সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-মানুষ, পুলিশ ও মানবিকতা by এএসএম শাহজাহান
রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমীর শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠান হচ্ছে আজ ৬ ডিসেম্বর। ১৯১২ সালে এর প্রতিষ্ঠান এবং যাত্রালগ্ন থেকেই ব্রিটিশ ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে এটি স্বীকৃত হয়।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ_ সব আমলেই এ প্রতিষ্ঠানটি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব পালন করছে। ১৯৭১ সালে আমাদের গৌরবের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সর্বত্র যেসব পুলিশ অফিসার ও বাহিনী সদস্য আত্মদান করেছিলেন তাদেরও বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ নেন এখানেই। আমার নিজেরও প্রশিক্ষণ এ মর্যাদার প্রতিষ্ঠানে। পাকিস্তান আমলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল। আবার সরকারের নির্দেশের কারণে কখনও কখনও জনগণের বিরুদ্ধেও অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছে। স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সেই উত্থানপর্বে আমরা যারা এ বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছি, তাদের জন্য পরিস্থিতি ছিল জটিল। আমাদের পা ফেলতে হয়েছে সতর্কতার সঙ্গে।
এর মধ্যেই কিন্তু পরম সৌভাগ্য ও আনন্দের মুহূর্ত এসেছে অনেকের জন্য। আমার নিজের জীবনে এমনটি ঘটেছে সেই অবিস্মরণীয় দিন ৭ মার্চ, ১৯৭১-এ। আমি তখন ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার। এসপির দায়িত্ব পালন করছিলেন ইআই চৌধুরী সাহেব। মার্চের প্রথম দিন থেকেই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। সবকিছু চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। এসপি সাহেব কাজ করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে। ২ মার্চ থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হচ্ছিল। ৭ মার্চের জনসভার প্রস্তুতি চলে এর মধ্যেই। ওইদিন আমার ওপর রেসকোর্স ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আমি খুব কাছ থেকে শুনেছি সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা_ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনসভা চলাকালেই আমি ওয়্যারলেসে এসপি সাহেবকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং সভাস্থলের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বারবার অবহিত করি। এদিনের পর দেশের সর্বত্র জনগণ স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ় সংকল্প হয় এবং পুলিশ বাহিনীতেও তার প্রভাব পড়ে। ২৫ মার্চের আগেই আমাদের বাহিনীর কেউ কেউ রাজারবাগের মজুদ ভাণ্ডার থেকে অস্ত্র ও গুলি নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের নিবৃত্ত করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের কাছে সবকিছুই স্পষ্ট ছিল। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানায় ইপিআর সদর দফতরের পাশাপাশি রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতরকে প্রধান লক্ষ্যস্থল করা তাদের জন্য ছিল সঙ্গত।
সারদার কথায় ফিরে যাই। 'মানুষকে পুলিশে পরিণত করবে'_ এটাই মূল ট্রেনিংয়ের লক্ষ্য। প্রতিটি মানুষই সৎ, ভালো ও মানুষের কল্যাণকামী_ এমনটিই ধরে নিতে হবে। পুলিশ কি ভিন্ন কিছু? পুলিশে পরিণত হয়ে তাদের ভেতর থেকে কি মানবিক গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়?
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রয়োজন মেটাতেই সৃষ্টি সারদা একাডেমীর। ১৯৪৭ সালের পরও ছিল একই ধারা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর পুলিশের মনোভাব বদলাবে, এমনই ছিল জনমনে প্রত্যাশা। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও ছিল অনুরূপ। গণমাধ্যমেও বিষয়টি সময় সময় গুরুত্ব পায়। কিন্তু অভিযোগ থেকেই যায়, স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পুলিশ বাহিনী নিজেকে যুগোপযোগী করে তুলতে পারেনি। কেবল প্রশিক্ষণের সিলেবাস ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলেই কি এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে, এ প্রশ্ন অনেকের। সাম্প্রতিক বছরগুলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুলিশের আচরণ, মানবাধিকার সংরক্ষণ, নারী-শিশুদের প্রতি মনোভাব, ফোর্স থেকে সার্ভিস_ এ ধরনের বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রিঅ্যাকটিভ থেকে প্রো-অ্যাকটিভ হওয়া_ এটাও পুলিশ বাহিনীতে পরিচিত টার্ম। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, পুলিশকে গণমুখী করার ওপর গুরুত্ব বেড়ে চলেছে এবং নানা পর্যায়ে এ জন্য আন্তরিক প্রয়াসও চলছে। কিন্তু মূল আইন যে এখনও ঔপনিবেশিক আমলের!
পুলিশের দুটি মূল কাজ_ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। জরুরি অনেক দায়িত্বও তাদের ওপর এসে পড়ে। দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। এর ভিত্তি আইনানুগ হতে হবে। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কোনো বাড়াবাড়ি যেন না হয়। সেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিককে সমান ঘোষণা করেছে। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতায় রয়েছে সবার সমান অধিকার। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের ক্ষেত্রেও অধিকার সমান। আইন অনুযায়ী জীবনযাপনে কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হয় যে, গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছাই সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি। আইনের শাসনের অর্থ কোনোভাবেই আইনের দ্বারা শাসন নয়, বরং আইনেরই শাসন। যথাযথ জ্ঞান প্রশিক্ষণ থাকলে এ দায়িত্ব পালন সহজ হয়। অন্যথায় তারা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবে না। অব্যাহত প্রশিক্ষণ চাই। কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে চাই বিচারবোধ। একই আইন এবং একই ধরনের ঘটনা; কিন্তু তা মোকাবেলায় পুলিশের আচরণ এক হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক রকম হবে, খেলার মাঠে আরেক রকম। হাটবাজারে যা হবে, প্রত্যন্ত গ্রামে তা হবে না। এমনকি পাশাপাশি অবস্থানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের বিক্ষোভ মোকাবেলার কৌশল হতে পারে ভিন্ন। আইনে বলা আছে, কোন ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি করতে পারবে। কিন্তু অনেক কিছু বিবেচনায় রাখতে হয় পুলিশকে। ১৯৯৩ সালে আমি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুই পক্ষের গুলিবর্ষণের সময় চৌকস পুলিশ অফিসার ফরহাদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সেখানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাকে পুলিশ ফোর্স প্রত্যাহারের আদেশ দিতে হয়। আরেক ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বে থাকা এক অফিসার জানান যে, দুই দল ছাত্রের মধ্যে গোলাগুলি চলছে এবং তারা এমন একজনকে নাগালের মধ্যে পেয়েছে যার গুলিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ চাইলেই ওই ঘাতককে গুলি করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও আলোচনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত গুলিবর্ষণ না করে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
পুলিশের কাজে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আমি ব্রিটেনের একটি মামলার কথা উল্লেখ করতে চাই। মামলাটি ছিল খেলা নিয়ে_ একজন ক্রিকেটের ব্যাটসম্যান এলবিডবি্লউ আউট হলে তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা শেষে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত মেলে যে, আম্পায়ার ভুল করেছিলেন। আম্পায়ার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মাননীয় আদালত বছর দুয়েক সময় নিয়ে অনেকের মতামত শুনে রায় দিয়েছেন। আর আমার জন্য বরাদ্দ ছিল এক সেকেন্ডেরও অনেক কম সময়। পুলিশের জন্যও এ ঘটনা শিক্ষামূলক। তাদের কখনও কখনও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। পেশাদারিত্বের মনোভাব থাকলে এ কাজ অনেক সহজ হয়।
পুলিশের সংস্কারের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল ইস্যু দুটি_ বাহিনীর কারও কারও অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সরকারের পক্ষে বলপ্রয়োগ। আমি বেশ আগেই অবসর নিয়েছি বাহিনী থেকে। তারপর সরকারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদেও কাজ করেছি। কখনও কখনও এমন মন্তব্য শুনি যে, স্যার, আপনাকে দেখলে পুলিশে ছিলেন মনে হয় না। এ ধরনের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, অনেকের মনে পুলিশ সম্পর্কে একটি ধারণা গেঁথে আছে এবং সেটা মূলত নেতিবাচক। আমাকে দেখে পুলিশ মনে হয় না_ এ ধরনের মন্তব্যে যতটা না শ্রদ্ধা, তার চেয়ে ঢের বেশি থাকে খুশি করার চেষ্টা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অব্যাহত চেষ্টা থাকতে হবে, যাতে সমাজে তাদের সম্পর্কে ধারণা বদলে যায়।
