মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন by শফিক আদনান
অন্য এক যুদ্ধের মধ্যে আছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক। বার্ধক্য-ব্যাধিতে শরীর একটু বিশ্রাম চায়। হাত থেকে খসে পড়তে চায় দফাদারের লাঠি। কিন্তু সংসারের কথা ভেবে লাঠি ছাড়েন না তিনি। যৌবনে লড়েছেন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারের বিরুদ্ধে।
বৃদ্ধ বয়সে লড়াই করছেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সঙ্গে।লোকে তাঁকে দফাদার রাজ্জাক বলে ডাকে। কারণ পেশায় তিনি গ্রামপুলিশ। এ পেশায় তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয় সারাক্ষণ অতন্দ্রপ্রহরীর মতো। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জাফরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন জাফরাবাদ গ্রামেই বাড়ি। গরিব বাবা মিছিরউদ্দিনও ছিলেন চৌকিদার। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া এক খণ্ড জমিতে ছোট্ট ভাঙাচোরা দোচালা ঘরে স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে থাকেন রাজ্জাক। ছোট ছেলে নূরকান ছাড়া আরো তিন ছেলে আছে তাঁর। তাঁরা যে যাঁর মতো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা থাকেন। কেউ রিকশা চালান, কেউ অটোরিকশা। মা-বাবাকে দেখার সামর্থ্য তাঁদেরও নেই। মেয়ে হাবিবাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও এখন এক সন্তান নিয়ে বাবার কাছে থাকেন। স্বামীর খোঁজ নেই। সব মিলিয়ে ছয় সদস্যের একটি পরিবারের বোঝা তাঁর কাঁধে।
চাকরিটা 'ছোট' হলেও কাজ অনেক রাজ্জাকের। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থানা-পুলিশকে সহযোগিতা করতে হয়। বয়স এখন ৫৯ বছর। অনেক সময় হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। রাজ্জাক বলেন, 'বয়স হইছে, এখন না খাইয়া বেশিক্ষণ থাকতাম পারি না, হাত-পাও কাঁপে। তখন কোনো কিছু চোখে ভাসে না, সব কিছু ঘোলা লাগে। কিন্তু কিছু করাই নাই, ঘরে অভাব। ডর-ভয় দূর কইরা অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য কইরা গ্রামের আনাচে-কানাচে দিন-রাত অপরাধীর সন্ধান করি। একবার পুলিশকে সহযোগিতা করার অভিযোগে স্থানীয় ডাকাতদল মাইরা ফালবার হুমকি দিছিল। পরে পরিবারের চাপে মাস তিনেক করিমগঞ্জ থানায় কাটাই।'
রাজ্জাকের স্ত্রী আছিয়া খাতুন আনুরা জানান, পানিটা ছাড়া সব কিছু কিনে খেতে হয়। তাঁর স্বামী যে বেতন পান তা দিয়ে মাসের ১৫ দিনও চলে না। বাকিটা সময় ধারদেনা করে চলতে হয়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত আনুরা। তিনি জানান, কিছুদিন পর তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর দফাদারের চাকরির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। তখন তাঁদের কী যে হবে! কেবল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে তো কিছুই হবে না।
আবদুর রাজ্জাক জানান, ঘরে অসুস্থ স্ত্রী, নিজেও ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। কারো সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। সংসারের প্রতিদিনের খাবারই জোটাতে পারেন না।
ইসলামপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল মনসুর লনু জানান, মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক আত্মমর্যাদাশীল মানুষ। তাঁকে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না তিনি কী কষ্ট, কী অন্তর্জ্বালা নিয়ে আছেন। নিজের কষ্টের কথা কাউকে পারতপক্ষে বলতে চান না তিনি। কেবল ঘনিষ্ঠজনরাই তাঁর দুর্দশার খবর কমবেশি জানে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই বলেও জানান রাজ্জাক। তিনি বলেন, 'প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শত অভাব-অনটনেও কেউর কাছে মাথা নত করে না। আমরা দেশকে স্বাধীনতা উপহার দিছি। এই দানের কোনো প্রতিদান হয় না।'
রাজ্জাক বলেন, 'আমি দিনের পর দিন না খাইয়া থাকছি। ক্ষুধার্ত সন্তানদের চোখের পানি দেইখা কানছি। আদর্শ জলাঞ্জলি দিলে অনেক কিছু পাইতাম। কিন্তু আমি সেদিকে যাই নাই।' তিনি বলেন, 'স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিইরা কিছুই করতে পারতাছিলাম না। তখন পরিবার নিয়া খুব কষ্ট করতে হইছে। ১৯৮৫ সালের দিকে ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান সোনা মিয়া আমাকে ২২০ টাকা মাইনের গ্রামপুলিশের চাকরিটা দেন। এখন ওই বেতন বাইড়া হইছে ২১০০ টাকা।'
আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'আমার ২১ দিনের পুত্রসন্তান খোকনরে রাইখা স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোনের চোখের পানি উপেক্ষা কইরা আটজনের একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন নিয়া বাড়ি ছাড়ি।' তিনি জানান, নৌকাযোগে বহু কষ্ট করে প্রথমে টেকেরঘাট, পরে ভারতীয় সেনাদের ট্রাকে করে ইকোওয়ান ট্রেনিং ক্যাম্প। ট্রেনিং শেষে পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীনে বড়ছড়া সাবসেক্টরে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন রাজ্জাক। কোবরা কম্পানির কমান্ডার মতিয়র রহমান বীর-বিক্রম ও গ্রুপ কমান্ডার হাবিবুর রহমান ঠাকুরের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয় তাঁদের। ১৯ অক্টোবর রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা নিকলী আক্রমণ করেন। টানা দুই রাত-এক দিন যুদ্ধের পর শত্রুবাহিনী পালিয়ে যায়। তবে রাজ্জাক ও গ্রুপ কমান্ডার হাবিবুর রহমান ঠাকুরসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। রাজ্জাক বলেন, '১৯ তারিখ ভোরে আমার খুব কাছে শত্রুপক্ষের একটি মর্টারের গোলা আইসা পড়ে এবং আমার বাম পায়ে গুলি লাগে।'
সারা দিনের দফাদারির কাজ শেষে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে টেনে ঘুমানোর চেষ্টা করেন তিনি। একে একে পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম আসে না কেবল তাঁর চোখে। কোথায় কী হয়- একটা কান পেতে রাখেন বাইরে। ভোর হয়, আর এভাবেই আরেকটি কঠিনতম দিন এসে দাঁড়ায় তাঁর সামনে।
No comments