আমায় ক্ষমো হে-'ভারত সম্পর্কের' সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার by মামুন রশীদ
১৯৮৮ সালের কথা, তখন আমি এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে কর্মরত ছিলাম। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে একসঙ্গে ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম। আমাদের পাসপোর্টগুলো ঢাকার ধানমণ্ডিস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে জমা দেওয়ার দু্দিন পরে যেতে বলা হয়েছিল।
আমার বন্ধুরা সবাই নির্ধারিত তারিখে ভিসা পেলেও আমি পাইনি। আমাকে পাশের ভবনে হাইকমিশনের সামরিক অ্যাটাশের// সঙ্গে দেখা করতে বলা হলো। আমি যথারীতি গেলাম এবং যে ভদ্রলোক কথা বললেন তিনি সম্ভবত পদমর্যাদায় একজন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। তাঁর অফিসের কাছেই ছিল আমাদের ব্যাংকের একটি শাখা। সেখানে ভদ্রলোকের একটি বিরূপ বা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে জন্য তিনি আমার কাছে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়সংক্রান্ত কিছু নিয়মকানুন জানতে চাইলেন, যেগুলো তিনি জানতেন না। 'এক দেখাতেই বিশ্বাসের জন্ম' (seeing is believing)- এমনটাই ঘটল দুজনের মধ্যে। ভদ্রলোককে আমার অত্যন্ত বিনয়ী ও অনেক জানাশোনা আছে বলে মনে হলো। তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলোতে যেসব খবর বা লেখা ছাপা হয়ে আসছিল, সেগুলো নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাহেব বেশ সংক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁর মতে, ভারতের মতো একটি বৃহৎ প্রতিবেশীকে নিয়ে ছাপা ওসব খবর বা লেখা শুধু ভিত্তিহীনই ছিল না, ছিল অন্যায্য। সংগত কারণেই আমার কাছেও তাঁর প্রশ্নের পর্যাপ্ত উত্তর ছিল না।
অতীতের কথা যত দূর মনে করতে পারি তাতে দেখি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সব সময়ই ছিল বেশ তিক্ত বা অমধুর। দুই দেশই সম্ভবত পরস্পরকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছ থেকে যথাযথ মর্যাদা, প্রয়োজনীয় আনুকূল্য ও সহযোগিতা না পাওয়ায় 'ছোট ভাই' মানে বাংলাদেশের মধ্যে কিছুটা সংবেদনশীলতা বা সংক্ষুব্ধ ভাব কাজ করে বৈকি। অনেক সময়ই উভয় দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের দেশে সন্ত্রাসবাদে ইন্ধন জোগানো কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে মদদ দেওয়ার অভিযোগে পরস্পরকে অবিশ্বাস করে আসছে।
আমাদের স্বীকার করতেই হয় যে ভারতের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দ্রুত সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। বিশেষ করে সেই দেশের ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান শরিক কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সমর্থন-সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও বাংলাভাষী অর্থমন্ত্রী (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) প্রণব মুখার্জি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে হাত বাড়িয়ে দেন। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও প্রটোকল সম্পাদিত হয়। আবার এগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও সর্বোচ্চ মহল থেকে নিয়মিতভাবে নজরে রাখা হয়, যা অতীতে সেভাবে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিককালে স্থানীয় মিশনের কার্যক্রমও জোরদারকরণের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমাদের রেলওয়েসহ অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে ভারত ১০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্প্রতি আবার তার মধ্যে ২০ কোটি ডলারকে অনুদান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সীমান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ বিনিময় ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়েও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ১০০ জন তরুণের ভারত সফর ও সেখানকার জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনায় আমি বেশ খুশি হয়েছি। নাগরিক সমাজের মধ্যকার আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময় আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। তবে ভারতকে বাংলাদেশে ট্রানজিট ও বাংলাদেশকে ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানির সুযোগ প্রদান ও তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে এখনো সংশয়-সন্দেহ রয়ে গেছে।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) এরই মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে অনেক সেমিনার ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে। এতে উভয় দেশের বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়। আমি মনে করি না যে বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন বা বিধির আওতায় এখানকার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা নিকট ভবিষ্যতে ভারতে মূলধন স্থানাস্তরের অনুমতি পাবেন। তবে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে তা তাঁদের দেশের বাজারে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিপণন করতে পারেন। এতে দুই দেশেরই লাভ হবে। এভাবেই 'মেইড ইন বাংলাদেশ' খাদ্য, ব্যাটারি, কনজিউমার ইলেকট্রনিকস পণ্য ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর বা পার্শ্ববর্তী অন্য রাজ্যগুলোতে বাজারজাত করা যাবে। একইভাবে ভারতীয় কম্পানিগুলোও বাংলাদেশে যৌথ উদ্যোগে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা ফেব্রিক বা কাপড়, সুতা, ডাইং বা রং, কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পণ্য বা অ্যাকসেসরিজসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এ দেশে আনবে এবং এখানে ওভেন ও নিট পোশাক, সিরামিক পণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধসামগ্রী তৈরির পরে তা ভারতে রপ্তানি হবে। ভারত সরকার সেই দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সুযোগ দিলেও তাদের উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক 'সাপ্লাই চেইনে' সম্পৃক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাবে না বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের 'স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট' বা পণ্যের মান পরীক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ভারতীয় অনুদান-তহবিল বরাদ্দের কিছু অংশ কাজে লাগানো যেতে পারে। কাজটি ত্বরান্বিত করতে ভারতের বড় উদ্যোক্তাদেরও সহযোগিতা করতে হবে। আর মান পরীক্ষার ওই প্রতিষ্ঠানটিকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থায় তালিকাভুক্ত ও নিবন্ধন করতে হবে।
পারস্পরিক সংশয়-সন্দেহ ও সম্পর্কের টানাপড়েন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী অনেক বছর ধরে দীর্ঘ পথ একসঙ্গে চলেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বৈশ্বিক মানচিত্রে একটি উদার গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশ ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারত বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিশ্বের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। এ ছাড়া দেশটিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ বা উন্নয়ন, নলেজ ব্যাংক বা সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার, বিনিয়োগ সক্ষমতা এবং তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও শিক্ষায় বিশ্বের দরবারে আলোড়ন তুলেছে। সে জন্য বাংলাদেশ 'ভারত সম্পর্কের' নিবিড়তায় জড়াতে পারলে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে।
একদিন আমি এক কাজে ঢাকার সোবহানবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে (বিআইএম) গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছে, ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অনেকটাই অব্যবহৃত এই প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা প্রসারে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। তবে আমি বুঝতেই পারিনি যে প্রতিষ্ঠানটি কেন এখনো শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। বরং আমার মনে হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠান তো ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ম্যানেজমেন্টের (আইআইএম) সঙ্গে কৌশলগত জোট গঠনের মাধ্যমে দেশের ব্যবস্থাপনা শিক্ষাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারত। একইভাবে দেশের কৃষি ও ফার্মাসিউটিক্যালস বা ওষুধ খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান ভারতের একই ধরনের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কৌশলগত জোট গঠন করলে উভয় দেশের বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসকরা পারস্পরিক সহযোগিতায় শিক্ষা ও গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা উভয় দেশের বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বেও প্রকৌশল ও চিকিৎসাসেবা খাতে কিছু যৌথ উদ্যোগ দেখতে চাই।
ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ওই ব্রিগেডিয়ার ভদ্রলোকের পরে অবশ্য সেই দেশের আরো অনেক কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারক/নীতি প্রণয়নকারীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। কয়েক বছর ভারতে কাজেরও সুযোগ হয়েছে, ইদানীং তাদের অনেকেই বলেছেন যে দিলি্লর জ্যেষ্ঠ কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং ভারতকে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সহায়ক শরিক হিসেবে তুলে ধরতে বলেছেন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল আর কাউকে এ দেশে বসে ভারতে অস্থিরতা তৈরির কার্যক্রমে পরিচালনায় মদদ কিংবা উৎসাহ দেবে না। তেমনটি ভারতও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বিকাশে একযোগে কাজ করবে। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরকেও উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন আশাবাদের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর সঙ্গে বিনিয়োগ-বাণিজ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে পারলে তাতে দুই দেশেরই লাভ। তবে আমাদের নিজস্ব মৌলিক শক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদও কাজে লাগাতে হবে। তবেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও
অর্থনীতি বিশ্লেষক
অতীতের কথা যত দূর মনে করতে পারি তাতে দেখি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সব সময়ই ছিল বেশ তিক্ত বা অমধুর। দুই দেশই সম্ভবত পরস্পরকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছ থেকে যথাযথ মর্যাদা, প্রয়োজনীয় আনুকূল্য ও সহযোগিতা না পাওয়ায় 'ছোট ভাই' মানে বাংলাদেশের মধ্যে কিছুটা সংবেদনশীলতা বা সংক্ষুব্ধ ভাব কাজ করে বৈকি। অনেক সময়ই উভয় দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের দেশে সন্ত্রাসবাদে ইন্ধন জোগানো কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে মদদ দেওয়ার অভিযোগে পরস্পরকে অবিশ্বাস করে আসছে।
আমাদের স্বীকার করতেই হয় যে ভারতের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দ্রুত সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। বিশেষ করে সেই দেশের ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান শরিক কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সমর্থন-সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও বাংলাভাষী অর্থমন্ত্রী (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) প্রণব মুখার্জি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে হাত বাড়িয়ে দেন। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও প্রটোকল সম্পাদিত হয়। আবার এগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও সর্বোচ্চ মহল থেকে নিয়মিতভাবে নজরে রাখা হয়, যা অতীতে সেভাবে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিককালে স্থানীয় মিশনের কার্যক্রমও জোরদারকরণের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমাদের রেলওয়েসহ অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে ভারত ১০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্প্রতি আবার তার মধ্যে ২০ কোটি ডলারকে অনুদান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সীমান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ বিনিময় ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়েও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ১০০ জন তরুণের ভারত সফর ও সেখানকার জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনায় আমি বেশ খুশি হয়েছি। নাগরিক সমাজের মধ্যকার আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময় আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। তবে ভারতকে বাংলাদেশে ট্রানজিট ও বাংলাদেশকে ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানির সুযোগ প্রদান ও তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে এখনো সংশয়-সন্দেহ রয়ে গেছে।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) এরই মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে অনেক সেমিনার ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে। এতে উভয় দেশের বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়। আমি মনে করি না যে বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন বা বিধির আওতায় এখানকার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা নিকট ভবিষ্যতে ভারতে মূলধন স্থানাস্তরের অনুমতি পাবেন। তবে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে তা তাঁদের দেশের বাজারে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিপণন করতে পারেন। এতে দুই দেশেরই লাভ হবে। এভাবেই 'মেইড ইন বাংলাদেশ' খাদ্য, ব্যাটারি, কনজিউমার ইলেকট্রনিকস পণ্য ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর বা পার্শ্ববর্তী অন্য রাজ্যগুলোতে বাজারজাত করা যাবে। একইভাবে ভারতীয় কম্পানিগুলোও বাংলাদেশে যৌথ উদ্যোগে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা ফেব্রিক বা কাপড়, সুতা, ডাইং বা রং, কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পণ্য বা অ্যাকসেসরিজসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এ দেশে আনবে এবং এখানে ওভেন ও নিট পোশাক, সিরামিক পণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধসামগ্রী তৈরির পরে তা ভারতে রপ্তানি হবে। ভারত সরকার সেই দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সুযোগ দিলেও তাদের উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক 'সাপ্লাই চেইনে' সম্পৃক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাবে না বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের 'স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট' বা পণ্যের মান পরীক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ভারতীয় অনুদান-তহবিল বরাদ্দের কিছু অংশ কাজে লাগানো যেতে পারে। কাজটি ত্বরান্বিত করতে ভারতের বড় উদ্যোক্তাদেরও সহযোগিতা করতে হবে। আর মান পরীক্ষার ওই প্রতিষ্ঠানটিকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থায় তালিকাভুক্ত ও নিবন্ধন করতে হবে।
পারস্পরিক সংশয়-সন্দেহ ও সম্পর্কের টানাপড়েন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী অনেক বছর ধরে দীর্ঘ পথ একসঙ্গে চলেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বৈশ্বিক মানচিত্রে একটি উদার গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশ ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারত বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিশ্বের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। এ ছাড়া দেশটিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ বা উন্নয়ন, নলেজ ব্যাংক বা সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার, বিনিয়োগ সক্ষমতা এবং তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও শিক্ষায় বিশ্বের দরবারে আলোড়ন তুলেছে। সে জন্য বাংলাদেশ 'ভারত সম্পর্কের' নিবিড়তায় জড়াতে পারলে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে।
একদিন আমি এক কাজে ঢাকার সোবহানবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে (বিআইএম) গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছে, ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অনেকটাই অব্যবহৃত এই প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা প্রসারে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। তবে আমি বুঝতেই পারিনি যে প্রতিষ্ঠানটি কেন এখনো শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। বরং আমার মনে হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠান তো ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ম্যানেজমেন্টের (আইআইএম) সঙ্গে কৌশলগত জোট গঠনের মাধ্যমে দেশের ব্যবস্থাপনা শিক্ষাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারত। একইভাবে দেশের কৃষি ও ফার্মাসিউটিক্যালস বা ওষুধ খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান ভারতের একই ধরনের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কৌশলগত জোট গঠন করলে উভয় দেশের বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসকরা পারস্পরিক সহযোগিতায় শিক্ষা ও গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা উভয় দেশের বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বেও প্রকৌশল ও চিকিৎসাসেবা খাতে কিছু যৌথ উদ্যোগ দেখতে চাই।
ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ওই ব্রিগেডিয়ার ভদ্রলোকের পরে অবশ্য সেই দেশের আরো অনেক কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারক/নীতি প্রণয়নকারীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। কয়েক বছর ভারতে কাজেরও সুযোগ হয়েছে, ইদানীং তাদের অনেকেই বলেছেন যে দিলি্লর জ্যেষ্ঠ কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং ভারতকে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সহায়ক শরিক হিসেবে তুলে ধরতে বলেছেন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল আর কাউকে এ দেশে বসে ভারতে অস্থিরতা তৈরির কার্যক্রমে পরিচালনায় মদদ কিংবা উৎসাহ দেবে না। তেমনটি ভারতও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বিকাশে একযোগে কাজ করবে। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরকেও উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন আশাবাদের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর সঙ্গে বিনিয়োগ-বাণিজ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে পারলে তাতে দুই দেশেরই লাভ। তবে আমাদের নিজস্ব মৌলিক শক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদও কাজে লাগাতে হবে। তবেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও
অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments