মিয়ানমারের আদমশুমারি গণতন্ত্রের এক জটিল পরীক্ষা by সনু ত্রিবেদি
২০১৪ সালে আদমশুমারির জন্য মিয়ানমারে প্রস্তুতি চলছে। গত তিন দশকের মধ্যে এটাই হবে প্রথম আদমশুমারি। আশা করা হচ্ছে, এই লোক গণনার ওপর ভিত্তি করেই ২০১৫ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা দেশটিকে সত্যিকারের গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে।
আগের সামরিক কর্তৃপক্ষ কখনো এই আদমশুমারির প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। তারপর থেকে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তারা মিয়ানমারের গণনার ভেতরে নেই। সরকারের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সঠিক জনসংখ্যা গণনা একদিকে যেমন একটি জটিল বিষয়, অন্যদিকে তা মুখ্য সমস্যারও একটি।
প্রকৃত সংখ্যা গণনার মধ্য দিয়ে জিডিপির মতো মাথাপিছু আয় ও অন্যান্য আর্থসামাজিক তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ, কর্মসংস্থান, পয়োনিষ্কাশন, যোগাযোগ ও পরিবহনের মতো বিষয়ে মৌলিক নীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যে জাতি-গোষ্ঠীগুলো রয়েছে, তাদের হিসাব অনুসারে, নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণও এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জনসংখ্যা গণনা প্রকল্প শুরু হবে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে। জাতিসংঘ পপুলেশন ফান্ড এ প্রকল্পে সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।
বহু বছর ধরেই অর্থনীতিবিদ ও একাডেমিকরা বাধ্য হয়েছেন সরকারের চাপিয়ে দেওয়া অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করতে। যেসব অঞ্চলে বিদ্রোহীরা তৎপর হয়ে উঠেছিল, সেসব এলাকায় ১৯৮৩ সালে লোকসংখ্যা গণনা করা সম্ভব হয়নি। এর আগে গ্রহণযোগ্য আদমশুমারি হয়েছিল সেই ১৯৩১ সালে, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে। এ দেশের প্রথম আদমশুমারি হয়েছিল ১৮৯১ সালে, ব্রিটিশরা আপার বার্মাকে সংযুক্ত করার পর।
যা হোক, মিয়ানমারের আদমশুমারি নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই রোহিঙ্গাদের ইস্যুটি চলে আসে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাস করে দেশটির রাখাইন প্রদেশে। দেশের ১৩৫টি জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এই রোহিঙ্গাদের গণনা করা হয় না। ফলে তারা দেশটির নাগরিক নয়। ১৯৮৩ সালেও তাদের আদমশুমারির বাইরে রাখা হয়েছিল। এই রাষ্ট্রহীন অবস্থার কারণেই আজ তাদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে। এখন দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, নাগরিকদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে- ১. পূর্ণ নাগরিক, ২.অ্যাসোসিয়েট নাগরিক ও ৩. ন্যাচারালাইজড নাগরিক। এর কোনো ক্যাটাগরিতেই রোহিঙ্গারা পড়েনি। তাই তাদের ধরা হয় নন-ন্যাশনাল বা ফরেন রেসিডেন্ট হিসেবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দাবি, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। রাখাইন রাজ্যে সম্প্রতি বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংসতায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে এবং গৃহহীন হয়েছে হাজার হাজার। বিষয়টি অন্যান্য মুসলিম গ্রুপের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
সরকার এ ঘটনা তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটি দুটি ডেটলাইন পার হয়ে গেলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এই রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিবেচনা করার কথা দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর সেই প্রতিশ্রুতিতে নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে ঘাটতি আছে। প্রত্যাশা ছিল, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অং সান সু চি একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
রোহিঙ্গাদের বাইরেও প্রায় এক লাখ চীনা রয়েছে, যারা হয়রানি এড়াতে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের কাছে মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়ে আছে। বেশ কয়েকটি পাহাড়ি উপজাতি রয়েছে গভীর পাহাড়ে এবং তাদেরও গণনা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া একটি বিশালসংখ্যক নেটিভ রয়েছে, যারা আবার আদিবাসীও নয়, যেমন ভারতীয়রা। এখনো তাদের গণনায় আনা হয়নি। ১৯৮৩ সালের আদমশুমারি মতে, মিয়ানমারে রয়েছে চার লাখ ২৮ হাজার ভারতীয়। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারে বাস করে ২৫ লাখ ভারতীয়। যদিও তারা চার দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে বসবাস করছে; কিন্তু কাগজপত্রের অভাবে তারা ১৯৮২ সালের আইনে বার্মিজ নাগরিক হতে না পেরে রাষ্ট্রহীন হয়ে আছে। যা হোক, ২০১০ সালের নির্বাচনের সময় তাদের অনেকেই ন্যাচারালাইজড সিটিজেন হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে।
এখন সব ধরনের জাতি-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিশ্বমানের আদমশুমারি করতে মিয়ানমারকে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পাল্টাতে হবে। তবেই সেটা আন্তর্জাতিক কনভেনশন, প্রথা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রহীনদের স্ট্যাটাস বিষয়ে কনভেনশনের নেওয়া মূল্যবোধকেও বিবেচনায় আনতে হবে। তার মানে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো কার্যকর পথে এগোতে হবে। এভাবে সঠিক পথে এগোলে মিয়ানমারের আদমশুমারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করার সুযোগ থাকবে না।
