মিসর- সংবিধানের লড়াই by কামাল গাবালা
আরব জগতের খ্যাতনামা সাংবাদিক কামালগাবালা মিসরের প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যম আল আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। এখন থেকে প্রথম আলোর জন্য তিনি নিয়মিতভাবে লিখবেন।
মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি দেশটির খসড়া সংবিধানের ওপর সংবিধান সভায় ভোটাভুটি ডেকেছেন ১৫ ডিসেম্বর। সংবিধানটি প্রণয়ন করেছে ইসলামপন্থী-নিয়ন্ত্রিত সংবিধান সভা। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত মিশ্র।
মুরসির ভাষায়, ‘এই ভোটাভুটি মিসরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নতুন পদক্ষেপ হয়ে উঠবে।’
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট মুরসি জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন সংবিধান হাজির করার প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন। তার বদলে তিনি ইসলামপন্থী বনাম উদারপন্থীদের সংঘাত আরও তীব্র করে দিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জাতীয় সমঝোতা ছাড়াই ভোটাভুটির মাধ্যমে সংবিধান চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত সমঝোতার সব আশার ইতি ঘটাল। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মিসরীয় খসড়া সংবিধানের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে জনগণের দ্বারা নতুন একটি সংবিধান সভাও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হবে। এই ভোটাভুটির ঘোষণাটি এমন এক সময় দেওয়া হলো, যখন নভেম্বরের ২২ তারিখে জারি করা তাঁর দুটি ডিক্রির বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ চলছিল। ডিক্রি দুটির মাধ্যমে তিনি নিজের হাতে অধিকতর ক্ষমতা নিয়ে নিলেন এবং দেশের বিচার বিভাগের ওপর প্রেসিডেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক ডিক্রি জারি করলেন।
মুরসিবিরোধীরা হুমকি দিয়েছে, বিতর্কিত সংবিধান এবং সাংবিধানিক ডিক্রি ঠেকাতে আগামী বুধবার তারা প্রেসিডেন্ট ভবন ঘেরাও করবে। (শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভের মুখে মুরসি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন—অনুবাদক)।
ওই ডিক্রির কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে মিসরের বিচারকদের সমিতি ইতিমধ্যে ধর্মঘট পালন করছে। তারাও মুরসিকে হুমকি দিয়েছে ডিক্রিটা বাতিল করা না হলে তারা নির্বাচন তদারকি করবে না।
চার্চ ও সাংবাদিকেরাসহ সংবিধান সভার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও সংবিধানের চূড়ান্ত খসড়ার ওপর ভোটাভুটির আগে নিজেদের সেই সভা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এখন সংবিধান সভাজুড়ে আছে কেবল ইসলামপন্থীরাই। এই পরিস্থিতি হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং প্রেসিডেন্টও সেটা হয়তো জানেন যে সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত এখন সংবিধান সভা ভেঙে দিতে পারেন, যেমনটা তাঁরা করেছিলেন আগের সভার বেলায়ও।
‘আমরা মিসরের ইতিহাসে নবযুগে উত্থিত হতে চাই, আমাদের ভালোবাসার জনগণের জন্য আনতে চাই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’, ভাষণে বলেছিলেন মুরসি। তিনি আরও বলেন, এটা এক যুগান্তকারী ব্যাপার, এটাই প্রথম সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সংবিধান। এই সংবিধান সব মিসরীয়র অধিকার, স্বাধীনতা আর মর্যাদার রক্ষাকবচ। এর জন্ম হয়েছে ২৬ জানুয়ারির বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, শেষ বিপ্লব এসেছিল ১৭৫ বছর আগে মোহাম্মদ আলী পাশার মাধ্যমে (মোহাম্মদ আলী পাশা আধুনিক মিসরের জনক হিসেবে পরিচিত—অনুবাদক)।
এদিকে, মুরসির হাজার হাজার সমর্থক মুরসির ডিক্রি এবং মুরসির তত্ত্বাবধানে রচিত সংবিধানের সমর্থনে দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া তোলে। তারা আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দেয়, আতশবাজি পোড়ায় আর জাতীয় সংগীত গায়।
