চারদিক- অঞ্জলির স্মৃতির পাতা থেকে by প্রণব বল
‘প্রতিদিন মাথায় পুঁটলি নিয়ে দলে দলে নারী-পুরুষ আসছে। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই। নেই বাসস্থান। ভুগছে কলেরাসহ নানা অসুখে। এসব দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না। মানুষের এত কষ্ট! ছোট ছেলেমেয়ে রেখে প্রতিদিন ছুটতাম শরণার্থী শিবিরের দিকে।
ইচ্ছা ছিল, যদি একটু সহযোগিতা তাঁদের করা যায়।’
কথাগুলো বলতে বলতে নব্বই-ঊর্ধ্ব অঞ্জলি লাহিড়ী ফিরে গেলেন একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধের বছর। বয়স মাঝেমধ্যে তাঁর স্মৃতির সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়। কিন্তু দৃঢ়চেতা অঞ্জলির মনে ও মগজে এখনো সেসব মানুষের মুখ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটু আশ্রয়ের জন্য সীমান্তের ওপারে ছুটে যাওয়া শিশু-কিশোর-নারী পুরুষের স্মৃতি এখনো তিনি যেন দেখতে পান।
অঞ্জলি লাহিড়ীর বয়স এখন ৯১। শিলংয়ের বাসিন্দা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলং ও মেঘালয় সীমান্তে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এই নারী। ওষুধ, খাবার-দাবার এমনকি টাকা-পয়সা তুলেও নিজ উদ্যোগে বিতরণ করেন তিনি। তাঁর নিঃস্বার্থ সেই কর্মের স্বীকৃতি মিলল স্বাধীনতার ৪২ বছর পর। গত ২০ অক্টোবর ঢাকায় রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মাননা জানিয়েছেন তাঁকে। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে পাশে দাঁড়ানোর জন্য দুজনকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও ৫৯ জনকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেওয়া হয়। তাঁর মধ্যে একজন অঞ্জলি লাহিড়ী।
সম্মাননা নিয়ে ঢাকা থেকে তিনি এসেছিলেন চট্টগ্রামে। ছিলেন একে খানের বাংলোয়। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য সম্মাননা—এমন বাক্যে অঞ্জলি যেন কিছুটা বিব্রত হলেন, ‘বীরত্বপূর্ণ কি না জানি না। আমি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম—বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পাশে। মানবিকতাবোধ থেকেই ছুটে গেছি।’
সে সময়ের কথা উঠতেই অঞ্জলি বলেন, ‘আমি সেলা, বালার্ট ও মাইলাম শরণার্থী শিবিরে কাজ করেছি। কখনো ওষুধ নিয়ে, কখনো খাবার নিয়ে ছুটে গেছি। প্রথমে কৌতূহল থেকে শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিলাম। পরে নিজেকে তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললাম। বক্তৃতাও দিতে হতো শিবিরে গিয়ে। মানুষের কষ্ট তখন আমি দেখেছি। এই স্মৃতি ভোলা যায় না।’
ভোলা যায় না বলেই একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। পরে ১৯৯৯ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় অঞ্জলি লাহিড়ীর স্মৃতি ও কথা ১৯৭১। ওই বইতে সেলা, বালার্ট, টেংরাটিলা, বাঁশতলা ইত্যাদি জায়গায় নিজের কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
অঞ্জলি লাহিড়ী নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মূল সহযোগিতাটা পেয়েছিলেন স্বামী প্রয়াত নীরেন লাহিড়ীর কাছ থেকে। তাই ছোট ছেলে ও মেয়েকে রেখে প্রতিদিন তিনি ছুটে যেতে পেরেছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরে। নীরেন লাহিড়ী তখন মেঘালয়ের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন।
সেই সময়টাতে অঞ্জলির সঙ্গে ছিলেন আশরাফি বেগম ও জোছনা বিশ্বাস নামের আরও দুই সহযোগী। তাঁরাও অঞ্জলির সঙ্গে এসব ক্যাম্পে যেতেন এবং ওষুধ ও খাবার তোলার জন্য সহযোগিতা করতেন।
মহীয়সী এই নারী বলেন, ‘একটা সময়ে দেখেছি, কলেরা-ডায়রিয়ায় লোক মারা যাচ্ছে। আরেকটা রোগ হতো, চোখ ওঠা। তার নাম দিয়েছিল ‘জয় বাংলা।’ কলেরায় মানুষ মারা যাচ্ছে। কোনো চিকিৎসা নেই। তাদের কবর কিংবা দাহ করার জায়গাও নেই। মেঘালয় কিংবা শিলংয়ের স্থানীয় বাসিন্দারা কাঠ কাটতে দিচ্ছে না। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক কাঠ কাটা হয়ে গেছে। ফলে যেখানে-সেখানে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। আর তা এসে শকুনে খেত। কী দুঃসহ সেই স্মৃতি।’
শিবিরের মধ্যে নারী-পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয় নিতেন মুক্তিযোদ্ধারাও। তাঁরা ওখানে আশ্রয় নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করতেন। এমনকি রাজাকারদের ক্যাম্পে ধরে এনে মারধরের দৃশ্যও দেখেছেন অঞ্জলি লাহিড়ী।
একজন কিশোর যোদ্ধার কথা তিনি ভুলতে পারেন না। তাঁকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে লিখেছেন জগৎজ্যোতি নামে একটি বইও। সুনামগঞ্জের জগৎজ্যোতি দাশ নামে ওই কিশোর বালার্ট ক্যাম্প থেকে গিয়ে আক্রমণ করতেন।
‘এর আগে জগৎ ১৭ বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসে। তার শরীরে কয়েকটি স্প্লিন্টারও ছিল। শেষবার যাওয়ার সময় সে আমার বাসায় আসে। এসে তারা কয়েকজন বলে, দিদি, খেতে দাও। পাকিস্তানি বার্জ আসছে। আক্রমণ করতে হবে। আমি তাকে বারণ করলাম। সে শুনল না। পরে আক্রমণে গিয়ে ধরা পড়ে জগৎ। তাঁকে মেরে মরদেহ একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।’ চুপ হয়ে গেলেন অঞ্জলি।
প্রণব বল
কথাগুলো বলতে বলতে নব্বই-ঊর্ধ্ব অঞ্জলি লাহিড়ী ফিরে গেলেন একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধের বছর। বয়স মাঝেমধ্যে তাঁর স্মৃতির সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়। কিন্তু দৃঢ়চেতা অঞ্জলির মনে ও মগজে এখনো সেসব মানুষের মুখ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটু আশ্রয়ের জন্য সীমান্তের ওপারে ছুটে যাওয়া শিশু-কিশোর-নারী পুরুষের স্মৃতি এখনো তিনি যেন দেখতে পান।
অঞ্জলি লাহিড়ীর বয়স এখন ৯১। শিলংয়ের বাসিন্দা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলং ও মেঘালয় সীমান্তে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এই নারী। ওষুধ, খাবার-দাবার এমনকি টাকা-পয়সা তুলেও নিজ উদ্যোগে বিতরণ করেন তিনি। তাঁর নিঃস্বার্থ সেই কর্মের স্বীকৃতি মিলল স্বাধীনতার ৪২ বছর পর। গত ২০ অক্টোবর ঢাকায় রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মাননা জানিয়েছেন তাঁকে। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে পাশে দাঁড়ানোর জন্য দুজনকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও ৫৯ জনকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেওয়া হয়। তাঁর মধ্যে একজন অঞ্জলি লাহিড়ী।
সম্মাননা নিয়ে ঢাকা থেকে তিনি এসেছিলেন চট্টগ্রামে। ছিলেন একে খানের বাংলোয়। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য সম্মাননা—এমন বাক্যে অঞ্জলি যেন কিছুটা বিব্রত হলেন, ‘বীরত্বপূর্ণ কি না জানি না। আমি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম—বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পাশে। মানবিকতাবোধ থেকেই ছুটে গেছি।’
সে সময়ের কথা উঠতেই অঞ্জলি বলেন, ‘আমি সেলা, বালার্ট ও মাইলাম শরণার্থী শিবিরে কাজ করেছি। কখনো ওষুধ নিয়ে, কখনো খাবার নিয়ে ছুটে গেছি। প্রথমে কৌতূহল থেকে শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিলাম। পরে নিজেকে তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললাম। বক্তৃতাও দিতে হতো শিবিরে গিয়ে। মানুষের কষ্ট তখন আমি দেখেছি। এই স্মৃতি ভোলা যায় না।’
ভোলা যায় না বলেই একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। পরে ১৯৯৯ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় অঞ্জলি লাহিড়ীর স্মৃতি ও কথা ১৯৭১। ওই বইতে সেলা, বালার্ট, টেংরাটিলা, বাঁশতলা ইত্যাদি জায়গায় নিজের কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
অঞ্জলি লাহিড়ী নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মূল সহযোগিতাটা পেয়েছিলেন স্বামী প্রয়াত নীরেন লাহিড়ীর কাছ থেকে। তাই ছোট ছেলে ও মেয়েকে রেখে প্রতিদিন তিনি ছুটে যেতে পেরেছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরে। নীরেন লাহিড়ী তখন মেঘালয়ের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন।
সেই সময়টাতে অঞ্জলির সঙ্গে ছিলেন আশরাফি বেগম ও জোছনা বিশ্বাস নামের আরও দুই সহযোগী। তাঁরাও অঞ্জলির সঙ্গে এসব ক্যাম্পে যেতেন এবং ওষুধ ও খাবার তোলার জন্য সহযোগিতা করতেন।
মহীয়সী এই নারী বলেন, ‘একটা সময়ে দেখেছি, কলেরা-ডায়রিয়ায় লোক মারা যাচ্ছে। আরেকটা রোগ হতো, চোখ ওঠা। তার নাম দিয়েছিল ‘জয় বাংলা।’ কলেরায় মানুষ মারা যাচ্ছে। কোনো চিকিৎসা নেই। তাদের কবর কিংবা দাহ করার জায়গাও নেই। মেঘালয় কিংবা শিলংয়ের স্থানীয় বাসিন্দারা কাঠ কাটতে দিচ্ছে না। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক কাঠ কাটা হয়ে গেছে। ফলে যেখানে-সেখানে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। আর তা এসে শকুনে খেত। কী দুঃসহ সেই স্মৃতি।’
শিবিরের মধ্যে নারী-পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয় নিতেন মুক্তিযোদ্ধারাও। তাঁরা ওখানে আশ্রয় নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করতেন। এমনকি রাজাকারদের ক্যাম্পে ধরে এনে মারধরের দৃশ্যও দেখেছেন অঞ্জলি লাহিড়ী।
একজন কিশোর যোদ্ধার কথা তিনি ভুলতে পারেন না। তাঁকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে লিখেছেন জগৎজ্যোতি নামে একটি বইও। সুনামগঞ্জের জগৎজ্যোতি দাশ নামে ওই কিশোর বালার্ট ক্যাম্প থেকে গিয়ে আক্রমণ করতেন।
‘এর আগে জগৎ ১৭ বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসে। তার শরীরে কয়েকটি স্প্লিন্টারও ছিল। শেষবার যাওয়ার সময় সে আমার বাসায় আসে। এসে তারা কয়েকজন বলে, দিদি, খেতে দাও। পাকিস্তানি বার্জ আসছে। আক্রমণ করতে হবে। আমি তাকে বারণ করলাম। সে শুনল না। পরে আক্রমণে গিয়ে ধরা পড়ে জগৎ। তাঁকে মেরে মরদেহ একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।’ চুপ হয়ে গেলেন অঞ্জলি।
প্রণব বল
No comments