লেখক : দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকির হোসেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
দ্য হিন্দু থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
প্রকৃত সংখ্যা গণনার মধ্য দিয়ে জিডিপির মতো মাথাপিছু আয় ও অন্যান্য আর্থসামাজিক তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ, কর্মসংস্থান, পয়োনিষ্কাশন, যোগাযোগ ও পরিবহনের মতো বিষয়ে মৌলিক নীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যে জাতি-গোষ্ঠীগুলো রয়েছে, তাদের হিসাব অনুসারে, নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণও এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জনসংখ্যা গণনা প্রকল্প শুরু হবে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে। জাতিসংঘ পপুলেশন ফান্ড এ প্রকল্পে সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।
বহু বছর ধরেই অর্থনীতিবিদ ও একাডেমিকরা বাধ্য হয়েছেন সরকারের চাপিয়ে দেওয়া অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করতে। যেসব অঞ্চলে বিদ্রোহীরা তৎপর হয়ে উঠেছিল, সেসব এলাকায় ১৯৮৩ সালে লোকসংখ্যা গণনা করা সম্ভব হয়নি। এর আগে গ্রহণযোগ্য আদমশুমারি হয়েছিল সেই ১৯৩১ সালে, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে। এ দেশের প্রথম আদমশুমারি হয়েছিল ১৮৯১ সালে, ব্রিটিশরা আপার বার্মাকে সংযুক্ত করার পর।
যা হোক, মিয়ানমারের আদমশুমারি নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই রোহিঙ্গাদের ইস্যুটি চলে আসে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাস করে দেশটির রাখাইন প্রদেশে। দেশের ১৩৫টি জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এই রোহিঙ্গাদের গণনা করা হয় না। ফলে তারা দেশটির নাগরিক নয়। ১৯৮৩ সালেও তাদের আদমশুমারির বাইরে রাখা হয়েছিল। এই রাষ্ট্রহীন অবস্থার কারণেই আজ তাদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে। এখন দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, নাগরিকদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে- ১. পূর্ণ নাগরিক, ২.অ্যাসোসিয়েট নাগরিক ও ৩. ন্যাচারালাইজড নাগরিক। এর কোনো ক্যাটাগরিতেই রোহিঙ্গারা পড়েনি। তাই তাদের ধরা হয় নন-ন্যাশনাল বা ফরেন রেসিডেন্ট হিসেবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দাবি, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। রাখাইন রাজ্যে সম্প্রতি বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংসতায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে এবং গৃহহীন হয়েছে হাজার হাজার। বিষয়টি অন্যান্য মুসলিম গ্রুপের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
সরকার এ ঘটনা তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটি দুটি ডেটলাইন পার হয়ে গেলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এই রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিবেচনা করার কথা দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর সেই প্রতিশ্রুতিতে নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে ঘাটতি আছে। প্রত্যাশা ছিল, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অং সান সু চি একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
রোহিঙ্গাদের বাইরেও প্রায় এক লাখ চীনা রয়েছে, যারা হয়রানি এড়াতে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের কাছে মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়ে আছে। বেশ কয়েকটি পাহাড়ি উপজাতি রয়েছে গভীর পাহাড়ে এবং তাদেরও গণনা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া একটি বিশালসংখ্যক নেটিভ রয়েছে, যারা আবার আদিবাসীও নয়, যেমন ভারতীয়রা। এখনো তাদের গণনায় আনা হয়নি। ১৯৮৩ সালের আদমশুমারি মতে, মিয়ানমারে রয়েছে চার লাখ ২৮ হাজার ভারতীয়। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারে বাস করে ২৫ লাখ ভারতীয়। যদিও তারা চার দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে বসবাস করছে; কিন্তু কাগজপত্রের অভাবে তারা ১৯৮২ সালের আইনে বার্মিজ নাগরিক হতে না পেরে রাষ্ট্রহীন হয়ে আছে। যা হোক, ২০১০ সালের নির্বাচনের সময় তাদের অনেকেই ন্যাচারালাইজড সিটিজেন হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে।
এখন সব ধরনের জাতি-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিশ্বমানের আদমশুমারি করতে মিয়ানমারকে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পাল্টাতে হবে। তবেই সেটা আন্তর্জাতিক কনভেনশন, প্রথা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রহীনদের স্ট্যাটাস বিষয়ে কনভেনশনের নেওয়া মূল্যবোধকেও বিবেচনায় আনতে হবে। তার মানে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো কার্যকর পথে এগোতে হবে। এভাবে সঠিক পথে এগোলে মিয়ানমারের আদমশুমারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করার সুযোগ থাকবে না।
লেখক : দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকির হোসেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
দ্য হিন্দু থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments