রাজনীতি- বিজয়ের মাস হয়েই বারবার ফিরে আসুক ডিসেম্বর by আবদুল মান্নান
২০১২ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এখন শেষ পক্ষে। এবারের বিজয়ের মাসটি নানা কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী প্রথমবারের মতো বিজয়ের এ মাসে উল্লাস-নৃত্য করেছে।
তার কারণ, পেছনে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি আন্দোলনের নামে পরিচালিত তাদের সব কর্মকাণ্ডে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে এবং সেই সমর্থনে বলীয়ান হয়ে জামায়াতের ক্যাডার ছাত্রশিবির দেশব্যাপী তাদের হিংস্রতার কিছু নমুনা ইতিমধ্যে দেখিয়েছে। তারা প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রকাশ্যে হামলা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর এ আক্রমণকে তাদের মিত্র বিএনপি সমর্থন দিয়েছে এই বলে যে, জামায়াত-শিবির শুধু ওই পুলিশদের ওপরই আক্রমণ করছে, যারা রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করলে তাদের ওপর আক্রমণ করে। বিজয়ের এ মাসে জামায়াত-শিবির এককভাবে হরতাল আহ্বান করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে এবং সাহস দেখিয়েছে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের যেসব শীর্ষস্থানীয় নেতার বিচার চলছে, তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করার এবং ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেওয়ার। জামায়াত জানে, আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে তাদের সমর্থন ছাড়া সমর্থনদাতাদের একক শক্তিতে আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সহজ হবে না।
এবারের বিজয় দিবস দ্বিতীয় যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ তা হচ্ছে, এবারের মতো অতীতে কখনো লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেনি। ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, তেমনটি ঘোষণা করেছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে তাদের আবার জনগণের সামনে যেতে হলে তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই অঙ্গীকারটি পূরণ করতে হবে। তা পূরণ করতে হলে তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক প্রতিকূল অবস্থা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ছিল। সেই সেতু নিয়ে একধরনের কানামাছি খেলা চলছে প্রায় এক বছর ধরে। সেই কানামাছি খেলা কখন শেষ হবে, তা আন্দাজ করা মুশকিল। এই সেতুকে কেন্দ্র করে বর্তমানে অনেকগুলো স্বার্থান্বেষী মহল ক্রিয়াশীল আছে। সরকার অবশ্যই চায়, তাদের বর্তমান মেয়াদেই এই সেতুর কাজ শুরু হোক। কিন্তু যারা চায় না তাদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। সেতু না হলে সামনের নির্বাচনে তা আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করে তারা তাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এতে তাদের ষোলো আনা লাভ। আওয়ামী লীগ যে সামনের বার আর ক্ষমতায় আসছে না, সে সম্পর্কে বেশ কজন স্বনামধন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক রায় দিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ভুলেও বর্তমান সরকারের কোনো অর্জনকে স্বীকার করতে নারাজ। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত ও চীন সফরকে তাঁরা মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এটি তাঁর প্রথম কদম। এরই মধ্যে আবার ঢাকা শহরের অলিগলিতে পোস্টার লাগিয়ে দলটির নেতা-কর্মীরা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন ‘বাংলাদেশের ভব্যিষৎ প্রধানমন্ত্রী তারেক জিয়া আসছে বাংলাদেশ কাঁপছে’ বলে। তাঁদের এসব প্রত্যাশাকে কিছুটা শক্তিশালী করেছে সরকারি দলের নিম্নপর্যায়ের কিছু অর্বাচীনের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড, যার সর্বশেষ উদাহরণ পুরান ঢাকায় বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড। সরকারি দলের যে অঙ্গসংগঠনটি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত; দল ক্ষমতায় না থাকলে তাদের হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
