আফসোস, তবে আশা ফুরায়নি-বাংলাদেশ : ৪৯.১ ওভারে ২২৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৪৭ ওভারে ২২৮/৬ ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী by মোস্তফা মামুন
সারা দিন সবচেয়ে বেশি যে শব্দগুলো শোনা গেল সেগুলো 'উহ' 'আহ' 'ইশ' 'উফ'। আর এই শব্দমালা মিলেই তৈরি হচ্ছে ম্যাচের সমাপ্তি সংগীত। সেই করুণ সমাপ্তি সংগীত যার একপিঠে হৃদয়ভেদী আফসোস, আরেক পিঠে জেগে থাকা আশা।
যদি আরো ২০টা রান বেশি হতো! যদি টসটা জিতে আগে ফিল্ডিং করা যেত, তাহলে শিশিরমাখা হাত নিয়ে সুনীল নারিন এমন বিষময় হতে পারতেন না! হৃদয়ে কাটাকুটি খেলছে যখন এসব আফসোস, তখন তার অন্য অংশ দেখাচ্ছে আশার দিগন্ত। বাংলাদেশ ম্যাচ জেতেনি, তাই সিরিজ জেতার অপেক্ষাও রয়ে গেল; কিন্তু হারা ম্যাচেও তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘাম-শ্রম-শক্তি সব কিছু বের করে নেওয়া গেল। এই প্রতিজ্ঞা আর চেষ্টা থাকলে দুই ম্যাচের একটিতে হবেই হবে! হতেই হবে!
সবচেয়ে বেশি শুনলাম 'উহ' 'আহ', আর সবচেয়ে বেশি দেখলাম মাথায় হাত। বল ঘুরছে অবিশ্বাস্য, বোলাররাও সঠিক জায়গা মেপে বল করছেন, ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের কানা মিস করার সংখ্যা গুনতে গেলে ক্যালকুলেটর লাগে এমন অবস্থা; কিন্তু কোনোভাবে সেগুলো ব্যাট ছুঁয়ে যায় না! আবার ক্যাচ ওঠে কিন্তু পড়ে একটু সামনে। সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়েও লাভ হয় না। ওদিকে আম্পায়াররাও কাঠিন্যের প্রতীক হয়ে থাকেন। ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনাগুলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের পক্ষেই যায়। কাজেই শুরুতে গেইলকে ফেরানোর পরও জুটি বড় থেকে বড় হয়। ম্যাচ দূর থেকে দূরে সরতে থাকে। এবং শেষে হাতছানি দিয়ে দিয়ে দেখাল বৃদ্ধাঙ্গুলি।
বাংলাদেশের এক পুরনো ক্রিকেট সাংবাদিক একসময় রসিকতা করে বলতেন, ক্রিকেট ম্যাচের প্রথম ইনিংস দেখতে হয় না। কারণ, প্রথম ইনিংস দেখে বোঝা যায় না কোন দল ভালো খেলছে। এক দল হয়তো অনেক রান করল, তখন মনে হলো দারুণ খেলেছে কিন্তু অন্য দল ব্যাটিংয়ে নেমে সেই রানকে যখন সামান্য বানিয়ে ফেলে তখন মনে হয়, কী বোকামিই না হয়েছে প্রথম ইনিংস দেখার সময়। রসিকতা যদিও কিন্তু সত্যিই ক্রিকেট ম্যাচের প্রথম ইনিংস দেখে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। যেমন আসলে যায় না দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। কাল তখন পর্যন্ত তো মনে হচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সহজেই জিততে যাচ্ছে। অথচ সেখান থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের পাল্টা আক্রমণ। এতক্ষণের 'উহ' 'আহ' হাততালি আর হুল্লোড়ে রূপ নিচ্ছে। ভাগ্যও মুখ ফিরিয়ে থাকা ছেড়ে দিয়েছে। ৩৬ বলে দরকার ৩৪, স্যামুয়েলস বাদ দিলে বাকি সব লেজের দিকের ব্যাটসম্যান, বল আবার একেবারে বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল মারছে! কিন্তু ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে শেষ নয়- এটা যেমন শিক্ষা, তেমনি এটাও শিক্ষা যে এসব সময়ে একটা গোলমাল ঠিক হয়ে যাবে। হয়ে গেল। রুবেল ৪৫তম ওভারে দিলেন ২৪ রান। আশার পিঠে ছুকিকাঘাত করে করে একেকটা বল ছিটকে পড়ল বাউন্ডারিতে। কাজেই এরপর যা বাকি থাকে তা দেখার অপেক্ষা করা লাগে না।
পুরনো আমলের গল্পে এমন শোনা যেত, মানুষের শক্তির কোনো একটা উৎস থাকে। কোনো একটা জিনিসের ছোঁয়ায় মানুষ অবিশ্বাস্য সব কীর্তি করে। এই সিরিজের ক্রিস গেইল কি সেই পুরনো আমলের গল্পের আধুনিক ছবি। সেই জাদুকর যে তাঁর ব্যাটিং জাদুবিদ্যার শক্তিটা ভুল করে ফেলে এসেছে। যে গেইলের কাছে বিশ্বসেরা বোলাররা সব গলির স্তরে নামেন, যার বিপক্ষে করা বল গ্যালারিতে না যেতে দেখলেই অনেক বোলার খুশি হন, সেই গেইল এখন যেন ছেলেখেলার বিষয়। শুরু করেছিলেন সোহাগ গাজী। এখন হাতবদল হয়ে তিনি মাশরাফির খাদ্য। মাশরাফি টানা দ্বিতীয় দিনের মতো তাঁকে আউট করলেন, আউট হতে পারতেন তার আগে আরো কয়েকবার। ওয়ানডে সিরিজে এসে গেইলের রোগের রোগী হয়ে গিয়েছিলেন আরেকজন। মারলন স্যামুয়েলস। যাঁর ক্যারিয়ার চলে সাপ-লুডু খেলার নিয়ম মেনে, ক্রিকেটের কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতার চরমতম অন্ধকার ঘুরে যিনি ফিরে আসেন তাঁর কাছে অবশ্য এক দুই ম্যাচের ব্যর্থতা এমন কিছু ব্যাপার না। সেটা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে না, বরং নতুন প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়তর করে। তাই তো সবাই যখন আসা-যাওয়ার মিছিলে তিনি তখন পাহাড়ের মতো অটল। বাকি ব্যাটিং লাইন আপ ভঙ্গুর, কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গ যোদ্ধা হয়েও ঠিকই লক্ষ্যে অবিচল। পাওয়েল ভালো সঙ্গ দিচ্ছিলেন, তাঁর বিদায়ের পরও যে নাটাইটা হাতছাড়া হয়নি তাঁর কারণ, স্যামুয়েলসের হাতের ব্যাটে সঠিক দিশা ছিল। এরপর একবার সব এলোমেলো হওয়ার জোগাড় হলো। ২৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ৪০তম ওভারে ১৮২, তখন বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের মাঝখানের দেয়াল তিনি একা। একা হলে দেয়াল ধসে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে, রান-বলের হিসাব, লেজের দিকের ব্যাটসম্যানদের রক্ষা করে চলা মিলিয়ে গোলমাল হওয়া স্বাভাবিক। হলো তো না-ই, বরং ফিফটি-ফিফটি অবস্থায় ৪৫তম ওভারে সেই ২৪ রানের বীরত্ব। শেষ পর্যন্ত ৪৭তম ওভারে আউট হলেও ততক্ষণে ম্যাচ শেষ, তাঁর ইনিংসটি ১৪৯ বলে ১৭ চার আর দুই ছক্কায় ১২৬। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এই যে স্যামুয়েলস আজ দাঁড়িয়ে কাজটা শেষ করে এলেন, সেটা কি বাংলাদেশের কেউ পারতেন? হয়ত আরো স্ট্রোকসমৃদ্ধ ঝলমলে ইনিংস খেলতেন কিন্তু ঠিক একেবারে তীরে পৌঁছার নিবিষ্ট ইনিংস কি সম্ভব ছিল? এখনো সম্ভব নয়। এবং এ জন্যই এখনো বাংলাদেশ একটু পিছিয়ে। তবে আশার কথা, দল হিসেবে বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে। এমন ইনিংস খেলার ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ তৈরি না হলেও তাদের বীজ কারো কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে। সময়ে সেই বীজগুলো ঠিক গাছে রূপান্তরিত হলেই হয়।
একাকী একজন জিতিয়ে দেবেন- এমন কীর্তি বাংলাদেশের ক্রিকেটেও আছে। সাকিব করছেন। তামিম করছেন। তাঁর আগে করতেন আশরাফুল। কিন্তু এই সিরিজে এসে দেখা যাচ্ছিল এমন ব্যক্তিনির্ভরতা বাদ দিয়ে দল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। একেকদিন একেকজন নায়ক। কালও কিন্তু বাংলাদেশ দল হিসেবেই খেলেছে। অল্পবিস্তর অবদান অনেকের আছে কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচে ইনিংসটাকে নিরাপদ জায়গায় নিতে হলে যে বা যারা দাঁড়ায়, তাদের দায়িত্বটা পুরো পালন করতে হয়। একজন নায়ক হন, তখন সহনায়করাও গুরুত্বপূর্ণ হন। কিন্তু কেউ যদি নায়কোচিত কিছু না করেন, তাহলে বাকিদের অবদানের আর কার্যকারিতা থাকে না। কাল যেমন কেউ একজন খুব বড় কিছু না করায় মাহমুদ উল্লাহর ৫২, মুশফিকের ৩৮, এনামুলের ৩৩, সোহাগের ৩০ কোনোটাই আর ম্যাচের চূড়ান্ত গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে খুব বড় ভূমিকা রাখছে না। সবাই-ই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে বা করেছে কিন্তু এর জন্য এমন কিছু পুরস্কার নেই। তবু প্রশংসনীয় যে ৭৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়েও পুরো দিকভ্রষ্ট না হয়ে বাংলাদেশ লড়ার স্কোর করেছে। এটাই এই বাংলাদেশের মহিমা। পথ হারায় কিন্তু গন্তব্য পুরো ভুলে যায় না। ফিরে আসার চেষ্টা থাকে। কখনো কখনো ফিরে আসেও।
কিন্তু দুঃখের ছবিও আছে কিছু। আগের দুই ম্যাচে ভালো দুটো ইনিংস খেলেছেন কিন্তু এনামুলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লেগেছিল সেটা তাঁর বিবেচনাবোধ। মরিয়া হয়ে ট্রেন ধরার তাড়া নেই। দেখেশুনে খেলছেন, সঠিক বলটা মারছেন। অথচ কাল কী আশ্চর্য, তৃতীয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে বেঁচে যাওয়ার পরের বলে চালালেন। সেটা ফ্রি হিট ছিল ঠিক আছে। পরের বলে আবার এমন চালাবেন এবং আউট হবেন। ছোট্ট শরীর কিন্তু রকমারি স্ট্রোক আছে হাতে-দর্শকদের পছন্দের তালিকায় মমিনুল এরই মধ্যে। গত ম্যাচে কার্যকর একটা ইনিংস খেলেছেন, কালও একটা জুটি জমিয়ে ফেলছিলেন তখনই এমন আত্মঘাতি শট খেলবেন! মুশফিকই বা কেন এত সুন্দর ভিত্তিপ্রস্তর করা ইনিংসটির সমাপ্তি ঘটাবেন পাওয়ার প্লের সুবিধা না নিয়ে। দুঃখের এই ছবিগুলো রয়েই যাচ্ছে। পাশে সুখের ছবিও আছে অনেক। ওই যে বারবার ওদের ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করা। ব্যাটিংয়ে পথ হারিয়েও ফিরে আসা। বোলিংয়ে হাল ছেড়ে না দিয়ে ম্যাচকে ফিফটি-ফিফটি করে ফেলা। শেষ পর্যন্ত হয়নি। প্রতিদিন হবেও না। হলে তো এখনই বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যায়!
স্যামুয়েলসের কীর্তিতে ৪৫তম ওভারে ২৪ রান হয়ে যাওয়ার পর শেষ কয়েকটা রান ছিল আনুষ্ঠানিকতা। এর শেষ রানগুলো এল স্লিপ আর উইকেটরক্ষকের ফাঁক গলিয়ে আসা বাউন্ডারিতে। আবার 'উহ' 'আহ', আবার সবার মাথায় হাত। শেষটা বোধহয় পুরো ম্যাচের ছবির প্রতীক। এই ম্যাচের সুর তো 'উহ' 'আহ'। এই ম্যাচের পোস্টার তো মাথায় হাত।
কাজেই শেষটাও 'উহ' 'আহ' আর 'মাথায় হাতে'। আর সমাপ্তি সংগীতের একপিঠে হৃদয়ভাঙা আফসোস। অন্যপিঠে জ্বলজ্বলে আশা।
সবচেয়ে বেশি শুনলাম 'উহ' 'আহ', আর সবচেয়ে বেশি দেখলাম মাথায় হাত। বল ঘুরছে অবিশ্বাস্য, বোলাররাও সঠিক জায়গা মেপে বল করছেন, ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের কানা মিস করার সংখ্যা গুনতে গেলে ক্যালকুলেটর লাগে এমন অবস্থা; কিন্তু কোনোভাবে সেগুলো ব্যাট ছুঁয়ে যায় না! আবার ক্যাচ ওঠে কিন্তু পড়ে একটু সামনে। সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়েও লাভ হয় না। ওদিকে আম্পায়াররাও কাঠিন্যের প্রতীক হয়ে থাকেন। ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনাগুলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের পক্ষেই যায়। কাজেই শুরুতে গেইলকে ফেরানোর পরও জুটি বড় থেকে বড় হয়। ম্যাচ দূর থেকে দূরে সরতে থাকে। এবং শেষে হাতছানি দিয়ে দিয়ে দেখাল বৃদ্ধাঙ্গুলি।
বাংলাদেশের এক পুরনো ক্রিকেট সাংবাদিক একসময় রসিকতা করে বলতেন, ক্রিকেট ম্যাচের প্রথম ইনিংস দেখতে হয় না। কারণ, প্রথম ইনিংস দেখে বোঝা যায় না কোন দল ভালো খেলছে। এক দল হয়তো অনেক রান করল, তখন মনে হলো দারুণ খেলেছে কিন্তু অন্য দল ব্যাটিংয়ে নেমে সেই রানকে যখন সামান্য বানিয়ে ফেলে তখন মনে হয়, কী বোকামিই না হয়েছে প্রথম ইনিংস দেখার সময়। রসিকতা যদিও কিন্তু সত্যিই ক্রিকেট ম্যাচের প্রথম ইনিংস দেখে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। যেমন আসলে যায় না দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। কাল তখন পর্যন্ত তো মনে হচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সহজেই জিততে যাচ্ছে। অথচ সেখান থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের পাল্টা আক্রমণ। এতক্ষণের 'উহ' 'আহ' হাততালি আর হুল্লোড়ে রূপ নিচ্ছে। ভাগ্যও মুখ ফিরিয়ে থাকা ছেড়ে দিয়েছে। ৩৬ বলে দরকার ৩৪, স্যামুয়েলস বাদ দিলে বাকি সব লেজের দিকের ব্যাটসম্যান, বল আবার একেবারে বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল মারছে! কিন্তু ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে শেষ নয়- এটা যেমন শিক্ষা, তেমনি এটাও শিক্ষা যে এসব সময়ে একটা গোলমাল ঠিক হয়ে যাবে। হয়ে গেল। রুবেল ৪৫তম ওভারে দিলেন ২৪ রান। আশার পিঠে ছুকিকাঘাত করে করে একেকটা বল ছিটকে পড়ল বাউন্ডারিতে। কাজেই এরপর যা বাকি থাকে তা দেখার অপেক্ষা করা লাগে না।
পুরনো আমলের গল্পে এমন শোনা যেত, মানুষের শক্তির কোনো একটা উৎস থাকে। কোনো একটা জিনিসের ছোঁয়ায় মানুষ অবিশ্বাস্য সব কীর্তি করে। এই সিরিজের ক্রিস গেইল কি সেই পুরনো আমলের গল্পের আধুনিক ছবি। সেই জাদুকর যে তাঁর ব্যাটিং জাদুবিদ্যার শক্তিটা ভুল করে ফেলে এসেছে। যে গেইলের কাছে বিশ্বসেরা বোলাররা সব গলির স্তরে নামেন, যার বিপক্ষে করা বল গ্যালারিতে না যেতে দেখলেই অনেক বোলার খুশি হন, সেই গেইল এখন যেন ছেলেখেলার বিষয়। শুরু করেছিলেন সোহাগ গাজী। এখন হাতবদল হয়ে তিনি মাশরাফির খাদ্য। মাশরাফি টানা দ্বিতীয় দিনের মতো তাঁকে আউট করলেন, আউট হতে পারতেন তার আগে আরো কয়েকবার। ওয়ানডে সিরিজে এসে গেইলের রোগের রোগী হয়ে গিয়েছিলেন আরেকজন। মারলন স্যামুয়েলস। যাঁর ক্যারিয়ার চলে সাপ-লুডু খেলার নিয়ম মেনে, ক্রিকেটের কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতার চরমতম অন্ধকার ঘুরে যিনি ফিরে আসেন তাঁর কাছে অবশ্য এক দুই ম্যাচের ব্যর্থতা এমন কিছু ব্যাপার না। সেটা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে না, বরং নতুন প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়তর করে। তাই তো সবাই যখন আসা-যাওয়ার মিছিলে তিনি তখন পাহাড়ের মতো অটল। বাকি ব্যাটিং লাইন আপ ভঙ্গুর, কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গ যোদ্ধা হয়েও ঠিকই লক্ষ্যে অবিচল। পাওয়েল ভালো সঙ্গ দিচ্ছিলেন, তাঁর বিদায়ের পরও যে নাটাইটা হাতছাড়া হয়নি তাঁর কারণ, স্যামুয়েলসের হাতের ব্যাটে সঠিক দিশা ছিল। এরপর একবার সব এলোমেলো হওয়ার জোগাড় হলো। ২৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ৪০তম ওভারে ১৮২, তখন বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের মাঝখানের দেয়াল তিনি একা। একা হলে দেয়াল ধসে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে, রান-বলের হিসাব, লেজের দিকের ব্যাটসম্যানদের রক্ষা করে চলা মিলিয়ে গোলমাল হওয়া স্বাভাবিক। হলো তো না-ই, বরং ফিফটি-ফিফটি অবস্থায় ৪৫তম ওভারে সেই ২৪ রানের বীরত্ব। শেষ পর্যন্ত ৪৭তম ওভারে আউট হলেও ততক্ষণে ম্যাচ শেষ, তাঁর ইনিংসটি ১৪৯ বলে ১৭ চার আর দুই ছক্কায় ১২৬। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এই যে স্যামুয়েলস আজ দাঁড়িয়ে কাজটা শেষ করে এলেন, সেটা কি বাংলাদেশের কেউ পারতেন? হয়ত আরো স্ট্রোকসমৃদ্ধ ঝলমলে ইনিংস খেলতেন কিন্তু ঠিক একেবারে তীরে পৌঁছার নিবিষ্ট ইনিংস কি সম্ভব ছিল? এখনো সম্ভব নয়। এবং এ জন্যই এখনো বাংলাদেশ একটু পিছিয়ে। তবে আশার কথা, দল হিসেবে বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে। এমন ইনিংস খেলার ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ তৈরি না হলেও তাদের বীজ কারো কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে। সময়ে সেই বীজগুলো ঠিক গাছে রূপান্তরিত হলেই হয়।
একাকী একজন জিতিয়ে দেবেন- এমন কীর্তি বাংলাদেশের ক্রিকেটেও আছে। সাকিব করছেন। তামিম করছেন। তাঁর আগে করতেন আশরাফুল। কিন্তু এই সিরিজে এসে দেখা যাচ্ছিল এমন ব্যক্তিনির্ভরতা বাদ দিয়ে দল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। একেকদিন একেকজন নায়ক। কালও কিন্তু বাংলাদেশ দল হিসেবেই খেলেছে। অল্পবিস্তর অবদান অনেকের আছে কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচে ইনিংসটাকে নিরাপদ জায়গায় নিতে হলে যে বা যারা দাঁড়ায়, তাদের দায়িত্বটা পুরো পালন করতে হয়। একজন নায়ক হন, তখন সহনায়করাও গুরুত্বপূর্ণ হন। কিন্তু কেউ যদি নায়কোচিত কিছু না করেন, তাহলে বাকিদের অবদানের আর কার্যকারিতা থাকে না। কাল যেমন কেউ একজন খুব বড় কিছু না করায় মাহমুদ উল্লাহর ৫২, মুশফিকের ৩৮, এনামুলের ৩৩, সোহাগের ৩০ কোনোটাই আর ম্যাচের চূড়ান্ত গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে খুব বড় ভূমিকা রাখছে না। সবাই-ই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে বা করেছে কিন্তু এর জন্য এমন কিছু পুরস্কার নেই। তবু প্রশংসনীয় যে ৭৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়েও পুরো দিকভ্রষ্ট না হয়ে বাংলাদেশ লড়ার স্কোর করেছে। এটাই এই বাংলাদেশের মহিমা। পথ হারায় কিন্তু গন্তব্য পুরো ভুলে যায় না। ফিরে আসার চেষ্টা থাকে। কখনো কখনো ফিরে আসেও।
কিন্তু দুঃখের ছবিও আছে কিছু। আগের দুই ম্যাচে ভালো দুটো ইনিংস খেলেছেন কিন্তু এনামুলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লেগেছিল সেটা তাঁর বিবেচনাবোধ। মরিয়া হয়ে ট্রেন ধরার তাড়া নেই। দেখেশুনে খেলছেন, সঠিক বলটা মারছেন। অথচ কাল কী আশ্চর্য, তৃতীয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে বেঁচে যাওয়ার পরের বলে চালালেন। সেটা ফ্রি হিট ছিল ঠিক আছে। পরের বলে আবার এমন চালাবেন এবং আউট হবেন। ছোট্ট শরীর কিন্তু রকমারি স্ট্রোক আছে হাতে-দর্শকদের পছন্দের তালিকায় মমিনুল এরই মধ্যে। গত ম্যাচে কার্যকর একটা ইনিংস খেলেছেন, কালও একটা জুটি জমিয়ে ফেলছিলেন তখনই এমন আত্মঘাতি শট খেলবেন! মুশফিকই বা কেন এত সুন্দর ভিত্তিপ্রস্তর করা ইনিংসটির সমাপ্তি ঘটাবেন পাওয়ার প্লের সুবিধা না নিয়ে। দুঃখের এই ছবিগুলো রয়েই যাচ্ছে। পাশে সুখের ছবিও আছে অনেক। ওই যে বারবার ওদের ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করা। ব্যাটিংয়ে পথ হারিয়েও ফিরে আসা। বোলিংয়ে হাল ছেড়ে না দিয়ে ম্যাচকে ফিফটি-ফিফটি করে ফেলা। শেষ পর্যন্ত হয়নি। প্রতিদিন হবেও না। হলে তো এখনই বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যায়!
স্যামুয়েলসের কীর্তিতে ৪৫তম ওভারে ২৪ রান হয়ে যাওয়ার পর শেষ কয়েকটা রান ছিল আনুষ্ঠানিকতা। এর শেষ রানগুলো এল স্লিপ আর উইকেটরক্ষকের ফাঁক গলিয়ে আসা বাউন্ডারিতে। আবার 'উহ' 'আহ', আবার সবার মাথায় হাত। শেষটা বোধহয় পুরো ম্যাচের ছবির প্রতীক। এই ম্যাচের সুর তো 'উহ' 'আহ'। এই ম্যাচের পোস্টার তো মাথায় হাত।
কাজেই শেষটাও 'উহ' 'আহ' আর 'মাথায় হাতে'। আর সমাপ্তি সংগীতের একপিঠে হৃদয়ভাঙা আফসোস। অন্যপিঠে জ্বলজ্বলে আশা।
No comments