শিক্ষা-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি by তারেক শামসুর রেহমান
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি। জাপানে সাম্প্রতিক ভয়াবহ ভূমিকম্প, সুনামি ও ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর একটি প্রতিক্রিয়া পড়বে বলেই অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন।
জাপানের ঘটনাবলির সঙ্গে যোগ হয়েছে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ছিল আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম উৎস। এসব রেমিটেন্সের প্রবাহ কমছে এবং আগামীতে আরও কমবে। লিবিয়ায় যুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, তাহলে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সবাইকে দেশে ফিরে আসতে হবে। সংখ্যাটাও একেবারে কম নয়, প্রায় ৬০ হাজার। বাংলাদেশে তাদের জন্য যদি কাজের কোনো ক্ষেত্র সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে সমাজে অসন্তোষ বাড়বে। তাদের জন্য কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে দরকার বিনিয়োগ, সরকারি আনুকূল্য। সরকারকে তাই অগ্রাধিকারভিত্তিক সেক্টরগুলো চিহ্নিত করতে হবে। নিঃসন্দেহে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রাধিকার পেতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। খাদ্যদ্রব্যের দামের ঊর্ধ্বগতি সরকারের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে খাদ্য আমদানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। খাদ্য আমদানিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে এবার। এটাও সরকারের অগ্রাধিকার।
জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার। জাপান এ বছর আমাদের ১৪৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মাওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা। দুই হাজার ৩৫৫ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এই সেতুটি নির্মাণে। জাপান বেশ বড় অঙ্কের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন এই সাহায্য পাওয়া যাবে না বলে জাপান জানিয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতু সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও এটি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু একটি বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে জাপানি সাহায্য পাওয়া না গেলেও সরকারকে নিজস্ব খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী সংসদে সম্প্রতি জানিয়েছেন, মাওয়া-জাজিরা অবস্থানে পদ্মা সেতু নির্মাণের বাইরেও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ অবস্থানে ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। এই সেতুর জন্য ১ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার প্রাক্কলিত ব্যয় সংবলিত প্রকল্পের পিডিপিপি নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এটিও সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এই প্রকল্পেও অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থ জোগাতে হবে। একদিকে রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে যাওয়া, অন্যদিকে অনুৎপাদশীল খাতে আমদানি ব্যয় ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ার ফলে সরকার যে চাপের মুখে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ ফাঁস করে দিয়েছে একটি সাপ্তাহিক। পরপর দুই সংখ্যায় যা ছাপা হয়েছে, তাতে উপাচার্যের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার সমর্থক শিক্ষকদের একটি অংশ (গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক সংগঠন) ২০ মার্চ প্রচারিত এক প্রচারপত্রে প্রকাশিত সংবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তারা প্রকাশিত সংবাদগুলোর ব্যাপারে ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন। যদিও পাল্টা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন উপাচার্য সমর্থক শিক্ষকরা। এর আগে রংপুর, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও একাধিক সংবাদ ছাপা হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এসব ঘটনায় আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে দু'জন প্রো-ভিসি রয়েছেন। এর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। যেখানে ঢাকা, রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় একজন প্রো-ভিসি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে দু'জন প্রো-ভিসি থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অতীতের উদাহরণ টেনে বর্তমানের সিদ্ধান্তকে জায়েজ করা যাবে না। জাবির উপাচার্য মহোদয় নতুন করে একজন প্রো-ভিসির নাম প্রস্তাব করে দু'জন শিক্ষকের নাম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন বলে সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে। এর আদৌ প্রয়োজন নেই। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে কৃচ্ছ্রসাধন যেখানে জরুরি, সেখানে জাবিতে দু'জন প্রো-ভিসির আদৌ প্রয়োজন নেই। একজন প্রো-ভিসির পেছনে মাসিক খরচ কয়েক লাখ টাকা। এই টাকা আমরা সাশ্রয় করতে পারি। জাতীয় প্রয়োজনে এ অর্থ অন্য কাজে ব্যয় করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করার সুবাদে জানি, শিক্ষক তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে হলে মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্-অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো উপাচার্য মহোদয়ই এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তারা নিজেদের স্বার্থে একটি পদের বিপরীতে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন। এর চেয়ে আরও দুঃখজনক হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয়রা নিজ ভাই, মেয়ে, নিজের আত্মীয়স্বজন এবং নিজ এলাকার লোকদের গণহারে শিক্ষক তথা কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে টান পড়ছে। এমনও দেখা গেছে, যিনি ওই বিভাগের আদৌ ডিগ্রি নেননি, কিন্তু তাকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থে ওই বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি নিজের স্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন যে নির্বাচনী সভায়, সেই নির্বাচনী সভায় তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছিলেন। বিষয়টি মাননীয় রাষ্ট্রপতির নজরে আসায় (তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর) প্রো-ভিসিকে তিনি অব্যাহতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখনও বহাল তবিয়তে আছেন, যিনি আত্মীয়করণের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একজন উপাচার্য যখন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। উপাচার্য মহোদয়রা আত্মীয়করণ কিংবা আঞ্চলিকতাকে প্রশ্রয় দেবেন, এটা কাম্য নয় এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যা আদৌ কোনো অবদান রাখবে না। মাননীয় রাষ্ট্রপতি বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে আসছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয়রা এ ব্যাপারে সিরিয়াস নন। তারা ব্যস্ত থাকছেন দলীয় ভিত্তিতে কিংবা আত্মীয়স্বজনদের চাকরির একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন মেধার বড় অবমূল্যায়ন হচ্ছে। মেধাবী ছাত্ররা এখন আর শিক্ষক হচ্ছেন না। আঞ্চলিকতা এখন এত বেশি যে, একটি বিশেষ জেলাকে চাকরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সে সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী ছাত্রটি এখন আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারছেন না। একটি অলিখিত নিয়ম এখন চালু হয়ে গেছে যে, নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রটিকেই নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে 'চাকরি' দিতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রধান অন্তরায়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটছে, তাতে শিক্ষকতার প্রতি আমি আমার বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি। আগামী দশ বছর শিক্ষকতায় আরও থাকব, তেমন আশা রাখতে পারছি না। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কে মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। একজন উপাচার্য যদি হুমকির সম্মুখীন হন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। এসব ঘটনা যদি শক্ত হাতে দমন করা না যায় তাহলে তা বারবার ঘটতে থাকবে। শিক্ষকদের নিয়ে কটূক্তি করা, শিক্ষকদের অসম্মানিত করা, তাদের নিয়ে ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দেওয়া_ সব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে। এসব ঘটনার একটিরও পূর্ণ তদন্ত হয়নি। ফলে ভিসিকে মোবাইলে হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। আমি শিক্ষক হিসেবে দুষ্কৃতকারীদের বিচার দাবি করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্বাভাবিকহারে ব্যয়বৃদ্ধি ঘটেছে। এই ব্যয়বৃদ্ধিকে শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে এক করে মেলানো যাবে না। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন নতুন অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে, যেখানে প্রভাব রয়েছে যোগ্য শিক্ষকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ শুদ্ধ করে কথা বলতে পারেন না। এ কথাটি আজ প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেক শিক্ষকই, বিশেষ করে তরুণ শিক্ষকরা জাতীয় রাজনীতি তথা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যতটুকু সম্পৃক্ত, গবেষণা তথা শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে ততটুকু জড়িত নন। বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা এনে শিক্ষার মানোন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হচ্ছে! কিন্তু আসলে কি মানোন্নয়ন হচ্ছে! তরুণ শিক্ষকদের দরকার প্রশিক্ষণ, যা ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে পারছে না। শিক্ষক নিয়োগের নামে যদি দলীয়-আত্মীয়করণ কিংবা অঞ্চলপ্রীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আমরা খুব অচিরেই একটি মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হবো। মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে। ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয় এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা সারাবিশ্বের অর্থনীতিকে আঘাত হানবে। আমরা এ থেকে বাদ যাব না। তাই সতর্ক হওয়ার সময় এখনই। এখনই পাবলিক সেক্টরে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব ধরনের নিয়োগ নূ্যনতম এক বছর বন্ধ রাখা উচিত। ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়রা যদি এ ব্যাপারে সদয় হন, আমি খুশি হবো।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও কলাম লেখক
tsrahmanbd@yahoo.com
জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার। জাপান এ বছর আমাদের ১৪৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মাওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা। দুই হাজার ৩৫৫ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এই সেতুটি নির্মাণে। জাপান বেশ বড় অঙ্কের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন এই সাহায্য পাওয়া যাবে না বলে জাপান জানিয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতু সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও এটি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু একটি বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে জাপানি সাহায্য পাওয়া না গেলেও সরকারকে নিজস্ব খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী সংসদে সম্প্রতি জানিয়েছেন, মাওয়া-জাজিরা অবস্থানে পদ্মা সেতু নির্মাণের বাইরেও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ অবস্থানে ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। এই সেতুর জন্য ১ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার প্রাক্কলিত ব্যয় সংবলিত প্রকল্পের পিডিপিপি নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এটিও সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এই প্রকল্পেও অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থ জোগাতে হবে। একদিকে রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে যাওয়া, অন্যদিকে অনুৎপাদশীল খাতে আমদানি ব্যয় ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ার ফলে সরকার যে চাপের মুখে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ ফাঁস করে দিয়েছে একটি সাপ্তাহিক। পরপর দুই সংখ্যায় যা ছাপা হয়েছে, তাতে উপাচার্যের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার সমর্থক শিক্ষকদের একটি অংশ (গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক সংগঠন) ২০ মার্চ প্রচারিত এক প্রচারপত্রে প্রকাশিত সংবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তারা প্রকাশিত সংবাদগুলোর ব্যাপারে ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন। যদিও পাল্টা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন উপাচার্য সমর্থক শিক্ষকরা। এর আগে রংপুর, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও একাধিক সংবাদ ছাপা হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এসব ঘটনায় আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে দু'জন প্রো-ভিসি রয়েছেন। এর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। যেখানে ঢাকা, রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় একজন প্রো-ভিসি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে দু'জন প্রো-ভিসি থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অতীতের উদাহরণ টেনে বর্তমানের সিদ্ধান্তকে জায়েজ করা যাবে না। জাবির উপাচার্য মহোদয় নতুন করে একজন প্রো-ভিসির নাম প্রস্তাব করে দু'জন শিক্ষকের নাম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন বলে সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে। এর আদৌ প্রয়োজন নেই। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে কৃচ্ছ্রসাধন যেখানে জরুরি, সেখানে জাবিতে দু'জন প্রো-ভিসির আদৌ প্রয়োজন নেই। একজন প্রো-ভিসির পেছনে মাসিক খরচ কয়েক লাখ টাকা। এই টাকা আমরা সাশ্রয় করতে পারি। জাতীয় প্রয়োজনে এ অর্থ অন্য কাজে ব্যয় করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করার সুবাদে জানি, শিক্ষক তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে হলে মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্-অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো উপাচার্য মহোদয়ই এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তারা নিজেদের স্বার্থে একটি পদের বিপরীতে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন। এর চেয়ে আরও দুঃখজনক হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয়রা নিজ ভাই, মেয়ে, নিজের আত্মীয়স্বজন এবং নিজ এলাকার লোকদের গণহারে শিক্ষক তথা কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে টান পড়ছে। এমনও দেখা গেছে, যিনি ওই বিভাগের আদৌ ডিগ্রি নেননি, কিন্তু তাকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থে ওই বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি নিজের স্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন যে নির্বাচনী সভায়, সেই নির্বাচনী সভায় তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছিলেন। বিষয়টি মাননীয় রাষ্ট্রপতির নজরে আসায় (তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর) প্রো-ভিসিকে তিনি অব্যাহতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখনও বহাল তবিয়তে আছেন, যিনি আত্মীয়করণের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একজন উপাচার্য যখন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। উপাচার্য মহোদয়রা আত্মীয়করণ কিংবা আঞ্চলিকতাকে প্রশ্রয় দেবেন, এটা কাম্য নয় এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যা আদৌ কোনো অবদান রাখবে না। মাননীয় রাষ্ট্রপতি বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে আসছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয়রা এ ব্যাপারে সিরিয়াস নন। তারা ব্যস্ত থাকছেন দলীয় ভিত্তিতে কিংবা আত্মীয়স্বজনদের চাকরির একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন মেধার বড় অবমূল্যায়ন হচ্ছে। মেধাবী ছাত্ররা এখন আর শিক্ষক হচ্ছেন না। আঞ্চলিকতা এখন এত বেশি যে, একটি বিশেষ জেলাকে চাকরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সে সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী ছাত্রটি এখন আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারছেন না। একটি অলিখিত নিয়ম এখন চালু হয়ে গেছে যে, নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রটিকেই নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে 'চাকরি' দিতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রধান অন্তরায়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটছে, তাতে শিক্ষকতার প্রতি আমি আমার বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি। আগামী দশ বছর শিক্ষকতায় আরও থাকব, তেমন আশা রাখতে পারছি না। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কে মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। একজন উপাচার্য যদি হুমকির সম্মুখীন হন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। এসব ঘটনা যদি শক্ত হাতে দমন করা না যায় তাহলে তা বারবার ঘটতে থাকবে। শিক্ষকদের নিয়ে কটূক্তি করা, শিক্ষকদের অসম্মানিত করা, তাদের নিয়ে ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দেওয়া_ সব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে। এসব ঘটনার একটিরও পূর্ণ তদন্ত হয়নি। ফলে ভিসিকে মোবাইলে হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। আমি শিক্ষক হিসেবে দুষ্কৃতকারীদের বিচার দাবি করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্বাভাবিকহারে ব্যয়বৃদ্ধি ঘটেছে। এই ব্যয়বৃদ্ধিকে শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে এক করে মেলানো যাবে না। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন নতুন অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে, যেখানে প্রভাব রয়েছে যোগ্য শিক্ষকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ শুদ্ধ করে কথা বলতে পারেন না। এ কথাটি আজ প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেক শিক্ষকই, বিশেষ করে তরুণ শিক্ষকরা জাতীয় রাজনীতি তথা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যতটুকু সম্পৃক্ত, গবেষণা তথা শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে ততটুকু জড়িত নন। বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা এনে শিক্ষার মানোন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হচ্ছে! কিন্তু আসলে কি মানোন্নয়ন হচ্ছে! তরুণ শিক্ষকদের দরকার প্রশিক্ষণ, যা ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে পারছে না। শিক্ষক নিয়োগের নামে যদি দলীয়-আত্মীয়করণ কিংবা অঞ্চলপ্রীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আমরা খুব অচিরেই একটি মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হবো। মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে। ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয় এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা সারাবিশ্বের অর্থনীতিকে আঘাত হানবে। আমরা এ থেকে বাদ যাব না। তাই সতর্ক হওয়ার সময় এখনই। এখনই পাবলিক সেক্টরে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব ধরনের নিয়োগ নূ্যনতম এক বছর বন্ধ রাখা উচিত। ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়রা যদি এ ব্যাপারে সদয় হন, আমি খুশি হবো।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও কলাম লেখক
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments