গোপন মার্কিন দলিল- এরশাদের পতনের শঙ্কা করেছিল সিআইএ by মিজানুর রহমান খান
সিআইএর চোখে জেনারেল এরশাদ এমন একজন নেতা, যাঁর সততা প্রশ্নবিদ্ধ। যোগ্য নেতা হিসেবেও তাঁর ঘাটতি আছে। গণভোটে ৫ ভাগের কম ভোট পড়লেও তিনি দেখিয়ে দেন, ৭২ শতাংশ পড়েছে। খালেদা জিয়া তাঁকে বিশ্বাস করেন না। সন্দেহ করেন, জিয়া হত্যায় তাঁর ইন্ধন ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আশির দশকে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও তাঁর বিরুদ্ধে ১৫ ও ৭ দলের আন্দোলন এবং সোভিয়েত ও ভারতের ভূমিকা-সংক্রান্ত অন্তত ২০টি গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, তাদের অন্তত একটি পূর্বানুমান সঠিক প্রমাণিত হয়নি। সিআইএ ধারণা করেছিল, শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার আন্দোলনের কারণে নয়, আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থানে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবেন।
অন্য কোনো জেনারেল ক্ষমতা নেবেন। উপরন্তু, সামরিক সরকারের প্রতি খালেদা জিয়াকে নমনীয় করতে এরশাদকে সরানোর কথা ভেবেছিল সেনাবাহিনী ও বিএনপির একটি অংশ। ১৯৮৪ সালের ১৯ নভেম্বর সিআইএ তার প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘খুব সম্ভবত এরশাদের পরিবর্তে অন্য একজন সামরিক নেতার আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে।’
প্রশ্নবিদ্ধ সততা: অবশ্য সিআইএর এই আশঙ্কার পেছনে ছিল এরশাদের আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত ভাবমূর্তি। দুর্নীতির কারণে যে তাঁর পতন ঘটতে পারে—এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের আট মাসের মধ্যে সিআইএ নির্দিষ্টভাবে সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর একটি হ্যান্ডবুক বের করে সিআইএ। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন অনিশ্চিত ছিল, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরেও তা-ই আছে।’
হ্যান্ডবুকে বলা হয়, ‘তাঁর ভবিষ্যতের জন্য হুমকি দুটি। প্রথমত, সামরিক অনৈক্য। দ্বিতীয়ত, ইতিপূর্বে তাঁর বিরুদ্ধে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে অভিযোগ ছিল, সেটা তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। এমনকি সে জন্য আবারও ক্যু ঘটতে পারে।’ এই প্রতিবেদনের তিন বছর পরে ১৯৮৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিআইএর আরেকটি প্রতিবেদন বলেছে, ‘এরশাদ সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমে তীব্র হচ্ছে, যা রাষ্ট্রপতি এরশাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।’
লক্ষণীয়, বাংলাদেশের রাজনীতির ওপরে সিআইএ সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এতগুলো প্রতিবেদন প্রায় একসঙ্গে প্রকাশ করেছে।
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে তৈরি করা সিআইএর অবমুক্ত করা অন্তত ২০টি গোপন প্রতিবেদন প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি এই প্রতিবেদনগুলোর বেশির ভাগই ২০১০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রায় কোনো প্রতিবেদনেরই সম্পূর্ণ অংশ প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে এর সংবেদনশীল অংশগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। এমনও অনেক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, যা পাতার পরে পাতা কালো কালিতে ঢেকে গেছে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে এরশাদ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন।
১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ সিআইএ প্রতিবেদন এ বিষয়ে উল্লেখ করে, ‘অভ্যুত্থানের পরে ঢাকা শান্ত আছে। এর প্রতি ভারতের সংযত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। যদিও ভারতীয় সেনাসদস্যরা সতর্কতামূলকভাবে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছেন। এখন দীর্ঘ মেয়াদে যদি সাহায্য বন্ধ থাকে, তাহলে এরশাদ সমর্থন হারাবেন। ভারতীয়রা সম্ভবত আশা করে যে সেনা ও সাবেক বিএনপি উভয়ে যথেষ্ট কলঙ্কিত হবে, যদি পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারে।’
‘জিয়া হত্যায় দায়ী’: সিআইএর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়ার সঙ্গে এরশাদের একটি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ রয়েছে। এর কারণ, বিএনপি চেয়ারপারসন মনে করেন, ১৯৮১ সালে তাঁর স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল এরশাদই দায়ী।’
১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ: এরশাদের জন্য একটি উষ্ণ শীতকাল?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সিআইএ বলেছে, এরশাদ বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে চাইছে। কারণ, তাঁকে সেনাবাহিনীর কাছে তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে। তাই তিনি বলছেন, নির্বাচন হবে একটি নিরপেক্ষ ইসির অধীনে। মন্ত্রীরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। মার্কিন দূতাবাসের সূত্রগুলো বলছে, এরশাদ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চাইছেন। কিন্তু বিএনপি উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত। এরশাদ এ থেকে ফায়দা নিতে চাইছেন। তবে একটি বড় বাধা হচ্ছে, খালেদা জিয়া মনে করেন, জিয়া হত্যায় এরশাদের দায় আছে। এ কারণে সেনাবাহিনী ও বিএনপির অনেকেই বিশ্বাস করেন, যদি এরশাদকে সরানো হয়, তাহলে খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসবেন।
‘সুপ্রসন্ন’: ১৯৮২ সালের ওই হ্যান্ডবুকে এরশাদ ও তাঁর মন্ত্রিসভার ১০ জনের বৈশিষ্ট্য চিত্রিত হয়েছে। এরশাদ সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা সমিতির সভাপতি হতে পেরেছেন। যে বিষয়ে তাঁর দখল আছে, তিনি সেই বিষয় নিয়েই বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন। আর সেটা হলো সামরিক বিষয়।’
জেনারেল এরশাদসহ তাঁর আমলের সেনাপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দীন, পররাষ্ট্রসচিব আতাউল করিম, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহব্বত জান চৌধুরী, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল আবদুল মান্নাফকে নির্দিষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘সুপ্রসন্ন মনোভাবের অধিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পাশ্চাত্য ঘেঁষা: সিআইএর মতে, সামরিক বাহিনীর জানা ছিল, জাতীয় নেতা হিসেবে এরশাদের সীমাবদ্ধতা আছে। এরশাদ সরকার সিআইএর চোখে ছিল ‘রক্ষণশীল, পাশ্চাত্যপন্থী, চীনপন্থী, ইসলামপন্থী—যারা পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে চায়।’ তবে সোভিয়েতের প্রতি এরশাদের দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নে সিআইএ তার অবস্থান বদল করেছিল। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে তারা বলেছিল, ‘এরশাদ যদিও ক্রমে পাশ্চাত্যের দিকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার নীতি অনুসরণ করছেন, তবে তাঁকে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও আগ্রহী মনে হয়। বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকার পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে মস্কোর প্রতি একটা সুদৃষ্টি রাখতে চাচ্ছিলেন।’ কিন্তু এরশাদ আমলে সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে তলানিতে পৌঁছায়। ১৯৮৩ সালে এরশাদ একসঙ্গে ১৫ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিলেন।
১৯৮৫ সালের ২১ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এরশাদের নেতৃত্বের প্রতি উল্লেখযোগ্য কোনো বিরোধিতা নেই। তবে চলতি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিণতি যা-ই হোক না কেন, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে উদারপন্থীরাই আসবেন, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থাকবেন।’
ভারত প্রশ্নে: সিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরশাদ গভীরভাবে সন্দিগ্ধচিত্ত। তবে তিনি এটাও বোঝেন যে দিল্লির সঙ্গে “সঠিক” সম্পর্ক রাখাই সমীচীন।’ উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের ২৮ জুলাই সিআইএর ৫৭ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে দীর্ঘকালীন অচলাবস্থা কাটিয়ে ভারতের পানি চুক্তি করার বিষয়ে এরশাদ সরকারের আশাবাদী হওয়ার কথা উল্লেখ করে। আবার এই প্রতিবেদনেই বলা হয়, ‘অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার কারণে দিল্লির সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায় প্রতিবেশীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংসতা এবং বন্যার মতো কিছু সমস্যা নিয়ে এরশাদ ভারতকে দায়ী করেন। এই দোষারোপের মধ্যে আসলে “বিদেশি হাত” আবিষ্কার করে অন্যের কাঁধে দায় চাপানোর দক্ষিণ এশীয় অভ্যাস সম্পৃক্ত রয়েছে। তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হাত খুঁজতে সচেষ্ট থাকেন।’ অবশ্য এই প্রতিবেদনের ৫৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘ভারতের আঞ্চলিক জটিল অবস্থার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা তাদের দ্বিপক্ষীয় বিরোধে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পাশে পেতে চাইবে।’
৫ ভাগের গণভোট: ১৯৮৫ সালের ২১ জুন সিআইএ বলেছে, ‘উপজেলা নির্বাচন এরশাদকে বিরাট শক্তি দিয়েছে। যদিও এতে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ভোট পড়েছে। আর গণভোটে ৫ ভাগের কম ভোট পড়লেও এরশাদ দেখিয়েছিলেন, তিনি ৭২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। দেশ চালাতে তিনি ছয় জেনারেলের ওপর ভরসা করতেন। কিন্তু সরকার চালাতে তাঁরা প্রত্যেকে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ ছিলেন। আর জ্যেষ্ঠ সেনা অধিনায়কেরা জানতেন, নেতা হিসেবে এরশাদের সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু দেশের বিরাট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যার দায় নিতে তাঁরা কেউ আগ্রহী ছিলেন না।
উর্দির রাজনীতি: উর্দি পরে রাজনীতি না করতে এরশাদের প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করে সিআইএ বলেছে, ‘গোড়াতে এরশাদ ছয় মাসের মধ্যে সীমিত রাজনীতি চালু করার আশ্বাস দেন। কিন্তু পরে মত দেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় দৃশ্যপটের গভীর অংশ, যারা কিনা শুধুই ক্ষমতা চায় এবং তাদের মধ্যে আদর্শগত তফাত সামান্যই আছে। মার্কিন দূতাবাস সূত্রের মতে, এরশাদ একটি বহুদলীয় ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে ন্যূনতম ভোটের দ্বারা রাজনৈতিক দলের সংখ্যা হবে সীমিত।’
১৯৮৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রস্তুত করা সিআইএর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদবিষয়ক প্রতিবেদনে ১৯৮৭ সালের ৯ ডিসেম্বরে বস্ত্রমন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে ও ২০ ডিসেম্বরে খুলনায় বোমা হামলার ঘটনা দুটি নির্দিষ্ট করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের চলতি সহিংসতার লক্ষ্য হলো এরশাদকে উৎখাত।
অন্য কোনো জেনারেল ক্ষমতা নেবেন। উপরন্তু, সামরিক সরকারের প্রতি খালেদা জিয়াকে নমনীয় করতে এরশাদকে সরানোর কথা ভেবেছিল সেনাবাহিনী ও বিএনপির একটি অংশ। ১৯৮৪ সালের ১৯ নভেম্বর সিআইএ তার প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘খুব সম্ভবত এরশাদের পরিবর্তে অন্য একজন সামরিক নেতার আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে।’
প্রশ্নবিদ্ধ সততা: অবশ্য সিআইএর এই আশঙ্কার পেছনে ছিল এরশাদের আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত ভাবমূর্তি। দুর্নীতির কারণে যে তাঁর পতন ঘটতে পারে—এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের আট মাসের মধ্যে সিআইএ নির্দিষ্টভাবে সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর একটি হ্যান্ডবুক বের করে সিআইএ। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন অনিশ্চিত ছিল, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরেও তা-ই আছে।’
হ্যান্ডবুকে বলা হয়, ‘তাঁর ভবিষ্যতের জন্য হুমকি দুটি। প্রথমত, সামরিক অনৈক্য। দ্বিতীয়ত, ইতিপূর্বে তাঁর বিরুদ্ধে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে অভিযোগ ছিল, সেটা তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। এমনকি সে জন্য আবারও ক্যু ঘটতে পারে।’ এই প্রতিবেদনের তিন বছর পরে ১৯৮৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিআইএর আরেকটি প্রতিবেদন বলেছে, ‘এরশাদ সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমে তীব্র হচ্ছে, যা রাষ্ট্রপতি এরশাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।’
লক্ষণীয়, বাংলাদেশের রাজনীতির ওপরে সিআইএ সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এতগুলো প্রতিবেদন প্রায় একসঙ্গে প্রকাশ করেছে।
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে তৈরি করা সিআইএর অবমুক্ত করা অন্তত ২০টি গোপন প্রতিবেদন প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি এই প্রতিবেদনগুলোর বেশির ভাগই ২০১০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রায় কোনো প্রতিবেদনেরই সম্পূর্ণ অংশ প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে এর সংবেদনশীল অংশগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। এমনও অনেক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, যা পাতার পরে পাতা কালো কালিতে ঢেকে গেছে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে এরশাদ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন।
১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ সিআইএ প্রতিবেদন এ বিষয়ে উল্লেখ করে, ‘অভ্যুত্থানের পরে ঢাকা শান্ত আছে। এর প্রতি ভারতের সংযত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। যদিও ভারতীয় সেনাসদস্যরা সতর্কতামূলকভাবে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছেন। এখন দীর্ঘ মেয়াদে যদি সাহায্য বন্ধ থাকে, তাহলে এরশাদ সমর্থন হারাবেন। ভারতীয়রা সম্ভবত আশা করে যে সেনা ও সাবেক বিএনপি উভয়ে যথেষ্ট কলঙ্কিত হবে, যদি পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারে।’
‘জিয়া হত্যায় দায়ী’: সিআইএর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়ার সঙ্গে এরশাদের একটি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ রয়েছে। এর কারণ, বিএনপি চেয়ারপারসন মনে করেন, ১৯৮১ সালে তাঁর স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল এরশাদই দায়ী।’
১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ: এরশাদের জন্য একটি উষ্ণ শীতকাল?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সিআইএ বলেছে, এরশাদ বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে চাইছে। কারণ, তাঁকে সেনাবাহিনীর কাছে তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে। তাই তিনি বলছেন, নির্বাচন হবে একটি নিরপেক্ষ ইসির অধীনে। মন্ত্রীরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। মার্কিন দূতাবাসের সূত্রগুলো বলছে, এরশাদ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চাইছেন। কিন্তু বিএনপি উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত। এরশাদ এ থেকে ফায়দা নিতে চাইছেন। তবে একটি বড় বাধা হচ্ছে, খালেদা জিয়া মনে করেন, জিয়া হত্যায় এরশাদের দায় আছে। এ কারণে সেনাবাহিনী ও বিএনপির অনেকেই বিশ্বাস করেন, যদি এরশাদকে সরানো হয়, তাহলে খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসবেন।
‘সুপ্রসন্ন’: ১৯৮২ সালের ওই হ্যান্ডবুকে এরশাদ ও তাঁর মন্ত্রিসভার ১০ জনের বৈশিষ্ট্য চিত্রিত হয়েছে। এরশাদ সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা সমিতির সভাপতি হতে পেরেছেন। যে বিষয়ে তাঁর দখল আছে, তিনি সেই বিষয় নিয়েই বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন। আর সেটা হলো সামরিক বিষয়।’
জেনারেল এরশাদসহ তাঁর আমলের সেনাপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দীন, পররাষ্ট্রসচিব আতাউল করিম, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহব্বত জান চৌধুরী, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল আবদুল মান্নাফকে নির্দিষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘সুপ্রসন্ন মনোভাবের অধিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পাশ্চাত্য ঘেঁষা: সিআইএর মতে, সামরিক বাহিনীর জানা ছিল, জাতীয় নেতা হিসেবে এরশাদের সীমাবদ্ধতা আছে। এরশাদ সরকার সিআইএর চোখে ছিল ‘রক্ষণশীল, পাশ্চাত্যপন্থী, চীনপন্থী, ইসলামপন্থী—যারা পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে চায়।’ তবে সোভিয়েতের প্রতি এরশাদের দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নে সিআইএ তার অবস্থান বদল করেছিল। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে তারা বলেছিল, ‘এরশাদ যদিও ক্রমে পাশ্চাত্যের দিকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার নীতি অনুসরণ করছেন, তবে তাঁকে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও আগ্রহী মনে হয়। বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকার পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে মস্কোর প্রতি একটা সুদৃষ্টি রাখতে চাচ্ছিলেন।’ কিন্তু এরশাদ আমলে সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে তলানিতে পৌঁছায়। ১৯৮৩ সালে এরশাদ একসঙ্গে ১৫ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিলেন।
১৯৮৫ সালের ২১ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এরশাদের নেতৃত্বের প্রতি উল্লেখযোগ্য কোনো বিরোধিতা নেই। তবে চলতি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিণতি যা-ই হোক না কেন, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে উদারপন্থীরাই আসবেন, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থাকবেন।’
ভারত প্রশ্নে: সিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরশাদ গভীরভাবে সন্দিগ্ধচিত্ত। তবে তিনি এটাও বোঝেন যে দিল্লির সঙ্গে “সঠিক” সম্পর্ক রাখাই সমীচীন।’ উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের ২৮ জুলাই সিআইএর ৫৭ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে দীর্ঘকালীন অচলাবস্থা কাটিয়ে ভারতের পানি চুক্তি করার বিষয়ে এরশাদ সরকারের আশাবাদী হওয়ার কথা উল্লেখ করে। আবার এই প্রতিবেদনেই বলা হয়, ‘অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার কারণে দিল্লির সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায় প্রতিবেশীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংসতা এবং বন্যার মতো কিছু সমস্যা নিয়ে এরশাদ ভারতকে দায়ী করেন। এই দোষারোপের মধ্যে আসলে “বিদেশি হাত” আবিষ্কার করে অন্যের কাঁধে দায় চাপানোর দক্ষিণ এশীয় অভ্যাস সম্পৃক্ত রয়েছে। তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হাত খুঁজতে সচেষ্ট থাকেন।’ অবশ্য এই প্রতিবেদনের ৫৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘ভারতের আঞ্চলিক জটিল অবস্থার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা তাদের দ্বিপক্ষীয় বিরোধে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পাশে পেতে চাইবে।’
৫ ভাগের গণভোট: ১৯৮৫ সালের ২১ জুন সিআইএ বলেছে, ‘উপজেলা নির্বাচন এরশাদকে বিরাট শক্তি দিয়েছে। যদিও এতে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ভোট পড়েছে। আর গণভোটে ৫ ভাগের কম ভোট পড়লেও এরশাদ দেখিয়েছিলেন, তিনি ৭২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। দেশ চালাতে তিনি ছয় জেনারেলের ওপর ভরসা করতেন। কিন্তু সরকার চালাতে তাঁরা প্রত্যেকে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ ছিলেন। আর জ্যেষ্ঠ সেনা অধিনায়কেরা জানতেন, নেতা হিসেবে এরশাদের সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু দেশের বিরাট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যার দায় নিতে তাঁরা কেউ আগ্রহী ছিলেন না।
উর্দির রাজনীতি: উর্দি পরে রাজনীতি না করতে এরশাদের প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করে সিআইএ বলেছে, ‘গোড়াতে এরশাদ ছয় মাসের মধ্যে সীমিত রাজনীতি চালু করার আশ্বাস দেন। কিন্তু পরে মত দেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় দৃশ্যপটের গভীর অংশ, যারা কিনা শুধুই ক্ষমতা চায় এবং তাদের মধ্যে আদর্শগত তফাত সামান্যই আছে। মার্কিন দূতাবাস সূত্রের মতে, এরশাদ একটি বহুদলীয় ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে ন্যূনতম ভোটের দ্বারা রাজনৈতিক দলের সংখ্যা হবে সীমিত।’
১৯৮৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রস্তুত করা সিআইএর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদবিষয়ক প্রতিবেদনে ১৯৮৭ সালের ৯ ডিসেম্বরে বস্ত্রমন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে ও ২০ ডিসেম্বরে খুলনায় বোমা হামলার ঘটনা দুটি নির্দিষ্ট করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের চলতি সহিংসতার লক্ষ্য হলো এরশাদকে উৎখাত।
No comments