২০১২ সালে বিজয়ের মাসের যে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই তা হচ্ছে পাকিস্তানের তিনজন প্রখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য ও তাঁদের মন্তব্য প্রতিবেদনের কথা বলে। প্রথমজন বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার। এবার বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় দফায় যে ৬০ জন বিদেশি মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুকে সম্মান জানাল, তাঁর মধ্যে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার একজন। ৬০ ব্যক্তি ছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানকেও এবার সম্মান জানানো হয়েছে। যাঁরা বর্তমান সরকার আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অহর্নিশ সমালোচনায় মুখর থাকেন, তাঁরা কখনো ভুলেও বলেন না এই বন্ধুদের সম্মান জানানোর জন্য বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা যে তেমন একটা অকৃতজ্ঞ নই, তা তো অন্তত প্রমাণ করতে পেরেছি।
১৯৭১ সালে বিচারপতি আসিফ শাহকার পাঞ্জাব ছাত্র সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত ১৬ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার- এবং ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে একাত্তরে পরিচালিত গণহত্যার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরে তাঁরা লাহোরে প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই সাক্ষাৎকার থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, তাঁরা সভা-সমাবেশ করেছেন, লিফলেট বিলি করেছেন, কবিতা লিখেছেন। তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁদের সবাইকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে জেলে পুরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল। তাঁর পরিবারও তাঁকে দেশদ্রোহী মনে করত এবং তারা কখনো তাঁকে কারাগারে দেখতে আসেনি। পরে অবশ্য তাদের ভুল ভেঙেছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সুইডেনে চলে যান। বর্তমানে সেই দেশে তিনি একজন বিচারপতি।
তিনি বলেছেন, আসলে পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে, তা জানত না। নতুন প্রজন্মের কাছে সবকিছু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে তারা পাকিস্তান সরকারকে একাত্তরে এরা এ দেশে যা করেছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য করবে। বিচারপতি শাহকারের এটাই বাংলাদেশে প্রথম সফর। তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে প্রথমে কপাল মাটিতে ছুঁয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছেন। এই সেই দেশ, যার জন্য তিনি তাঁর নিজ জন্মস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি এখন থেকে প্রতিবছর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ আসতে চান। এখানে একটা বাড়ি করতে চান। সরকারকে অনুরোধ করেছেন তাঁকে যেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তাঁর এ দাবিগুলো সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে।
তাহির মেহেদি একজন পাকিস্তানি গবেষক। তিনি সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ডন চার কিস্তিতে পাকিস্তানের গণতন্ত্র হত্যার ওপর তাঁর একটি ধারাবাহিক রচনা প্রকাশ শুরু করেছে। যার শিরোনাম ‘The cৎow is white, Bengal is Pakistan’ (কাক হচ্ছে সাদা আর বাংলা হচ্ছে পাকিস্তান)। প্রথম কিস্তিটি প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আর দ্বিতীয়টি ১৮ তারিখ। আরও দুই কিস্তি প্রকাশের অপেক্ষায়। তাহির মেহেদি তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন এই বলে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশিদের চোখের দিকে তাকাতে এখনো রাজি নয়। তারা এখনো পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাবকে একটি ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে দেখে, তবে এই ষড়যন্ত্রের জন্য কারা দায়ী, তারা তার গভীরে যেতে চায় না। মেহেদি তাঁর প্রতিবেদন শুরু করেছেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে। তিনি দেখিয়েছেন, কিছু পাঞ্জাবি আর ভারত থেকে হিজরত করে আসা লিয়াকত আলী খানের মতো নেতারা কীভাবে একেবারে শুরু থেকেই বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে কেমন করে কিছু বাঙালি রাজনৈতিক নেতা প্রতিবাদী হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে দেখিয়েছেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো কীভাবে ষড়যন্ত্র করে বাঙালিদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। মেহেদি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, জামায়াত সেই ‘নির্বাচনে’ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৫টি আসনে ‘জয়ী’ হয়েছিল। তাহির মেহেদির মতে, এটি ছিল জামায়াতের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন কিন্তু বিজয় মিছিল বের করার আগেই মিত্রবাহিনী ঢাকা দখল করে নিয়েছিল আর জামায়াতের নেতারা কেউ কেউ তাঁদের সাধের পাকিস্তান বা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। মেহেদির বাকি দুই কিস্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সর্বশেষ লেখাটি লিখেছেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খান। বর্তমানে তিনি অনেকটা গৃহবন্দী। তাঁর লেখাটিও প্রকাশিত হয়েছে পাকিস্তানের আরেকটি আন্তর্জাতিক মানের দৈনিক দি নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এ । তিনি পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৭১ সালের চেয়েও ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন। একাত্তরে তিনি বেলজিয়ামে গবেষণারত ছিলেন। সেখানে তিনি যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যা ও ধ্বংসের খবর পড়তেন বা দেখতেন, তিনি শুধু লজ্জিতই হতেন না, নিজেকে প্রশ্ন করতেন—একজন মুসলমান আর একজন মুসলমানের ওপর বা একটি দেশের সেনাবাহিনী কীভাবে তার নিজ দেশের মানুষের ওপর এত নৃশংস হতে পারে? তিনি আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে এসব নৃশংসতার দৃশ্য তাঁর দেশের মানুষ কখনো দেখতে পারবে না। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন, কীভাবে অতীতে মুসলমানরা মুসলমানদের ষড়যন্ত্র, হত্যা, যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে ধ্বংস করেছে। তিনি এও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, পাকিস্তানে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশটির ভাঙন কেউ রুখতে পারবে না।
নানা কারণে এবারের বিজয়ের মাসটি স্বাধীনতাবিরোধীদের উল্লাস-নৃত্যের মধ্যে শুরু হলেও প্রথমে কিছুটা আশা জাগিয়েছে, এবারের বিজয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রজন্মের লাখো মানুষের অংশগ্রহণ দেখে। আশা জাগিয়েছে একাত্তর সম্পর্কে পাকিস্তানের শিক্ষিত মহলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসছে দেখে। এই আশাকে জাগ্রত রাখতে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। ঠিক করতে হবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তারা কতটুকু যেতে দিতে চায়। বর্তমানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল দেশে ও দেশের বাইরে দুই হাতে ডলার ওড়াচ্ছে। তা ধরার জন্য অনেকে নিজেরাও উড়ছেন। সরকার যদি জনগণকে সঙ্গে রাখতে পারে, শত ষড়যন্ত্র আর ডলার উড়িয়েও একাত্তরের ঘাতকদের বিচার বন্ধ করা যাবে না।
কোনো কোনো পাঠক আমাকে ই-মেইল করে বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষকের কাজ হচ্ছে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা, তাঁরা কেন রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন? তাঁদের বলি, দেশের অস্তিত্ব যখন হুমকির সম্মুখীন, তখন কারও চুপ করে থাকা উচিত নয়। আমরা আরেকটি একাত্তর বা একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর দেখতে চাই না। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এবারের বিজয় দিবস দ্বিতীয় যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ তা হচ্ছে, এবারের মতো অতীতে কখনো লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেনি। ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, তেমনটি ঘোষণা করেছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে তাদের আবার জনগণের সামনে যেতে হলে তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই অঙ্গীকারটি পূরণ করতে হবে। তা পূরণ করতে হলে তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক প্রতিকূল অবস্থা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ছিল। সেই সেতু নিয়ে একধরনের কানামাছি খেলা চলছে প্রায় এক বছর ধরে। সেই কানামাছি খেলা কখন শেষ হবে, তা আন্দাজ করা মুশকিল। এই সেতুকে কেন্দ্র করে বর্তমানে অনেকগুলো স্বার্থান্বেষী মহল ক্রিয়াশীল আছে। সরকার অবশ্যই চায়, তাদের বর্তমান মেয়াদেই এই সেতুর কাজ শুরু হোক। কিন্তু যারা চায় না তাদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। সেতু না হলে সামনের নির্বাচনে তা আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করে তারা তাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এতে তাদের ষোলো আনা লাভ। আওয়ামী লীগ যে সামনের বার আর ক্ষমতায় আসছে না, সে সম্পর্কে বেশ কজন স্বনামধন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক রায় দিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ভুলেও বর্তমান সরকারের কোনো অর্জনকে স্বীকার করতে নারাজ। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত ও চীন সফরকে তাঁরা মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এটি তাঁর প্রথম কদম। এরই মধ্যে আবার ঢাকা শহরের অলিগলিতে পোস্টার লাগিয়ে দলটির নেতা-কর্মীরা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন ‘বাংলাদেশের ভব্যিষৎ প্রধানমন্ত্রী তারেক জিয়া আসছে বাংলাদেশ কাঁপছে’ বলে। তাঁদের এসব প্রত্যাশাকে কিছুটা শক্তিশালী করেছে সরকারি দলের নিম্নপর্যায়ের কিছু অর্বাচীনের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড, যার সর্বশেষ উদাহরণ পুরান ঢাকায় বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড। সরকারি দলের যে অঙ্গসংগঠনটি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত; দল ক্ষমতায় না থাকলে তাদের হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
২০১২ সালে বিজয়ের মাসের যে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই তা হচ্ছে পাকিস্তানের তিনজন প্রখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য ও তাঁদের মন্তব্য প্রতিবেদনের কথা বলে। প্রথমজন বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার। এবার বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় দফায় যে ৬০ জন বিদেশি মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুকে সম্মান জানাল, তাঁর মধ্যে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার একজন। ৬০ ব্যক্তি ছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানকেও এবার সম্মান জানানো হয়েছে। যাঁরা বর্তমান সরকার আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অহর্নিশ সমালোচনায় মুখর থাকেন, তাঁরা কখনো ভুলেও বলেন না এই বন্ধুদের সম্মান জানানোর জন্য বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা যে তেমন একটা অকৃতজ্ঞ নই, তা তো অন্তত প্রমাণ করতে পেরেছি।
১৯৭১ সালে বিচারপতি আসিফ শাহকার পাঞ্জাব ছাত্র সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত ১৬ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার- এবং ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে একাত্তরে পরিচালিত গণহত্যার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরে তাঁরা লাহোরে প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই সাক্ষাৎকার থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, তাঁরা সভা-সমাবেশ করেছেন, লিফলেট বিলি করেছেন, কবিতা লিখেছেন। তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁদের সবাইকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে জেলে পুরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল। তাঁর পরিবারও তাঁকে দেশদ্রোহী মনে করত এবং তারা কখনো তাঁকে কারাগারে দেখতে আসেনি। পরে অবশ্য তাদের ভুল ভেঙেছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সুইডেনে চলে যান। বর্তমানে সেই দেশে তিনি একজন বিচারপতি।
তিনি বলেছেন, আসলে পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে, তা জানত না। নতুন প্রজন্মের কাছে সবকিছু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে তারা পাকিস্তান সরকারকে একাত্তরে এরা এ দেশে যা করেছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য করবে। বিচারপতি শাহকারের এটাই বাংলাদেশে প্রথম সফর। তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে প্রথমে কপাল মাটিতে ছুঁয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছেন। এই সেই দেশ, যার জন্য তিনি তাঁর নিজ জন্মস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি এখন থেকে প্রতিবছর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ আসতে চান। এখানে একটা বাড়ি করতে চান। সরকারকে অনুরোধ করেছেন তাঁকে যেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তাঁর এ দাবিগুলো সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে।
