ব-দ্বীপ বর্ম by শেখ রোকন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অস্থির সাগরের ছোবল থেকে উপকূলীয় শহর কীভাবে রক্ষা পেতে পারে_ প্রশ্নটি নতুন করে সামনে এসেছে সুপারস্টর্ম স্যান্ডিতে নিউইয়র্ক লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার পর। এ নিয়ে গত সপ্তাহের টাইম সাময়িকীতে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, দুইশ' বছরের রেকর্ড ভেঙে জলোচ্ছ্বাসের পানি সাবওয়েতেও ঢুকে পড়ায় নিউইয়র্কবাসীর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সামনে রয়েছে দুই ধরনের উদাহরণ।
১৯৫৩ সালের কুখ্যাত 'নর্থ সি ফ্লাড' থেকে উদ্ভূত। সেবারও স্যান্ডির মতো ঝড় আঘাত হেনেছিল ইউরোপের উপকূলে। সঙ্গে ভরা কটালের জলোচ্ছ্বাস। ঝড়ের আঘাত যেমন-তেমন; প্লাবনের পাল্লায় পড়ে নাজেহাল হয়েছিল ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও বেলজিয়াম। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নেদারল্যান্ডস। সাগর-শিকস্তি থেকে সুরক্ষায় উপকূলজুড়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজে দেয়নি। প্রাণ হারিয়েছিল অন্তত দুই হাজার নাগরিক। শোক সামলে তখনকার ১৩শ' কোটি ডলারের এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়েছিল দেশটি। পরে এটা 'ডেল্টা ওয়ার্কস' বা ব-দ্বীপ বর্ম হিসেবে পরিচিতি পায়। উপকূলজুড়ে গড়ে তোলে ৬৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরক্ষা ব্যবস্থা_ বেড়িবাঁধ, সমুদ্রপ্রাচীর, পরিখা, লকগেট ও ড্যাম, যাতে জলোচ্ছ্বাস আর আঘাত হানতে না পারে। ওই ব্যবস্থাকে বলা হয় থাউজেন্ড-ইন-ওয়ান। স্থপতিরা দাবি করেছিলেন, পরবর্তী এক হাজার বছরের রক্ষাকবচ তৈরি করেছেন তারা।
ওই জলোচ্ছ্বাসের অভিজ্ঞতা ঐতিহ্যগতভাবে সমুদ্রচারী ব্রিটিশদেরও সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল। তিন দশক ধরে তারা গড়ে তুলেছে 'টেমস ব্যারিয়ার'। স্বাভাবিক অবস্থায় এর মধ্য দিয়ে নৌযান নদী থেকে সাগরে নামতে পারে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ওই স্থাপনা হয়ে ওঠে নিশ্ছিদ্র প্রাচীর। একই ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইতালির আধা-মগ্ন নগরী ভেনিস।
নিউইয়র্কবাসীও কি এসব নজির অনুসরণ করবে? বিষয়টি সহজ নয়। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এতে এক হাজার কোটি ডলার খরচ পড়বে। মূল সমস্যা, নিউইয়র্ক সিটির ৮০০ কিলোমিটার উপকূলরেখার ধরন। আমেরিকার পাদদেশ ইউরোপের মতো নয়। যে কারণে লন্ডনের সুরক্ষা প্রযুক্তি নিউইয়র্কে কাজ করবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। হ্যারিকেন ক্যাটরিনার সময় নিউ অরলিন্সের বাঁধ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
ভূমির গঠন কেবল নয়; সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির হারও বড় বাধা। গত কয়েক বছর ধরে যে মাত্রায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল; সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা তার চেয়েও তাতানো। এখনই ব-দ্বীপ বর্মের হাজার বছরের নিশ্চয়তায় পাঁচ দশকের মাথায় চিড় ধরেছে। ডাচ্রা তাদের বর্ম আরও মজবুত ও উঁচু করার পরিকল্পনা করছে। তাতে বাঁধ বাবদ তাদের সাংবৎসরিক খরচের সঙ্গে আরও এক বিলিয়ন ডলার করে যোগ হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ টেমস ব্যারিয়ারও সেকেলে হয়ে পড়তে পারে। সাগরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বহুমূল্য সুরক্ষা প্রাচীর কতটা উঁচু করা সম্ভব_ সে প্রশ্নও মাথা তুলছে।
এ ক্ষেত্রে ঢাকার উদাহরণ সামনে এনেছে টাইম। ঢাকায় কীভাবে পাম্প করে বন্যার পানি নামানো হয়; কীভাবে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র জলোচ্ছ্বাসের সময় কাজে আসে; কীভাবে ভাসমান বাগান তৈরি হচ্ছে। আবার এসব যে খুব কাজের নয়, তাও বলেছে। কাজের কাজ বরং হতে পারে উপকূলীয় গরান বনভূমি ও জলাভূমি অক্ষত রাখা গেলে। আমরা দেখেছি, সুন্দরবন কীভাবে একের পর এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় ঠেকিয়ে দিচ্ছে। উপকূলজুড়েই যদি সুন্দরবন থাকত! প্রাকৃতিক এ প্রযুক্তি লন্ডন-নিউইয়র্ক গ্রহণ করতে পারুক, না পারুক; বঙ্গীয় ব-দ্বীপের জন্য সেটাই উপযুক্ত বর্ম।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.