ইংরেজি ৬টি অক্ষর নিয়ে পুলিশ লেখা হয়। এর মধ্যেও অক্ষর বোঝায় ওবিডিয়েন্ট এবং এল-এ লয়াল। তারা কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, আইন ও মানুষের প্রতি অনুগত হবে ও বাধ্য থাকবে। আমি মনে করি, পুলিশকে হতে হবে নিরাপত্তা ও নির্ভরতার প্রতীক। যে কোনো লোক অপরাধের শিকার হয়ে কিংবা কোনো সমস্যায় পড়ে যদি থানায় যায় তাকে মন খুলে কথা বলার পরিবেশ দিতে হবে। তার যদি গোপন কথা থাকে, সেটা বলার জন্য আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারে এমন কাউকেও সেখানে পেতে হবে। থানা থেকে বের হয়ে আসার সময় যেন এ ভরসা মেলে যে, রাষ্ট্র তার সঙ্গে রয়েছে। যিনি থানায় আসবেন তিনি ধনী কিংবা নিঃস্ব, রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী কিংবা একেবারেই সাধারণ সেটা বিবেচনায় রাখা চলবে না। সবার জন্য একই মনোভাব থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল পুলিশ বাহিনী নয়, সমাজেরও ভূমিকা থাকে। তাদের সংশ্লিষ্টতা অপরিহার্য। কমিউনিটি পুলিশের ধারণা এখান থেকেই এসেছে। পুলিশ ও সমাজ পরস্পর হাত মিলিয়ে কাজ করবে। আমরা সারদায় ট্রেনিং পেয়েছি। প্রতি বছর নতুন নতুন দল সেখানে ট্রেনিং নিচ্ছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক পরিবেশের প্রভাব প্রতিনিয়ত পড়ছে পুলিশের ওপর। পুলিশের সদস্য কিংবা বাইরের কেউ যদি ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং ন্যায়নীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে, তাহলে তার মধ্যে মানবিক গুণের অভাব হওয়ার কথা নয়। পুলিশের সংস্কারের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন এ বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। কাজের ক্ষেত্রে তারা যেন সমাজকে সহযোগী হিসেবে পায় তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দুই পক্ষের চাই পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্ব।
পুলিশ বাহিনীতে দায়িত্ব পালনকালে আনন্দ ও বেদনার কত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। চট্টগ্রামে থাকাকালে আমার এক স্কুলশিক্ষক গিয়েছিলেন বাসায়। দুয়েকদিন থেকে তিনি চলে যান এবং কিছু সময় পরে ফিরে আসেন। তার কাছে থাকা ১০ হাজার টাকা পকেটমার হয়েছিল। এটা জেনে চট্টগ্রাম পুলিশের একটি দল সে টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিল। এ ঘটনা স্মরণ করে এখনও আনন্দ পাই। টাকা হারিয়ে আমার ওই শিক্ষকের মুখে যে বিষাদ দেখেছি সেটা মুহূর্তে দূর হয়ে গিয়েছিল। সমাজের সর্বত্র এমন অবস্থা সৃষ্টি করার জন্যই পুলিশ বাহিনী কাজ করে। এ জন্য অবশ্য একটি শর্ত অপরিহার্য_ জনস্বার্থে এ বাহিনীকে ব্যবহারে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সেটা যতদিন নিশ্চিত না হবে, পুলিশের কাছ থেকে প্রত্যাশার অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।
এএসএম শাহজাহান : সাবেক আইজিপি
এর মধ্যেই কিন্তু পরম সৌভাগ্য ও আনন্দের মুহূর্ত এসেছে অনেকের জন্য। আমার নিজের জীবনে এমনটি ঘটেছে সেই অবিস্মরণীয় দিন ৭ মার্চ, ১৯৭১-এ। আমি তখন ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার। এসপির দায়িত্ব পালন করছিলেন ইআই চৌধুরী সাহেব। মার্চের প্রথম দিন থেকেই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। সবকিছু চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। এসপি সাহেব কাজ করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে। ২ মার্চ থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হচ্ছিল। ৭ মার্চের জনসভার প্রস্তুতি চলে এর মধ্যেই। ওইদিন আমার ওপর রেসকোর্স ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আমি খুব কাছ থেকে শুনেছি সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা_ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনসভা চলাকালেই আমি ওয়্যারলেসে এসপি সাহেবকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং সভাস্থলের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বারবার অবহিত করি। এদিনের পর দেশের সর্বত্র জনগণ স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ় সংকল্প হয় এবং পুলিশ বাহিনীতেও তার প্রভাব পড়ে। ২৫ মার্চের আগেই আমাদের বাহিনীর কেউ কেউ রাজারবাগের মজুদ ভাণ্ডার থেকে অস্ত্র ও গুলি নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের নিবৃত্ত করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের কাছে সবকিছুই স্পষ্ট ছিল। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানায় ইপিআর সদর দফতরের পাশাপাশি রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতরকে প্রধান লক্ষ্যস্থল করা তাদের জন্য ছিল সঙ্গত।
সারদার কথায় ফিরে যাই। 'মানুষকে পুলিশে পরিণত করবে'_ এটাই মূল ট্রেনিংয়ের লক্ষ্য। প্রতিটি মানুষই সৎ, ভালো ও মানুষের কল্যাণকামী_ এমনটিই ধরে নিতে হবে। পুলিশ কি ভিন্ন কিছু? পুলিশে পরিণত হয়ে তাদের ভেতর থেকে কি মানবিক গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়?
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রয়োজন মেটাতেই সৃষ্টি সারদা একাডেমীর। ১৯৪৭ সালের পরও ছিল একই ধারা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর পুলিশের মনোভাব বদলাবে, এমনই ছিল জনমনে প্রত্যাশা। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও ছিল অনুরূপ। গণমাধ্যমেও বিষয়টি সময় সময় গুরুত্ব পায়। কিন্তু অভিযোগ থেকেই যায়, স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পুলিশ বাহিনী নিজেকে যুগোপযোগী করে তুলতে পারেনি। কেবল প্রশিক্ষণের সিলেবাস ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলেই কি এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে, এ প্রশ্ন অনেকের। সাম্প্রতিক বছরগুলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুলিশের আচরণ, মানবাধিকার সংরক্ষণ, নারী-শিশুদের প্রতি মনোভাব, ফোর্স থেকে সার্ভিস_ এ ধরনের বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রিঅ্যাকটিভ থেকে প্রো-অ্যাকটিভ হওয়া_ এটাও পুলিশ বাহিনীতে পরিচিত টার্ম। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, পুলিশকে গণমুখী করার ওপর গুরুত্ব বেড়ে চলেছে এবং নানা পর্যায়ে এ জন্য আন্তরিক প্রয়াসও চলছে। কিন্তু মূল আইন যে এখনও ঔপনিবেশিক আমলের!
পুলিশের দুটি মূল কাজ_ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। জরুরি অনেক দায়িত্বও তাদের ওপর এসে পড়ে। দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। এর ভিত্তি আইনানুগ হতে হবে। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কোনো বাড়াবাড়ি যেন না হয়। সেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিককে সমান ঘোষণা করেছে। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতায় রয়েছে সবার সমান অধিকার। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের ক্ষেত্রেও অধিকার সমান। আইন অনুযায়ী জীবনযাপনে কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হয় যে, গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছাই সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি। আইনের শাসনের অর্থ কোনোভাবেই আইনের দ্বারা শাসন নয়, বরং আইনেরই শাসন। যথাযথ জ্ঞান প্রশিক্ষণ থাকলে এ দায়িত্ব পালন সহজ হয়। অন্যথায় তারা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবে না। অব্যাহত প্রশিক্ষণ চাই। কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে চাই বিচারবোধ। একই আইন এবং একই ধরনের ঘটনা; কিন্তু তা মোকাবেলায় পুলিশের আচরণ এক হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক রকম হবে, খেলার মাঠে আরেক রকম। হাটবাজারে যা হবে, প্রত্যন্ত গ্রামে তা হবে না। এমনকি পাশাপাশি অবস্থানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের বিক্ষোভ মোকাবেলার কৌশল হতে পারে ভিন্ন। আইনে বলা আছে, কোন ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি করতে পারবে। কিন্তু অনেক কিছু বিবেচনায় রাখতে হয় পুলিশকে। ১৯৯৩ সালে আমি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুই পক্ষের গুলিবর্ষণের সময় চৌকস পুলিশ অফিসার ফরহাদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সেখানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাকে পুলিশ ফোর্স প্রত্যাহারের আদেশ দিতে হয়। আরেক ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বে থাকা এক অফিসার জানান যে, দুই দল ছাত্রের মধ্যে গোলাগুলি চলছে এবং তারা এমন একজনকে নাগালের মধ্যে পেয়েছে যার গুলিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ চাইলেই ওই ঘাতককে গুলি করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও আলোচনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত গুলিবর্ষণ না করে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
পুলিশের কাজে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আমি ব্রিটেনের একটি মামলার কথা উল্লেখ করতে চাই। মামলাটি ছিল খেলা নিয়ে_ একজন ক্রিকেটের ব্যাটসম্যান এলবিডবি্লউ আউট হলে তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা শেষে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত মেলে যে, আম্পায়ার ভুল করেছিলেন। আম্পায়ার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মাননীয় আদালত বছর দুয়েক সময় নিয়ে অনেকের মতামত শুনে রায় দিয়েছেন। আর আমার জন্য বরাদ্দ ছিল এক সেকেন্ডেরও অনেক কম সময়। পুলিশের জন্যও এ ঘটনা শিক্ষামূলক। তাদের কখনও কখনও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। পেশাদারিত্বের মনোভাব থাকলে এ কাজ অনেক সহজ হয়।
পুলিশের সংস্কারের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল ইস্যু দুটি_ বাহিনীর কারও কারও অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সরকারের পক্ষে বলপ্রয়োগ। আমি বেশ আগেই অবসর নিয়েছি বাহিনী থেকে। তারপর সরকারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদেও কাজ করেছি। কখনও কখনও এমন মন্তব্য শুনি যে, স্যার, আপনাকে দেখলে পুলিশে ছিলেন মনে হয় না। এ ধরনের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, অনেকের মনে পুলিশ সম্পর্কে একটি ধারণা গেঁথে আছে এবং সেটা মূলত নেতিবাচক। আমাকে দেখে পুলিশ মনে হয় না_ এ ধরনের মন্তব্যে যতটা না শ্রদ্ধা, তার চেয়ে ঢের বেশি থাকে খুশি করার চেষ্টা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অব্যাহত চেষ্টা থাকতে হবে, যাতে সমাজে তাদের সম্পর্কে ধারণা বদলে যায়।
ইংরেজি ৬টি অক্ষর নিয়ে পুলিশ লেখা হয়। এর মধ্যেও অক্ষর বোঝায় ওবিডিয়েন্ট এবং এল-এ লয়াল। তারা কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, আইন ও মানুষের প্রতি অনুগত হবে ও বাধ্য থাকবে। আমি মনে করি, পুলিশকে হতে হবে নিরাপত্তা ও নির্ভরতার প্রতীক। যে কোনো লোক অপরাধের শিকার হয়ে কিংবা কোনো সমস্যায় পড়ে যদি থানায় যায় তাকে মন খুলে কথা বলার পরিবেশ দিতে হবে। তার যদি গোপন কথা থাকে, সেটা বলার জন্য আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারে এমন কাউকেও সেখানে পেতে হবে। থানা থেকে বের হয়ে আসার সময় যেন এ ভরসা মেলে যে, রাষ্ট্র তার সঙ্গে রয়েছে। যিনি থানায় আসবেন তিনি ধনী কিংবা নিঃস্ব, রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী কিংবা একেবারেই সাধারণ সেটা বিবেচনায় রাখা চলবে না। সবার জন্য একই মনোভাব থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল পুলিশ বাহিনী নয়, সমাজেরও ভূমিকা থাকে। তাদের সংশ্লিষ্টতা অপরিহার্য। কমিউনিটি পুলিশের ধারণা এখান থেকেই এসেছে। পুলিশ ও সমাজ পরস্পর হাত মিলিয়ে কাজ করবে। আমরা সারদায় ট্রেনিং পেয়েছি। প্রতি বছর নতুন নতুন দল সেখানে ট্রেনিং নিচ্ছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক পরিবেশের প্রভাব প্রতিনিয়ত পড়ছে পুলিশের ওপর। পুলিশের সদস্য কিংবা বাইরের কেউ যদি ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং ন্যায়নীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে, তাহলে তার মধ্যে মানবিক গুণের অভাব হওয়ার কথা নয়। পুলিশের সংস্কারের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন এ বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। কাজের ক্ষেত্রে তারা যেন সমাজকে সহযোগী হিসেবে পায় তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দুই পক্ষের চাই পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্ব।
পুলিশ বাহিনীতে দায়িত্ব পালনকালে আনন্দ ও বেদনার কত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। চট্টগ্রামে থাকাকালে আমার এক স্কুলশিক্ষক গিয়েছিলেন বাসায়। দুয়েকদিন থেকে তিনি চলে যান এবং কিছু সময় পরে ফিরে আসেন। তার কাছে থাকা ১০ হাজার টাকা পকেটমার হয়েছিল। এটা জেনে চট্টগ্রাম পুলিশের একটি দল সে টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিল। এ ঘটনা স্মরণ করে এখনও আনন্দ পাই। টাকা হারিয়ে আমার ওই শিক্ষকের মুখে যে বিষাদ দেখেছি সেটা মুহূর্তে দূর হয়ে গিয়েছিল। সমাজের সর্বত্র এমন অবস্থা সৃষ্টি করার জন্যই পুলিশ বাহিনী কাজ করে। এ জন্য অবশ্য একটি শর্ত অপরিহার্য_ জনস্বার্থে এ বাহিনীকে ব্যবহারে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সেটা যতদিন নিশ্চিত না হবে, পুলিশের কাছ থেকে প্রত্যাশার অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।
এএসএম শাহজাহান : সাবেক আইজিপি
No comments