সড়কে ৬৮ কোটি টাকার দুর্নীতি ধামাচাপার চেষ্টা by পার্থ সারথি দাস
সড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের বিভিন্ন প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎসব চলছে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ, জেলা প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ নানা মহল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ জমছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে।
বিভিন্ন অভিযোগে মন্ত্রণালয় একের পর এক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও বেশির ভাগ কমিটির কার্যক্রমই ঝুলে থাকছে দিনের পর দিন। আবার জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত অভিযোগ আড়াল করে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বা ঠিকাদারদের বাঁচিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের ১১টি জেলায় ৫১টি সড়কের নির্মাণ ও সংস্কারকাজের অভিযোগ এবং তদন্ত প্রতিবেদন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এসব কাজে কমপক্ষে ৬৮ কোটি টাকার দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তদন্তে দুর্নীতি প্রশ্রয়ের আশঙ্কায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন এ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খাগড়াছড়িতে তিন সড়ক উন্নয়নে ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি : খাগড়াছড়ি জেলায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তিনটি কাজে ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরই প্রশ্ন রয়েছে। জানা গেছে, খাগড়াছড়ি সওজ অধিদপ্তরের ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে আহ্বান করা একাধিক দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সড়ক মেরামত ও উন্নয়নকাজে গুরুতর অনিয়মের বিষয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকের একটি চিঠি আসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। গত ২২ মার্চ পাঠানো ওই চিঠিতে এ বিষয়ে তদন্তের তাগিদ দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসনের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগে তিনটি সড়কের সংস্কারকাজে প্রায় ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সড়ক তিনটি হচ্ছে, দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি, খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার ও ফটিকছড়ি-দীঘিনালা। দীঘিনালা-পানছড়ি সড়কের উন্নয়নকাজে ফ্লেঙ্বিল কার্পেটিং, এইচবিবিকরণ, আরসিসি, প্যালাসাইডিং, ব্রিক রিটেইনিং ওয়াল, নালা তৈরি, মাটিকাটা ও ভরাটকাজে প্রায় ১১ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়নকাজে দুর্নীতি হয় প্রায় ছয় কোটি টাকা। একই সঙ্গে নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-দীঘিনালা সড়কের উন্নয়নকাজে ১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ তদন্তে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব চন্দন কুমার দে-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ পাওয়ার মাস থেকে গত জুন পর্যন্ত তিনি তদন্ত করেন এবং এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ১১ জুলাই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। প্রতিবেদনে তিনি দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কের উন্নয়নকাজে নির্ধারিত পুরুত্বের চেয়ে কম পুরুত্ব, সড়কের বেইস ও সাব-বেইসে মান অনুযায়ী নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। প্যালাসাইডিং, ব্রিক রিটেইনিং ওয়াল ও নালা নির্মাণেও কিছু ত্রুটি দেখতে পান তিনি। প্রতিবেদনে উপসচিব উল্লেখ করেন, ওই সড়কের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য দুটি টেস্ট পিট খননের মাধ্যমে কার্য-পরবর্তী মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এতে বর্ধিত দুই কিলোমিটার সড়কাংশের মধ্যে ৪০ মিলিমিটার পুরুত্বের কার্পেটিংয়ের মধ্যে বাস্তবে ৩০ মিলিমিটার পুরুত্ব রয়েছে। খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজে অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদনে চন্দন কুমার দে উল্লেখ করেন, এই সড়কেও টেস্ট পিট খনন করা হয়েছে। তবে এই সড়কে পুরুত্বের মিল পাওয়া গেছে। ব্যবহৃত উপকরণের মান মোটামুটি। এ প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র ৪০ ভাগ।
নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সড়কের বিভিন্ন স্তরে সঠিক পরিমাণে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র শতকরা তিন ভাগ। প্রতিবেদনটি নানা কারণে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় গত ২২ জুলাই মন্ত্রণালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ শাখা থেকে তদন্ত কর্মকর্তা চন্দন কুমার দে-কে এই দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের নাম ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে জানানোর জন্য চিঠি দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেদনে ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে কাজ শুরু হলেও চলতি বছরে কাজগুলো কেন শতভাগ শেষ হয়নি এর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া দায়ী ব্যক্তিদের জন্য কী শাস্তি দেওয়া যায় এর সুপারিশও করা হয়নি। এ বিষয়ে এখনো কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। তদন্ত ঝুলে আছে। এ বিষয়ে চন্দন কুমার দের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছি। সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। তিনি এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি।
ময়মনসিংহে ১২ কোটি টাকার দুর্নীতি : নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সংস্কারকাজ করার কয়েক মাসেই গর্ত আর ফাটল দেখা দেয় ময়মনসিংহ-মুক্তাগাছা ও ময়মনসিংহ শহরের থানাঘাট-জুবলিঘাট সড়কে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ পেয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি সরেজমিনে গেলেও প্রথমবার দেওয়া প্রতিবেদনে দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগের সত্যতা ধরা পড়ে একই তদন্ত কমিটির দ্বিতীয় প্রতিবেদনে। ততদিনে প্রকল্পের বিল তুলে নিয়ে যায় ঠিকাদার। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলে নির্বাহী প্রকৌশলীর পাঠানো জবাব গত ১৭ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে আসে। নির্বাহী প্রকৌশলী ঠিকাদারকে দিয়ে রাস্তা দুটি ভালোভাবে কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেবেন বলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর ময়মনসিংহের এই দুটি রাস্তার সংস্কারকাজ শুরু হয়। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে শতভাগ কাজ হয়েছে দেখিয়ে গত ২০ জুন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঠিকাদার সওজের কাছ থেকে ১২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকার বিল তুলে নেয়। কাজ শুরুর পর তিন মাসের মধ্যেই নিম্নমানের কাজ করা হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে। এরপর মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে বদরুল মজিদকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ২৫ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু তদন্ত দায়সারা গোছের হয়েছে মন্তব্য করে মন্ত্রণালয় আবারও বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটিকে নির্দেশ দেয় গত ৮ মে। এরপর কমিটি দুর্নীতির অভিযোগ খুঁজে পায়। অভিযোগ অনুযায়ী কমিটিও তদন্তে দেখতে পায়, সঠিকভাবে পরিষ্কার না করে পিচ ঢালাই করা হয়েছে, রাস্তার মূল প্রস্থ থেকে কৌশলে কম প্রস্থের কাজ করা হয়েছে। যে পরিমাণ পুরুত্ব থাকার কথা তা করা হয়নি এবং কাজ চলাকালে সওজের কোনো কর্মকর্তা তা তত্ত্বাবধান করেননি। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুবলিঘাট এলাকায় সড়কের এক পাশে কমপক্ষে ২০০ ফুট ও উভয় পাশে ২০ ফুট অংশ খারাপ অবস্থায় থাকতে দেখেছে কমিটি। রাস্তার বিরাট অংশজুড়ে তৈরি হয় গর্ত ও ফাটল। থানাঘাট-জুবলিঘাট সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কমিটি প্রতিবেদনে মন্তব্য করে। তবে কমিটির প্রধান এ কে বদরুল মজিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্ষা থাকায় সরেজমিন তদন্তে যেতে একটু দেরি হয়েছিল। আমি দুবার সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। সত্য ঘটনা অনুসন্ধানের জন্যই একটু সময় লেগেছে। এখানে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়নি। জানা গেছে, পুরনো সামগ্রী ব্যবহার করে এখানে সিংহভাগ অর্থই লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে।
ছয় জেলার ৪০ সড়কে কাজ না করেই ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ : সওজের খুলনা জোনের ছয় জেলার ৪০টি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগকে ঘিরে তদন্তের নামে প্রায় এক বছর সময় পার হয়েছে। মূল অপরাধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। গত বছরের ২৪ ও ২৫ নভেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী (তৎকালীন যুগ্ম সচিব, উন্নয়ন) সওজের প্রকৌশলীদের নিয়ে 'ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর জরুরি পুনর্বাসন প্রকল্প এবং মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ' কাজ পরিদর্শন করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, প্রধান প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের উপস্থিতিতে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ কাজ না হওয়ার, এমনকি কর্মসূচি প্রণয়ন পর্যন্ত না হওয়া সত্ত্বেও উল্লিখিত ব্যয়ের বিষয়টি অস্পষ্ট এবং তদন্তযোগ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা জোন ও যশোর সার্কেলের আওতায় রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কাজ না করে বিল পরিশোধের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এ ঘটনা তদন্তে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এ কে এম বদরুল মজিদকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ২ ও ৩ মার্চ কমিটির সদস্যরা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, নড়াইলের ৪০টি সড়ক পরিদর্শন করেন। মন্ত্রণালয় পরে প্রশ্ন তোলে, দুই দিনে ৪০টি সড়ক পরিদর্শন করা সম্ভব হলো কিভাবে? কমিটি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ না পাওয়ার কথা বললেও এখন সেই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
তিন জেলায় ছয় সড়কের কাজে ১৫ কোটি টাকা লুটপাট : কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার ছয়টি সড়ক নির্মাণে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে গত ১৮ অক্টোবর আসা এই অভিযোগের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা এখনো সরেজমিন তদন্তে যাননি। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অভিযোগের তদন্তভার আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমি সওজের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যে সরেজমিনে যাব। অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ছয়টি সড়কে সওজের সঙ্গে ঠিকাদারদের চুক্তি অনুযায়ী ৮০ মিলিমিটার পুরুত্বে কার্পেটিংয়ের কাজ করার কথা ছিল। কাজ হয়েছে ২০ মিলিমিটার। সিলকোট করার কথা ছিল ১২ মিলিমিটার, করা হয়েছে মাত্র ছয় মিলিমিটার। মাটির কাজ করা হয়েছে নামকাওয়াস্তে। এই ছয়টি সড়কের মধ্যে রয়েছে- কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হোমনা-বাঞ্ছারামপুর-বি. বাড়িয়া সড়ক, কুমিল্লার মুরাদনগর-হোমনা সড়ক, পালপাড়া-বুড়িচং-মিরপুর সড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ও ভোলাচং-শ্যামগ্রাম-জীবনগঞ্জ বাজার সড়ক এবং চাঁদপুরের বাবুরহাট-মতলব-পেন্নাই সড়ক।
খাগড়াছড়িতে তিন সড়ক উন্নয়নে ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি : খাগড়াছড়ি জেলায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তিনটি কাজে ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরই প্রশ্ন রয়েছে। জানা গেছে, খাগড়াছড়ি সওজ অধিদপ্তরের ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে আহ্বান করা একাধিক দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সড়ক মেরামত ও উন্নয়নকাজে গুরুতর অনিয়মের বিষয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকের একটি চিঠি আসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। গত ২২ মার্চ পাঠানো ওই চিঠিতে এ বিষয়ে তদন্তের তাগিদ দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসনের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগে তিনটি সড়কের সংস্কারকাজে প্রায় ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সড়ক তিনটি হচ্ছে, দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি, খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার ও ফটিকছড়ি-দীঘিনালা। দীঘিনালা-পানছড়ি সড়কের উন্নয়নকাজে ফ্লেঙ্বিল কার্পেটিং, এইচবিবিকরণ, আরসিসি, প্যালাসাইডিং, ব্রিক রিটেইনিং ওয়াল, নালা তৈরি, মাটিকাটা ও ভরাটকাজে প্রায় ১১ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়নকাজে দুর্নীতি হয় প্রায় ছয় কোটি টাকা। একই সঙ্গে নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-দীঘিনালা সড়কের উন্নয়নকাজে ১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ তদন্তে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব চন্দন কুমার দে-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ পাওয়ার মাস থেকে গত জুন পর্যন্ত তিনি তদন্ত করেন এবং এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ১১ জুলাই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। প্রতিবেদনে তিনি দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কের উন্নয়নকাজে নির্ধারিত পুরুত্বের চেয়ে কম পুরুত্ব, সড়কের বেইস ও সাব-বেইসে মান অনুযায়ী নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। প্যালাসাইডিং, ব্রিক রিটেইনিং ওয়াল ও নালা নির্মাণেও কিছু ত্রুটি দেখতে পান তিনি। প্রতিবেদনে উপসচিব উল্লেখ করেন, ওই সড়কের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য দুটি টেস্ট পিট খননের মাধ্যমে কার্য-পরবর্তী মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এতে বর্ধিত দুই কিলোমিটার সড়কাংশের মধ্যে ৪০ মিলিমিটার পুরুত্বের কার্পেটিংয়ের মধ্যে বাস্তবে ৩০ মিলিমিটার পুরুত্ব রয়েছে। খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজে অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদনে চন্দন কুমার দে উল্লেখ করেন, এই সড়কেও টেস্ট পিট খনন করা হয়েছে। তবে এই সড়কে পুরুত্বের মিল পাওয়া গেছে। ব্যবহৃত উপকরণের মান মোটামুটি। এ প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র ৪০ ভাগ।
নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সড়কের বিভিন্ন স্তরে সঠিক পরিমাণে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র শতকরা তিন ভাগ। প্রতিবেদনটি নানা কারণে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় গত ২২ জুলাই মন্ত্রণালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ শাখা থেকে তদন্ত কর্মকর্তা চন্দন কুমার দে-কে এই দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের নাম ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে জানানোর জন্য চিঠি দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেদনে ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে কাজ শুরু হলেও চলতি বছরে কাজগুলো কেন শতভাগ শেষ হয়নি এর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া দায়ী ব্যক্তিদের জন্য কী শাস্তি দেওয়া যায় এর সুপারিশও করা হয়নি। এ বিষয়ে এখনো কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। তদন্ত ঝুলে আছে। এ বিষয়ে চন্দন কুমার দের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছি। সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। তিনি এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি।
ময়মনসিংহে ১২ কোটি টাকার দুর্নীতি : নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সংস্কারকাজ করার কয়েক মাসেই গর্ত আর ফাটল দেখা দেয় ময়মনসিংহ-মুক্তাগাছা ও ময়মনসিংহ শহরের থানাঘাট-জুবলিঘাট সড়কে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ পেয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি সরেজমিনে গেলেও প্রথমবার দেওয়া প্রতিবেদনে দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগের সত্যতা ধরা পড়ে একই তদন্ত কমিটির দ্বিতীয় প্রতিবেদনে। ততদিনে প্রকল্পের বিল তুলে নিয়ে যায় ঠিকাদার। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলে নির্বাহী প্রকৌশলীর পাঠানো জবাব গত ১৭ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে আসে। নির্বাহী প্রকৌশলী ঠিকাদারকে দিয়ে রাস্তা দুটি ভালোভাবে কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেবেন বলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর ময়মনসিংহের এই দুটি রাস্তার সংস্কারকাজ শুরু হয়। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে শতভাগ কাজ হয়েছে দেখিয়ে গত ২০ জুন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঠিকাদার সওজের কাছ থেকে ১২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকার বিল তুলে নেয়। কাজ শুরুর পর তিন মাসের মধ্যেই নিম্নমানের কাজ করা হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে। এরপর মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে বদরুল মজিদকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ২৫ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু তদন্ত দায়সারা গোছের হয়েছে মন্তব্য করে মন্ত্রণালয় আবারও বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটিকে নির্দেশ দেয় গত ৮ মে। এরপর কমিটি দুর্নীতির অভিযোগ খুঁজে পায়। অভিযোগ অনুযায়ী কমিটিও তদন্তে দেখতে পায়, সঠিকভাবে পরিষ্কার না করে পিচ ঢালাই করা হয়েছে, রাস্তার মূল প্রস্থ থেকে কৌশলে কম প্রস্থের কাজ করা হয়েছে। যে পরিমাণ পুরুত্ব থাকার কথা তা করা হয়নি এবং কাজ চলাকালে সওজের কোনো কর্মকর্তা তা তত্ত্বাবধান করেননি। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুবলিঘাট এলাকায় সড়কের এক পাশে কমপক্ষে ২০০ ফুট ও উভয় পাশে ২০ ফুট অংশ খারাপ অবস্থায় থাকতে দেখেছে কমিটি। রাস্তার বিরাট অংশজুড়ে তৈরি হয় গর্ত ও ফাটল। থানাঘাট-জুবলিঘাট সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কমিটি প্রতিবেদনে মন্তব্য করে। তবে কমিটির প্রধান এ কে বদরুল মজিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্ষা থাকায় সরেজমিন তদন্তে যেতে একটু দেরি হয়েছিল। আমি দুবার সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। সত্য ঘটনা অনুসন্ধানের জন্যই একটু সময় লেগেছে। এখানে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়নি। জানা গেছে, পুরনো সামগ্রী ব্যবহার করে এখানে সিংহভাগ অর্থই লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে।
ছয় জেলার ৪০ সড়কে কাজ না করেই ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ : সওজের খুলনা জোনের ছয় জেলার ৪০টি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগকে ঘিরে তদন্তের নামে প্রায় এক বছর সময় পার হয়েছে। মূল অপরাধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। গত বছরের ২৪ ও ২৫ নভেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী (তৎকালীন যুগ্ম সচিব, উন্নয়ন) সওজের প্রকৌশলীদের নিয়ে 'ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর জরুরি পুনর্বাসন প্রকল্প এবং মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ' কাজ পরিদর্শন করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, প্রধান প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের উপস্থিতিতে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ কাজ না হওয়ার, এমনকি কর্মসূচি প্রণয়ন পর্যন্ত না হওয়া সত্ত্বেও উল্লিখিত ব্যয়ের বিষয়টি অস্পষ্ট এবং তদন্তযোগ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা জোন ও যশোর সার্কেলের আওতায় রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কাজ না করে বিল পরিশোধের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এ ঘটনা তদন্তে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এ কে এম বদরুল মজিদকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ২ ও ৩ মার্চ কমিটির সদস্যরা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, নড়াইলের ৪০টি সড়ক পরিদর্শন করেন। মন্ত্রণালয় পরে প্রশ্ন তোলে, দুই দিনে ৪০টি সড়ক পরিদর্শন করা সম্ভব হলো কিভাবে? কমিটি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ না পাওয়ার কথা বললেও এখন সেই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
তিন জেলায় ছয় সড়কের কাজে ১৫ কোটি টাকা লুটপাট : কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার ছয়টি সড়ক নির্মাণে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে গত ১৮ অক্টোবর আসা এই অভিযোগের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা এখনো সরেজমিন তদন্তে যাননি। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অভিযোগের তদন্তভার আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমি সওজের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যে সরেজমিনে যাব। অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ছয়টি সড়কে সওজের সঙ্গে ঠিকাদারদের চুক্তি অনুযায়ী ৮০ মিলিমিটার পুরুত্বে কার্পেটিংয়ের কাজ করার কথা ছিল। কাজ হয়েছে ২০ মিলিমিটার। সিলকোট করার কথা ছিল ১২ মিলিমিটার, করা হয়েছে মাত্র ছয় মিলিমিটার। মাটির কাজ করা হয়েছে নামকাওয়াস্তে। এই ছয়টি সড়কের মধ্যে রয়েছে- কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হোমনা-বাঞ্ছারামপুর-বি. বাড়িয়া সড়ক, কুমিল্লার মুরাদনগর-হোমনা সড়ক, পালপাড়া-বুড়িচং-মিরপুর সড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ও ভোলাচং-শ্যামগ্রাম-জীবনগঞ্জ বাজার সড়ক এবং চাঁদপুরের বাবুরহাট-মতলব-পেন্নাই সড়ক।
No comments