‘র্যাব হতে চাই, প্রতিশোধ নেব’ by হাসান শাহরিয়ার হৃদয়
“তুই মরতে পারিস না! মরতে পারিস না!” এভাবেই ছেলের রক্তমাখা শরীর কোলে নিয়ে
চিৎকার করছিলেন বাবা। সন্তানের পেট চিড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে আসা ঠেকানোর
জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছিলেন তিনি।
দৃশ্যটি ঢাকার রাস্তায় ছুটে
চলা এক রিকশায় দেখা। যদিও মুমূর্ষু সন্তানকে হাসপাতালে নেওয়ার বাহন হিসেবে
রিকশা মোটেই উপযোগী নয়, কিন্তু দরিদ্র বাবার এর চেয়ে বেশি কিছু করার
সামর্থ্য নেই।৭ বছরের ছোট্ট ছেলেটিকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই চারজন লোক ঘিরে ধরেছিল। তার হাত-পা বেঁধে ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল মাথা। গলার কাছে ছুরি ধরে টান দিয়ে পেট পর্যন্ত চিড়ে দিয়েছিল। পেটের চারপাশে ঘুরিয়ে ছুরি দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছিল। আর সবশেষে, তার পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ ছুরির পোঁচ মেরে কেটে ফেলা হলো।
এই শিশুটি এখনও এক ভয়াবহ ‘প্রথা’র জীবন্ত সাক্ষী। বাংলাদেশের অন্যতম নিষ্ঠুর, একই সঙ্গে অন্যতম উপেক্ষিত এই প্রথার নাম জোরপূর্বক ভিক্ষাবৃত্তি।
নাটকীয় এই কাহিনী অবশ্য এটাও শিক্ষা দেয় যে পৃথিবী থেকে সব ভালো এখনো হারিয়ে যায়নি। পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে হতভাগা এই শিশুকে বাঁচিয়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কিছু মানুষ।
এ ঘটনার পর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। শিশুটির শীর্ণ শরীরে এখনো আঘাতের চিহ্নের ছড়াছড়ি। অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পায় সে। এমনকি ঘুমের মধ্যেও প্রায়ই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
২০১০ সালের ঈদুল ফিতরের মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটেছিল এ ঘটনা। স্থানীয় তিনটি শিশু তাকে আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে ঘর থেকে বের করে এনেছিল।
ঘর ছেড়ে বের হতেই একদল লোক জাপটে ধরে তাকে একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে অচেতন করে ফেলে তাকে।
শিশুটি বেঁচে থাকতে পারে, সেটা চিন্তাও করেনি নরপিশাচরা। তারা ঐ গলিতেই তাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। শিশুর টানেই হয়তো তার মা খুঁজতে খুঁজতে চলে আসেন ঐ গলিতে। দেখতে পান রক্তে ভেসে যাওয়া নিজের অর্ধমৃত সন্তানকে। ছুটে আসে আশেপাশের মানুষ, ছুটে আসেন শিশুটির বাবা।
তিন মাস ঢাকায় হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল শিশুটির। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায় বেঁচে গিয়েছিল সে। কিন্তু তার ক্ষতবিক্ষত পুরুষাঙ্গের ব্যাপারে তেমন কিছু করতে পারেননি ডাক্তাররা; কেবল তার মূত্রত্যাগের জন্য বিকল্প একটি পদ্ধতি করে দিয়েছিলেন।
এই নৃশংসতার ঘটনা সেসময় বিস্তারিতভাবে সম্প্রচার করেছিল সিএনএন। ঢাকা থেকে আট হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে বসে বাকরুদ্ধ হয়ে সে ঘটনা দেখেছিলেন ব্যবসায়ী আরাম কোভাচ।
তার ভাষায়, “আমরা সাধারণত টিভিতে ভয়ঙ্কর কিছু দেখার পর বলি, ‘ওহ খোদা!’ তারপরই সব শেষ। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এই শিশুটিকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। অবশ্যই করতে হবে।”
যুগোশ্লাভিয়ার এই বংশোদ্ভুত বর্তমানে একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক, যারা গ্রাহকদের ই-কমার্স ভিত্তিক নানা সুবিধা দিয়ে থাকে।
সিএনএনকে একটি ছোট্ট মেইল পাঠিয়েছিলেন কোভাচ। সেখানে লেখা ছিল, “এই কাহিনী আমি কোনোভাবেই আমি আমার মাথা থেকে দূর করতে পারছি না। আমি ও আমার স্ত্রী যে কোনো মূল্যে এই পরিবার ও তাদের ছোট শিশুটিকে সাহায্য করতে চাই।” শিশুর হতভাগ্য বাবা অবশ্য জানেন না, সিএনএনের পাঁচ মিনিটের একটি পরিবর্তন ততোক্ষণে তার সন্তানের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে শুরু করেছে।
এর আগে অনেক জায়গায় গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দরিদ্র রিকশাচালক হওয়ায় শিশুর জন্য তেমন কিছুই করতে পারেননি। আইন তার শিশুকে চিরকালের মতো পঙ্গু করে দেওয়া শিশুকে রক্ষা করতে পারেনি। বিষয়টি নজরে আসে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এলিনা খানের। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছেন।
মামলা পরিচালনার জন্য সবরকম সহায়তা করেন এলিনা খান। ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচ অপরাধীকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব)।
জানা যায়, এভাবে আরও অন্তত পাঁচ শিশুকে পঙ্গু করেছে এই নরপশুরা। শিশুদের অভুক্ত রেখে, পঙ্গু করে তাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হতো। তবে আমাদের আলোচ্য শিশুটির উপর মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এ নির্যাতন তারা কেনো করল, এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি। শিশুটির বাবা মনে করছেন, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তার শিশুর উপর এ নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়েছে।
আবারও হামলা করতে পারে নরপশুরা, এই ভয়ে র্যাবের হেফাজতে ছিলেন তিনি ও তার পরিবার। শিশুটিও সেখানেই ছিল। এগিয়ে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স চিলড্রেনস সেন্টারের পেডিয়াট্রিক ইউরোলজিস্ট জন গিয়ারহার্ট। তিনি বলেছিলেন, “আমার ২৩ বছরের অভিজ্ঞতায় কখনো পুরষাঙ্গে এতো ভয়াবহ ইনজুরি দেখিনি।” আরও বলেছিলেন, “একজন মানুষ যে আরেকজনকে এমন কিছু করতে পারে, তা কল্পনা করা যায় না।”
আরও কয়েক সঙ্গী যোগাড় করলেন গিয়ারহার্ট, যারা তার মতোই শিশুটিকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। তৈরি হল চিকিৎসক দল। কাতার এয়ারওয়েজ বিনামূল্যে শিশুটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাল। অন্যান্য সব খরচার দায়িত্ব নিলেন কোভাচ।
শিশুর বাবা আবেগ বিহ্বল হয়ে বলেছিলেন, “ফেরেশতা নাকি শুধু বেহেশতে থাকে। তারা যে আমাদের মাঝেও থাকে, এরাই তার প্রমাণ।” শিশুটি ও তার বাবাকে নিয়ে ওয়াশিংটনে এলেন মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান।
শিশুটিকে সামনে পেয়ে কোভাচ বলেছিলেন, “তুমি প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের মাঝে আছো। তোমাকে কাছে পেয়ে আমরা আনন্দিত।”
সুযোগ বুঝে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কোভাচকে জিজ্ঞেস করেছিলেন শিশুর বাবা, “কেন তোমরা আমাদের জন্য এতো করছো?” কোভাচ উত্তরে বলেছিলেন, “কারণ আমরা মানুষ।”
ডাক্তারদের বারবার একটা প্রশ্নই জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি, “আমার ছেলে কি আবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে? সে কি বংশধর রক্ষা করতে পারবে?”
ডাক্তাররা স্বীকার করেছিলেন যে অপারেশনটি অত্যন্ত জটিল। এমনকি এর উল্লেখও নেই কোথাও। তারা বলেছিলেন, এর জন্য নতুন কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর নাম দেওয়া হল, ‘অপারেশন হোপ’।
পেডিয়াট্রিক সার্জারির আরও দুই খ্যাতনামা সার্জন ডা. রিচার্ড রেডিট ও ডা. ডায়লান স্টুয়ার্টকে দলে নিলেন গিয়ারহার্ট। শুরু হলো এক নতুন সংগ্রাম। শিশুর হাত থেকে টিস্যু নিয়ে পুরুষাঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করলেন ডাক্তাররা। কিন্তু ডা. রেডিট এক দুঃসংবাদ দিলেন- শিশুটির আর কোনো প্রজনন টিস্যু অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। তাই জননাঙ্গ স্থাপন করলেও সেটি ঠিকভাবে কাজ করবে না।
খবরটা শুনে একেবারেই ভেঙে পড়লেন শিশুর বাবা। তারপরও তাকে খোদার উপর ভরসা রাখতে বলে কাজ শুরু করলেন ডাক্তাররা।
হাসিমুখেই অপারেশনের টেবিলে গেল শিশুটি। ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে কিংবা কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই তার। অপারেশনের টেবিলে শুয়ে ডাক্তারদের মহা উৎসাহে বলল, “চলো, শুরু করি!”
ঠিক সকাল ৯টায় শুরু হয় জটিল এই অপারেশন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, আট থেকে দশ ঘণ্টাও লাগতে পারে এতে। দেশে ফোন করে শিশুটির মাকে তার বাবা বললেন, “সবাইকে ওর জন্য দোয়া করতে বলো। সব খোদার হাতে।”
অপারেশনের কিছুক্ষণের মধ্যে একটি চমৎকার ব্যাপার লক্ষ্য করলেন ডাক্তাররা। শিশুটির শরীরের বাইরে প্রজনন টিস্যু আর না থাকলেও তার শরীরের ভেতর দিকে অল্পকিছু সংবেদনশীল টিস্যু অবশিষ্ট ছিল, যেটা এমআরআই রিপোর্টে ধরা পড়েনি। উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ডাক্তাররা। আরও পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন, মূত্রনালীর বদলে যে টিউব দিয়ে শিশুটির মূত্রত্যাগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ঢাকার ডাক্তাররা, তাকেও সঠিক অবস্থানে আনা সম্ভব।
অপারেশন শেষ হওয়ার আগেই বাইরে এসে শিশুর বাবাকে খবরটা দিলেন গিয়ারহার্ট। আনন্দে কাঁদতে শুরু করলেন বাবা।
এমনকি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি এলিনা খানও। প্রায় এক বছরের উপর তিনি পরিবারটির সঙ্গে আছেন, এই প্রথম এমন কোনো ভালো খবর এলো। তিনি বললেন, “এতোদিনের এতো কষ্ট, সব সার্থক।”
যেখানে ১০ ঘণ্টার অপারেশনের কথা বলেছিলেন ডাক্তাররা, সেখানে তা তিন ঘণ্টাতেই শেষ হয়ে গেল। অপারেশন থিয়েটার থেকে হাসিমুখে বের হয়ে রেডিট জানালেন, “অপারেশন সাক্সেসফুল।”
অস্ত্রোপচারের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই হাসপাতাল ছাড়ল শিশুটি। তবে তিন মাস তাকে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। এ সময় খুব অল্প নড়াচড়া ছাড়া তেমন কিছু করা যাবে না।
এলিনা খান আশা প্রকাশ করলেন, এই শিশু একদিন বড় হয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হবে। আর কোনো শিশুর জীবনে যেন এমন কিছু না ঘটে। কোভাচ ও তার স্ত্রীরও একই আশা। তারা দুজন শিশুটির পড়াশোনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে চান।
এর আগেও শিশুটিকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বড় হয়ে সে কী হতে চায়। দাঁতে দাঁত পিষে সে বলেছিল, “র্যাবের অফিসার, যাতে প্রতিশোধ নিতে পারি।”
এখন তার স্বপ্ন ভিন্ন। জন হপকিন্স ছাড়ার আগে সে জানিয়ে গেল, “আমি মানুষকে বাঁচাতে চাই। আমি ডাক্তার হবো।”
No comments