চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-'পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে' by যতীন সরকার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের সঙ্গে মৈত্রীজোট গঠিত না হলে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। ইতালির একনায়ক মুসোলিনির হাতেই ফ্যাসিবাদের সূচনা ঘটলেও জার্মানির তথাকথিত 'আর্য জাতি' ও 'নর্ডিক জাতি'র শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নাৎসি মতবাদ এবং জাপানের 'দৈবশক্তিসম্পন্ন জাপানি জাতি'র মতবাদ- এ তিনটিই একত্রে ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত হয়ে গেছে।
সভ্যতাবিরোধী এ ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্রের পত্তন ঘটল, গড়ে উঠল সমাজতন্ত্রী বিশ্বশিবির। এ শিবির ধ্বংস করা তথা সমাজতন্ত্রেরই উচ্ছেদ ঘটানোর লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদীরা একেবারেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেদিন। তারা 'ন্যাটো' জোট প্রতিষ্ঠা করল সেই লক্ষ্যেই। সে লক্ষ্যেই ১৯৪৮ সালে তাদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
ইসরায়েলিরা অত্যন্ত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি জনগোষ্ঠী। এরাই ইহুদি নামে পরিচিত। ইহুদি নির্যাতন ও বিতাড়নের মধ্য দিয়েই হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে নাৎসিবাদের অভ্যুদয়। নাৎসিদের হাতে ইহুদি নির্যাতন, বীভৎসতা ও অমানবিকতার সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুনিয়ার যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই লাঞ্ছিত-নির্যাতিত ইহুদি জাতির প্রতি সহানুভূতিপরায়ণ না হয়ে পারে না। এ সহানুভূতিকেই সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের বদ মতলব হাসিলের কাজে লাগায় জেরুজালেমে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের একটি শত্রুখুঁটি পুঁতে রাখা। শুধু তাই নয়, ওই ভূখণ্ডে আবহমান কাল ধরে খুঁটি পোঁতা ছিল যাদের, তাদের সমূলে উপড়ে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতাও পেয়ে গেল উড়ে এসে জুড়ে বসে যাওয়া এ রাষ্ট্র। বিতাড়িত ও নির্যাতিত হওয়ার দরুন যে ইহুদিরা বিশ্বমানুষের গভীর ও অকৃত্রিম সহানুভূতি আকর্ষণ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদ সেই ইহুদিদেরই বিতাড়ক ও নির্যাতকের ভূমিকায় নামিয়ে দিল। ইহুদি রাষ্ট্রটি তার জন্মলগ্ন থেকেই জন্মভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন-পর্ব শুরু করেছিল, ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে এর নির্যাতক ও ভীতিসঞ্চারক রূপটি।
আসলে নির্যাতন ও ভীতি সঞ্চারণের মূল হোতা সাম্রাজ্যবাদ, ইসরায়েল তার একান্ত বিশ্বস্ত দাস। প্রভু তার দাসটিকে নানাভাবেই শক্তির জোগান দিয়ে যাচ্ছে, এমনকি একটি বিরাট অঞ্চলকে ভীতিগ্রস্ত করে রাখার জন্য তার হাতে পারমাণবিক অস্ত্রও তুলে দিয়েছে। প্রভু ও দাস দুইয়ের হাতেই পারমাণবিকসহ নানা বিধ্বংসী অস্ত্র অবশ্যই থাকতে পারবে- এটি যেন তাদের জন্য বিধিদত্ত অধিকার। অন্য কেউ যাতে আত্মরক্ষার জন্যও কোনো অস্ত্র রাখতে না পারে, তার নিশ্চয়তা বিধানের অধিকারও বোধ হয় বিধাতা আমেরিকা ও ইসরায়েলের হাতে অর্পণ করেছেন! ইহুদিরা যে বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট জাতি, এমন প্রচার তো তারা স্মরণাতীতকাল থেকেই করে আসছে।
সে যাই হোক, বিধাতার ন্যায়বিধানের প্রতি অটুট আস্থা পোষণ করেন যাঁরা, তাঁরা নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ জাতির প্রতি বিধাতার বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করতে পারেন না। ইহুদিদের একসময়কার সুকৃতির জন্য বিধাতা যদি সন্তুষ্ট হয়েও থাকেন, আজ কিন্তু তাদের দুষ্কৃতিকে তিনি কিছুতেই ক্ষমা করছেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়-
একদিকটা উঁচু হয়েছিল বেশি,
ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,
সেইখান থেকে মারলেন টান,
বড়োটাকে দিলেন কাত করে।
