সাক্ষাৎকার-শ্রমিক স্বার্থ দেখার কেউ নেই by ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :অজয় দাশগুপ্ত ম্যাক্রো-ইকোনমিস্ট ও পাবলিক পলিসি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রণী থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির সম্মানিত ফেলো। ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক।
২০০৯ সাল থেকে দুই বছর তিনি আঙ্কটাডের মহাসচিবের স্বল্পোন্নত দেশ বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। এর আগের দুই বছর ছিলেন জেনেভায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ দফতর এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি মস্কোর প্লেখানভ ইনস্টিটিউট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি নেন বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড থেকে


সমকাল :বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আবারও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলো ...
দেবপ্রিয় :দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবারের শিরোনাম নেতিবাচক কারণে। সাভারের দুর্ঘটনা মর্মান্তিক। শ্রমিকদের এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। সবাইকে তা ব্যথিত করেছে। নিহতদের জন্য আমার শোক এবং স্বজনদের সমবেদনা জানাই। বাংলাদেশ এখন তৈরি পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ। চীন রয়েছে শীর্ষে। আমরা সে স্থান দখল করতে পারি, এমন সম্ভাবনার কথা অনেকে বলছেন।
সমকাল : তাজরীন ফ্যাশনের অগি্নকাণ্ড বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন?
দেবপ্রিয় : বিদেশি ক্রেতাদের মাঝে কোনো ধরনের ভয়ভীতি যেন সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে আমরা সর্বদা সচেতন থাকি এবং সবাইকে তা অনুসরণের আহ্বান জানাই। পোশাকশিল্পের সঙ্গে দেশের স্বার্থ জড়িত। ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ স্বার্থে এ শিল্পের ক্ষতি হোক, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু সবকিছু আমাদের ওপর নির্ভর করে না। বর্তমান সময়টা জটিল। আমাদের পোশাকশিল্পের প্রধান বাজার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। সেখানে বড়দিন ও খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে কেনাকাটার ধুম পড়ে। এ উৎসবের এক মাসও বাকি নেই। এ উৎসবের জন্য যেসব পোশাক তৈরি করা হয়েছে, বাংলাদেশের রফতানিকারকরা হয়তো তার প্রায় সবটাই রফতানি করেছেন। এ কারণে এ মৌসুমের রফতানি খুব একটা ব্যাহত নাও হতে পারে। কিন্তু পরবর্তী অর্ডার পাওয়ার ওপর এ ঘটনা কালো ছায়া ফেলতে পারে। বিশ্বব্যাপী এ অগি্নকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা চলছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদ, ফেসবুক_ সবকিছুতে স্থান পেয়েছে এ বিপর্যয়ের সচিত্র খবর। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের ক্রেতারা সেসব শুনছেন, জানছেন। এ কারণে স্বল্পমেয়াদে না হলেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূল হতে পারে, এমন শঙ্কা রয়েছে। আমাদের পোশাক সরাসরি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে নয়, যায় চেইন স্টোরে। সেখান থেকে সাধারণ ক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতারা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পেতে পারে। বিক্রেতারাও তাদের ব্র্যান্ডের সুনাম রক্ষার জন্য বাংলাদেশে অর্ডার কমিয়ে দিতে পারেন। এমনও হতে পারে, বাংলাদেশের কিছু
কারখানা এক ধরনের কালো তালিকায় পড়ে গেল কিংবা মান ঠিকঠাক রাখার জন্য নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে। এসব কেবল অনুমান, বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটবে না বলে বসে থাকলে ভুল করা হবে।
সমকাল : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরের সময় পোশাকশিল্প শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন...
দেবপ্রিয় :বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনার সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের উল্লেখকে সংশ্লিষ্টরা পোশাকশিল্পের পরিবেশ ও শ্রম অধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে তাদের অব্যাহত মনোযোগের নজির হিসেবে তুলে ধরছেন। আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন বা এএফএল-সিআইও সংগঠন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব রেখেছে কয়েক বছর আগে। সম্প্রতি তা শুনানির জন্য আমলে নেওয়া হয়েছে। আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন একটি সাধারণ অপরাধের ঘটনা হিসেবে নয়, বরং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থেকে বিবেচনা করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর সঙ্গে কারখানার পরিবেশ, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না দেওয়া, বেতন-ভাতাসহ আরও অনেক কিছু জড়িয়ে থাকতে পারে। তাজরীন ফ্যাশনের অগি্নকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ঘটনা আগুনে ঘি ঢালার মতো হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
সমকাল :বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প খাত নিয়ে তো আমাদের অনেক স্বপ্ন। আমাদের উদ্যোক্তারা এক নম্বর স্থান দখল করতে সংকল্পবদ্ধ। মূল্য সংযোগ বেশি হয় এমন পোশাক উৎপাদন বাড়াতে তারা যত্নবান। তাজরীনের ঘটনার পর আমরা কীভাবে অগ্রসর হবো?
