নিশ্চিন্তপুর ট্র্যাজেডি ও তৈরি পোশাক শিল্প by আনিসুজ্জামান মানিক
সাভারের নিশ্চিন্তপুরে ১১১ জন গার্মেন্ট শ্রমিক আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। একই কারখানায় এত শ্রমিকের লাশ এর আগে কেউ দেখেনি। লাশ চেনার উপায় নেই। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। মা চিনতে পারছেন না সন্তানের লাশ। স্বামী খুঁজছেন স্ত্রীর লাশ। চারপাশে সব লাশ আর লাশ।
সাদা কাপড়ে মুড়ে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়িতে যাচ্ছে লাশ। নিশ্চিন্তপুরে যেন লাশের মিছিল। পরিচয়হীন লাশের শেষ আশ্রয়স্থল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কারখানার দরজা খোলার উপায় নেই। মালিকের নির্দেশ- দরজা খোলা যাবে না। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের করুণ আকুতি দরজায় দাঁড়ানো দারোয়ানের কানে পৌঁছে না। সে মালিকের নির্দেশ পালন করে। কারখানার ভেতরের আগুনের উত্তাপ সে টের পায়; কিন্তু কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করার উপায় নেই। সে মালিকের নুন খায়।
তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টটি সাভারের নিশ্চিন্তপুরে। এই তৈরি পোশাক কারখানায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নয়, বেঁচে থাকার আশা নিয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছিল। শ্রমিকদের বেতন সামান্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে গার্মেন্ট শ্রমিকরা কোনো রকমে বেঁচে থাকে; ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। তাজরীন ফ্যাশনসের অধিকাংশ শ্রমিক এসেছিল রংপুর ও জামালপুরের চরাঞ্চল থেকে। তারা লাশ হয়েও বাড়ি যেতে পারল না। রংপুর ও জামালপুরে কাজ থাকলে বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার জন্য তারা নিশ্চিন্তপুরে আসত না।
মাঝেমধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় আগুন লাগে। অনেকে বলেন, আগুন লাগানো হয়। শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে। হরতাল হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানা ধ্বংস করে। রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করে। মালিকের অর্ডার বাতিল হয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ঘটেই চলেছে। এ গল্পের যেন শেষ নেই।
গার্মেন্ট কারখানা আমাদের দেশে প্রথমে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। প্রথমে বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন গার্মেন্ট বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন লাগলে বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই। বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও তালা লাগানো থাকে অথবা ওই সিঁড়ি ব্যবহারের অযোগ্য।
তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। এই হাঁস হত্যা করা হলে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষকে হত্যা করার শামিল হবে। কিন্তু মালিকের লোভ বেশি। সে দ্রুত আরো দ্রুত বড় হতে চায়। ফলে কারখানায় বিনিয়োগ কম। শ্রমিকের বেতন কম। বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা তৈরি করে না।
আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরে গার্মেন্ট, রেমিট্যান্স ও কৃষির মাধ্যমে। এই তিন খাতে যারা শ্রম দেয়, তাদের জীবনের মূল্য এত নগণ্য যে মৃত্যুর পর লাশের সন্ধান পর্যন্ত পাওয়া যায় না। প্রবাসী শ্রমিকদের দেখভাল করার ব্যাপারে আমাদের দূতাবাসগুলোর চরম উদাসীনতার খবর মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে পাওয়া যায়। প্রবাসী শ্রমিকরা লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। কৃষকের অবস্থা সংকটাপন্ন। মৌসুমে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। উন্নতমানের বীজ-সার কৃষকের নাগালের বাইরে। সারে ভেজাল, কীটনাশকে বালাই নাশ হয় না। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ থাকে না। ফসল সংরক্ষণ ও বিপণনের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুতের জন্য, সারের জন্য লাশ হয় কৃষক। এই কৃষক প্রান্তিক কৃষক।
গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকের লাশ। তারা উৎপাদন করে। উৎপাদন করে যারা দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে তারা লাশ। এদিকে আদম ব্যাপারীদের দৌরাত্ম্যে নষ্ট হচ্ছে শ্রমবাজার। দোষী-অপরাধী-খুনিরা সব সময় পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় আগুন লাগলে ওই কারখানার মালিককে জবাবদিহি করতে কখনো দেখা যায়নি। লাশের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে মাত্র এক লাখ টাকা।
আমাদের তৈরি পোশাক সারা বিশ্বে সমাদৃত। গার্মেন্ট ব্যবসা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কথিত আছে, মিসরের মমি মোড়ানো হতো একসময় ঢাকার মসলিন দিয়ে। সারা বিশ্বে আমরা কাপড় রপ্তানি করেছি। বাংলাদেশের মোটা কাপড়ের চাহিদা ছিল। বাংলাদেশের কাপড়ের চাহিদা বিশ্বে আবারও সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যবসা কিছু ব্যবসায়ী নষ্ট করছে। তারা বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা নির্মাণ করে না। যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য শ্রমিকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে না। ওভারটাইম পরিশোধ করে না। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে। শ্রমিকরা পুড়ে কয়লা হয়, বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম নষ্ট হয়।
তৈরি পোশাক শিল্প টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব শ্রমিক-মালিক দুই পক্ষেরই এবং দেশের প্রতিটি মানুষের। শুধু বিজিএমইএ, বিটিএমইএর ওপর নির্ভর করে সম্ভাবনার এই শিল্পকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তবে উল্লিখিত দুটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের ওপর তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ অনেকখানিই নির্ভর করছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নতির ওপর। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সবার দায়িত্ব।
লেখক : শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Mqnik780@yahoo.com
তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টটি সাভারের নিশ্চিন্তপুরে। এই তৈরি পোশাক কারখানায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নয়, বেঁচে থাকার আশা নিয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছিল। শ্রমিকদের বেতন সামান্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে গার্মেন্ট শ্রমিকরা কোনো রকমে বেঁচে থাকে; ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। তাজরীন ফ্যাশনসের অধিকাংশ শ্রমিক এসেছিল রংপুর ও জামালপুরের চরাঞ্চল থেকে। তারা লাশ হয়েও বাড়ি যেতে পারল না। রংপুর ও জামালপুরে কাজ থাকলে বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার জন্য তারা নিশ্চিন্তপুরে আসত না।
মাঝেমধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় আগুন লাগে। অনেকে বলেন, আগুন লাগানো হয়। শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে। হরতাল হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানা ধ্বংস করে। রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করে। মালিকের অর্ডার বাতিল হয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ঘটেই চলেছে। এ গল্পের যেন শেষ নেই।
গার্মেন্ট কারখানা আমাদের দেশে প্রথমে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। প্রথমে বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন গার্মেন্ট বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন লাগলে বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই। বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও তালা লাগানো থাকে অথবা ওই সিঁড়ি ব্যবহারের অযোগ্য।
তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। এই হাঁস হত্যা করা হলে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষকে হত্যা করার শামিল হবে। কিন্তু মালিকের লোভ বেশি। সে দ্রুত আরো দ্রুত বড় হতে চায়। ফলে কারখানায় বিনিয়োগ কম। শ্রমিকের বেতন কম। বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা তৈরি করে না।
আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরে গার্মেন্ট, রেমিট্যান্স ও কৃষির মাধ্যমে। এই তিন খাতে যারা শ্রম দেয়, তাদের জীবনের মূল্য এত নগণ্য যে মৃত্যুর পর লাশের সন্ধান পর্যন্ত পাওয়া যায় না। প্রবাসী শ্রমিকদের দেখভাল করার ব্যাপারে আমাদের দূতাবাসগুলোর চরম উদাসীনতার খবর মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে পাওয়া যায়। প্রবাসী শ্রমিকরা লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। কৃষকের অবস্থা সংকটাপন্ন। মৌসুমে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। উন্নতমানের বীজ-সার কৃষকের নাগালের বাইরে। সারে ভেজাল, কীটনাশকে বালাই নাশ হয় না। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ থাকে না। ফসল সংরক্ষণ ও বিপণনের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুতের জন্য, সারের জন্য লাশ হয় কৃষক। এই কৃষক প্রান্তিক কৃষক।
গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকের লাশ। তারা উৎপাদন করে। উৎপাদন করে যারা দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে তারা লাশ। এদিকে আদম ব্যাপারীদের দৌরাত্ম্যে নষ্ট হচ্ছে শ্রমবাজার। দোষী-অপরাধী-খুনিরা সব সময় পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় আগুন লাগলে ওই কারখানার মালিককে জবাবদিহি করতে কখনো দেখা যায়নি। লাশের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে মাত্র এক লাখ টাকা।
আমাদের তৈরি পোশাক সারা বিশ্বে সমাদৃত। গার্মেন্ট ব্যবসা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কথিত আছে, মিসরের মমি মোড়ানো হতো একসময় ঢাকার মসলিন দিয়ে। সারা বিশ্বে আমরা কাপড় রপ্তানি করেছি। বাংলাদেশের মোটা কাপড়ের চাহিদা ছিল। বাংলাদেশের কাপড়ের চাহিদা বিশ্বে আবারও সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যবসা কিছু ব্যবসায়ী নষ্ট করছে। তারা বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা নির্মাণ করে না। যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য শ্রমিকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে না। ওভারটাইম পরিশোধ করে না। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে। শ্রমিকরা পুড়ে কয়লা হয়, বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম নষ্ট হয়।
তৈরি পোশাক শিল্প টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব শ্রমিক-মালিক দুই পক্ষেরই এবং দেশের প্রতিটি মানুষের। শুধু বিজিএমইএ, বিটিএমইএর ওপর নির্ভর করে সম্ভাবনার এই শিল্পকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তবে উল্লিখিত দুটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের ওপর তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ অনেকখানিই নির্ভর করছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নতির ওপর। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সবার দায়িত্ব।
লেখক : শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Mqnik780@yahoo.com
No comments