শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন- অবসরটা দিলেন আমিনুর স্যার by মীর মাহমুদুল হাসান
দীর্ঘ কর্মজীবনের পর বাকি সময়টা অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজের মতো কাটাতে চান। থাকতে চান আয়েশে, নিশ্চিন্তে-নিরাপদে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আমিনুর রহমানেরও সেই সুযোগটা ছিল।
কিন্তু মনে-প্রাণে যিনি একজন শিক্ষক, ছাত্র পড়িয়ে যিনি পার করে দিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়, তিনি কীভাবে নিশ্চিন্তে অবসর যাপনের বিলাসিতা দেখান!
অবসরে গিয়েও আমিনুর রহমানের তাই অবসর নেই। খারাপ ফল করায় যেসব শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে, পরিবারে অভাব-অনটনের কারণে স্কুলে যেতে চায় না, সেই শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তিন বছর ধরে এসব শিশুকে পড়াচ্ছেন তিনি, খোলা আকাশের নিচে, গোল করে বসিয়ে এবং অবশ্যই বিনা পয়সায়।
আমিনুর রহমান বিদ্যোৎসাহী ও সমাজকর্মী হিসেবে ২০১২ সালে রংপুর বিভাগেও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁকে বাংলাদেশের ‘ভলান্টিয়ার অব দ্য ইয়ার ২০১২’ মনোনীত করে।
শুরু: ১৯৭২ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন জলঢাকার হাড়োয়া শিমুলবাড়ী গ্রামের আমিনুর রহমান। ৩৬ বছর চাকরি করার পর ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর অবসর নেন। চাকরিজীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে একটা ভাবনা কাজ করত। যেসব শিশু ফেল করে স্কুল থেকে ঝরে পড়ত, এরপর এদের দেখতেন মাঠে-কারখানায় কাজ করতে। তখন তাঁর মনটা অনুশোচনায় মোচড় দিয়ে উঠত। মনে করতেন, শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারছেন না। তাই সব সময় ভাবনা ছিল, এই শিশুগুলোর জন্য কিছু একটা করার।
অবসর নেওয়ার পরের বছর ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ২৮টি শিশু ফেল করে। আমিনুর স্যার বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে এদের ঠিকানা সংগ্রহ করেন। যান ওই শিশুদের বাড়ি বাড়ি। অভিভাবকেরা এসব শিশুকে আর পড়াতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত শিশুদের বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হন তিনি।
২০১০ সালের শুরুতে ওই ২৮ শিশুকে নিয়ে শুরু হয় আমিনুর স্যারের পাঠশালা। প্রথম দিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পরিত্যক্ত একটি কক্ষে বসেন। পরে সেখানে জায়গা না হওয়ায় বাইরে খোলা আকাশের নিচে পড়ানো শুরু করেন।
পড়ানোর পাশাপাশি শরীরচর্চা, খেলাধুলা, বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য, পরিচ্ছন্নতা ও ছবি আঁকা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দেন আমিনুর স্যার। মাস শেষে নেন মূল্যায়ন পরীক্ষাও। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ছয় দিন বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পড়ান তিনি।
সরেজমিন: আমিনুর স্যারের বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইউপি ভবনের সামনের খোলা মাঠে পাঠশালা। সম্প্রতি এক বিকেলে পাঠশালায় গিয়ে দেখা গেল, শিশুরা ঘাসের ওপর বসে আছে। সবার হাতে বই-খাতা। স্যার তাদের কিছু বোঝাচ্ছেন। শিশুরা মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। এই প্রতিবেদককে দেখে স্যার এগিয়ে এলেন। পরিচয় পেয়ে জানালেন তাঁর ইচ্ছার কথা।
‘অভাবের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তির পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। বিষয়টি আমাকে ভাবাত। তাই অবসরের পর এমন শিশুদের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। অবসর সময়টা না হয় ওদেরই দিলাম।’ বললেন আমিনুর রহমান।
ওদের কথা: স্থানীয় শিমুলবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী অধিবাসী রায়। সে জানাল, ‘আমি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ফেল করলে বাবা-মা বললেন, আর পড়তে হবে না। একদিন আমিনুর স্যার আমাদের বাড়িতে এসে বাবা-মাকে বলে আমার দায়িত্ব নিলেন। ২০১০ সালে আমি প্রথম বিভাগে পাস করি।’ একই কথা জানাল তার সহপাঠী শারমিন আক্তার।
আমিনুর স্যারের পাঠশালায় পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র কমল রায়। সে বলে, ‘স্যার শুধু বই-ই পড়ান না, রাস্তায় কেমন করে চলতে হয়, কেমন করে বড়দের সম্মান করতে হয়, তা-ও শেখান।’
এই পাঠশালায় এখন প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ১৯টি শিশু নিয়মিত পড়ছে। মাঝেমধ্যে অন্যরাও এসে পড়া দেখিয়ে নেয়।
শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি: পাঠশালা শুরুর পাশাপাশি আমিনুর স্যারের উদ্যোগে শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ করে শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করে।
আমিনুর স্যারের পাঠশালায় পড়ে ২০০৯ সালে ফেল করা ২৮ শিশুই ২০১০ সালে পরীক্ষায় পাস করে। ওই বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় শিমুলবাড়ী ইউনিয়নে শতভাগ শিশু পাস করে। এরপর আমিনুর স্যার ঝরে পড়া, ঝরে পড়ার পর্যায়ে যাওয়া, পিছিয়ে পড়াসহ বিভিন্ন শ্রেণীর শিশুদের নিয়ে পাঠশালা চালাতে থাকেন।
তাঁরা যা বলেন: স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোমিনুর রশিদ বলেন, ‘আমিনুর স্যার আমাদের মডেল। স্যারের উদ্যোগের ফলে শিশু ঝরে পড়ার হার কমেছে।’ তিনি জানালেন, স্যারের এই দৃষ্টান্ত দেখে পাশের ধর্মপাল ইউনিয়নে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জলঢাকা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, মানসম্মত শিক্ষা, ঝরে পড়া রোধ এবং শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করতে আমিনুর রহমান নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন। তাঁর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
ছয় সন্তানের বাবা আমিনুর রহমান। তাঁর মেজ ছেলে স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক মঞ্জুরুল হাসান বললেন, ‘বাবার রক্তের মধ্যে পড়ানোর নেশা রয়েছে। এমন বাবার ছেলে হয়ে গর্ববোধ করি।’
স্যার বলেন: আমিনুর রহমান বললেন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশু সুরক্ষায় জনগণকে সচেতন করার পরিকল্পনা আছে। মায়েদের নিরাপদ প্রসবও নিশ্চিত করতে হবে। আমিনুর রহমানের বিশ্বাস, মেধাবীরাই একদিন দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নেবে।
অবসরে গিয়েও আমিনুর রহমানের তাই অবসর নেই। খারাপ ফল করায় যেসব শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে, পরিবারে অভাব-অনটনের কারণে স্কুলে যেতে চায় না, সেই শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তিন বছর ধরে এসব শিশুকে পড়াচ্ছেন তিনি, খোলা আকাশের নিচে, গোল করে বসিয়ে এবং অবশ্যই বিনা পয়সায়।
আমিনুর রহমান বিদ্যোৎসাহী ও সমাজকর্মী হিসেবে ২০১২ সালে রংপুর বিভাগেও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁকে বাংলাদেশের ‘ভলান্টিয়ার অব দ্য ইয়ার ২০১২’ মনোনীত করে।
শুরু: ১৯৭২ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন জলঢাকার হাড়োয়া শিমুলবাড়ী গ্রামের আমিনুর রহমান। ৩৬ বছর চাকরি করার পর ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর অবসর নেন। চাকরিজীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে একটা ভাবনা কাজ করত। যেসব শিশু ফেল করে স্কুল থেকে ঝরে পড়ত, এরপর এদের দেখতেন মাঠে-কারখানায় কাজ করতে। তখন তাঁর মনটা অনুশোচনায় মোচড় দিয়ে উঠত। মনে করতেন, শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারছেন না। তাই সব সময় ভাবনা ছিল, এই শিশুগুলোর জন্য কিছু একটা করার।
অবসর নেওয়ার পরের বছর ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ২৮টি শিশু ফেল করে। আমিনুর স্যার বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে এদের ঠিকানা সংগ্রহ করেন। যান ওই শিশুদের বাড়ি বাড়ি। অভিভাবকেরা এসব শিশুকে আর পড়াতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত শিশুদের বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হন তিনি।
২০১০ সালের শুরুতে ওই ২৮ শিশুকে নিয়ে শুরু হয় আমিনুর স্যারের পাঠশালা। প্রথম দিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পরিত্যক্ত একটি কক্ষে বসেন। পরে সেখানে জায়গা না হওয়ায় বাইরে খোলা আকাশের নিচে পড়ানো শুরু করেন।
পড়ানোর পাশাপাশি শরীরচর্চা, খেলাধুলা, বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য, পরিচ্ছন্নতা ও ছবি আঁকা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দেন আমিনুর স্যার। মাস শেষে নেন মূল্যায়ন পরীক্ষাও। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ছয় দিন বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পড়ান তিনি।
সরেজমিন: আমিনুর স্যারের বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইউপি ভবনের সামনের খোলা মাঠে পাঠশালা। সম্প্রতি এক বিকেলে পাঠশালায় গিয়ে দেখা গেল, শিশুরা ঘাসের ওপর বসে আছে। সবার হাতে বই-খাতা। স্যার তাদের কিছু বোঝাচ্ছেন। শিশুরা মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। এই প্রতিবেদককে দেখে স্যার এগিয়ে এলেন। পরিচয় পেয়ে জানালেন তাঁর ইচ্ছার কথা।
‘অভাবের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তির পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। বিষয়টি আমাকে ভাবাত। তাই অবসরের পর এমন শিশুদের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। অবসর সময়টা না হয় ওদেরই দিলাম।’ বললেন আমিনুর রহমান।
ওদের কথা: স্থানীয় শিমুলবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী অধিবাসী রায়। সে জানাল, ‘আমি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ফেল করলে বাবা-মা বললেন, আর পড়তে হবে না। একদিন আমিনুর স্যার আমাদের বাড়িতে এসে বাবা-মাকে বলে আমার দায়িত্ব নিলেন। ২০১০ সালে আমি প্রথম বিভাগে পাস করি।’ একই কথা জানাল তার সহপাঠী শারমিন আক্তার।
আমিনুর স্যারের পাঠশালায় পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র কমল রায়। সে বলে, ‘স্যার শুধু বই-ই পড়ান না, রাস্তায় কেমন করে চলতে হয়, কেমন করে বড়দের সম্মান করতে হয়, তা-ও শেখান।’
এই পাঠশালায় এখন প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ১৯টি শিশু নিয়মিত পড়ছে। মাঝেমধ্যে অন্যরাও এসে পড়া দেখিয়ে নেয়।
শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি: পাঠশালা শুরুর পাশাপাশি আমিনুর স্যারের উদ্যোগে শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ করে শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করে।
আমিনুর স্যারের পাঠশালায় পড়ে ২০০৯ সালে ফেল করা ২৮ শিশুই ২০১০ সালে পরীক্ষায় পাস করে। ওই বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় শিমুলবাড়ী ইউনিয়নে শতভাগ শিশু পাস করে। এরপর আমিনুর স্যার ঝরে পড়া, ঝরে পড়ার পর্যায়ে যাওয়া, পিছিয়ে পড়াসহ বিভিন্ন শ্রেণীর শিশুদের নিয়ে পাঠশালা চালাতে থাকেন।
তাঁরা যা বলেন: স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোমিনুর রশিদ বলেন, ‘আমিনুর স্যার আমাদের মডেল। স্যারের উদ্যোগের ফলে শিশু ঝরে পড়ার হার কমেছে।’ তিনি জানালেন, স্যারের এই দৃষ্টান্ত দেখে পাশের ধর্মপাল ইউনিয়নে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জলঢাকা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, মানসম্মত শিক্ষা, ঝরে পড়া রোধ এবং শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করতে আমিনুর রহমান নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন। তাঁর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
ছয় সন্তানের বাবা আমিনুর রহমান। তাঁর মেজ ছেলে স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক মঞ্জুরুল হাসান বললেন, ‘বাবার রক্তের মধ্যে পড়ানোর নেশা রয়েছে। এমন বাবার ছেলে হয়ে গর্ববোধ করি।’
স্যার বলেন: আমিনুর রহমান বললেন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশু সুরক্ষায় জনগণকে সচেতন করার পরিকল্পনা আছে। মায়েদের নিরাপদ প্রসবও নিশ্চিত করতে হবে। আমিনুর রহমানের বিশ্বাস, মেধাবীরাই একদিন দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নেবে।
No comments