবর বেরুল, নতুন ইতিহাস খুঁড়ে পাওয়া গেছে মিসরে।
ভারতের অন্যতম প্রাচীন শহর আহমেদাবাদের ৬০০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। এ উপলক্ষে ফরাসি সরকার ও ভারতের জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি ট্রাস্ট গুজরাটের প্রায় ১২ হাজার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। একজন প্রত্নবিদ সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সংস্কারের নামে কোনো প্রাচীন স্থাপনার আদল পাল্টে ফেললে চলবে না। এগুলো ভারতীয় সভ্যতার মূর্ত দলিল, ভারতের আত্মপরিচয়ের ইতিহাস।
এবার ইরাক, মিসর, ভারত ছেড়ে আসা যাক বাংলাদেশে। ২৫ মার্চ পত্রিকায় খবর বেরুলো, পদ্মা নদীর বুজে জেগে উঠেছে পাঠান যুগের দালানকোঠা। দুটি গম্বুজের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। লোকজন ডুব দিয়ে দালানের ভেতর থেকে তুলে আনছে মাথার খুলি, হাড়গোড়, দরজা-জানালার কাঠ, তৈজসপত্র, ইট ইত্যাদি। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর গ্রামে মানুষের ভিড়। প্রশাসন থেকে পাঠানো হলো পুলিশ, যাতে লোকজন ডুবে গিয়ে বিপদে না পড়ে এবং নিমজ্জমান স্থাপত্যের কোনো ক্ষতি না করে। যেসব জিনিস এ পর্যন্ত তারা এনেছে সেগুলোও সংরক্ষণের আদেশ দেয়া হলো। পরদিন খবর এলো সেগুলো এরই মধ্যে লোপাট হয়েছে। সাঁতরে গিয়ে ইট খসিয়ে আনছে লোকজন এমনকি কাজেও লাগাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, জেগে ওঠা এ ভবনটি পাঠান শাসনামলের। অন্তত চারশ বছর আগে নির্মিত। কেউ বলেছেন, এখানে একসময় নগর-জনপদ ছিল। আমাদের প্রত্নবিদ, পূর্ত মন্ত্রণালয়, প্রত্নরাজি সংরক্ষক কর্তৃপক্ষ, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তাত্ক্ষণিক কিছুই বলেনি। অকুস্থলে যাননি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক কেউ। পরে জানা গেল স্থানীয় এমপি ও প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক সেখানে গেছেন। ডুব দিয়ে দেখেছেন। চারপাশে লাল নিশান টানিয়ে সতর্কতামূলক নির্দেশ জারি করেছেন। কিন্তু এসব ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। আখেরে সব উদ্যোগই মাটি হয়ে যায়। হতে পারে এ নিয়ে ক’দিন হৈচৈ হবে, জনশ্রুতি ছড়াবে। তারপর জেগে ওঠা অতীত বঙ্গের ইতিহাসের একটি পরিচ্ছেদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পদ্মার বুকেই।
বাংলাদেশ-পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রত্নভূমি। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ভাসুবিহার, সীতাকোট বিহার, ওয়ারি-বটেশ্বর—এসব প্রত্ন-আকর বুকে ধারণ করে আছে। এগুলোর আকর্ষণে ছুটে আসছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটক-পণ্ডিত ও সাধারণ দর্শণার্থী। প্রায়শই পত্রিকায় খবর আসছে—এসব প্রত্নভূমি থেকে ইট চুরি হচ্ছে, গবাদি পশুর বিচরণক্ষেত্র পরিণত হয়েছে সংরক্ষিত এলাকার মাঠ। এভাবে আবিষ্কৃত ইতিহাসের সূবর্ণ পরিচ্ছেদ বিপন্ন-বিনষ্ট হচ্ছে মানুষের অবমৃষ্যকারিতায়, সরকারের অবহেলায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কত সংখ্যক দুর্লভ পাথুরে মূর্তি পাচার হয়েছে, কত শত প্রাচীন মন্দির-মঠ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, খোদ রাজধানীতে কয়টি প্রাচীন বাড়ি, পুকুর, নদীর ঘাটলা, তোরণ হারিয়ে গেছে তার হদিস সরকারের মোহাফেজখানায়ও নেই। ভাগ্যিস মোগল আমলের লালবাগ দুর্গ, ওসমানি উদ্যানে রাখা কামানসহ কিছু মাজার ও কবর অক্ষত আছে। নইলে ৫০০ বছরের পূরনো ঢাকার ঐতিহ্য ও ইতিহাস গবেষকদেরও খুঁজে পেরেশান হতে হতো। আমাদের নদী ফি-বছর ভরাট হয়ে যায়, মরে যায়। উজাড় হয়ে যায় প্রাচীন বনভূমি। লোপাট হয়ে যায় প্রত্নভূমি, প্রত্নসামগ্রী। আমরা হাজারো প্রজাতির পশু-পাখি হারিয়েছি। প্রায় সাত হাজার প্রজাতির ধান হারিয়েছি। হারাতে বসেছি গ্রামীণ সভ্যতার সব কিছু। আমাদের দিগন্ত ধূসর হচ্ছে, প্রকৃতি বিপন্ন হচ্ছে। কেবল অর্থের নির্দয় অন্বেষণ বাড়ছে, ক্ষমতা বাগানোর রাজনীতি ফাঁপছে, সমকালীন ইতিহাস বিকৃতির বিতর্ক হচ্ছে। আর বাড়ছে ক্ষুধা। এই ফাঁকে ঐতিহ্য-ইতিহাস এখন চুলোয় যাওয়ার উপক্রম। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা প্রাচীন ভবন সংরক্ষণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকারের বা সংশ্লিষ্ট মহলের যে ভূমিকা তা থেকে প্রমাণ হয়, আমরা আমাদের অতীতের গ্রন্থিসূত্র টিকিয়ে রাখতে উচিতমতো আগ্রহী নই। আমাদের কি তেমন কেউ নেই—কোনো সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, মন্ত্রী, প্রত্নবিদ, গবেষক বা অন্য কোনো সুধীজন যিনি পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে বলবেন, জেগে ওঠা এ ভবন আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক, অতীত ইতিহাসের মূর্ত স্বাক্ষর, এগুলো সংরক্ষণ করার কথা ভাবো আত্মপরিচয়ের ইতিহাস বিনষ্ট করো না।
No comments