বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৮১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আমির হোসেন, বীর প্রতীক বুকে গুলি লাগে তাঁর
আমির হোসেন পেশায় তেলি বা তেল বিক্রেতা ছিলেন। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কেরোসিন তেল বিক্রি করতেন।
পড়াশোনার প্রাথমিক গণ্ডি শেষ করে পরিবারের
ভরণ-পোষণের জন্য বাবার হাত ধরে তিনি এই পেশায় যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স
ছিল আনুমানিক ২৫ বছর। তখন তিনি বিবাহিত এবং এক মেয়ের জনক। মেয়ের বয়স ছিল
মাত্র তিন মাস।আমির হোসেন পেশায় তেলি বা তেল বিক্রেতা ছিলেন। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কেরোসিন তেল বিক্রি করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমির হোসেন নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকেননি। ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার যোগ দেন যুদ্ধে। এক যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন, পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। স্বাধীনতার পর সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাঁকে বীরত্বসূচক বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। তিনি যে শহীদ, এটা অবশ্য গেজেটে উল্লেখ নেই। ১৯৭৩ সালের গেজেটে তাঁর ক্রমিক নম্বর ৩৪৭।
আমির হোসেনসহ ৫২ জন খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাকে চিহ্নিত করতে না পারায় সম্প্রতি আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিই। এরপর আমাদের নবাবগঞ্জ প্রতিনিধির মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে তথ্য পাই। মুক্তিযুদ্ধে আমির হোসেনের বীরত্বসূচক খেতাব পাওয়ার বিষয়টি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও জানতেন না। ৩৫ বছর পর তাঁরা জানতে পারেন। ২০০৮ সালে নবাবগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আমির হোসেনের স্ত্রীকে খবরটি জানায়।
১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে একদিন রাতে আমির হোসেন বাড়ি থেকে চলে যান। তাঁর স্ত্রী ও বাবা-মা কেউ জানতেন না তিনি কোথায় গেছেন। অনেক দিন পর এক রাতে তিনি বাড়ি ফেরেন। তখন পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন যে তিনি গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে।
আমির হোসেন ভারতে গিয়ে ৩ নম্বর সেক্টরে নাম অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে এই সেক্টরে কিছুদিন যুদ্ধ করার পর অনুমতি নিয়ে নিজ এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য চলে আসেন। স্ত্রী, বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দু-তিন দিন থাকেন। তারপর বিদায় নিয়ে আবার যুদ্ধে যোগ দেন। তিনি নিজ এলাকায় যুদ্ধ করেন হালিম বাহিনীর অধীনে।
এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মানিকগঞ্জ জেলার অধিবাসী ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি নিজ উদ্যোগে ও স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে এই বাহিনী গড়েন। দুর্গম হরিরামপুর উপজেলায় (তখন থানা) ছিল বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প। মানিকগঞ্জ জেলা এবং ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার যাঁরা ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরে প্রশিক্ষণ নেন, তাঁদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে এই বাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৭১ সালের ৪ অক্টোবর বেলা আনুমানিক দুইটায় আমির হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা হালিম বাহিনীর একটি গোপন উপক্যাম্পে (সাদাপুর) ছিলেন। তখন ক্যাম্পে দুপুরের খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এমন সময় খবর আসে, পাশের সমসাবাদ গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ও রাজাকাররা এসেছে। আমির হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা দ্রুত প্রস্তুত হয়ে ওই গ্রামে যান এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে পাঁচ-ছয়জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এরপর দুই পক্ষে সামনাসামনি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বেশি ছিল। অস্ত্রশস্ত্রেও তারা এগিয়ে ছিল। মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা আক্রমণ করে। একপর্যায়ে আমির হোসেনের বুকে তিন-চারটি গুলি লাগে। গুরুতর আহত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
সহযোদ্ধারা দ্রুত আমির হোসেনকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। কিন্তু তাঁর অবস্থা ক্রমে অবনতি হয়। তখন সহযোদ্ধারা স্থানীয় গ্রামবাসীর সহায়তায় তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে পাঠান। কিন্তু পথেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। পরে তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
শহীদ আমির হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারীপাড়া ইউনিয়নের বক্তানগর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম বাবর আলী, মা তসিরন নেছা। স্ত্রী রাহেলা খাতুন।
আমির হোসেনের স্ত্রী এখনো বেঁচে আছেন। স্বাধীনতার পর স্বামী হারানোর শোক তাঁকে শুধু কাঁদিয়েছে। একপর্যায়ে তাঁর চোখে ছানি পড়ে যায়। এখন তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন। এখন স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান।
একমাত্র মেয়ে সেলিনা আক্তার বিবাহিত। তবে তাঁর স্বামীও মারা গেছেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বাবাকে দেখিনি। দেশের জন্য বাবা জীবন দিয়েছেন। এ জন্য ভালো লাগে। আমার বাকি জীবন বাবার পরিচয়ে অহংকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’
সূত্র: প্রথম আলোর নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি আজহারুল হক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ ও ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments