মমতার জনপ্রিয়তা কেন তলানিতে by মোহাম্মদ সাদউদ্দিন
পুরো ভারতের রাজনীতিতে এক বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো তথা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৮ সাল থেকে একের পর এক নির্বাচনে শাসক বামফ্রন্টকে ধরাশায়ী করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজয়ডঙ্কা অর্জনও করেন।
কিন্তু ২০১১ সালের শেষ দিক থেকে ২০১২ সালের শেষ দিক পর্যন্ত তৃণমূল নেত্রীর জনপ্রিয়তা যেন ক্রমেই তলানিতে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে তার এ জনপ্রিয়তা কমছে কেন?
রাজনীতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম জ্যামিতি। আর সেই জ্যামিতিতে যদি পরিমাপটা সূক্ষ্ম না হয় তাহলে রাজনীতিতে স্লিপ খেতেই হয়। কলকাতার কালীঘাটের টালিরঘর থেকে উঠে আসা এক সাধারণ পরিবারের মহিলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের কারণ পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ভোটব্যাংক। এ ক্ষেত্রে শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষিজীবী, তফসিলি জাতি, উপজাতি, অনগ্রসর সম্প্রদায়, মুসলিমসহ সংখ্যালঘু ভোটকে অগ্রণী হিসেবে রাখা যায়। যাদের ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের কুর্শিতে এসেছেন, কেন্দ্রের মন্ত্রীও হতে পেরেছেন। আসলে যে ৮৫ শতাংশ ভোট নিয়ে মমতা ক্ষমতায় এসেছিলেন, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, তফসিলি জাতি-উপজাতি অনগ্রসর ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেগুলো কোনোভাবেই পালন করেননি।
২০০৬ সালের নভেম্বরে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে ভারতে মুসলিমদের জীবনযাপনের চালচিত্র বিষয়ক যে সাচার কমিটির রিপোর্ট বের হয়েছিল তাতে দেখা গেছে, ভারতের মধ্যে মুসলিমদের চাকরি-বাকরি এবং জীবনযাপনের করুণ চিত্র পশ্চিমবঙ্গে। আর সে সাচার কমিটির রিপোর্টকে তুরুপের তাস করে একের পর এক মুসলিম ভোটকে তৃণমূলের দিকে নিয়ে এসেছে। মুসলমানরা দেখেছে, ৩৪ বছর হয়েছে বামফ্রন্টের; আর নয়। এবার বাংলায় পরিবর্তন চাই। আর সেই মানসিকতা থেকেই মুসলিম ভোট তৃণমূলের দিকে প্রায় একচেটিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ২০১১ সালে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসে দেখা গেল মুসলিমদের জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা। যেমন মুসলিমদের আয়ের উৎস হলো গরুর ব্যবসা, কৃষি কাজ, বিড়িশিল্প, রেশমশিল্প, পোশাকশিল্প, জরিশিল্প। ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি দলের এক আইনজীবী হাইকোর্টের নির্দেশ এনে কলকাতা মহানগরীর সবচেয়ে বড় গরুর হাট খিদিরপুরের ওরফানগঞ্জ গরুর হাট এক রকম বন্ধ। মুসলিমরা আশঙ্কা করছে, এশিয়ার বৃহত্তম গরুর হাট মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা গরুর হাটও বন্ধ হয়ে যাবে। হাওড়ার এশিয়ার বৃহত্তম কাপড়ের হাট মঙ্গলাহাটের হকার উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে। এ হকারদের ৯৫ শতাংশই মুসলমান। মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিক, মালদার রেশমশিল্পের শ্রমিক, হাওড়া-হুগলির জরি শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরির অভাবে ধুঁকছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের কবর আস্তানা বাঁধানো কিংবা ইমাম ভাতা আর মাদ্রাসা তৈরির ধোয়া তুলে শুধু মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট ধরার চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম এলাকায় গিয়ে হিজাব পরে আর আসসালামু আলাইকুম দিয়ে শিষ্টাচারভিত্তিক সেন্টিমেন্টকেই উস্কে দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিমদের জীবন-জীবিকা বা চাকরি-বাকরি নিয়ে সেভাবে কাজের কাজ কিছুই করেননি। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এর প্রধান কারণ ১৯৮৩ সাল থেকে মুসলিমদের নিজস্ব দানের টাকায় আল আমিন মিশন (হাওড়া)সহ অন্তত ১০০টি মিশন গড়ে উঠেছে। তাদের প্রচেষ্টায় মুসলিমদের শিক্ষার প্রসার ঘটছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওইসব মিশনের জন্য কোনো আর্থিক বরাদ্দ বাদ দিয়ে কেবল মাদ্রাসার কথা বলে মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট আকর্ষণ করছেন; কিন্তু শিক্ষিত মুসলমানরা মনে করছেন, এতে আমাদের কিছু হবে না। পশ্চিমবঙ্গে ১০০ কৃষক ক্ষেতমজুর আত্মহত্যা করেছেন, যার অন্তত ৫০ শতাংশই মুসলিম। রেল পরিসেবায় রেলমন্ত্রী থাকাকালে মুর্শিদাবাদ, মালদা, দুই দিনাজপুর, কোচবিহারের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে রকম কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। শুধু মুসলিমদের মাদ্রাসা করে দেব, অমুক করে দেব, তমুক করে দেব বলে পশ্চিমবঙ্গের অমুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘাত ও উন্মাদনা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সাচার কমিটির রিপোর্টকে নিয়ে মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল যতখানি মায়াকান্না করেছে, ক্ষমতায় আসার পর সাচার কমিটির সুপারিশগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকার ততখানি উদ্যোগী হলে ভালো হতো।
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন : পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাংবাদিক
রাজনীতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম জ্যামিতি। আর সেই জ্যামিতিতে যদি পরিমাপটা সূক্ষ্ম না হয় তাহলে রাজনীতিতে স্লিপ খেতেই হয়। কলকাতার কালীঘাটের টালিরঘর থেকে উঠে আসা এক সাধারণ পরিবারের মহিলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের কারণ পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ভোটব্যাংক। এ ক্ষেত্রে শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষিজীবী, তফসিলি জাতি, উপজাতি, অনগ্রসর সম্প্রদায়, মুসলিমসহ সংখ্যালঘু ভোটকে অগ্রণী হিসেবে রাখা যায়। যাদের ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের কুর্শিতে এসেছেন, কেন্দ্রের মন্ত্রীও হতে পেরেছেন। আসলে যে ৮৫ শতাংশ ভোট নিয়ে মমতা ক্ষমতায় এসেছিলেন, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, তফসিলি জাতি-উপজাতি অনগ্রসর ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেগুলো কোনোভাবেই পালন করেননি।
২০০৬ সালের নভেম্বরে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে ভারতে মুসলিমদের জীবনযাপনের চালচিত্র বিষয়ক যে সাচার কমিটির রিপোর্ট বের হয়েছিল তাতে দেখা গেছে, ভারতের মধ্যে মুসলিমদের চাকরি-বাকরি এবং জীবনযাপনের করুণ চিত্র পশ্চিমবঙ্গে। আর সে সাচার কমিটির রিপোর্টকে তুরুপের তাস করে একের পর এক মুসলিম ভোটকে তৃণমূলের দিকে নিয়ে এসেছে। মুসলমানরা দেখেছে, ৩৪ বছর হয়েছে বামফ্রন্টের; আর নয়। এবার বাংলায় পরিবর্তন চাই। আর সেই মানসিকতা থেকেই মুসলিম ভোট তৃণমূলের দিকে প্রায় একচেটিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ২০১১ সালে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসে দেখা গেল মুসলিমদের জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা। যেমন মুসলিমদের আয়ের উৎস হলো গরুর ব্যবসা, কৃষি কাজ, বিড়িশিল্প, রেশমশিল্প, পোশাকশিল্প, জরিশিল্প। ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি দলের এক আইনজীবী হাইকোর্টের নির্দেশ এনে কলকাতা মহানগরীর সবচেয়ে বড় গরুর হাট খিদিরপুরের ওরফানগঞ্জ গরুর হাট এক রকম বন্ধ। মুসলিমরা আশঙ্কা করছে, এশিয়ার বৃহত্তম গরুর হাট মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা গরুর হাটও বন্ধ হয়ে যাবে। হাওড়ার এশিয়ার বৃহত্তম কাপড়ের হাট মঙ্গলাহাটের হকার উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে। এ হকারদের ৯৫ শতাংশই মুসলমান। মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিক, মালদার রেশমশিল্পের শ্রমিক, হাওড়া-হুগলির জরি শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরির অভাবে ধুঁকছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের কবর আস্তানা বাঁধানো কিংবা ইমাম ভাতা আর মাদ্রাসা তৈরির ধোয়া তুলে শুধু মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট ধরার চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম এলাকায় গিয়ে হিজাব পরে আর আসসালামু আলাইকুম দিয়ে শিষ্টাচারভিত্তিক সেন্টিমেন্টকেই উস্কে দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিমদের জীবন-জীবিকা বা চাকরি-বাকরি নিয়ে সেভাবে কাজের কাজ কিছুই করেননি। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এর প্রধান কারণ ১৯৮৩ সাল থেকে মুসলিমদের নিজস্ব দানের টাকায় আল আমিন মিশন (হাওড়া)সহ অন্তত ১০০টি মিশন গড়ে উঠেছে। তাদের প্রচেষ্টায় মুসলিমদের শিক্ষার প্রসার ঘটছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওইসব মিশনের জন্য কোনো আর্থিক বরাদ্দ বাদ দিয়ে কেবল মাদ্রাসার কথা বলে মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট আকর্ষণ করছেন; কিন্তু শিক্ষিত মুসলমানরা মনে করছেন, এতে আমাদের কিছু হবে না। পশ্চিমবঙ্গে ১০০ কৃষক ক্ষেতমজুর আত্মহত্যা করেছেন, যার অন্তত ৫০ শতাংশই মুসলিম। রেল পরিসেবায় রেলমন্ত্রী থাকাকালে মুর্শিদাবাদ, মালদা, দুই দিনাজপুর, কোচবিহারের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে রকম কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। শুধু মুসলিমদের মাদ্রাসা করে দেব, অমুক করে দেব, তমুক করে দেব বলে পশ্চিমবঙ্গের অমুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘাত ও উন্মাদনা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সাচার কমিটির রিপোর্টকে নিয়ে মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল যতখানি মায়াকান্না করেছে, ক্ষমতায় আসার পর সাচার কমিটির সুপারিশগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকার ততখানি উদ্যোগী হলে ভালো হতো।
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন : পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাংবাদিক
No comments