পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-সোয়া ১১ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ by রফিকুল ইসলাম
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. সাখাওয়াত হোসেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ করা অন্তত ১১ কোটি ২৬ লাখ ১১ হাজার ৬৯৪ টাকার হিসাব ঠিকমতো দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এর মধ্যে বিগত অর্থবছরেই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা।
স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের করা অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে (এআইআর) এই আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ তহবিলের অন্তত সোয়া ১১ কোটি টাকার হিসাব ঠিকমতো দিতে পারেনি পবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ।
সঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তহবিলের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে এবং এতে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে পবিপ্রবির সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, তহবিলের অর্থ হারিয়ে যায়নি বরং খরচের হিসাবগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাখা আছে। হিসাবগুলো খুঁজে বের করতে তাদের অনেক সময় লাগবে। তারা অধিকাংশ খরচের হিসাবের কাগজ নিরীক্ষাকারীদের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষা বিভাগ বলছে, তারা অধিকাংশ খরচের হিসাবের কাগজ পায়নি। এমনকি বিধিবহির্ভূতভাবেও অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দ করা অর্থের মধ্যে সোয়া ১১ কোটি টাকার যথাযথ হিসাব দিতে পারেনি পবিপ্রবি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব বিভাগের যেসব শাখা এই তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ পায় তারা ঠিকভাবে এর হিসাব দেয়নি। সরকারি এই তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কিংবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ না করেই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। পাশাপাশি পিপিআর লঙ্ঘিত হয়েছে। অনেক খরচের হিসাব সম্পন্ন করা হয়নি। বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়সহ ৪৬টি অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
পিপিআর লঙ্ঘন করে ঠিকাদারকে কাজ : পবিপ্রবির বিএমএ এবং সিএসই অনুষদের চারতলা ভবন (১ম ব্লক) নির্মাণকাজের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল চার কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু পবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ প্রাক্কলিত ব্যয় অনুমোদন করে চার কোটি ৪৫ লাখ টাকা। পরে কার্যাদেশ নং পবিপ্রবি/প্রকৌশল/প্র-০২/১৭/২০১১-২০১২/২৯৫৫-এর মাধ্যমে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ১৪.৩০ শতাংশ কম হারে তিন কোটি ৮১ লাখ টাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সৈয়দ মাহবুব ট্রেডার্সকে কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ১৯ (ক) উপধারা (১) অনুযায়ী, সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত কাজের ক্ষেত্রে দাপ্তরিক প্রাক্কলনের ৫ শতাংশের অধিক কম বা অধিক বেশি দর দরপত্রে উদ্ধৃত করা হলে দরপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি অর্থের বড় একটা অংশ বেঁচে গেলেও সরাসরি পিপিআর ২০০৮ বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বরাদ্দের চেয়ে কোটি টাকা বেশি ব্যয় : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা দেয়। এ ছাড়া পবিপ্রবির নিজস্ব আয় ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকার বিপরীতে ওই অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অতিরিক্ত ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
বিএফআর-৩১৭ ও ৩১৯ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং অম/অবি (গ) অনুযায়ী বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। তবে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
পেনশন তহবিলের ৮৭ লাখ টাকা ক্ষতি : পবিপ্রবি পেনশন তহবিলে ২০১১-১২ সালে স্থিতি ছিল ৬৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে প্রাপ্তি ৬০ লাখ টাকা ও ব্যাংক লভ্যাংশ থেকে ৪৫ হাজার টাকাসহ মোট এক কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রকৃত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। সে হিসেবে উদ্বৃত্ত থাকে ৮৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। কিন্তু উদ্বৃত্ত টাকার মধ্যে ক্যাশ বইয়ে স্থিতি দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ৫০ লাখ টাকা বেতন খাতে (হিসাব নং ৮৪১) ধার দেওয়া হয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী, ধার দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং উদ্বৃত্ত টাকা সরকারি খাতে ফেরত দেওয়াই নিয়ম। তবে নথি পর্যালোচনায় জানা যায়, পেনশন তহবিলের ব্যয় শেষে উদ্বৃত্ত ৮৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা সমর্পণ না করায় আর্থিক ক্ষতি হয়।
ভাউচার ছাড়াই ৩০ লাখ টাকা ব্যয় : হিসাব নিরীক্ষাকালে অগ্রিম রেজিস্ট্রার বিল-ভাউচার এবং অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১১-১২ সালে অগ্রিম উত্তোলিত ৩০ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হলেও সমন্বয় ভাউচার পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদায় করা অর্থের ব্যয় নীতিমালা ৩২ (খ) অনুযায়ী, প্রদত্ত অগ্রিম সংশ্লিষ্ট কাজ শেষ হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অথবা অর্থিক বছরের মধ্যে সমন্বয় করার কথা। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও টাকা সমন্বয় ভাউচার সংগ্রহ করতে পারেনি।
