শিক্ষাঙ্গন-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন by আবু সাঈদ খান

নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হলে এবং সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে তা কার্যকর থাকলে দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়ে যায় বলে একটি ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল রয়েছে। এ কথা ঠিক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ অপরিহার্য।
তবে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়নের বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন, রাজনৈতিক ও গণসংগঠন সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ণতা পায় না। দেশে অগণতান্ত্রিক-আমলাতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন বহাল রেখে কেবল নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কায়েম করে গণতন্ত্র ধরে রাখাও যায় না। এমন ব্যবস্থা যে কোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন না হওয়ায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত সংসদ পরিণত হয়েছে গণতন্ত্রের সাইনবোর্ডে। একে সামনে রেখে চলছে ক্ষমতাবাজি, দলবাজি ও স্বেচ্ছাচারিতা।
সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উৎস হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক আবহ দরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। কারণ, শিক্ষাঙ্গনগুলোতেই তৈরি হচ্ছে আগামী দিনের নেতৃত্ব। শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে নির্বাচিত প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন নির্বাচন থেকে শুরু করে ছাত্র সংসদ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি। যারা আজ কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারাই আগামী দিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যদি যোগ্য ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে গড়ে না ওঠে, তাহলে কী করে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে নেবে?
আশার কথা_ শিক্ষাঙ্গনে বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশনসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসুসহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়ক আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, 'গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর রীতিনীতি চর্চার অভাবে শিক্ষার্থী-শিক্ষক নির্বিশেষ সবার ভেতর বেশকিছু নেতিবাচক প্রবণতা গাঢ় হয়ে উঠছে। শিক্ষকদের শিক্ষাদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বৈরতান্ত্রিক ও তোষামোদে মনোভাব, একচ্ছত্র ও যথেচ্ছ ক্ষমতার অপব্যবহার, শিক্ষার্থীদের একটা অংশের স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় দলীয় (বিশেষত সরকারদলীয়) লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হল দখল, শিক্ষাঙ্গনে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের সংকটের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মূল দলের পোষ্য গুণ্ডা বাহিনীতে পরিণত হওয়া_ এসবই আজ শিক্ষাঙ্গনগুলোয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে।'
এ লেখায় শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের নির্বাচনের কথা না-ইবা বললাম, ছাত্ররাজনীতির অবস্থা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্যই উদ্বেগজনক। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে মত্ত। ছাত্রসমাজের অতীত গৌরবগাথা আজ ম্লান। একদা ছাত্রসমাজ হয়ে উঠেছিল জনগণের আশা-ভরসার স্থল। ষাটের দশকের কথা। কৃষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখা করতেন। বলতেন, বাবারা, কত কষ্ট করে পাট ফলিয়েছি। কিন্তু ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। উৎপাদন খরচও উঠবে না। তখন সব সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা বসে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নিতেন। সেই প্রতিবাদ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হতো না, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রসমাজের প্রতি আস্থা এত বেড়ে যায় যে, গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে দিতে ছাত্রদের অনুরোধ করা হতো। এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রামের দীর্ঘদিনের দুটি বিরোধ আমাদের মিটিয়ে দিতে হয়েছিল। ছাত্রসমাজের প্রতি সেই আস্থা আর নেই। জনগণ এখন কথিত ছাত্রনেতাদের দেখে ভয় পায়। আতঙ্কিত হয়। কারও অজানা নেই যে, তারা কত কিসিমের অপরাধকর্মে লিপ্ত। কখনও দুই দলের মধ্যে, কখনও দলের ভেতরেই তারা অস্ত্র হাতে লড়াই করছে। সতীর্থের রক্তে হাত রঞ্জিত করছে। এটি সত্য, এরা সংখ্যায় অতি সামান্য। কিন্তু এসব ঘটনাই সমগ্র ছাত্রসমাজের মুখে কালিমা লেপন করছে। ছাত্ররাজনীতির গৌরব ম্লান করেছে। এভাবে ছাত্রসমাজের মর্যাদা ধুলায় লুটিয়ে পড়ছে। যে ছাত্ররা ছিল দেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণের চোখের মণি, আজ তারাই জনগণের উৎকণ্ঠার কারণ।
ছাত্র নেতৃত্ব ছিল রাজনৈতিক দলের চেয়ে অগ্রসর ও সাহসী। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতারা বলেছিলেন, ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করো না। ছাত্ররা তা অগ্রাহ্য করে গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। গড়ে তোলে প্রতিরোধ। এভাবে ছাত্রদের সাহসী রক্তদানে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ইতিহাস বলে, ছাত্র ও যুব নেতাদের ঐক্যবদ্ধ চাপের মুখে ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একমঞ্চে আসীন হন। এভাবেই যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় সূচিত হয়। ছাত্রসমাজই ষাটের দশকজুড়ে সংগ্রামের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রেখেছিল। সব দল মিলে ১১ দফা রচনা করে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। একাত্তরের মার্চে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। অগণিত ছাত্র একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। সর্বশেষ '৯০-এ সব মত-পথের ছাত্র সংগঠন একত্র হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গণজাগরণ তৈরি করেছে। যে ছাত্ররা সর্বদাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগে হেঁটেছে, জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সেই ছাত্রসমাজ আজ রাজনৈতিক দলের অন্ধ সেবাদাস ও লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ জনগণের ঘাম ও রক্তে ভেজা অর্থে চলে। সেই জনগণ শিক্ষাঙ্গনে হানাহানি দেখতে চায় না। বন্দুকযুদ্ধ দেখতে চায় না, দেখতে চায় না সন্তানের রক্তাক্ত নিথর দেহ। অথচ এখানে দরকার মেধার প্রতিযোগিতা, গবেষণা, উন্নত জীবনবোধের চর্চা, মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
শিক্ষাঙ্গনে এখন একটি প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসে যে, কীভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করা হবে। একাত্তরে পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসের রাজত্ব
কায়েম করেছে। এই অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের কি খালি হাতে মোকাবেলা করা সম্ভব?
অস্ত্রবাজদের যে সম্মিলিত প্রতিরোধ বূ্যহ রচনা করে মোকাবেলা করা যায়, তার নজির নিকট অতীতেই আছে। নব্বইয়ে নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের অস্ত্রবাজরা ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে শিক্ষাঙ্গন ছেড়েছিল। ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে অপশক্তি বরাবরই পরাস্ত হয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরে নিই_ গুটিকতক যুবক যদি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েও অস্ত্র হাতে শিবির মোকাবেলা করে, তবে সেটি জনগণের কাছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলেই বিবেচিত হবে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধকে জনগণ অস্ত্রবাজি হিসেবেই দেখে, শান্তিপ্রিয় মানুষ তা সমর্থন করে না। সঙ্গত কারণে জাতি আশা করে, শিক্ষাঙ্গন থেকে দেশ গড়ার কারিগর আগামী দিনের সৎ ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, গবেষক, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী জন্ম নেবে, যারা জাতির হাল ধরবে। দেশকে সমৃদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত দেশে পরিণত করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে তা সম্ভব? ছাত্রসমাজের মধ্যে নানা অশুভ উপাদান ঢুকে পড়েছে। বিপথগামীরা ছাত্রসমাজের মুখে কলঙ্ক কালিমা লেপন করেছে, তা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ মিলবে?
এসব অপতৎপরতা রুখতে চাই আদর্শবাদী ছাত্র নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। কিন্তু নির্বাচন না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, খুনোখুনি হবে, শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনেও এমন আশঙ্কা আছে, তাই বলে কি তা বন্ধ রাখা উচিত? কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন কিছু নয়। তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর তো বটেই, কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক অবস্থান জরুরি। বলাবাহুল্য, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রের দাবিদার দুই দল বা দুই জোটের শাসনামলে তা অনুষ্ঠিত হলো না। একে আমরা কীভাবে দেখব?
আজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেই শুধু ইতিবাচক অগ্রগতি হতো না, বেরিয়ে আসত নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতাও, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঋদ্ধ করত।
১৯৫০-৬০-৭০ দশকের ছাত্রনেতারা আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন। কিন্তু এখন আর শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনৈতিক কর্মী মূল রাজনীতিতে আসছে না। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। এতে অবারিত হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াবহির্ভূত নব্য ধনী, কালো টাকার মালিকদের আগমনের পথ। এসব অরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীদের কাছে রাজনীতি আত্মপ্রতিষ্ঠার উপায়। তাই তারা সংসদ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকে তদবিরবাজিতে নিবেদিতপ্রাণ!
গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন গণতন্ত্রমনস্ক প্রজন্ম। আর সেই নতুন প্রজন্ম যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে না ওঠে, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে_ যা কিছুতেই কাম্য নয়।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.