তাহির মেহেদি একজন পাকিস্তানি গবেষক। তিনি সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ডন চার কিস্তিতে পাকিস্তানের গণতন্ত্র হত্যার ওপর তাঁর একটি ধারাবাহিক রচনা প্রকাশ শুরু করেছে। যার শিরোনাম ‘The cৎow is white, Bengal is Pakistan’ (কাক হচ্ছে সাদা আর বাংলা হচ্ছে পাকিস্তান)। প্রথম কিস্তিটি প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আর দ্বিতীয়টি ১৮ তারিখ। আরও দুই কিস্তি প্রকাশের অপেক্ষায়। তাহির মেহেদি তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন এই বলে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশিদের চোখের দিকে তাকাতে এখনো রাজি নয়। তারা এখনো পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাবকে একটি ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে দেখে, তবে এই ষড়যন্ত্রের জন্য কারা দায়ী, তারা তার গভীরে যেতে চায় না। মেহেদি তাঁর প্রতিবেদন শুরু করেছেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে। তিনি দেখিয়েছেন, কিছু পাঞ্জাবি আর ভারত থেকে হিজরত করে আসা লিয়াকত আলী খানের মতো নেতারা কীভাবে একেবারে শুরু থেকেই বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে কেমন করে কিছু বাঙালি রাজনৈতিক নেতা প্রতিবাদী হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে দেখিয়েছেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো কীভাবে ষড়যন্ত্র করে বাঙালিদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। মেহেদি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, জামায়াত সেই ‘নির্বাচনে’ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৫টি আসনে ‘জয়ী’ হয়েছিল। তাহির মেহেদির মতে, এটি ছিল জামায়াতের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন কিন্তু বিজয় মিছিল বের করার আগেই মিত্রবাহিনী ঢাকা দখল করে নিয়েছিল আর জামায়াতের নেতারা কেউ কেউ তাঁদের সাধের পাকিস্তান বা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। মেহেদির বাকি দুই কিস্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সর্বশেষ লেখাটি লিখেছেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খান। বর্তমানে তিনি অনেকটা গৃহবন্দী। তাঁর লেখাটিও প্রকাশিত হয়েছে পাকিস্তানের আরেকটি আন্তর্জাতিক মানের দৈনিক দি নিউজ ইন্টারন্যাশনাল-এ । তিনি পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৭১ সালের চেয়েও ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন। একাত্তরে তিনি বেলজিয়ামে গবেষণারত ছিলেন। সেখানে তিনি যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যা ও ধ্বংসের খবর পড়তেন বা দেখতেন, তিনি শুধু লজ্জিতই হতেন না, নিজেকে প্রশ্ন করতেন—একজন মুসলমান আর একজন মুসলমানের ওপর বা একটি দেশের সেনাবাহিনী কীভাবে তার নিজ দেশের মানুষের ওপর এত নৃশংস হতে পারে? তিনি আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে এসব নৃশংসতার দৃশ্য তাঁর দেশের মানুষ কখনো দেখতে পারবে না। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন, কীভাবে অতীতে মুসলমানরা মুসলমানদের ষড়যন্ত্র, হত্যা, যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে ধ্বংস করেছে। তিনি এও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, পাকিস্তানে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশটির ভাঙন কেউ রুখতে পারবে না।
নানা কারণে এবারের বিজয়ের মাসটি স্বাধীনতাবিরোধীদের উল্লাস-নৃত্যের মধ্যে শুরু হলেও প্রথমে কিছুটা আশা জাগিয়েছে, এবারের বিজয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রজন্মের লাখো মানুষের অংশগ্রহণ দেখে। আশা জাগিয়েছে একাত্তর সম্পর্কে পাকিস্তানের শিক্ষিত মহলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসছে দেখে। এই আশাকে জাগ্রত রাখতে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। ঠিক করতে হবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তারা কতটুকু যেতে দিতে চায়। বর্তমানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল দেশে ও দেশের বাইরে দুই হাতে ডলার ওড়াচ্ছে। তা ধরার জন্য অনেকে নিজেরাও উড়ছেন। সরকার যদি জনগণকে সঙ্গে রাখতে পারে, শত ষড়যন্ত্র আর ডলার উড়িয়েও একাত্তরের ঘাতকদের বিচার বন্ধ করা যাবে না।
কোনো কোনো পাঠক আমাকে ই-মেইল করে বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষকের কাজ হচ্ছে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা, তাঁরা কেন রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন? তাঁদের বলি, দেশের অস্তিত্ব যখন হুমকির সম্মুখীন, তখন কারও চুপ করে থাকা উচিত নয়। আমরা আরেকটি একাত্তর বা একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর দেখতে চাই না। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments