সমঝোতা ছাড়াই ফিরে গেল বিশ্বব্যাংক দল
তিন দিনে চার দফা বৈঠক করেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা হলো না দুদকের। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার দায়ে অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে দুদকের মামলা করার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল।
এ নিয়ে গতকাল বুধবার বিকেলে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুদকের দুই দফা বৈঠক হয়। আবুল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করার জন্য দুদককে আগেই নিজেদের মতামত জানিয়ে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংকের প্যানেল। কিন্তু গতকালের বৈঠকে দুদকের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন না দেখে নাখোশ হয়েই ফিরে যায় তারা। এর ফলে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যে আশা জেগে উঠেছিল, তা আবার স্তিমিত হয়ে গেল।
গতকালের বৈঠকের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'বিভিন্ন বিষয়ে প্যানেলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমাদের কাছে জানতে চাওয়া বিভিন্ন বিষয় আমরা তাদের অবহিত করেছি। এগুলো অতি গোপনীয় বিষয়। প্রচলিত আইনের আলোকে এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখব এবং আমাদের তদন্তদলও বিষয়টি আবার যাচাই-বাছাই করে দেখবে।'
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের নামে মামলা হবে কি না- এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'আপনাদের একটি কথা স্পষ্ট করে বলি, বিশ্বব্যাংক কী বলল, প্যানেল কী বলল, তা আমরা শুনব; তবে বাংলাদেশের আইন ও বিধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে দুদক।'
গোলাম রহমান বলেন, 'আইনি ব্যবস্থা দু-এক দিনের মধ্যে বিবেচনা করব। একটু দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।' গতকালের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাদের ভিউ পয়েন্টস বলেছে। আমরাও আমাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি। তারাও ভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে।'
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান ওকাম্পো বলেন, 'দুদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমরা এখানেই সমাপ্তি টানছি।'
তদন্ত ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ নীরব থেকে ওকাম্পো বলেন, 'আমরা এখন এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।' রাতেই ওকাম্পো ঢাকা ছেড়ে গেছেন।
এদিকে দুদক সূত্র জানায়, গত দুই দিনে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে তিন দফা বৈঠকে সৈয়দ আবুল হোসেন ও
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি না করার পক্ষে অবস্থান নেয় কমিশন। পরে কেবল আবুল হোসেনকে আসামি না করার ব্যাপারে অবস্থান নেয় তারা। দুদক গতকাল বিশ্বব্যাংকের প্যানেলকে জানায়, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দালিলিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই দেশের প্রচলিত আইনে তাঁকে আসামি করা সমীচীন নয়। তবে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১২০(খ) ধারায় মামলা করা যায়। কিন্তু আবুল হোসেনকে আসামি না করার সিদ্ধান্তে সরাসরি আপত্তি জানান বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা।
গতকালের বৈঠকের ওপরই নির্ভর করছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ভবিষ্যৎ। তাই সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল এই বৈঠকের দিকে। বিশ্বব্যাংকের প্যানেল শর্ত দিয়েছিল, দুদকের অনুসন্ধান সুষ্ঠু হলে এবং দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলেই কেবল তারা অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে জানাবে।
গতকাল বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে যায় লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদল। পৌনে ৪টায় শুরু হয় দুদকের সঙ্গে তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক। ৪টা ৩৫ মিনিটে হঠাৎ বৈঠক থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন দুদকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, 'আলোচনায় কোনো মীমাংসা হয়নি। নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আবার দুদকে ফিরে আসতে পারি।' সেখান থেকে তাঁরা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় যান।
সন্ধ্যা সোয়া ৫টায় সেখানে বৈঠক শুরু হয়। সে সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ ও ইআরডির নবনিযুক্ত সচিব আবুল কালাম আজাদ। বৈঠকটি শেষ হয় ৬টা ৪০ মিনিটে। এরপর সন্ধ্যা ৭টায় দুদকে ফিরে আসে বিশ্বব্যাংক প্যানেল। ওকাম্পোসহ দলের তিনজন ফিরলেও ফেরেননি গোল্ডস্টেইন।
অর্থমন্ত্রীর বাড়িতে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে মুখ খোলেননি কেউ। ওকাম্পো সাংবাদিকদের সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।
ওই বৈঠকে থাকা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর কাছে আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে 'অর্থমন্ত্রী বলবেন' বলে তিনিও সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান। আর অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান 'নো কমেন্ট' বলে।
প্যানেলের সঙ্গে দুদকের বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়
দুদক সূত্র জানায়, গতকাল মূলত তিনটি বিষয়ে দুদকের সঙ্গে আলোচনা হয় বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের। প্রথমত, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি না করার বিষয়ে দুদকের অবস্থান। দ্বিতীয়ত, আইনি প্রক্রিয়া ও শাস্তির বিধানে দুর্বলতা এবং অপরটি হচ্ছে এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বিদেশি নাগরিকদের জড়ানো। এ ক্ষেত্রে আবুল হোসেনকে নিয়ে যথেষ্ট উত্তপ্ত ছিল বৈঠকের পরিবেশ। পুরো বৈঠকে নীরব ছিলেন দুদক চেয়ারম্যান। দুদকের পক্ষ থেকে প্যানেলকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, অনিয়মের সঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাংকের চাওয়া অনুযায়ী আবুল হোসেনকে মামলায় জড়ানো হলে তা আদালতে টিকবে না। প্যানেলের সদস্যরা এতে আপত্তি জানান। তাঁরা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও আলামতের ভিত্তিতে অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা গেলে আবুল হোসেনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন? এরপর প্যানেলের সদস্যরা প্রয়োজনে আইন সংশোধন করার পরামর্শ দেন। জানা গেছে, উত্তপ্ত বাক্যালাপের একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধির নেতা লুই মোরেনো ওকাম্পো কমিশনকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আপনারা কি তাঁর (আবুল হোসেন) সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেন নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন? তা না হলে তাঁর পক্ষ কেন নিচ্ছেন?' সূত্র জানায়, কমিশন দুদক আইন ও বাংলাদেশের আইন সম্পর্কে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওকাম্পো। টিমোথি ও ওকাম্পো উভয়েই বাংলাদেশি আইন সম্পর্কে উল্টো কমিশনকেই বুঝিয়ে দেন।
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ : বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের ভিত্তিতে দুদকের অনুসন্ধানী দল প্রথম দফায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, নিক্সন চৌধুরী, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ মোট ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি।
দ্বিতীয় দফা অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে পাওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক রমেশ সাহার ডায়েরিতে লেখা কিছু নামের আদ্যক্ষর থেকে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় অভিযোগকারীদের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁদের জবানবন্দি ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র হয়েছে। দুর্নীতির উদ্দেশ্যে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা আবুল হাসান চৌধুরী ও সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরীর মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১১ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের সমন্বয় করেন তৎকালীন যোগাযোগসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রার্থী নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একমের বাংলাদেশের স্থানীয় সাব-এজেন্ট ড. মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালশ, রমেশ সাহা ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইসমাইল। এ ব্যাপারে কিছু দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থবিনিময় হয়নি। আবুল হোসেন দুর্নীতি বা অনিয়মে রাজি হয়েছিলেন কি না- তার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া না গেলেও জিজ্ঞাসাবাদে অন্যান্য ব্যক্তির বক্তব্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাঁর সঙ্গে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছিল। এ ছাড়া আবুল হাসান চৌধুরী এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে আবুল হোসেনকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গতকালের বৈঠকের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'বিভিন্ন বিষয়ে প্যানেলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমাদের কাছে জানতে চাওয়া বিভিন্ন বিষয় আমরা তাদের অবহিত করেছি। এগুলো অতি গোপনীয় বিষয়। প্রচলিত আইনের আলোকে এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখব এবং আমাদের তদন্তদলও বিষয়টি আবার যাচাই-বাছাই করে দেখবে।'
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের নামে মামলা হবে কি না- এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'আপনাদের একটি কথা স্পষ্ট করে বলি, বিশ্বব্যাংক কী বলল, প্যানেল কী বলল, তা আমরা শুনব; তবে বাংলাদেশের আইন ও বিধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে দুদক।'
গোলাম রহমান বলেন, 'আইনি ব্যবস্থা দু-এক দিনের মধ্যে বিবেচনা করব। একটু দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।' গতকালের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাদের ভিউ পয়েন্টস বলেছে। আমরাও আমাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি। তারাও ভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে।'
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান ওকাম্পো বলেন, 'দুদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমরা এখানেই সমাপ্তি টানছি।'
তদন্ত ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ নীরব থেকে ওকাম্পো বলেন, 'আমরা এখন এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।' রাতেই ওকাম্পো ঢাকা ছেড়ে গেছেন।
এদিকে দুদক সূত্র জানায়, গত দুই দিনে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে তিন দফা বৈঠকে সৈয়দ আবুল হোসেন ও
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি না করার পক্ষে অবস্থান নেয় কমিশন। পরে কেবল আবুল হোসেনকে আসামি না করার ব্যাপারে অবস্থান নেয় তারা। দুদক গতকাল বিশ্বব্যাংকের প্যানেলকে জানায়, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দালিলিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই দেশের প্রচলিত আইনে তাঁকে আসামি করা সমীচীন নয়। তবে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১২০(খ) ধারায় মামলা করা যায়। কিন্তু আবুল হোসেনকে আসামি না করার সিদ্ধান্তে সরাসরি আপত্তি জানান বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা।
গতকালের বৈঠকের ওপরই নির্ভর করছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ভবিষ্যৎ। তাই সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল এই বৈঠকের দিকে। বিশ্বব্যাংকের প্যানেল শর্ত দিয়েছিল, দুদকের অনুসন্ধান সুষ্ঠু হলে এবং দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলেই কেবল তারা অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে জানাবে।
গতকাল বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে যায় লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদল। পৌনে ৪টায় শুরু হয় দুদকের সঙ্গে তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক। ৪টা ৩৫ মিনিটে হঠাৎ বৈঠক থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন দুদকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, 'আলোচনায় কোনো মীমাংসা হয়নি। নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আবার দুদকে ফিরে আসতে পারি।' সেখান থেকে তাঁরা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় যান।
সন্ধ্যা সোয়া ৫টায় সেখানে বৈঠক শুরু হয়। সে সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ ও ইআরডির নবনিযুক্ত সচিব আবুল কালাম আজাদ। বৈঠকটি শেষ হয় ৬টা ৪০ মিনিটে। এরপর সন্ধ্যা ৭টায় দুদকে ফিরে আসে বিশ্বব্যাংক প্যানেল। ওকাম্পোসহ দলের তিনজন ফিরলেও ফেরেননি গোল্ডস্টেইন।
অর্থমন্ত্রীর বাড়িতে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে মুখ খোলেননি কেউ। ওকাম্পো সাংবাদিকদের সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।
ওই বৈঠকে থাকা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর কাছে আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে 'অর্থমন্ত্রী বলবেন' বলে তিনিও সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান। আর অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান 'নো কমেন্ট' বলে।
প্যানেলের সঙ্গে দুদকের বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়
দুদক সূত্র জানায়, গতকাল মূলত তিনটি বিষয়ে দুদকের সঙ্গে আলোচনা হয় বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের। প্রথমত, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি না করার বিষয়ে দুদকের অবস্থান। দ্বিতীয়ত, আইনি প্রক্রিয়া ও শাস্তির বিধানে দুর্বলতা এবং অপরটি হচ্ছে এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বিদেশি নাগরিকদের জড়ানো। এ ক্ষেত্রে আবুল হোসেনকে নিয়ে যথেষ্ট উত্তপ্ত ছিল বৈঠকের পরিবেশ। পুরো বৈঠকে নীরব ছিলেন দুদক চেয়ারম্যান। দুদকের পক্ষ থেকে প্যানেলকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, অনিয়মের সঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাংকের চাওয়া অনুযায়ী আবুল হোসেনকে মামলায় জড়ানো হলে তা আদালতে টিকবে না। প্যানেলের সদস্যরা এতে আপত্তি জানান। তাঁরা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও আলামতের ভিত্তিতে অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা গেলে আবুল হোসেনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন? এরপর প্যানেলের সদস্যরা প্রয়োজনে আইন সংশোধন করার পরামর্শ দেন। জানা গেছে, উত্তপ্ত বাক্যালাপের একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধির নেতা লুই মোরেনো ওকাম্পো কমিশনকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আপনারা কি তাঁর (আবুল হোসেন) সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেন নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন? তা না হলে তাঁর পক্ষ কেন নিচ্ছেন?' সূত্র জানায়, কমিশন দুদক আইন ও বাংলাদেশের আইন সম্পর্কে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওকাম্পো। টিমোথি ও ওকাম্পো উভয়েই বাংলাদেশি আইন সম্পর্কে উল্টো কমিশনকেই বুঝিয়ে দেন।
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ : বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের ভিত্তিতে দুদকের অনুসন্ধানী দল প্রথম দফায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, নিক্সন চৌধুরী, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ মোট ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি।
দ্বিতীয় দফা অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে পাওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক রমেশ সাহার ডায়েরিতে লেখা কিছু নামের আদ্যক্ষর থেকে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় অভিযোগকারীদের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁদের জবানবন্দি ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র হয়েছে। দুর্নীতির উদ্দেশ্যে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা আবুল হাসান চৌধুরী ও সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরীর মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১১ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের সমন্বয় করেন তৎকালীন যোগাযোগসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রার্থী নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একমের বাংলাদেশের স্থানীয় সাব-এজেন্ট ড. মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালশ, রমেশ সাহা ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইসমাইল। এ ব্যাপারে কিছু দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থবিনিময় হয়নি। আবুল হোসেন দুর্নীতি বা অনিয়মে রাজি হয়েছিলেন কি না- তার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া না গেলেও জিজ্ঞাসাবাদে অন্যান্য ব্যক্তির বক্তব্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাঁর সঙ্গে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছিল। এ ছাড়া আবুল হাসান চৌধুরী এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে আবুল হোসেনকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
No comments