পিপি-বহির্ভূতভাবে প্রকল্প : বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পুরনো স্থাপনাসমূহ মেরামত ও সংস্কার প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট পিপি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তিনটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে পিপি-বহির্ভূতভাবে। শিক্ষক ও অফিসার্স ক্লাব মেরামত, প্রশাসনিক ভবন এবং শেরে বাংলা হলের ড্রেন মেরামত করা হয়েছে পিপি-বহির্ভূতভাবে। কারণ পিপিতে যেসব স্থাপনা মেরামতের কথা উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে ওই তিনটির নাম নেই। ফলে ওই তিন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এক অর্থবছরের বরাদ্দ অন্য বছর ব্যয় : পবিপ্রবির ২০১১-১২ সালের হিসাব নিরীক্ষা ক্যাশ বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ইস্যুর মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে এক কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা আর্থিক ক্ষতির শামিল। চলতি বছরের ৩০ জুন ক্যাশ বইয়ে লেনদেন শেষ করে সমাপনী স্থিতি চার কোটি ১৪ লাখ টাকা দেখানো হয়।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট অফিসার মো. কাসেদ আলী বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি থাকলে এত অনিয়মের ঘটনা ঘটত না। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পবিপ্রবিতে নিরীক্ষা হয়েছে। ২০১১-১২ সালের অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৮টি অডিট আপত্তির বিপরীতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিষয়গুলো মীমাংসার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
পবিপ্রবির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক পূর্ণেন্দু বিশ্বাস ৪৬টি অডিট আপত্তির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'এগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য শিগগির একটি ত্রিপক্ষীয় সভা হবে। ওই সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
আর্থিক অনিয়ম ও অডিট আপত্তির সত্যতা স্বীকার করে বিদায়ী উপাচার্য ড. সাখাওয়াত হোসেন জানান, নিরীক্ষায় আপত্তির বিষয়টি যথাযথ হয়নি। তাঁর দপ্তরে আর্থিক অনিয়মের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জবাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছালে আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি হবে বলে তিনি দাবি করেন।
সাবেক ভিসির বিচার দাবি
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠে 'বিদায়বেলায় ভিসির নিয়োগ উৎসব' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বিদায়ী উপাচার্য ড. সাখাওয়াত হোসেনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী পরিষদ।
অন্যদিকে পবিপ্রবি ক্যাম্পাস থেকে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় বরিশাল সদর রোডের টাউন হলের সামনে আয়োজিত এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, সহকারী অধ্যাপক সন্তোষ কুমার বোস, মো. মেহেদি হাসান, সহকারী রেজিস্ট্রার আরিফ আহম্মেদ জুয়েল, সেকশন অফিসার লুৎফর রহমান, কর্মচারী পরিষদের সভাপতি রিয়াজ কাঞ্চন শহীদ, কর্মচারী ক্লাবের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা প্রমুখ।
স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের করা অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে (এআইআর) এই আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ তহবিলের অন্তত সোয়া ১১ কোটি টাকার হিসাব ঠিকমতো দিতে পারেনি পবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ।
সঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তহবিলের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে এবং এতে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে পবিপ্রবির সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, তহবিলের অর্থ হারিয়ে যায়নি বরং খরচের হিসাবগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাখা আছে। হিসাবগুলো খুঁজে বের করতে তাদের অনেক সময় লাগবে। তারা অধিকাংশ খরচের হিসাবের কাগজ নিরীক্ষাকারীদের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষা বিভাগ বলছে, তারা অধিকাংশ খরচের হিসাবের কাগজ পায়নি। এমনকি বিধিবহির্ভূতভাবেও অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দ করা অর্থের মধ্যে সোয়া ১১ কোটি টাকার যথাযথ হিসাব দিতে পারেনি পবিপ্রবি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব বিভাগের যেসব শাখা এই তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ পায় তারা ঠিকভাবে এর হিসাব দেয়নি। সরকারি এই তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কিংবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ না করেই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। পাশাপাশি পিপিআর লঙ্ঘিত হয়েছে। অনেক খরচের হিসাব সম্পন্ন করা হয়নি। বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়সহ ৪৬টি অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
পিপিআর লঙ্ঘন করে ঠিকাদারকে কাজ : পবিপ্রবির বিএমএ এবং সিএসই অনুষদের চারতলা ভবন (১ম ব্লক) নির্মাণকাজের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল চার কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু পবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ প্রাক্কলিত ব্যয় অনুমোদন করে চার কোটি ৪৫ লাখ টাকা। পরে কার্যাদেশ নং পবিপ্রবি/প্রকৌশল/প্র-০২/১৭/২০১১-২০১২/২৯৫৫-এর মাধ্যমে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ১৪.৩০ শতাংশ কম হারে তিন কোটি ৮১ লাখ টাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সৈয়দ মাহবুব ট্রেডার্সকে কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ১৯ (ক) উপধারা (১) অনুযায়ী, সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত কাজের ক্ষেত্রে দাপ্তরিক প্রাক্কলনের ৫ শতাংশের অধিক কম বা অধিক বেশি দর দরপত্রে উদ্ধৃত করা হলে দরপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি অর্থের বড় একটা অংশ বেঁচে গেলেও সরাসরি পিপিআর ২০০৮ বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বরাদ্দের চেয়ে কোটি টাকা বেশি ব্যয় : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা দেয়। এ ছাড়া পবিপ্রবির নিজস্ব আয় ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকার বিপরীতে ওই অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অতিরিক্ত ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
বিএফআর-৩১৭ ও ৩১৯ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং অম/অবি (গ) অনুযায়ী বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। তবে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
পেনশন তহবিলের ৮৭ লাখ টাকা ক্ষতি : পবিপ্রবি পেনশন তহবিলে ২০১১-১২ সালে স্থিতি ছিল ৬৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে প্রাপ্তি ৬০ লাখ টাকা ও ব্যাংক লভ্যাংশ থেকে ৪৫ হাজার টাকাসহ মোট এক কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রকৃত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। সে হিসেবে উদ্বৃত্ত থাকে ৮৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। কিন্তু উদ্বৃত্ত টাকার মধ্যে ক্যাশ বইয়ে স্থিতি দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ৫০ লাখ টাকা বেতন খাতে (হিসাব নং ৮৪১) ধার দেওয়া হয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী, ধার দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং উদ্বৃত্ত টাকা সরকারি খাতে ফেরত দেওয়াই নিয়ম। তবে নথি পর্যালোচনায় জানা যায়, পেনশন তহবিলের ব্যয় শেষে উদ্বৃত্ত ৮৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা সমর্পণ না করায় আর্থিক ক্ষতি হয়।
ভাউচার ছাড়াই ৩০ লাখ টাকা ব্যয় : হিসাব নিরীক্ষাকালে অগ্রিম রেজিস্ট্রার বিল-ভাউচার এবং অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১১-১২ সালে অগ্রিম উত্তোলিত ৩০ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হলেও সমন্বয় ভাউচার পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদায় করা অর্থের ব্যয় নীতিমালা ৩২ (খ) অনুযায়ী, প্রদত্ত অগ্রিম সংশ্লিষ্ট কাজ শেষ হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অথবা অর্থিক বছরের মধ্যে সমন্বয় করার কথা। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও টাকা সমন্বয় ভাউচার সংগ্রহ করতে পারেনি।
পিপি-বহির্ভূতভাবে প্রকল্প : বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পুরনো স্থাপনাসমূহ মেরামত ও সংস্কার প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট পিপি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তিনটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে পিপি-বহির্ভূতভাবে। শিক্ষক ও অফিসার্স ক্লাব মেরামত, প্রশাসনিক ভবন এবং শেরে বাংলা হলের ড্রেন মেরামত করা হয়েছে পিপি-বহির্ভূতভাবে। কারণ পিপিতে যেসব স্থাপনা মেরামতের কথা উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে ওই তিনটির নাম নেই। ফলে ওই তিন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এক অর্থবছরের বরাদ্দ অন্য বছর ব্যয় : পবিপ্রবির ২০১১-১২ সালের হিসাব নিরীক্ষা ক্যাশ বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ইস্যুর মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে এক কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা আর্থিক ক্ষতির শামিল। চলতি বছরের ৩০ জুন ক্যাশ বইয়ে লেনদেন শেষ করে সমাপনী স্থিতি চার কোটি ১৪ লাখ টাকা দেখানো হয়।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট অফিসার মো. কাসেদ আলী বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি থাকলে এত অনিয়মের ঘটনা ঘটত না। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পবিপ্রবিতে নিরীক্ষা হয়েছে। ২০১১-১২ সালের অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৮টি অডিট আপত্তির বিপরীতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিষয়গুলো মীমাংসার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
পবিপ্রবির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক পূর্ণেন্দু বিশ্বাস ৪৬টি অডিট আপত্তির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'এগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য শিগগির একটি ত্রিপক্ষীয় সভা হবে। ওই সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
আর্থিক অনিয়ম ও অডিট আপত্তির সত্যতা স্বীকার করে বিদায়ী উপাচার্য ড. সাখাওয়াত হোসেন জানান, নিরীক্ষায় আপত্তির বিষয়টি যথাযথ হয়নি। তাঁর দপ্তরে আর্থিক অনিয়মের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জবাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছালে আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি হবে বলে তিনি দাবি করেন।
সাবেক ভিসির বিচার দাবি
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠে 'বিদায়বেলায় ভিসির নিয়োগ উৎসব' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বিদায়ী উপাচার্য ড. সাখাওয়াত হোসেনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী পরিষদ।
অন্যদিকে পবিপ্রবি ক্যাম্পাস থেকে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় বরিশাল সদর রোডের টাউন হলের সামনে আয়োজিত এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, সহকারী অধ্যাপক সন্তোষ কুমার বোস, মো. মেহেদি হাসান, সহকারী রেজিস্ট্রার আরিফ আহম্মেদ জুয়েল, সেকশন অফিসার লুৎফর রহমান, কর্মচারী পরিষদের সভাপতি রিয়াজ কাঞ্চন শহীদ, কর্মচারী ক্লাবের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা প্রমুখ।
No comments