বড়ত্বের অভিমানে প্রচণ্ড ঘা খেয়ে ইসরায়েল কাত হয়ে গেল গত ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক বৈঠকে ১৩৮টি সদস্য দেশের ভোটে। ফিলিস্তিন পেল জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ও ইসরায়েলি বর্বরতার পক্ষে যাদের অবস্থান, তাদের নাটের গুরু যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, তার প্রমাণ এবারের জাতিসংঘের ভোটাভুটিতেও পাওয়া গেল। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে আমেরিকা, ইসরায়েলসহ মাত্র ৯টি দেশ ফিলিস্তিনিদের দাবির বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এ ৯টি দেশের শাসকগোষ্ঠী কি দুনিয়ার লোকসাধারণের ধিক্কার ও ঘৃণার পাত্র হলো না? আর ব্রিটেন ও জার্মানির মতো যে ৪১টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থেকে প্রকারান্তরে ইসরায়েলি বর্বরতাকেই নীরব সমর্থন জানিয়েছে, তারাও কি ধিক্কার ও ঘৃণার পাত্র নয়?
তবে কারো ধিক্কার ও ঘৃণাতেই সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দোসররা যে কখনো বিচলিত হয় না, এবারও তার প্রমাণ রেখেছে তারা। জাতিসংঘে ফিলিস্তিন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার পরপরই পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের অধিকৃত এলাকায় তিন হাজার নতুন বাড়ি নির্মাণের ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। ফিলিস্তিন যদি আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার সদস্য হয়, তবে সেই সংস্থাকে এক পয়সাও দেবে না- আমেরিকা এমন সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে রেখেছে। গত বছর ফিলিস্তিন যখন ইউনেসকোর সদস্য পদ পেল, তখনই আমেরিকা ইউনেসকোকে আট কোটি ডলার সাহায্য বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ কোনোই সন্দেহ নেই : মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কোনো অবস্থায়ই ইসরায়েলকে সক্রিয় সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকবে না। যে ইহুদিরা বিংশ শতাব্দীর চলি্লশের মধ্যভাগ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের হাতে চরম নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছিল, সেই ইহুদিদের রাষ্ট্র ইসরায়েলেই আজ সাম্রাজ্যবাদের মদদে নয়া ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ ও বীরত্বই ফ্যাসিবাদের পতনের প্রধান শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজকে সোভিয়েত নেই, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাও বিপর্যস্ত। কে এখন আজকের সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করবে? জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে পরাজিত হয়েও আমেরিকা আর ইসরায়েল প্রতিনিয়তই ফিলিস্তিনিদের লাঞ্ছিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ করে যেতে থাকবে কি? একবিংশ শতাব্দীতে তারাই কি থাকবে বিশ্বের অধিপতি হয়ে?
না, মানুষের ইতিহাসের চাকা কখনো পিছেনের দিকে ঘুরে যায় না। সাময়িকভাবে ইতিহাসের চলার গতি কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত হয়, তখন মনে হয়, তার সম্মুুখযাত্রা বুঝি রুদ্ধই হয়ে গেল। প্রকৃত প্রস্তাবে, তখনো কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রগতির নতুন শক্তির বিকাশ ঘটতেই থাকে। এবারও তেমনটিই ঘটছে। এখনকার সত্যসন্ধানী চিন্তাবিদরা প্রগতির শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করছেন এবং প্রগতির যাত্রাপথে আলোর প্রক্ষেপণ ঘটাচ্ছেন। এ রকম চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রয়াত এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে শুরু করে নোয়াম চমস্কি, সামির আমিন, অমর্ত্য সেন, অরুন্ধতী রায়, জোসেফ স্টিগলিৎস এবং আরো অনেকেই আছেন। তাঁদের সবার মত ও পথ অভিন্ন নয়। তবু তাঁদের ভাবনাচিন্তা সব প্রগতিকামী মানুষকেই নানাভাবেই উদ্বুদ্ধ করছে এবং সবাই আপন আপন দেশ ও সমাজের বাস্তব অবস্থা ও অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছেন। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেও বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠতে দেখছি, সেসব দেশে এক শতাংশ শোষকের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশ শোষিতের সংগ্রামের রণধ্বনিও শুনছি। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম প্রায় সবই স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বতঃস্ফূর্ততার সব দুর্বলতাও এগুলোতে পরিস্ফুট অবশ্যই। তবে সেসব দুর্বলতা দূর করে সচেতন সংগঠিত প্রগতিশীল শক্তিও যে অচিরেই জেগে উঠবে- এমন আশা পোষণের মতো নানা উপাদানও আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে বৈকি।
বিপর্যস্ত সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরাও আজ সক্রিয় হয়ে উঠছে, বিভিন্ন সম্মেলনে মিলিত হয়ে তারা অতীতের ভুলত্রুটির পর্যালোচনা ও নতুন পথের সন্ধানে নিরত হচ্ছে। এ রকমই একটি সম্মেলন হয়ে গেল গত ২২ থেকে ২৫ নভেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। এটি ছিল বিশ্বের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর চতুর্দশ সম্মেলন। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ ৪৫টি দেশের ৬০টি পার্টির ৮৪ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের আলোচনার মূল বিষয় ছিল- 'সমাজতন্ত্রের জন্য ও মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সংগ্রাম গড়ে তোল।'
বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে যেসব অপকর্ম করে চলছে, সেসবের স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে ওই সম্মেলনে। অদূর ভবিষ্যতেও যে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে রাজনীতিকে কলুষিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, তাদের সহায়তায় যে অনেক সন্ত্রাসী ধর্মীয় মৌলবাদী ও ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ঘটতে থাকবে- সেসব বিষয়েও বিশ্ববাসীকে সজাগ থাকতে ওই সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছে এবং অনেক ব্যাপারেই কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে সম্মেলনে বলা হয়েছে-
'ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের অমানবিক আগ্রাসন রুখে দিতে হবে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি বীর জনতার সংগ্রামী আন্দোলনের সপক্ষে জোরদার অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং পশ্চিম তীর ও গাজায় অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করে ফিলিস্তিনি জনগণকে তার প্রাপ্য মর্যাদা বুঝিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে শামিল হতে হবে।'
আরো বলা হয়েছে-
'সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদার করতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণসংগঠনগুলোর হাত শক্তিশালী করতে হবে।'
এ রকম নানা দিক থেকে নানাভাবেই বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণচেতনার জাগরণ ঘটছে। বিশ্বের সচেতন জনগণই ওই সব অপশক্তির উৎখাত ঘটাবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। এ দেশেও সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটবেই। এ রকম জাগরণ ঘটলেই সব অপশক্তি 'পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে'।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ
ইসরায়েলিরা অত্যন্ত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি জনগোষ্ঠী। এরাই ইহুদি নামে পরিচিত। ইহুদি নির্যাতন ও বিতাড়নের মধ্য দিয়েই হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে নাৎসিবাদের অভ্যুদয়। নাৎসিদের হাতে ইহুদি নির্যাতন, বীভৎসতা ও অমানবিকতার সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুনিয়ার যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই লাঞ্ছিত-নির্যাতিত ইহুদি জাতির প্রতি সহানুভূতিপরায়ণ না হয়ে পারে না। এ সহানুভূতিকেই সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের বদ মতলব হাসিলের কাজে লাগায় জেরুজালেমে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের একটি শত্রুখুঁটি পুঁতে রাখা। শুধু তাই নয়, ওই ভূখণ্ডে আবহমান কাল ধরে খুঁটি পোঁতা ছিল যাদের, তাদের সমূলে উপড়ে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতাও পেয়ে গেল উড়ে এসে জুড়ে বসে যাওয়া এ রাষ্ট্র। বিতাড়িত ও নির্যাতিত হওয়ার দরুন যে ইহুদিরা বিশ্বমানুষের গভীর ও অকৃত্রিম সহানুভূতি আকর্ষণ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদ সেই ইহুদিদেরই বিতাড়ক ও নির্যাতকের ভূমিকায় নামিয়ে দিল। ইহুদি রাষ্ট্রটি তার জন্মলগ্ন থেকেই জন্মভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন-পর্ব শুরু করেছিল, ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে এর নির্যাতক ও ভীতিসঞ্চারক রূপটি।
আসলে নির্যাতন ও ভীতি সঞ্চারণের মূল হোতা সাম্রাজ্যবাদ, ইসরায়েল তার একান্ত বিশ্বস্ত দাস। প্রভু তার দাসটিকে নানাভাবেই শক্তির জোগান দিয়ে যাচ্ছে, এমনকি একটি বিরাট অঞ্চলকে ভীতিগ্রস্ত করে রাখার জন্য তার হাতে পারমাণবিক অস্ত্রও তুলে দিয়েছে। প্রভু ও দাস দুইয়ের হাতেই পারমাণবিকসহ নানা বিধ্বংসী অস্ত্র অবশ্যই থাকতে পারবে- এটি যেন তাদের জন্য বিধিদত্ত অধিকার। অন্য কেউ যাতে আত্মরক্ষার জন্যও কোনো অস্ত্র রাখতে না পারে, তার নিশ্চয়তা বিধানের অধিকারও বোধ হয় বিধাতা আমেরিকা ও ইসরায়েলের হাতে অর্পণ করেছেন! ইহুদিরা যে বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট জাতি, এমন প্রচার তো তারা স্মরণাতীতকাল থেকেই করে আসছে।
সে যাই হোক, বিধাতার ন্যায়বিধানের প্রতি অটুট আস্থা পোষণ করেন যাঁরা, তাঁরা নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ জাতির প্রতি বিধাতার বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করতে পারেন না। ইহুদিদের একসময়কার সুকৃতির জন্য বিধাতা যদি সন্তুষ্ট হয়েও থাকেন, আজ কিন্তু তাদের দুষ্কৃতিকে তিনি কিছুতেই ক্ষমা করছেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়-
একদিকটা উঁচু হয়েছিল বেশি,
ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,
সেইখান থেকে মারলেন টান,
বড়োটাকে দিলেন কাত করে।
বড়ত্বের অভিমানে প্রচণ্ড ঘা খেয়ে ইসরায়েল কাত হয়ে গেল গত ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক বৈঠকে ১৩৮টি সদস্য দেশের ভোটে। ফিলিস্তিন পেল জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ও ইসরায়েলি বর্বরতার পক্ষে যাদের অবস্থান, তাদের নাটের গুরু যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, তার প্রমাণ এবারের জাতিসংঘের ভোটাভুটিতেও পাওয়া গেল। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে আমেরিকা, ইসরায়েলসহ মাত্র ৯টি দেশ ফিলিস্তিনিদের দাবির বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এ ৯টি দেশের শাসকগোষ্ঠী কি দুনিয়ার লোকসাধারণের ধিক্কার ও ঘৃণার পাত্র হলো না? আর ব্রিটেন ও জার্মানির মতো যে ৪১টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থেকে প্রকারান্তরে ইসরায়েলি বর্বরতাকেই নীরব সমর্থন জানিয়েছে, তারাও কি ধিক্কার ও ঘৃণার পাত্র নয়?
তবে কারো ধিক্কার ও ঘৃণাতেই সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দোসররা যে কখনো বিচলিত হয় না, এবারও তার প্রমাণ রেখেছে তারা। জাতিসংঘে ফিলিস্তিন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার পরপরই পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের অধিকৃত এলাকায় তিন হাজার নতুন বাড়ি নির্মাণের ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। ফিলিস্তিন যদি আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার সদস্য হয়, তবে সেই সংস্থাকে এক পয়সাও দেবে না- আমেরিকা এমন সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে রেখেছে। গত বছর ফিলিস্তিন যখন ইউনেসকোর সদস্য পদ পেল, তখনই আমেরিকা ইউনেসকোকে আট কোটি ডলার সাহায্য বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ কোনোই সন্দেহ নেই : মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কোনো অবস্থায়ই ইসরায়েলকে সক্রিয় সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকবে না। যে ইহুদিরা বিংশ শতাব্দীর চলি্লশের মধ্যভাগ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের হাতে চরম নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছিল, সেই ইহুদিদের রাষ্ট্র ইসরায়েলেই আজ সাম্রাজ্যবাদের মদদে নয়া ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ ও বীরত্বই ফ্যাসিবাদের পতনের প্রধান শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজকে সোভিয়েত নেই, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাও বিপর্যস্ত। কে এখন আজকের সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করবে? জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে পরাজিত হয়েও আমেরিকা আর ইসরায়েল প্রতিনিয়তই ফিলিস্তিনিদের লাঞ্ছিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ করে যেতে থাকবে কি? একবিংশ শতাব্দীতে তারাই কি থাকবে বিশ্বের অধিপতি হয়ে?
না, মানুষের ইতিহাসের চাকা কখনো পিছেনের দিকে ঘুরে যায় না। সাময়িকভাবে ইতিহাসের চলার গতি কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত হয়, তখন মনে হয়, তার সম্মুুখযাত্রা বুঝি রুদ্ধই হয়ে গেল। প্রকৃত প্রস্তাবে, তখনো কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রগতির নতুন শক্তির বিকাশ ঘটতেই থাকে। এবারও তেমনটিই ঘটছে। এখনকার সত্যসন্ধানী চিন্তাবিদরা প্রগতির শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করছেন এবং প্রগতির যাত্রাপথে আলোর প্রক্ষেপণ ঘটাচ্ছেন। এ রকম চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রয়াত এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে শুরু করে নোয়াম চমস্কি, সামির আমিন, অমর্ত্য সেন, অরুন্ধতী রায়, জোসেফ স্টিগলিৎস এবং আরো অনেকেই আছেন। তাঁদের সবার মত ও পথ অভিন্ন নয়। তবু তাঁদের ভাবনাচিন্তা সব প্রগতিকামী মানুষকেই নানাভাবেই উদ্বুদ্ধ করছে এবং সবাই আপন আপন দেশ ও সমাজের বাস্তব অবস্থা ও অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছেন। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেও বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠতে দেখছি, সেসব দেশে এক শতাংশ শোষকের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশ শোষিতের সংগ্রামের রণধ্বনিও শুনছি। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম প্রায় সবই স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বতঃস্ফূর্ততার সব দুর্বলতাও এগুলোতে পরিস্ফুট অবশ্যই। তবে সেসব দুর্বলতা দূর করে সচেতন সংগঠিত প্রগতিশীল শক্তিও যে অচিরেই জেগে উঠবে- এমন আশা পোষণের মতো নানা উপাদানও আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে বৈকি।
বিপর্যস্ত সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরাও আজ সক্রিয় হয়ে উঠছে, বিভিন্ন সম্মেলনে মিলিত হয়ে তারা অতীতের ভুলত্রুটির পর্যালোচনা ও নতুন পথের সন্ধানে নিরত হচ্ছে। এ রকমই একটি সম্মেলন হয়ে গেল গত ২২ থেকে ২৫ নভেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। এটি ছিল বিশ্বের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর চতুর্দশ সম্মেলন। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ ৪৫টি দেশের ৬০টি পার্টির ৮৪ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের আলোচনার মূল বিষয় ছিল- 'সমাজতন্ত্রের জন্য ও মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সংগ্রাম গড়ে তোল।'
বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে যেসব অপকর্ম করে চলছে, সেসবের স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে ওই সম্মেলনে। অদূর ভবিষ্যতেও যে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে রাজনীতিকে কলুষিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, তাদের সহায়তায় যে অনেক সন্ত্রাসী ধর্মীয় মৌলবাদী ও ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ঘটতে থাকবে- সেসব বিষয়েও বিশ্ববাসীকে সজাগ থাকতে ওই সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছে এবং অনেক ব্যাপারেই কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে সম্মেলনে বলা হয়েছে-
'ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের অমানবিক আগ্রাসন রুখে দিতে হবে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি বীর জনতার সংগ্রামী আন্দোলনের সপক্ষে জোরদার অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং পশ্চিম তীর ও গাজায় অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করে ফিলিস্তিনি জনগণকে তার প্রাপ্য মর্যাদা বুঝিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে শামিল হতে হবে।'
আরো বলা হয়েছে-
'সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদার করতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণসংগঠনগুলোর হাত শক্তিশালী করতে হবে।'
এ রকম নানা দিক থেকে নানাভাবেই বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণচেতনার জাগরণ ঘটছে। বিশ্বের সচেতন জনগণই ওই সব অপশক্তির উৎখাত ঘটাবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। এ দেশেও সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটবেই। এ রকম জাগরণ ঘটলেই সব অপশক্তি 'পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে'।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ
No comments