খালপাড়ে ভাসমান বাজার-গ্রামঃ থাইল্যান্ড পারলে আমরাও পারি! by উজ্জ্বল ধর
পাতার তৈরি টুপি মাথায়, হাত-মুখ-চামড়ায় ভাঁজপড়া ষাটোর্ধ্ব বয়েসী এক নারী।
ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে আড়াই ফুট চওড়া ছোট নৌকা নিয়ে বৈঠা বেয়ে বেয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছেন খালের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত।
তার ছিমছাম নৌকায়
সাজানো রয়েছে- কলা, পেয়ারা, ড্রাগনসহ বাহারি ফল-ফুল। ক্রেতাদের ডেকে তিনি
তার পণ্য দেখাচ্ছেন। শুধু তার মতো বয়েসী নারীই নয়, বিভিন্ন নারী-পুরুষ
নৌকায় পণ্য নিয়ে তারই মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন খালের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত
পর্যন্ত।নৌকায় ভেসে ভেসে এভাবে পণ্য বিকিকিনির মনোরম এ দৃশ্যটি চোখে পড়বে থাইল্যান্ডের ড্যামনোয়েন সাদুয়াক ফ্লোটিং মার্কেটে, যাকে আমরা ‘ভাসমান হাট’ বলে জানি।
থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী পাতা-কাপড়ের তৈরি টুপি, শার্ট-গেঞ্জি, আম, আতা, কাঁঠাল, ঘর সাজানোর রকমারি পসরা নিয়ে অসংখ্য নৌকা ভিড় করছে এ ভাসমান হাটে। পিঠাসহ নানান রকমের থাই খাবারের সঙ্গে পর্যটকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এই সব বিক্রেতারা। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে মাঝে মাঝে নৌকাজটও লেগে যাচ্ছে। তাতে কী!
এরই মাঝে নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিদেশি পর্যটকরা। তাদের সঙ্গে আছেন স্থানীয় লোকজনও। পণ্য পছন্দ হলেই শুরু হয় দর কষাকষি। ইংরেজিতে কথা বলতে না পেরে হাত ক্যালকুলেটরে বাটন চেপে বিক্রেতা তাদের পণ্যের দাম জানাচ্ছেন। ক্রেতাও বাটন চেপে দেখিয়ে দাম হাঁকাচ্ছেন।
শুধু ফলমূল, ঘর সাজানোর আসবাবপত্রই নয়, নৌকা ভাসিয়ে বিক্রি হয় ভাতও। কিছু নৌকায় রোজ ভোর থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত চলে ভাতসহ নানান পসরা কেনাবেচার হুলস্থুল কর্মকাণ্ড।
এই বাজারই আশপাশের গ্রামবাসীর জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান উৎস। শুধু বয়স্করাই নয়, পরিবারের সব বয়েসী নারী-পুরুষ ব্যস্ত নিজেদের উৎপাদিত পণ্য কিংবা নিজেদের হাতে তৈরি পণ্য বাজারজাতকরণের কাজে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থাইল্যান্ডের চতুর্থ রাজা রামা ১৮৬৮ সালে রাচাবুড়ী প্রদেশের চাষাবাদের পানি সংকট নিরসনে ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১২ মিটার প্রস্থ ও ৩ মিটার গভীরতার ড্যামনোয়েন সাদুয়াক খালটি খনন করেন। সামুত সার্খন প্রদেশের থাসিন নদী ও সামুদ শংখারাম প্রদেশের ম্যাখলং নদীকে সংযুক্ত করেছে এই খাল।
ব্যাংকক থেকে ১শ ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ড্যামনোয়েন সাদুয়াক এলাকায় এই খালকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে ভাসমান বাজার আর আবাস কেন্দ্রও।
কৃষিনির্ভর গরিব মানুষের জীবিকা পুরোপুরি নির্ভরশীল এই খালের পানির ওপর। বর্তমানে খালের কিছু অংশ পচা কালো পানিতে সয়লাব। দেখতে অনেকটা আমাদের বুড়িগঙ্গা বা চট্টগ্রামের চাকতাই খালের পানির মতোই।
ঘুরে দেখা গেছে, দুইপাড় পাকা দেওয়াল দিয়ে গড়া। রয়েছে পায়ে হাঁটার পথ। দুইধারে অসংখ্য ছোট ছোট শাকসব্জি, নারকেল গাছ, বিভিন্ন ধরনের চাইনিজ কমলা জাতীয় ফল, ম্যালাককা আঙুর, আম, কলার বাগান। এরই মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে পানির ওপর ভাসমান থাই ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি বাড়ি।
বাড়ির সামনে শোভা বাড়াচ্ছে, ছোট ছোট টবে বাহারি ফুলের গাছ। প্রথম দেখাতেই মনে হবে যেন রং তুলিতে আঁকা ছবি।
প্রতিটি বাড়িতিই আছে নৌকা। বাড়ির সামনে একটি ছাউনির নিচে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নৌকাগুলোকে। কিছু বাড়ির কাঠের ছাদে আধুনিকতার ছোঁয়া, ছোট ডিস অ্যান্টেনা। খোলা দরজা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, বুদ্ধমুর্তি, টিভি, ফ্রিজ কাঠের তৈরি হাতিসহ রকমারি থাই ঐতিহ্যের সাজে সজ্জিত বাড়ি। দেখলে মন ভরে যায়।
ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা পর্যটকদের নিয়ে ছুটে চলেছে গ্রামের এ পাড়া থেকে ও পাড়া। একই সঙ্গে পর্যটকরা পরিচিত হচ্ছেন, এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে।
ড্যামনোয়েন সাদুয়াক ফ্লোটিং মার্কেট ছাড়াও থাইল্যান্ডে রয়েছে ৪টি ট্যালিং সান, থা খা, ডন ওয়াই, এমপাওয়া ফ্লোটিং মার্কেট। এই ভাসমান মার্কেটগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল পর্যটন কেন্দ্র ।
প্রতিদিন দেশি-বিদেশি সহস্রাধিক পর্যটক ভ্রমণ করছেন এইসব বাজার আর গ্রামগুলো। থাই সরকারও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিছু দূর পর পর তৈরি করেছে, খালের ওপর পায়েহাঁটা ব্রিজ। আর এর মাধ্যমে থাই সরকার প্রতিবছর আয় করছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
বড়ই দুঃখের যে, থাই যা পেরেছে, সেই সুযোগ আমাদেরও আছে। তারপরও তা আমরা করতে পারিনি। আমাদের দেশে হাওর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বড় বড় খালগুলোকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা যেত ভাসমান মার্কেট বা বাজার কিংবা হাট।
যদি এমন হতো, আমাদের দেশের খাল-বিল-হাওরকে এভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে নৌকায় করে ঘুরে বেরিয়ে শীতের সময় দেখা যেত হাজার অতিথি পাখি। ফেরি করে বিক্রি করা যেত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজ আর হস্তশিল্প সামগ্রী; তাহলে আকৃষ্ট করা যেত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যটক। আর এতে আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হতো। আর সেই সঙ্গে আয় হতো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের অভাবে আমরা আমাদের সবুজ-শ্যামল বাংলাকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারছি না। যদি পারতাম তবে আমরাও বাংলাদেশের ভাবভূর্তিকে বিশ্বে মানচিত্রে অন্যভাবে তুলে ধরতে পারতাম। পারতাম ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ’ নয়, ‘সৌন্দর্যের বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তুলতে!
তাহলে প্রতিবছর হাজার হাজার সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটক আসতো আমাদের দেশে। সে আশা থেকে আমরা এখনও বঞ্চিত হতে চাই না। ভবিষ্যতের জনকল্যাণমুখি নেতৃত্বের আশায় আমরা এখনও অপেক্ষা করে আছি!!
No comments