তাদের বিশ্বাস, অবশেষে মিসরীয় জনগণ ক্ষমতা পাবে এবং সংবিধান পাস হলে তারা খুশিই হবে। আর যা-ই হোক, গণজাগরণের সময় থেকে তো তারা এর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের বিশ্বাস, খসড়া সংবিধান ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবে—হয়তো ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ভোট পাবে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে বিশ্বাস করে, সংবিধান প্রবর্তন হয়ে গেলে মুরসি তাঁর ‘স্বৈরাচারী ডিক্রি’ বাতিল করবেন। এর মধ্যে মুরসিপন্থীদের সমাবেশ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তাহরির স্কয়ারে সাংবিধানিক ডিক্রি ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে মুরসিবিরোধী পক্ষ।
বিরোধীদের বিশ্বাস, শিগগিরই তাদের সামনে দুটি দুর্ভাগ্যের যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে; মুরসির স্বৈরাচারমূলক সাংবিধানিক ডিক্রি এবং অগ্রহণযোগ্য খসড়া সংবিধান।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ খসড়া সংবিধানের নিন্দা করেছে। তাদের ভাষায়, এই সংবিধানে মত প্রকাশের আর ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। তারা জাতীয় মতৈক্য ছাড়াই খসড়া সংবিধান পাস করার বিষয়ে সংবিধান সভার সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেছে। সংবিধান সভা থেকে উদারপন্থী সদস্যদের নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়টিও তারা উল্লেখ করেছে। সংবিধান সভা সমগ্র মিসরীয় সমাজের প্রতিনিধিত্ব না করে বরং সমাজের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। এভাবে তারা ব্যর্থ করছে মিসরীয় রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের ওপর ধর্মকে প্রতিষ্ঠার রাস্তা পাকা করছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, ‘সংবিধান সভার নেতারা যে গলদযুক্ত ও স্ববিরোধী খসড়া সংবিধানকে ভোটে পাঠিয়েছেন, এটা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার অথবা আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর সঠিক পথ নয়।’
এই বেসরকারি সংস্থাটি যে সাংবিধানিক ডিক্রির বলে আইনি হস্তক্ষেপ থেকে মুরসি নিজের সিদ্ধান্তগুলোকে সুরক্ষা দিয়েছেন, তারও নিন্দা করেছে।
কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।a
মুরসির ভাষায়, ‘এই ভোটাভুটি মিসরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নতুন পদক্ষেপ হয়ে উঠবে।’
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট মুরসি জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন সংবিধান হাজির করার প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন। তার বদলে তিনি ইসলামপন্থী বনাম উদারপন্থীদের সংঘাত আরও তীব্র করে দিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জাতীয় সমঝোতা ছাড়াই ভোটাভুটির মাধ্যমে সংবিধান চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত সমঝোতার সব আশার ইতি ঘটাল। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মিসরীয় খসড়া সংবিধানের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে জনগণের দ্বারা নতুন একটি সংবিধান সভাও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হবে। এই ভোটাভুটির ঘোষণাটি এমন এক সময় দেওয়া হলো, যখন নভেম্বরের ২২ তারিখে জারি করা তাঁর দুটি ডিক্রির বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ চলছিল। ডিক্রি দুটির মাধ্যমে তিনি নিজের হাতে অধিকতর ক্ষমতা নিয়ে নিলেন এবং দেশের বিচার বিভাগের ওপর প্রেসিডেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক ডিক্রি জারি করলেন।
মুরসিবিরোধীরা হুমকি দিয়েছে, বিতর্কিত সংবিধান এবং সাংবিধানিক ডিক্রি ঠেকাতে আগামী বুধবার তারা প্রেসিডেন্ট ভবন ঘেরাও করবে। (শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভের মুখে মুরসি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন—অনুবাদক)।
ওই ডিক্রির কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে মিসরের বিচারকদের সমিতি ইতিমধ্যে ধর্মঘট পালন করছে। তারাও মুরসিকে হুমকি দিয়েছে ডিক্রিটা বাতিল করা না হলে তারা নির্বাচন তদারকি করবে না।
চার্চ ও সাংবাদিকেরাসহ সংবিধান সভার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও সংবিধানের চূড়ান্ত খসড়ার ওপর ভোটাভুটির আগে নিজেদের সেই সভা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এখন সংবিধান সভাজুড়ে আছে কেবল ইসলামপন্থীরাই। এই পরিস্থিতি হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং প্রেসিডেন্টও সেটা হয়তো জানেন যে সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত এখন সংবিধান সভা ভেঙে দিতে পারেন, যেমনটা তাঁরা করেছিলেন আগের সভার বেলায়ও।
‘আমরা মিসরের ইতিহাসে নবযুগে উত্থিত হতে চাই, আমাদের ভালোবাসার জনগণের জন্য আনতে চাই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’, ভাষণে বলেছিলেন মুরসি। তিনি আরও বলেন, এটা এক যুগান্তকারী ব্যাপার, এটাই প্রথম সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সংবিধান। এই সংবিধান সব মিসরীয়র অধিকার, স্বাধীনতা আর মর্যাদার রক্ষাকবচ। এর জন্ম হয়েছে ২৬ জানুয়ারির বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, শেষ বিপ্লব এসেছিল ১৭৫ বছর আগে মোহাম্মদ আলী পাশার মাধ্যমে (মোহাম্মদ আলী পাশা আধুনিক মিসরের জনক হিসেবে পরিচিত—অনুবাদক)।
এদিকে, মুরসির হাজার হাজার সমর্থক মুরসির ডিক্রি এবং মুরসির তত্ত্বাবধানে রচিত সংবিধানের সমর্থনে দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া তোলে। তারা আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দেয়, আতশবাজি পোড়ায় আর জাতীয় সংগীত গায়।
তাদের বিশ্বাস, অবশেষে মিসরীয় জনগণ ক্ষমতা পাবে এবং সংবিধান পাস হলে তারা খুশিই হবে। আর যা-ই হোক, গণজাগরণের সময় থেকে তো তারা এর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের বিশ্বাস, খসড়া সংবিধান ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবে—হয়তো ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ভোট পাবে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে বিশ্বাস করে, সংবিধান প্রবর্তন হয়ে গেলে মুরসি তাঁর ‘স্বৈরাচারী ডিক্রি’ বাতিল করবেন। এর মধ্যে মুরসিপন্থীদের সমাবেশ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তাহরির স্কয়ারে সাংবিধানিক ডিক্রি ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে মুরসিবিরোধী পক্ষ।
বিরোধীদের বিশ্বাস, শিগগিরই তাদের সামনে দুটি দুর্ভাগ্যের যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে; মুরসির স্বৈরাচারমূলক সাংবিধানিক ডিক্রি এবং অগ্রহণযোগ্য খসড়া সংবিধান।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ খসড়া সংবিধানের নিন্দা করেছে। তাদের ভাষায়, এই সংবিধানে মত প্রকাশের আর ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। তারা জাতীয় মতৈক্য ছাড়াই খসড়া সংবিধান পাস করার বিষয়ে সংবিধান সভার সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেছে। সংবিধান সভা থেকে উদারপন্থী সদস্যদের নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়টিও তারা উল্লেখ করেছে। সংবিধান সভা সমগ্র মিসরীয় সমাজের প্রতিনিধিত্ব না করে বরং সমাজের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। এভাবে তারা ব্যর্থ করছে মিসরীয় রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের ওপর ধর্মকে প্রতিষ্ঠার রাস্তা পাকা করছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, ‘সংবিধান সভার নেতারা যে গলদযুক্ত ও স্ববিরোধী খসড়া সংবিধানকে ভোটে পাঠিয়েছেন, এটা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার অথবা আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর সঠিক পথ নয়।’
এই বেসরকারি সংস্থাটি যে সাংবিধানিক ডিক্রির বলে আইনি হস্তক্ষেপ থেকে মুরসি নিজের সিদ্ধান্তগুলোকে সুরক্ষা দিয়েছেন, তারও নিন্দা করেছে।
কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।a
No comments