মহীয়সী নারী ফজিলাতুন নেছা by বেবী মওদুদ
(শেষাংশ) দীর্ঘ সময় পর ক্যান্টনমেন্টে বন্দী শেখ মুজিবের সঙ্গে ফজিলাতুন নেছাকে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হতো। এ সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছাত্র নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন ফজিলাতুন নেছা। সে এক দুর্বার সময় ছিল তাঁর জীবনে। গল্পের বই পড়তে খুব ভালবাসতেন তিনি।
এ কঠিন সময়েও নিজেই চলে যেতেন পছন্দের বই কিনতে নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে। দুশ্চিন্তা দূর করতে এ সময় গল্পের বই তাঁর একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে।
৫ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত কেঁপে ওঠে। জেনারেল আইয়ুবের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। জেনারেল আইয়ুবের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ শুরু হলো। ছাত্র আন্দোলনের আসাদ ও মতিউর শহীদ হলে এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তখন গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। তখন অনেক নেতা শেখ মুজিবকে এই প্রস্তাব মেনে নিতে আহ্বান জানান।
কিন্তু দৃঢ়তায় অবিচল ফজিলাতুন নেছা রেণু শেখ মুজিবের প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। শেখ মুজিব তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি আইয়ুবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্তি দিলে শেখ মুজিব গোলটেবিলে যোগ দিতে রাজি হন। সারা পাকিস্তানে তখন জেনারেল আইয়ুববিরোধী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব শেখ মুজিবের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দী মুক্তি পান।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্র-জনতা ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে সংবর্ধনা জানিয়ে বাঙালীর একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি হয়ে ওঠে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের নির্ভরযোগ্য দুর্গ। এই বাড়ির কর্ত্রী ফজিলাতুন নেছা স্বামী শেখ মুজিবের প্রতি সতর্ক দৃষ্টিই শুধু রাখতেন না, তাঁর নেতাকর্মী, আত্মীয়স্বজনের প্রতিও সকল দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বুঝতে পারেন, দেশ ও জাতির এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছেন তাঁর স্বামী।
২৪ মার্চ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করে। এরপর এলো সত্তরের নির্বাচন। শেখ মুজিব সত্তরের নির্বাচনে বিশাল জয় অর্জন করে সামনে এগিয়ে চলেছেন। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া এবং রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ জয় কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। শাসক হয়ে বাঙালী তাদের শাসন করবে এটা কোনভাবে মেনে নিতে পারেনি বলেই জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ ১৯৭১ সালে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণেই তিনি ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার’ ডাক দেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁর কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য মুক্তি সংগ্রামের সবুজ সংকেত পেয়ে যায়।
ঐতিহাসিক এ ভাষণের নেপথ্য প্রেরণাদাত্রী হিসেবে ফজিলাতুন নেছা রেণুর একটি অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ঘটনাটি ছিল এ রকমÑএই ভাষণ দিতে যাবার আগে শেখ মুজিব কী বলবেন সে বিষয়ে অনেকে তাঁকে পরামর্শ, উপদেশ, চিরকুট পাঠিয়েছিল। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা রেণু তাঁকে সভায় যাবার আগে ঘরে বিশ্রাম নেবার জন্য কিছুটা সময় একাকী থাকতে দেন। সে সময় তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, তোমার সামনে আছে জনতা এবং পেছনে বুলেট। তোমার মন যা চাইছে তুমি শুধু সেটাই আজ বলবে।’ সেই শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি শেখ মুজিবের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত। শেখ মুজিবের সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার ওপর যথেষ্ট আস্থা তাঁর। শেখ মুজিবের স্ত্রী ও সহযাত্রী হিসেবে বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালীর প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাই ৭ মার্চে শেখ মুজিব কি বলবেন জনতাকে, তা রেণুকেও আলোড়িত করেছিল। এ ঘটনা সে সাক্ষ্যই দেয়।
শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ফজিলাতুন নেছার একটা দৃঢ়চেতা অথচ দরদি মন ছিল এবং ছিল আন্তরিক সহযোগিতা। তিনি তো তাঁকে খুব ভালভাবে চিনতেন। নিজের জীবন উৎসর্গ করেও শেখ মুজিব যে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করবেন এটা তিনি খুব ভাল করে জানতেন। কোন পিছুটান তাঁর রাখতে দেননি। সে সব দেখার দায়িত্ব ছিল রেণুর হাতে। সেখানেই ছিল শেখ মুজিবের শান্তি ও স্বস্তি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পর ঘরে ফিরে তিনি এই শান্তির আশ্রয় পেতেন স্ত্রীর কাছে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনন্দের মাঝে। সন্তানরাও মুজিবের আদর্শের ছিলেন। তারাও আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষর রেখেছেন। শেখ মুজিবকে কোন লোভ ও ভয় দেখিয়ে কাবু করতে পারেনি পাকিস্তানের শাসকবর্গ। তারা দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে পক্ষে আনতে পারলেও মুজিব ছিল তাদের কাছে আতঙ্ক। বাঙালীর অধিকার আদায় ছাড়া শেখ মুজিবের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার কোন আকর্ষণ ছিল না। ফজিলাতুন নেছাও সেই আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। সন্তানদের তৈরি করেন। দেশপ্রেমের আলোকছটায় এ পরিবার ছিল বাঙালীর কাছে আদর্শস্থানীয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের শেষ রাতে আবার পাকিস্তানী সেনারা বত্রিশ নম্বর বাড়িটি আক্রমণ করে এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শেখ মুজিবের অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার ডাক দেন। স্ত্রী-সন্তানদের মৃত্যুর মুখে সঁপে দিয়ে নিজের জীবনের পরোয়া না করে শেখ মুজিব শুধু বাংলার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। এই ত্যাগ ইতিহাসে খুব কম দেখা যায়। শেখ মুজিব দেশপ্রেম ও আদর্শের পরীক্ষায় ছিলেন সবার শীর্ষে। এ ত্যাগের পেছনে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন রেণু। এখানেই ছিল এ আদর্শ দম্পতির একাত্মতা।
স্বামীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার পর ফজিলাতুন নেছা রেণু তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রথমে পাশের বাসায় এবং পরে মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বত্রিশ নম্বর বাড়িটি সৈন্যরা দখল করে রাখে। তারা ঘরের জিনিসপত্র লুটপাটও করে। একইভাবে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার চোখের সামনে আগুন দিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। শ্বশুর-শাশুড়ির দুরবস্থার খবর পেয়ে ফজিলাতুন নেছা ডা. নূরুল ইসলামকে অনুরোধ করে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) রেখে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। মগবাজারের বাড়িটিও একদিন সৈন্যরা ঘেরাও করে তিন ছেলেমেয়েসহ ফজিলাতুন নেছাকে গ্রেফতার করে ধানম-ি আবাসিক এলাকার ১৮নং সড়কের (বর্তমানে ৯/এ সড়ক) একটি একতলা বাড়িতে আটক করে রাখে। শেখ হাসিনা ও তাঁর স্বামী ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়াকেও তাঁদের সঙ্গে আটক করে রাখা হয়। বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই বাড়ি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। আটক অবস্থা থেকে একদিন মেজো ছেলে শেখ জামালও কাউকে না বলে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়।
স্বামী ও ছেলেদের জন্য এ সময় দুশ্চিন্তা করা ছাড়া ফজিলাতুন নেছা রেণুর আর কোন উপায় ছিল না। প্রহরারত সৈন্যদের দুর্ব্যবহার সহ্য করতেন তিনি। শেখ হাসিনার পুত্র সন্তান জন্ম নেবার সময় তাঁদের একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যেতে দেয়নি পাকসেনারা। তাঁকে তারা ধমক দিয়ে বলত, ‘আপনি কি নার্স না ডাক্তার যে সেখানে যাবেন?’ ঘরে বসে শুধু অশ্রু ফেলে তাঁকে সময় কাটাতে হয়েছে। তারপরও তিনি দৃঢ়তায় ছিলেন অটল। তাদের অনুরোধ উপরোধ করেননি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করে। কিন্তু ১৮ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে তখনও কড়া প্রহরায় আটক রেখেছিল পাকবাহিনী। মেজর অশোক তারার নেতৃত্বে ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা ১৭ ডিসেম্বর সকালে তাদের অস্ত্রসমর্পণে বাধ্য করে বাড়ির সবাইকে মুক্ত করে। মুক্তি পেয়েই ফজিলাতুন নেছা বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছিল তাঁর প্রচণ্ড দেশপ্রেমের একটি নজির।
পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালা কারাগারে সামরিক গোপন বিচারে শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড হয়। শাস্তির দণ্ড মাথায় নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন তিনি। এদিকে সারাবিশ্বে তাঁর মুক্তির দাবিতে জনমত গড়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশে বিজয় উৎসবও চলেছে। স্বাধীনতার স্থপতিকে ছাড়া এ উৎসব যেন ম্লান। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় স্থাপিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ ও একই সঙ্গে সাথীহারা বেদনা নিয়ে ঘরে ফিরছে।
শেখ কামাল ও শেখ জামালও মুক্তিযুদ্ধ থেকে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু এই পরিবারে তখনও বেদনা ও দুশ্চিন্তার অশ্রুধারা বয়ে চলেছে। স্বামীর জন্য বুকের মাঝে এক বিরাট পাথর সমান ভার নিয়ে ফজিলাতুন নেছা রেণু পথ চেয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জাতির পিতা হয়ে উঠেছেন। তাঁকে ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব যেন অসম্পূর্ণ। বিদেশীরা এসে ফজিলাতুন নেছা রেণুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। অবশেষে খবর এলো শেখ মুজিব মুক্ত। তাঁকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন পাঠানো হয়েছে। ১০ জানুয়ারি সেখানে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে রাজপরিবারের বিশেষ বিমানে চড়ে দিল্লি হয়ে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামলেন। সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বঙ্গবন্ধু রাজপথের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালবাসায় অভিষিক্ত হয়ে জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে আবার উপস্থিত হলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দীর্ঘদিন পর তাঁর ভাষণ শুনল জনগণ।
বেতারে স্বামীর কণ্ঠ শুনে কাঁদলেন ফজিলাতুন নেছা রেণু। তিনিও যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। স্বামীর সংগ্রামের একান্ত সঙ্গীও ছিলেন তিনি। স্বামীর আদর্শ ও সাহসিকতার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ছিল তাঁর। একজন জাতির জনকের স্ত্রী হিসেবে তাঁরও ছিল আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ। জাতির জনকের ভাষণ শুনে তিনিও স্থির থাকতে পারেননি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্লান্ত-শ্রান্ত-আনন্দবিহ্বল হয়ে ঘরে ফিরেছেন সেদিন। অশ্রু ও বেদনায় সিক্ত হয়ে ফজিলাতুন নেছা স্বামীকে বীরের মর্যাদায় বরণ করে নিলেন। এক গভীর অনুভূতিসম্পন্ন হৃদয় আবেগে ভরপুর মুহূর্ত ছিল সেটি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা মুজিব আপন ঘরে আপনজনদের ভালবাসায় সিক্ত হলেন এবং নতুন করে দেশ ও মানুষের জন্য তাঁর স্বপ্নের কাজ শুরু করলেন।
জাতির জনক হয়ে কি তিনি বিশ্রাম নিতে পারেন? যেখানে দেশ ও জাতির জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দু’লক্ষ মা-বোনের সম্মানহানি হয়েছে, পঙ্গু ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ত্ব, শহীদ পরিবারের কান্না, ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধবিধ্বস্ত পথঘাট, ভাঙা ব্রিজ, বিরান ফসলের মাঠ, আগুন আর লুটতরাজে বিধ্বস্ত গ্রাম-শহর, মাইন পোতা বন্দর। সে এক মহাসঙ্কটের সময় ছিল। পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য আনা, দেশকে গড়ে তোলার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। এ সময়ও নেপথ্যে থেকে সবরকম সহযোগিতা করেন রেণু।
১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন, বিদেশ থেকে স্বীকৃতি ও সাহায্য এলো। তিনি শক্ত হাতে দেশের ভিত গড়ে তুললেন। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, শত্রুরা দেশ-বিদেশে পালিয়ে গিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বামীর গর্বের গর্বিত হন রেণু। আল্লাহ্র দরবারে জানান লাখো শুকরিয়া।
প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও ফজিলাতুন নেছা ফার্স্ট লেডির পদ বা ভূমিকা গ্রহণ করেননি। খুবই সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন তিনি। কখনও কোন লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও বিলাসিতার কথা চিন্তা করেননি। একজন সংস্কারমুক্ত বাঙালী নারী হিসেবে জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত পার করেছেন, টানাপোড়েনকে এড়িয়ে চলেছেন এবং হাসিমুখ আর অসীম ধৈর্য নিয়ে স্বামীর সাথে থেকে জীবনকে জয় করেছেন। ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এলে তিনি বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান।
তিনি সরল-সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই বত্রিশ নম্বর বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কখনও থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামী আসবাবপত্র, এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করেননি। নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনও নিজে নিয়ে যেতেন। স্বামী অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেলে ফজিলাতুন নেছা সঙ্গে যেতেন। কেননা তিনি তাঁর সেবাযতেœর দায়িত্ব নিজের হাতে না করলে শান্তি পেতেন না। একজন আদর্শ বাঙালী নারীর প্রতীক যেন তিনি। তাঁর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই একজন মমতাময়ী মায়ের প্রতিকৃতি। প্রিয় স্বামী-সন্তান স্বজন-পরিবারের বাইরে যে বৃহত্তর সমাজ ও দেশ সেখানেও তাঁর হৃদয় উৎসারিত ছিল।
স্বভাবে শান্তশিষ্ট হলেও অত্যন্ত রসিক ছিলেন রেণু। পারিবারিক ও আত্মীয়-স্বজনের সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ রক্ষা সবই তিনি সুষ্ঠুভাবে করতেন। স্বামী রাজনীতি করতেন, সরকার চালাতেন, দেশ শাসন করতেন, বড় বড় সমস্যা নিয়ে ভাবতেন ও সমাধান করতেন কিন্তু পেছনে থেকে নীরবে নিভৃতে তাঁকে সাহস যোগাতেন রেণু। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, অসুস্থতা, শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসা ও সেবাযতœ সব সামলে একটা পারিবারিক বন্ধন তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। এ বন্ধনকে তিনি শান্তিময় রাখতে চেষ্টা করতেন। বঙ্গবন্ধুকে পারিবারিক ব্যাপারে জড়িয়ে বিচলিত হতে দেননি।
শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের রেণু ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। এসব কাজ তিনি নিজ উদ্যোগে করতেন। কখনও সরকারীভাবে কিছু করতে চাইতেন না। টুঙ্গিপাড়ায় সাহারা খাতুন হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে। নিভৃতচারী, ত্যাগী, সফল এ নারীকে জনগণ বঙ্গমাতা হিসেবে সম্মানিত করেছে।
একজন জাতির জনকের স্ত্রী হিসেবে এখানেই আমরা পাই তাঁর আদর্শ ও যোগ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থ লিখেছেন, ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী, রানীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।’ আমরা রাজনীতিবিদদের নাম শুনি, ছবি দেখি, তাঁদের বক্তৃতা শুনি কিন্তু তাঁদের বড় হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারের আত্মত্যাগ ও সহযোগিতার মূল্যায়ন করি না। যেমনটি হয়েছে বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণুর বেলায়। এই মহীয়সী নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে তিনি একাকার হয়ে ছিলেন। তাঁর প্রতিও ছিল শেখ মুজিবের অগাধ ভালবাসা এবং আস্থা। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন দু’জনের অবলম্বন, আশ্রয়। এখানেই পাওয়া যায় তাঁদের দায়িত্বশীলতা ও ভালবাসার পরিচয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশকে একটা স্থিতিশীল অবস্থানে দাঁড় করান। তিনি দারিদ্র্য দূর করে উন্নত জীবনের লক্ষ্য সামনে রেখে অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিলেন, যার সম্ভাবনা ছিল অপরিসীম। কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বাঙালীর উন্নয়ন চায়নি। বাংলাদেশের শান্তি সমৃদ্ধিও তাদের পছন্দ ছিল না। দরিদ্র এ দেশকে তারা দরিদ্রতম রাখতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের আলো ফোটার আগেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক, স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশী-বিদেশী শত্রুদের সহযোগিতায় একদল বিপথগামী সেনাসদস্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বুলেটবিদ্ধ করে হত্যা করে। বাঙালীর ভালবাসার এই মানুষটিকে রক্তাক্ত করে চিরবিদায় করেছিল তারা, যিনি তাঁর ত্যাগ-সাধনা-সাহস ও আদর্শ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেন, ঘাতকের দল তাঁর ছবি, স্মৃতি ও নামকে পর্যন্ত মুছে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বাঙালীর হৃদয়ে সেই নাম ও প্রিয় মুখ গভীর শ্রদ্ধায় গাঁথা হয়ে আছে। কবির কণ্ঠে আমরা শুনেছিÑ
‘যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী-মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
আমরা আরও বেদনাহত হয়ে দেখি ঘাতকের দল সেদিন নিষ্ঠুর হাতে গুলি করেছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবন সঙ্গী, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও ভালবাসার সাথী ফজিলাতুন নেছা রেণুকে। আদর্শময়ী স্ত্রী, স্নেহময়ী মা আর এক সাহসী দেশপ্রেমিক নারীকে। কি অপরাধ করেছিলেন তিনি? বর্বর ঘাতকরা হত্যা করেছিল তাঁদের তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও দশ বছরের শিশু পুত্র রাসেলকে। কি ছিল তাঁদের অপরাধ? তাঁরা তো রাজনীতি করতেন না। তাহলে কেন এই হিংসার রাজনীতি? এঁদের সঙ্গে সেদিন তারা হত্যা করেছিল শেখ কামাল ও শেখ জামালের নবপরিণীতা স্ত্রীদের, আত্মীয়স্বজনসহ মোট ১৮ জনকে। কেন এই নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়? কেন এই নৃশংসতা, বর্বরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন? ইতিহাস এই অপরাধকে কখনও কমা করবে না।
রেণুর নিজ হাতে গড়া ৩২ নম্বর বাড়ি আজ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। বাড়িটির পরতে পরতে আছে রেণুর হাতের স্পর্শ। স্বাধীনতার অন্যতম প্রেরণাকেন্দ্র এ বাড়ির সর্বত্র রয়েছে রেণুর অসাধারণ সারল্য, একই সঙ্গে একজন রাষ্ট্রনায়কের স্ত্রীর সুদৃঢ় সংগ্রামের ছোঁয়া। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিণী রেণুর ব্যবহৃত আসবাব সামগ্রী, তৈজসপত্র দেখে বোঝা যায় কত সাধারণ ছিল দেশের রাষ্ট্রপতি আর তাঁর পরিবারের জীবনযাত্রা। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও কত সাধারণ জীবনযাপন করতেন এই মমতাময়ী নারী। একটি আদর্শ বাঙালী পরিবার ছিল তাঁদের, যেখানে বাঙলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিরাজমান।
আমাদের আরও বেদনাহত হতে হয় যখন ভাবি সেই শৈশব-কৈশোরের খেলার সঙ্গী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন নেছা রেণু জীবনেও যেমন দু’জনে দু’জনার সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ও সংগ্রামের সাথী ছিলেন, তেমনি মরণেও সঙ্গী হয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন।
ঘাতকের বুলেটে রক্তাক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর ফজিলাতুন নেছা রেণু অমর হয়ে থাকবেন বাংলার মাটিতে, জনগণের হৃদয়ে চিরকাল।
লেখক : সাংবাদিক ও সংসদ সদস্য
৫ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত কেঁপে ওঠে। জেনারেল আইয়ুবের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। জেনারেল আইয়ুবের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ শুরু হলো। ছাত্র আন্দোলনের আসাদ ও মতিউর শহীদ হলে এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তখন গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। তখন অনেক নেতা শেখ মুজিবকে এই প্রস্তাব মেনে নিতে আহ্বান জানান।
কিন্তু দৃঢ়তায় অবিচল ফজিলাতুন নেছা রেণু শেখ মুজিবের প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। শেখ মুজিব তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি আইয়ুবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্তি দিলে শেখ মুজিব গোলটেবিলে যোগ দিতে রাজি হন। সারা পাকিস্তানে তখন জেনারেল আইয়ুববিরোধী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব শেখ মুজিবের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দী মুক্তি পান।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্র-জনতা ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে সংবর্ধনা জানিয়ে বাঙালীর একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি হয়ে ওঠে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের নির্ভরযোগ্য দুর্গ। এই বাড়ির কর্ত্রী ফজিলাতুন নেছা স্বামী শেখ মুজিবের প্রতি সতর্ক দৃষ্টিই শুধু রাখতেন না, তাঁর নেতাকর্মী, আত্মীয়স্বজনের প্রতিও সকল দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বুঝতে পারেন, দেশ ও জাতির এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছেন তাঁর স্বামী।
২৪ মার্চ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করে। এরপর এলো সত্তরের নির্বাচন। শেখ মুজিব সত্তরের নির্বাচনে বিশাল জয় অর্জন করে সামনে এগিয়ে চলেছেন। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া এবং রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ জয় কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। শাসক হয়ে বাঙালী তাদের শাসন করবে এটা কোনভাবে মেনে নিতে পারেনি বলেই জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ ১৯৭১ সালে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণেই তিনি ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার’ ডাক দেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁর কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য মুক্তি সংগ্রামের সবুজ সংকেত পেয়ে যায়।
ঐতিহাসিক এ ভাষণের নেপথ্য প্রেরণাদাত্রী হিসেবে ফজিলাতুন নেছা রেণুর একটি অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ঘটনাটি ছিল এ রকমÑএই ভাষণ দিতে যাবার আগে শেখ মুজিব কী বলবেন সে বিষয়ে অনেকে তাঁকে পরামর্শ, উপদেশ, চিরকুট পাঠিয়েছিল। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা রেণু তাঁকে সভায় যাবার আগে ঘরে বিশ্রাম নেবার জন্য কিছুটা সময় একাকী থাকতে দেন। সে সময় তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, তোমার সামনে আছে জনতা এবং পেছনে বুলেট। তোমার মন যা চাইছে তুমি শুধু সেটাই আজ বলবে।’ সেই শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি শেখ মুজিবের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত। শেখ মুজিবের সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার ওপর যথেষ্ট আস্থা তাঁর। শেখ মুজিবের স্ত্রী ও সহযাত্রী হিসেবে বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালীর প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাই ৭ মার্চে শেখ মুজিব কি বলবেন জনতাকে, তা রেণুকেও আলোড়িত করেছিল। এ ঘটনা সে সাক্ষ্যই দেয়।
শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ফজিলাতুন নেছার একটা দৃঢ়চেতা অথচ দরদি মন ছিল এবং ছিল আন্তরিক সহযোগিতা। তিনি তো তাঁকে খুব ভালভাবে চিনতেন। নিজের জীবন উৎসর্গ করেও শেখ মুজিব যে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করবেন এটা তিনি খুব ভাল করে জানতেন। কোন পিছুটান তাঁর রাখতে দেননি। সে সব দেখার দায়িত্ব ছিল রেণুর হাতে। সেখানেই ছিল শেখ মুজিবের শান্তি ও স্বস্তি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পর ঘরে ফিরে তিনি এই শান্তির আশ্রয় পেতেন স্ত্রীর কাছে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনন্দের মাঝে। সন্তানরাও মুজিবের আদর্শের ছিলেন। তারাও আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষর রেখেছেন। শেখ মুজিবকে কোন লোভ ও ভয় দেখিয়ে কাবু করতে পারেনি পাকিস্তানের শাসকবর্গ। তারা দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে পক্ষে আনতে পারলেও মুজিব ছিল তাদের কাছে আতঙ্ক। বাঙালীর অধিকার আদায় ছাড়া শেখ মুজিবের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার কোন আকর্ষণ ছিল না। ফজিলাতুন নেছাও সেই আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। সন্তানদের তৈরি করেন। দেশপ্রেমের আলোকছটায় এ পরিবার ছিল বাঙালীর কাছে আদর্শস্থানীয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের শেষ রাতে আবার পাকিস্তানী সেনারা বত্রিশ নম্বর বাড়িটি আক্রমণ করে এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শেখ মুজিবের অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার ডাক দেন। স্ত্রী-সন্তানদের মৃত্যুর মুখে সঁপে দিয়ে নিজের জীবনের পরোয়া না করে শেখ মুজিব শুধু বাংলার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। এই ত্যাগ ইতিহাসে খুব কম দেখা যায়। শেখ মুজিব দেশপ্রেম ও আদর্শের পরীক্ষায় ছিলেন সবার শীর্ষে। এ ত্যাগের পেছনে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন রেণু। এখানেই ছিল এ আদর্শ দম্পতির একাত্মতা।
স্বামীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার পর ফজিলাতুন নেছা রেণু তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রথমে পাশের বাসায় এবং পরে মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বত্রিশ নম্বর বাড়িটি সৈন্যরা দখল করে রাখে। তারা ঘরের জিনিসপত্র লুটপাটও করে। একইভাবে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার চোখের সামনে আগুন দিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। শ্বশুর-শাশুড়ির দুরবস্থার খবর পেয়ে ফজিলাতুন নেছা ডা. নূরুল ইসলামকে অনুরোধ করে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) রেখে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। মগবাজারের বাড়িটিও একদিন সৈন্যরা ঘেরাও করে তিন ছেলেমেয়েসহ ফজিলাতুন নেছাকে গ্রেফতার করে ধানম-ি আবাসিক এলাকার ১৮নং সড়কের (বর্তমানে ৯/এ সড়ক) একটি একতলা বাড়িতে আটক করে রাখে। শেখ হাসিনা ও তাঁর স্বামী ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়াকেও তাঁদের সঙ্গে আটক করে রাখা হয়। বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই বাড়ি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। আটক অবস্থা থেকে একদিন মেজো ছেলে শেখ জামালও কাউকে না বলে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়।
স্বামী ও ছেলেদের জন্য এ সময় দুশ্চিন্তা করা ছাড়া ফজিলাতুন নেছা রেণুর আর কোন উপায় ছিল না। প্রহরারত সৈন্যদের দুর্ব্যবহার সহ্য করতেন তিনি। শেখ হাসিনার পুত্র সন্তান জন্ম নেবার সময় তাঁদের একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যেতে দেয়নি পাকসেনারা। তাঁকে তারা ধমক দিয়ে বলত, ‘আপনি কি নার্স না ডাক্তার যে সেখানে যাবেন?’ ঘরে বসে শুধু অশ্রু ফেলে তাঁকে সময় কাটাতে হয়েছে। তারপরও তিনি দৃঢ়তায় ছিলেন অটল। তাদের অনুরোধ উপরোধ করেননি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করে। কিন্তু ১৮ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে তখনও কড়া প্রহরায় আটক রেখেছিল পাকবাহিনী। মেজর অশোক তারার নেতৃত্বে ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা ১৭ ডিসেম্বর সকালে তাদের অস্ত্রসমর্পণে বাধ্য করে বাড়ির সবাইকে মুক্ত করে। মুক্তি পেয়েই ফজিলাতুন নেছা বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছিল তাঁর প্রচণ্ড দেশপ্রেমের একটি নজির।
পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালা কারাগারে সামরিক গোপন বিচারে শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড হয়। শাস্তির দণ্ড মাথায় নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন তিনি। এদিকে সারাবিশ্বে তাঁর মুক্তির দাবিতে জনমত গড়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশে বিজয় উৎসবও চলেছে। স্বাধীনতার স্থপতিকে ছাড়া এ উৎসব যেন ম্লান। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় স্থাপিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ ও একই সঙ্গে সাথীহারা বেদনা নিয়ে ঘরে ফিরছে।
শেখ কামাল ও শেখ জামালও মুক্তিযুদ্ধ থেকে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু এই পরিবারে তখনও বেদনা ও দুশ্চিন্তার অশ্রুধারা বয়ে চলেছে। স্বামীর জন্য বুকের মাঝে এক বিরাট পাথর সমান ভার নিয়ে ফজিলাতুন নেছা রেণু পথ চেয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জাতির পিতা হয়ে উঠেছেন। তাঁকে ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব যেন অসম্পূর্ণ। বিদেশীরা এসে ফজিলাতুন নেছা রেণুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। অবশেষে খবর এলো শেখ মুজিব মুক্ত। তাঁকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন পাঠানো হয়েছে। ১০ জানুয়ারি সেখানে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে রাজপরিবারের বিশেষ বিমানে চড়ে দিল্লি হয়ে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামলেন। সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বঙ্গবন্ধু রাজপথের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালবাসায় অভিষিক্ত হয়ে জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে আবার উপস্থিত হলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দীর্ঘদিন পর তাঁর ভাষণ শুনল জনগণ।
বেতারে স্বামীর কণ্ঠ শুনে কাঁদলেন ফজিলাতুন নেছা রেণু। তিনিও যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। স্বামীর সংগ্রামের একান্ত সঙ্গীও ছিলেন তিনি। স্বামীর আদর্শ ও সাহসিকতার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ছিল তাঁর। একজন জাতির জনকের স্ত্রী হিসেবে তাঁরও ছিল আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ। জাতির জনকের ভাষণ শুনে তিনিও স্থির থাকতে পারেননি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্লান্ত-শ্রান্ত-আনন্দবিহ্বল হয়ে ঘরে ফিরেছেন সেদিন। অশ্রু ও বেদনায় সিক্ত হয়ে ফজিলাতুন নেছা স্বামীকে বীরের মর্যাদায় বরণ করে নিলেন। এক গভীর অনুভূতিসম্পন্ন হৃদয় আবেগে ভরপুর মুহূর্ত ছিল সেটি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা মুজিব আপন ঘরে আপনজনদের ভালবাসায় সিক্ত হলেন এবং নতুন করে দেশ ও মানুষের জন্য তাঁর স্বপ্নের কাজ শুরু করলেন।
জাতির জনক হয়ে কি তিনি বিশ্রাম নিতে পারেন? যেখানে দেশ ও জাতির জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দু’লক্ষ মা-বোনের সম্মানহানি হয়েছে, পঙ্গু ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ত্ব, শহীদ পরিবারের কান্না, ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধবিধ্বস্ত পথঘাট, ভাঙা ব্রিজ, বিরান ফসলের মাঠ, আগুন আর লুটতরাজে বিধ্বস্ত গ্রাম-শহর, মাইন পোতা বন্দর। সে এক মহাসঙ্কটের সময় ছিল। পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য আনা, দেশকে গড়ে তোলার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। এ সময়ও নেপথ্যে থেকে সবরকম সহযোগিতা করেন রেণু।
১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন, বিদেশ থেকে স্বীকৃতি ও সাহায্য এলো। তিনি শক্ত হাতে দেশের ভিত গড়ে তুললেন। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, শত্রুরা দেশ-বিদেশে পালিয়ে গিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বামীর গর্বের গর্বিত হন রেণু। আল্লাহ্র দরবারে জানান লাখো শুকরিয়া।
প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও ফজিলাতুন নেছা ফার্স্ট লেডির পদ বা ভূমিকা গ্রহণ করেননি। খুবই সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন তিনি। কখনও কোন লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও বিলাসিতার কথা চিন্তা করেননি। একজন সংস্কারমুক্ত বাঙালী নারী হিসেবে জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত পার করেছেন, টানাপোড়েনকে এড়িয়ে চলেছেন এবং হাসিমুখ আর অসীম ধৈর্য নিয়ে স্বামীর সাথে থেকে জীবনকে জয় করেছেন। ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এলে তিনি বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান।
তিনি সরল-সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই বত্রিশ নম্বর বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কখনও থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামী আসবাবপত্র, এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করেননি। নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনও নিজে নিয়ে যেতেন। স্বামী অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেলে ফজিলাতুন নেছা সঙ্গে যেতেন। কেননা তিনি তাঁর সেবাযতেœর দায়িত্ব নিজের হাতে না করলে শান্তি পেতেন না। একজন আদর্শ বাঙালী নারীর প্রতীক যেন তিনি। তাঁর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই একজন মমতাময়ী মায়ের প্রতিকৃতি। প্রিয় স্বামী-সন্তান স্বজন-পরিবারের বাইরে যে বৃহত্তর সমাজ ও দেশ সেখানেও তাঁর হৃদয় উৎসারিত ছিল।
স্বভাবে শান্তশিষ্ট হলেও অত্যন্ত রসিক ছিলেন রেণু। পারিবারিক ও আত্মীয়-স্বজনের সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ রক্ষা সবই তিনি সুষ্ঠুভাবে করতেন। স্বামী রাজনীতি করতেন, সরকার চালাতেন, দেশ শাসন করতেন, বড় বড় সমস্যা নিয়ে ভাবতেন ও সমাধান করতেন কিন্তু পেছনে থেকে নীরবে নিভৃতে তাঁকে সাহস যোগাতেন রেণু। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, অসুস্থতা, শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসা ও সেবাযতœ সব সামলে একটা পারিবারিক বন্ধন তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। এ বন্ধনকে তিনি শান্তিময় রাখতে চেষ্টা করতেন। বঙ্গবন্ধুকে পারিবারিক ব্যাপারে জড়িয়ে বিচলিত হতে দেননি।
শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের রেণু ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। এসব কাজ তিনি নিজ উদ্যোগে করতেন। কখনও সরকারীভাবে কিছু করতে চাইতেন না। টুঙ্গিপাড়ায় সাহারা খাতুন হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে। নিভৃতচারী, ত্যাগী, সফল এ নারীকে জনগণ বঙ্গমাতা হিসেবে সম্মানিত করেছে।
একজন জাতির জনকের স্ত্রী হিসেবে এখানেই আমরা পাই তাঁর আদর্শ ও যোগ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থ লিখেছেন, ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী, রানীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।’ আমরা রাজনীতিবিদদের নাম শুনি, ছবি দেখি, তাঁদের বক্তৃতা শুনি কিন্তু তাঁদের বড় হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারের আত্মত্যাগ ও সহযোগিতার মূল্যায়ন করি না। যেমনটি হয়েছে বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণুর বেলায়। এই মহীয়সী নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে তিনি একাকার হয়ে ছিলেন। তাঁর প্রতিও ছিল শেখ মুজিবের অগাধ ভালবাসা এবং আস্থা। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন দু’জনের অবলম্বন, আশ্রয়। এখানেই পাওয়া যায় তাঁদের দায়িত্বশীলতা ও ভালবাসার পরিচয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশকে একটা স্থিতিশীল অবস্থানে দাঁড় করান। তিনি দারিদ্র্য দূর করে উন্নত জীবনের লক্ষ্য সামনে রেখে অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিলেন, যার সম্ভাবনা ছিল অপরিসীম। কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বাঙালীর উন্নয়ন চায়নি। বাংলাদেশের শান্তি সমৃদ্ধিও তাদের পছন্দ ছিল না। দরিদ্র এ দেশকে তারা দরিদ্রতম রাখতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের আলো ফোটার আগেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক, স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশী-বিদেশী শত্রুদের সহযোগিতায় একদল বিপথগামী সেনাসদস্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বুলেটবিদ্ধ করে হত্যা করে। বাঙালীর ভালবাসার এই মানুষটিকে রক্তাক্ত করে চিরবিদায় করেছিল তারা, যিনি তাঁর ত্যাগ-সাধনা-সাহস ও আদর্শ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেন, ঘাতকের দল তাঁর ছবি, স্মৃতি ও নামকে পর্যন্ত মুছে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বাঙালীর হৃদয়ে সেই নাম ও প্রিয় মুখ গভীর শ্রদ্ধায় গাঁথা হয়ে আছে। কবির কণ্ঠে আমরা শুনেছিÑ
‘যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী-মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
আমরা আরও বেদনাহত হয়ে দেখি ঘাতকের দল সেদিন নিষ্ঠুর হাতে গুলি করেছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবন সঙ্গী, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও ভালবাসার সাথী ফজিলাতুন নেছা রেণুকে। আদর্শময়ী স্ত্রী, স্নেহময়ী মা আর এক সাহসী দেশপ্রেমিক নারীকে। কি অপরাধ করেছিলেন তিনি? বর্বর ঘাতকরা হত্যা করেছিল তাঁদের তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও দশ বছরের শিশু পুত্র রাসেলকে। কি ছিল তাঁদের অপরাধ? তাঁরা তো রাজনীতি করতেন না। তাহলে কেন এই হিংসার রাজনীতি? এঁদের সঙ্গে সেদিন তারা হত্যা করেছিল শেখ কামাল ও শেখ জামালের নবপরিণীতা স্ত্রীদের, আত্মীয়স্বজনসহ মোট ১৮ জনকে। কেন এই নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়? কেন এই নৃশংসতা, বর্বরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন? ইতিহাস এই অপরাধকে কখনও কমা করবে না।
রেণুর নিজ হাতে গড়া ৩২ নম্বর বাড়ি আজ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। বাড়িটির পরতে পরতে আছে রেণুর হাতের স্পর্শ। স্বাধীনতার অন্যতম প্রেরণাকেন্দ্র এ বাড়ির সর্বত্র রয়েছে রেণুর অসাধারণ সারল্য, একই সঙ্গে একজন রাষ্ট্রনায়কের স্ত্রীর সুদৃঢ় সংগ্রামের ছোঁয়া। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিণী রেণুর ব্যবহৃত আসবাব সামগ্রী, তৈজসপত্র দেখে বোঝা যায় কত সাধারণ ছিল দেশের রাষ্ট্রপতি আর তাঁর পরিবারের জীবনযাত্রা। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও কত সাধারণ জীবনযাপন করতেন এই মমতাময়ী নারী। একটি আদর্শ বাঙালী পরিবার ছিল তাঁদের, যেখানে বাঙলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিরাজমান।
আমাদের আরও বেদনাহত হতে হয় যখন ভাবি সেই শৈশব-কৈশোরের খেলার সঙ্গী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন নেছা রেণু জীবনেও যেমন দু’জনে দু’জনার সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ও সংগ্রামের সাথী ছিলেন, তেমনি মরণেও সঙ্গী হয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন।
ঘাতকের বুলেটে রক্তাক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর ফজিলাতুন নেছা রেণু অমর হয়ে থাকবেন বাংলার মাটিতে, জনগণের হৃদয়ে চিরকাল।
লেখক : সাংবাদিক ও সংসদ সদস্য
No comments