চরাচর-পাখির অভয়ারণ্য by আনন্দ কুমার ভৌমিক
২০০৭ সালের চৈত্র মাস। এক পড়ন্ত বিকেলে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার সুরিচোঁ গ্রামের স্থানীয় বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় ঢাকা থেকে যোগ দিলেন একজন পাখিপ্রেমী। তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয় উপস্থিত পাঁচটি গ্রামের মানুষ। নিজেদের আগ্রহ ও দায়িত্ববোধ থেকে তারা পাখি রক্ষার কর্মসূচি হাতে নেয়।
প্রথম দিকে পাখি শিকারিদের সঙ্গে বিবাদ হলেও গ্রামবাসীর সচেতনতায় বিষয়টি ক্রমে স্বাভাবিকতা পায়। আর এ কাজের কর্মীবাহিনী মূলত শিশুরাই। গ্রামগুলোতে হাঁটলে কিছু দূর পরপর চোখে পড়ে পাখি রক্ষায় সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড। যাতে লেখা রয়েছে- 'পাখির জন্য ভালোবাসা; আমরা পাখির বন্ধু হব, সব পাখিদের যত্ন নেব; গুলতি বা ফাঁদ পেতে কেউ পাখি মারবেন না; পাখি প্রকৃতির সম্পদ, এদের রক্ষা করুন।' শুধু সাইনবোর্ডেই লেখা শোভা পাচ্ছে তা নয়, গ্রামের লোকজন এসব পালনও করছে দৃঢ়তার সঙ্গে। এলাকার যুবক ও শিশু-কিশোররা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বাঁশ, কাঠ, মাটির পাত্র, প্লাস্টিকের জার, বোতল, খড় ইত্যাদি দিয়ে পাখির জন্য কৃত্রিম বাসা বানিয়ে গাছে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে। এসব কৃত্রিম বাসার কোনো কোনোটিতে পাখি ডিম দিয়েছে, কোনো কোনোটিতে বাচ্চাদের খাওয়াতে দেখা যায়। গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাঁশঝাড়েই রয়েছে পাখির সমাগম। পাওয়া যায় পাখির বিষ্ঠার আঁষ্টে গন্ধ। কোনো কোনো বাঁশঝাড়ের পাতাগুলো বকের বিষ্ঠায় সাদা হয়ে গেছে। সকাল-সন্ধ্যায় বড় বড় গাছ, বাঁশঝাড়, বাগানে শুধুই পাখির কিচিরমিচির। এলাকাটিতে যেন পাখিরই রাজত্ব। বড় বড় গাছে শত শত পানকৌড়ি সন্ধ্যায় এসে আশ্রয় নেয়। আবার সকালে উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে। সন্ধ্যার আগে হোগলা ক্ষেতে প্রচুর বাবুই পাখির আনাগোনা দেখা যায়। ডিম পাড়ার সময় এরা এলাকার তাল ও নারিকেল গাছে নির্ভয়ে তৈরি করে বাসা। শালিক, বুলবুলি ও দোয়েল কোনো কোনো পরিবারের নিয়মিত সদস্যের মতোই। গৃহিণীরা গৃহপালিত পাখির মতোই মাঝেমধ্যে উঠানে খাবার ছিটিয়ে দেয়। এলাকার লোকজন প্রথম থেকেই পেঁচার প্রতি খুব যত্নবান। কারণ তারা জানে, পেঁচা ফসলের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর দমন করে। একবার দিনের বেলায় একটি কাক একটি পেঁচাকে তাড়া করে ঠোকরাতে ঠোকরাতে আহত করেছিল। আহত পেঁচাটি এক সময় মাটিতে পড়ে যায়। শিশুরা পেঁচাটিকে উদ্ধার করে এবং সেবাযত্নে সুস্থ করে সন্ধ্যার পর মুক্ত করে দেয়। এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতাই শোনা যাবে পাঁচটি গ্রামের শিশুদের কাছে। ঘুঘু পাখি এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ফসলের মাঠ সবখানেই দেখা যায়। 'পাখির জন্য ভালোবাসা' নামক একটি নাটিকা গ্রামে গ্রামে, স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নাটিকাটির মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের পাখির উপকারিতার দিক তুলে ধরা হয়েছে। এলাকায় নিম ও বটগাছ লাগানোর বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল, আর তাতে ভালো ফলও পাওয়া গেছে। পাঁচটি গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় দিন দিন অভয়ারণ্যটি সমৃদ্ধ হচ্ছে। গ্রামবাসীর প্রত্যাশা- এ অভয়ারণ্য টিকে থাক অনন্তকাল।
আনন্দ কুমার ভৌমিক
আনন্দ কুমার ভৌমিক
No comments