দেবপ্রিয় : আমরা উচ্চ মজুরি, উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও উচ্চ পণ্যমূল্য_ এই শুভচক্রে যেতে চাই। আমাদের কোনো মহলের কারণে এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হোক, সেটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনে বা শিল্প সংগঠনে সুশাসনের অভাব আবারও প্রকটভাবে প্রকাশ পেল। বস্ত্র খাতে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম গড়ে তোলায় শিল্প মালিকদের বরাবর অনীহা। সরকারের মনোভাবও তাদের সহায়ক। বাইরের চাপ দিয়ে কোনো দেশেই শ্রমিকদের আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। প্রকৃতই বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থ দেখভাল করার কেউ নেই। সরকার মনে করছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের কারখানা পরিবেশ দফতরের অফিসার ও কর্মীরা শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। তারা বিষয়টিকে নিছক টেকনিক্যাল কিছু মনে করছে। যেন শ্রমিক আন্দোলন কারখানার অবকাঠামো বা যন্ত্রপাতির মতোই কিছু একটা। বাস্তবে ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হতে পারে না। আবার এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য যে টার্মস অব রেফারেন্স বা করণীয় নির্দিষ্ট রয়েছে এবং এ দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত তারাও যে ঠিকভাবে কাজ করছে, সেটা বলা যাবে না। শ্রমের পরিবেশ যথাযথ রক্ষা না হলে, ন্যায্য মজুরি ও অন্য সুবিধা থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হলে সরকারি দফতর তৎপর হয় এমন নজির মিলবে না। বরং এ ধরনের দফতর সর্বদা মালিকদের হয়েই শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে বলে অভিযোগ এবং তা অমূলক বলা যাবে না।
সমকাল :পোশাকশিল্পে কিছু ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় ...
দেবপ্রিয় :প্রথমত, এ ধরনের কোনো শক্তিশালী সংগঠন নেই। পাকিস্তান আমলে বেসরকারি খাতের পাট ও বস্ত্রকলে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ছিল। শ্রমিকরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে উঠছে না। মালিক ও সরকার উভয়পক্ষেরই প্রবল অনীহা এতে। আবার সীমিত পরিসরে যেসব ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠছে তাদের কোনো কোনো নেতার সম্পর্কে মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ শোনা যায়। এ থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। আমরা একটি শুভচক্রে যেতে চাই। এ লক্ষ্য অর্জনের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ। এ কাজে শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। মালিক বা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শ্রমিক ফেডারেশনের চাপে সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠবে বা প্রভাবশালী হয়ে উঠবে, এমন আশা করা বৃথা। বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক শাসন বিরাজ করছে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ভোটের মাধ্যমে বারবার ক্ষমতায় আসছে। তারা কেন তৈরি পোশাক শিল্পের ৩০-৪০ লাখ শ্রমিকের স্বার্থের ব্যাপারে চরম উদাসীন, সেটা বোধগম্য নয়। বারবার এমন অসহায় মৃত্যু তারা কীভাবে মেনে নিচ্ছেন?
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ২০০৯ সালের ১৫ জুলাই বিনিয়োগ পরিবেশ এবং শিল্পাঙ্গনে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি শীর্ষ এক আলোচনার আয়োজন করেছিল। এতে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, শিল্প মালিক এবং সরকারের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তাতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উপায়ে শ্রমিক সংগঠন করার সুযোগ তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ত্রিপক্ষীয় যে কাঠামো বা সংগঠন রয়েছে তাকে আরও সক্রিয় ও সক্ষম করে তোলার কথাও বলা হয়। আরও আগে ২০০৬ সালের ৭ জুন ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে 'পোশাকশিল্পে সাম্প্রতিক অস্থিরতা : সমাধান কোন পথে' শীর্ষক সিপিডি সংলাপে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের শিল্প খাত-বস্ত্র খাত শুধু মালিকদের নয়, শুধু শ্রমিকের নয়, শুধু ব্যক্তির নয়, শুধু সরকারেরও নয়_ এটা বাংলাদেশের সব নাগরিকের। এ খাতের ভবিষ্যৎ বিকাশ ও সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরেই বাংলাদেশে শিল্প বিকাশ ঘটেছে। তাই এ খাত নিয়ে যে উদ্বেগ এবং একই সঙ্গে যে উৎসাহ তা শুধু শ্রমিক বা মালিকের একার নয়, নাগরিক হিসেবে সবার। এ খাতে যে অস্থিরতা তা জাতীয়ভাবেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। তিন বছরের ব্যবধানে দুটি আলোচনার কথা তুলে ধরেছি। এরপর আরও সময় গড়িয়েছে। এ সময়ে শ্রমিক সংখ্যা বেড়েছে। শিল্প আরও বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্ববাজারে আমাদের হিস্যা বেড়েছে। কিন্তু শ্রমের পরিবেশ এবং শ্রমিকদের মূল যে সমস্যা তাতে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা কেউই বোধকরি বলবে না। শ্রমিকদের হয়ে মালিক ও সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার কোনো সংগঠন এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।
সমকাল :আমরা জানি বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশে কারখানার পরিবেশ ও শ্রমের মান সম্পর্কে খুবই সংবেদনশীল। শিশুশ্রমের যে অবসান ঘটেছে, তার পেছনে ক্রেতাদের চাপ কাজ করেছে। কারখানার পরিবেশ উন্নত করায় তাদের সক্রিয়তা সুফল দিতে পারে ...।
দেবপ্রিয় : নিজেদের কাজ নিজেরা করাই ভালো। হিতে বিপরীত ফল হওয়ার অনেক ঘটনা আমরা জানি। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, কমপ্লায়েন্স নিয়ে অনেক কথা আমরা শুনি। কিন্তু এ দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে সেটা যে মানা হয় না, তা বহির্বিশ্বে একেবারে অজানা থাকার কথা নয়। এখান থেকে সস্তায় পোশাক কেনা যায় এবং এর প্রধান কারণ শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি প্রদান, সেটাও তারা নিশ্চয়ই জানে।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
দেবপ্রিয় : সমকাল পাঠকদের ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.