লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথা আমরা সবাই জানি। জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের কথা কি আমরা জানি? by জুয়েল আইচ
পিরোজপুর তখন মহকুমা শহর। সালটা
১৯৭০। মহকুমা শহরে তখন আমরা সাধারণ পুলিশদেরই ভয় পেতাম। আর মহকুমাপ্রধান,
মানে এসডিপিওর সামনে পড়লে তো পিলে কেঁপে উঠত। আমাদের এসডিপিও সাহেবের
দু-তিনটি অতিশয় সুন্দরী তরুণী কন্যা ছিল। অতএব তাঁর বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে
এমন তরুণ কি কেউ ছিল?
এসডিপিও
সাহেবের বাড়ির উল্টো দিকে রাস্তার অপর পারে আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি। সেই
বাড়িতে অনেক দিন যাবৎ আমরা তিন-চারজন বন্ধু মিলে বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়াম
এবং গান অনুশীলন করতাম।
একদিন বিকেলে অনুশীলন শেষে সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি। উদ্দেশ্য বলেশ্বর নদের পারে হাঁটতে যাব। হঠাৎ একজন তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে এসডিপিওর বাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইল।
অন্যরা ঘাবড়ে গেলাম। ওরে বাবা কী সাহস! এসডিপিওর মেয়েদের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকা! আমাদের বন্ধুটি ইশারায় সবাইকে তার কাছে ডাকল। আমরা ভয়ে ভয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। ঘাড় লম্বা করে তাকিয়ে দেখি সেখানে কোনো মেয়েই নেই। ফরসা একটি নিরীহ ধরনের ছেলে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। জানলাম, তার নাম হুমায়ূন আহমেদ।
আমাদের বন্ধু মহাদেব সাহা—যার বাড়ির সামনে আমরা দাঁড়িয়ে—বলল, এসডিপিও সাহেবের বড় ছেলে।
মনজু সরদার বলল, তুখোড় ছাত্র। বোর্ডে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। এবার বুঝলাম ওদের কৌতূহলের কারণ কী।
আমি তখন ঢাকায় পড়াশোনা করি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কে কোথায় ছিটকে পড়ি। যুদ্ধের শুরুতেই এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন। বুকের মধ্যে কষ্টটা বড় কঠিন হয়ে বাজে। ভয়টা ভালোবাসা হয়ে যায়। সামনে যে কত-শত যন্ত্রণার ফাঁদ পাতা ছিল তা জানতে যুদ্ধের বাকি মাসগুলো প্রাণ বাজি রেখে এগোতে হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে ঘর ছিল না, কাপড় ছিল না, ছিল শুধু আশা। বাঁশি এবং ম্যাজিক ধরলাম শক্ত করে। খ্যাতি বরিশাল পর্যন্ত ছড়াল। বরিশালের এটি মেয়ে একখানা বই উপহার দিল। নাম, তোমাদের জন্য ভালোবাসা। প্রেমের উপন্যাস ভেবে পড়তে গিয়ে দেখি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। অবিশ্বাস্য সুন্দর বইখানার লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বইয়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এই প্রতিভাধর লেখকের আরও দুই খানা বই দোকানে পাওয়া যায়। কিনে ফেললাম। এবং প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম, নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগার।
আমার কাছে মনে হলো এই হলো আসল ম্যাজিক। তা না হলে ছাত্র বয়সে এই রকম উপন্যাস লেখা কী করে সম্ভব!
আমার এক ম্যাজিশিয়ান বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ত। নাম এম এ রহিম। বয়সে আমার চেয়ে কিছু বেশি হলেও ঘনিষ্ঠতা সেই পার্থক্য একদমই ঘুচিয়ে দিয়েছিল। সে একদিন কথায় কথায় বলল, ‘পাকিস্তানের শেষ দিকগুলোতে আমি এবং হুমায়ূন আহমেদ টিভিতে ম্যাজিক করতাম। ছাত্র অবস্থায় এতে আমাদের যথেষ্ট খ্যাতি এবং কিছু আয়ও হতো।’
আমি জানতে চাই, ‘এ কোন হুমায়ূন আহমেদ?’
‘ওই যে নন্দিত নরক-এর লেখক।’ আমার বিস্ময়ের অবধি রইল না। টেলিভিশনের জাদুকর, গল্পের জাদুসম্রাট!
‘তুমি কি জানো ওনার আব্বা পিরোজপুরের এসডিপিও ছিলেন এবং ওখানেই মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে বলেশ্বর নদীতে ভাসিয়ে দেয়?’
‘আরে জানব না কেন? আমার বাড়ি নেত্রকোনা ওর বাড়িও নেত্রকোনা। আমরা একই সঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়েছি। একসঙ্গে ম্যাজিক করেছি।’ এর পরে যথাসময়ে ডাক্তার হয়ে রহিম আবুধাবী চলে যায়। চাকরির মেয়াদ শেষে এখন সে ঢাকায়। ম্যাজিকের নেশাটা এখন আরও বহু গুণে বেড়েছে। যেমন বেড়েছিল হুমায়ূন ভাইয়ের, পৃথিবীর যে শহরেই যেতেন, ম্যাজিকের সরঞ্জাম অবশ্যই নিয়ে আসতেন। বাদকের মতো তা সাধনা করতেন, অবশেষে বন্ধুদের দেখিয়ে তিনি অবাক করতেন। আহা রে, হুমায়ূন ভাই সম্পর্কে করতেন, বলতেন ইত্যাদি ‘অতীত কালে’ লিখতে ভারি কান্না পাচ্ছে।
কতবার কেঁদেছি তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়ে। সিনেমা হলে গিয়ে তো ধারায় কেঁদেছি। লজ্জা পেয়েছি পাছে কেউ দেখে ফেলে। কিন্তু আজকের এ কান্না ঢাকি কী করে?
এ রকম প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা সৃষ্টিশীল একজন মানুষকে আরও কিছুদিন বাঁচতে দিলে সৃষ্টিকর্তার এমন কী ক্ষতি হতো!
মনে পড়ে তাঁর ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি সারা দেশের টিভি দর্শকদের বিমোহিত করে ফেলেছে। যেদিন এইসব দিনরাত্রি প্রচারিত হওয়ার কথা থাকত, অবাক হয়ে দেখেছি, অনেক আগে থেকে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসত। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। যেন নাটক নয়, কিছু পরে কারফিউ শুরু হবে। এ কী ভাবা যায়!
এমনকি আমরা পর্যন্ত অডিটরিয়ামের গ্রিনরুমে টিভি সেট করে নিতাম। নাটক দেখে মেকআপে যেতাম। শোর সময়ও সেই হিসাব মাথায় রেখে করা হতো। কারণ, হুমায়ূন ভাইয়ের ওই নাটক মিস করে দর্শকেরা হলো পূর্ণ করে ম্যাজিক দেখবেন এমন দুরাশা কখনোই করতাম না।
এইসব দিনরাত্রি নাটকে একজন তরুণ ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র ছিল। ভারি মিষ্টি স্বভাবের এই তরুণ খুব গরিব। এক বড়লোকের বাড়ির চিলেকোঠায় থেকে লেখাপড়া করে। তার প্রেমে পড়ে গেল বাড়ির আদুরে মেয়েটি। এ রকম যখন গল্প এগোচ্ছে, তখন একদিন মুস্তাফিজ ভাইয়ের (মুস্তাফিজুর রহমান) কাছ থেকে ফোন এল।
‘জুয়েল, টিভি স্টেশনে একটু আসতে পারবেন?
‘অবশ্যই। কখন আসতে হবে?’
‘এখনই পারলে ভালো হয়।’
‘আসছি।’
মুস্তাফিজ ভাইয়ের রুমে গিয়ে দেখি প্রায় সবাই এইসব দিনরাত্রির কুশীলব। অধিকাংশই পূর্বচেনা। মুস্তাফিজ ভাই শুরুতেই পরিচয় করাতে গিয়ে বললেন,
‘ইনি হুমায়ূন আহমেদ।’
‘আমি আপনার বিরাট ফ্যান।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
হুমায়ূন ভাই হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, ‘কে কার ফ্যান?’
স্নেহার্দ্র কণ্ঠে মুস্তাফিজ ভাই বললেন, ‘এইসব দিনরাত্রিতে জুয়েল আইচ নামে একজন ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র আছে। যিনি গরিব তরুণ ম্যাজিশিয়ানকে টেলিভিশন দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে দেবেন। এই পার্টটুকু যে আপনাকে করে দিতে হবে।’
‘আবশ্যই করে দেব। আনন্দের সঙ্গে করে দেব।’
নাটকের শিল্পীরা বোধহয় বেশি মুখচোরা হন না। কে একজন মুখ ফুটে বলেই ফেললেন, ‘জুয়েলকে এত কাছে পেয়েছি, ম্যাজিক না দেখে ছাড়ি কী করে?’
তাকিয়ে দেখি হুমায়ূন ভাইয়েরও সে কথায় সায় রয়েছে। আমি দর্শকের কাছ থেকে একটা কয়েন চেয়ে নিলাম। এবার পয়সাটার ধারালো একটা পাশ অতি ধীরে ধীরে বাম বাহুর মধ্যে ঢুকে গেল। প্রায় সবাই হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনুভব করল শক্ত কয়েনটি তখনো চামড়ার নিচে। মাংসের মধ্যে অনুভব করা যাচ্ছে। হুমায়ূন ভাই কিন্তু শক্ত হয়ে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এই দৃষ্টি আমার চেনা। কোনো আত্মবিশ্বাসী বড় ম্যাজিশিয়ান যখন অন্য কারও ম্যাজিক দেখে মোহিত হন, এ হলো সেই দৃষ্টি।
এর পরে ডান বাহু থেকে ধীরে ধীরে কয়েনটি বেরিয়ে আসার পালা। হুমায়ূন ভাইয়ের দৃষ্টি এবার আরও তীক্ষ্ন।
ওই যে আমাদের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হলো তা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হলো। সেই যে ১৯ জুলাই চলে গেলেন, আমাদের সম্পর্ক তো একটুও ফিকে হচ্ছে না। আমি জানি, যত দিন বেঁচে থাকব তাঁর ভালোবাসার স্মৃতিতে সিক্ত হয়েই থাকব।
হুমায়ূন ভাই কখনোই আদেখিলার মতো ম্যাজিক শিখতে চাইতেন না। আমার বুঝে নিতে হতো। বাহুর মধ্যে কয়েন ঢুকিয়ে দেওয়ার ম্যাজিকটি তিনি যে কখনোই রহস্য ভেদ করতে পারেননি, তা বুঝে আমি তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম প্রথম দেখানোর অন্তত ৩০ বছর পরে। তাঁর হাতের তালুতে কয়েন লুকিয়ে রাখার (পামিং) দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ক্লোজআপ ম্যাজিকের তাঁর ছিল রাজার ভান্ডার। আসলে তাঁর হূদয়টাই ছিল রাজার। মনে আছে, তিনি তখনো অতি কষ্টে টেনেটুনে সংসার চালান। তখন নিউমার্কেটের পিছনের দিকে পুরানা পল্টন লাইনে থাকতেন। সরু রাস্তার পাশে ছোট্ট বাড়ি। আমি আর বিপাশা শুধুই আড্ডা দিতে যেতাম। অথবা স্টেজ ম্যাজিকে কীভাবে কথা বললে ভালো লাগবে এসব নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করতাম। বেরিয়ে আসার সময় লজ্জায় পড়ে যেতাম। রাতের খাবার না খেয়ে কোনো দিন আসতে পারিনি।
একে একে তাঁর পরিবারের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ভাব হলো। খালাম্মা আমাকে এতটাই ভালোবাসলেন, যার যোগ্য বলে আমি নিজেকে মনে করি না।
কিছুদিন পরে আমরা দুই পরিবার কাকতালীয়ভাবে ধানমন্ডি ১০/এ সড়কে একদম পাশাপাশি বাড়িতে বাস করতে লাগলাম।
একদিন হঠাৎ দেখি কারা যেন ছয়খানা তাজা লাউ, অনেক অনেক সবজি, শাক, বিশাল পাত্র ভরা দুধ...আরও কত কী রেখে গেছে। ব্যাপার কী? চিঠি পড়ে দেখি হুমায়ূন ভাইয়ের কাজ। নুহাশপল্লীতে ফলেছে।
যত রকমভাবে সম্ভব মানুষকে অবাক করে দিয়ে আনন্দ পেতেন হুমায়ূন ভাই। প্রতি ঈদে পাঞ্জাবি বা শার্টের প্যাকেট পাঠাতেন। সঙ্গে থাকত অপূর্ব সুন্দর একখানা করে চিঠি। গত ঈদে একটা লাল স্ট্রাইপ শার্টের সঙ্গে যে চিঠিখানা পাঠিয়েছিলেন তাতে তিনি লিখেছিলেন, একই রকম আরও একটা শার্ট তিনি নিজের জন্যও কিনে রেখেছেন। একদিন আমরা দুজন একই রকম কাপড় পরব। সেই শার্ট আর একসঙ্গে পরা হলো না।
একদিন বিকেলে অনুশীলন শেষে সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি। উদ্দেশ্য বলেশ্বর নদের পারে হাঁটতে যাব। হঠাৎ একজন তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে এসডিপিওর বাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইল।
অন্যরা ঘাবড়ে গেলাম। ওরে বাবা কী সাহস! এসডিপিওর মেয়েদের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকা! আমাদের বন্ধুটি ইশারায় সবাইকে তার কাছে ডাকল। আমরা ভয়ে ভয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। ঘাড় লম্বা করে তাকিয়ে দেখি সেখানে কোনো মেয়েই নেই। ফরসা একটি নিরীহ ধরনের ছেলে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। জানলাম, তার নাম হুমায়ূন আহমেদ।
আমাদের বন্ধু মহাদেব সাহা—যার বাড়ির সামনে আমরা দাঁড়িয়ে—বলল, এসডিপিও সাহেবের বড় ছেলে।
মনজু সরদার বলল, তুখোড় ছাত্র। বোর্ডে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। এবার বুঝলাম ওদের কৌতূহলের কারণ কী।
আমি তখন ঢাকায় পড়াশোনা করি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কে কোথায় ছিটকে পড়ি। যুদ্ধের শুরুতেই এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন। বুকের মধ্যে কষ্টটা বড় কঠিন হয়ে বাজে। ভয়টা ভালোবাসা হয়ে যায়। সামনে যে কত-শত যন্ত্রণার ফাঁদ পাতা ছিল তা জানতে যুদ্ধের বাকি মাসগুলো প্রাণ বাজি রেখে এগোতে হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে ঘর ছিল না, কাপড় ছিল না, ছিল শুধু আশা। বাঁশি এবং ম্যাজিক ধরলাম শক্ত করে। খ্যাতি বরিশাল পর্যন্ত ছড়াল। বরিশালের এটি মেয়ে একখানা বই উপহার দিল। নাম, তোমাদের জন্য ভালোবাসা। প্রেমের উপন্যাস ভেবে পড়তে গিয়ে দেখি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। অবিশ্বাস্য সুন্দর বইখানার লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বইয়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এই প্রতিভাধর লেখকের আরও দুই খানা বই দোকানে পাওয়া যায়। কিনে ফেললাম। এবং প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম, নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগার।
আমার কাছে মনে হলো এই হলো আসল ম্যাজিক। তা না হলে ছাত্র বয়সে এই রকম উপন্যাস লেখা কী করে সম্ভব!
আমার এক ম্যাজিশিয়ান বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ত। নাম এম এ রহিম। বয়সে আমার চেয়ে কিছু বেশি হলেও ঘনিষ্ঠতা সেই পার্থক্য একদমই ঘুচিয়ে দিয়েছিল। সে একদিন কথায় কথায় বলল, ‘পাকিস্তানের শেষ দিকগুলোতে আমি এবং হুমায়ূন আহমেদ টিভিতে ম্যাজিক করতাম। ছাত্র অবস্থায় এতে আমাদের যথেষ্ট খ্যাতি এবং কিছু আয়ও হতো।’
আমি জানতে চাই, ‘এ কোন হুমায়ূন আহমেদ?’
‘ওই যে নন্দিত নরক-এর লেখক।’ আমার বিস্ময়ের অবধি রইল না। টেলিভিশনের জাদুকর, গল্পের জাদুসম্রাট!
‘তুমি কি জানো ওনার আব্বা পিরোজপুরের এসডিপিও ছিলেন এবং ওখানেই মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে বলেশ্বর নদীতে ভাসিয়ে দেয়?’
‘আরে জানব না কেন? আমার বাড়ি নেত্রকোনা ওর বাড়িও নেত্রকোনা। আমরা একই সঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়েছি। একসঙ্গে ম্যাজিক করেছি।’ এর পরে যথাসময়ে ডাক্তার হয়ে রহিম আবুধাবী চলে যায়। চাকরির মেয়াদ শেষে এখন সে ঢাকায়। ম্যাজিকের নেশাটা এখন আরও বহু গুণে বেড়েছে। যেমন বেড়েছিল হুমায়ূন ভাইয়ের, পৃথিবীর যে শহরেই যেতেন, ম্যাজিকের সরঞ্জাম অবশ্যই নিয়ে আসতেন। বাদকের মতো তা সাধনা করতেন, অবশেষে বন্ধুদের দেখিয়ে তিনি অবাক করতেন। আহা রে, হুমায়ূন ভাই সম্পর্কে করতেন, বলতেন ইত্যাদি ‘অতীত কালে’ লিখতে ভারি কান্না পাচ্ছে।
কতবার কেঁদেছি তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়ে। সিনেমা হলে গিয়ে তো ধারায় কেঁদেছি। লজ্জা পেয়েছি পাছে কেউ দেখে ফেলে। কিন্তু আজকের এ কান্না ঢাকি কী করে?
এ রকম প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা সৃষ্টিশীল একজন মানুষকে আরও কিছুদিন বাঁচতে দিলে সৃষ্টিকর্তার এমন কী ক্ষতি হতো!
মনে পড়ে তাঁর ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি সারা দেশের টিভি দর্শকদের বিমোহিত করে ফেলেছে। যেদিন এইসব দিনরাত্রি প্রচারিত হওয়ার কথা থাকত, অবাক হয়ে দেখেছি, অনেক আগে থেকে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসত। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। যেন নাটক নয়, কিছু পরে কারফিউ শুরু হবে। এ কী ভাবা যায়!
এমনকি আমরা পর্যন্ত অডিটরিয়ামের গ্রিনরুমে টিভি সেট করে নিতাম। নাটক দেখে মেকআপে যেতাম। শোর সময়ও সেই হিসাব মাথায় রেখে করা হতো। কারণ, হুমায়ূন ভাইয়ের ওই নাটক মিস করে দর্শকেরা হলো পূর্ণ করে ম্যাজিক দেখবেন এমন দুরাশা কখনোই করতাম না।
এইসব দিনরাত্রি নাটকে একজন তরুণ ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র ছিল। ভারি মিষ্টি স্বভাবের এই তরুণ খুব গরিব। এক বড়লোকের বাড়ির চিলেকোঠায় থেকে লেখাপড়া করে। তার প্রেমে পড়ে গেল বাড়ির আদুরে মেয়েটি। এ রকম যখন গল্প এগোচ্ছে, তখন একদিন মুস্তাফিজ ভাইয়ের (মুস্তাফিজুর রহমান) কাছ থেকে ফোন এল।
‘জুয়েল, টিভি স্টেশনে একটু আসতে পারবেন?
‘অবশ্যই। কখন আসতে হবে?’
‘এখনই পারলে ভালো হয়।’
‘আসছি।’
মুস্তাফিজ ভাইয়ের রুমে গিয়ে দেখি প্রায় সবাই এইসব দিনরাত্রির কুশীলব। অধিকাংশই পূর্বচেনা। মুস্তাফিজ ভাই শুরুতেই পরিচয় করাতে গিয়ে বললেন,
‘ইনি হুমায়ূন আহমেদ।’
‘আমি আপনার বিরাট ফ্যান।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
হুমায়ূন ভাই হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, ‘কে কার ফ্যান?’
স্নেহার্দ্র কণ্ঠে মুস্তাফিজ ভাই বললেন, ‘এইসব দিনরাত্রিতে জুয়েল আইচ নামে একজন ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র আছে। যিনি গরিব তরুণ ম্যাজিশিয়ানকে টেলিভিশন দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে দেবেন। এই পার্টটুকু যে আপনাকে করে দিতে হবে।’
‘আবশ্যই করে দেব। আনন্দের সঙ্গে করে দেব।’
নাটকের শিল্পীরা বোধহয় বেশি মুখচোরা হন না। কে একজন মুখ ফুটে বলেই ফেললেন, ‘জুয়েলকে এত কাছে পেয়েছি, ম্যাজিক না দেখে ছাড়ি কী করে?’
তাকিয়ে দেখি হুমায়ূন ভাইয়েরও সে কথায় সায় রয়েছে। আমি দর্শকের কাছ থেকে একটা কয়েন চেয়ে নিলাম। এবার পয়সাটার ধারালো একটা পাশ অতি ধীরে ধীরে বাম বাহুর মধ্যে ঢুকে গেল। প্রায় সবাই হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনুভব করল শক্ত কয়েনটি তখনো চামড়ার নিচে। মাংসের মধ্যে অনুভব করা যাচ্ছে। হুমায়ূন ভাই কিন্তু শক্ত হয়ে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এই দৃষ্টি আমার চেনা। কোনো আত্মবিশ্বাসী বড় ম্যাজিশিয়ান যখন অন্য কারও ম্যাজিক দেখে মোহিত হন, এ হলো সেই দৃষ্টি।
এর পরে ডান বাহু থেকে ধীরে ধীরে কয়েনটি বেরিয়ে আসার পালা। হুমায়ূন ভাইয়ের দৃষ্টি এবার আরও তীক্ষ্ন।
ওই যে আমাদের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হলো তা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হলো। সেই যে ১৯ জুলাই চলে গেলেন, আমাদের সম্পর্ক তো একটুও ফিকে হচ্ছে না। আমি জানি, যত দিন বেঁচে থাকব তাঁর ভালোবাসার স্মৃতিতে সিক্ত হয়েই থাকব।
হুমায়ূন ভাই কখনোই আদেখিলার মতো ম্যাজিক শিখতে চাইতেন না। আমার বুঝে নিতে হতো। বাহুর মধ্যে কয়েন ঢুকিয়ে দেওয়ার ম্যাজিকটি তিনি যে কখনোই রহস্য ভেদ করতে পারেননি, তা বুঝে আমি তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম প্রথম দেখানোর অন্তত ৩০ বছর পরে। তাঁর হাতের তালুতে কয়েন লুকিয়ে রাখার (পামিং) দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ক্লোজআপ ম্যাজিকের তাঁর ছিল রাজার ভান্ডার। আসলে তাঁর হূদয়টাই ছিল রাজার। মনে আছে, তিনি তখনো অতি কষ্টে টেনেটুনে সংসার চালান। তখন নিউমার্কেটের পিছনের দিকে পুরানা পল্টন লাইনে থাকতেন। সরু রাস্তার পাশে ছোট্ট বাড়ি। আমি আর বিপাশা শুধুই আড্ডা দিতে যেতাম। অথবা স্টেজ ম্যাজিকে কীভাবে কথা বললে ভালো লাগবে এসব নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করতাম। বেরিয়ে আসার সময় লজ্জায় পড়ে যেতাম। রাতের খাবার না খেয়ে কোনো দিন আসতে পারিনি।
একে একে তাঁর পরিবারের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ভাব হলো। খালাম্মা আমাকে এতটাই ভালোবাসলেন, যার যোগ্য বলে আমি নিজেকে মনে করি না।
কিছুদিন পরে আমরা দুই পরিবার কাকতালীয়ভাবে ধানমন্ডি ১০/এ সড়কে একদম পাশাপাশি বাড়িতে বাস করতে লাগলাম।
একদিন হঠাৎ দেখি কারা যেন ছয়খানা তাজা লাউ, অনেক অনেক সবজি, শাক, বিশাল পাত্র ভরা দুধ...আরও কত কী রেখে গেছে। ব্যাপার কী? চিঠি পড়ে দেখি হুমায়ূন ভাইয়ের কাজ। নুহাশপল্লীতে ফলেছে।
যত রকমভাবে সম্ভব মানুষকে অবাক করে দিয়ে আনন্দ পেতেন হুমায়ূন ভাই। প্রতি ঈদে পাঞ্জাবি বা শার্টের প্যাকেট পাঠাতেন। সঙ্গে থাকত অপূর্ব সুন্দর একখানা করে চিঠি। গত ঈদে একটা লাল স্ট্রাইপ শার্টের সঙ্গে যে চিঠিখানা পাঠিয়েছিলেন তাতে তিনি লিখেছিলেন, একই রকম আরও একটা শার্ট তিনি নিজের জন্যও কিনে রেখেছেন। একদিন আমরা দুজন একই রকম কাপড় পরব। সেই শার্ট আর একসঙ্গে পরা হলো না।
No comments