জামদানির পর ফজলি গেল নকশিকাঁথাও যায় যায় by আবুল কাশেম

ফজলি আমও হাতছাড়া হলো বাংলাদেশের। রাজশাহীর ফজলির বিশ্বজুড়ে পরিচিতি থাকলেও এ আমটির মালিকানা স্বত্ব বাগিয়ে নিয়েছে ভারত। সম্প্রতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডাব্লিউটিও) থেকে ফজলি আমের মালিকানা স্বত্ব ভারতকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।


শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথার মালিকানা স্বত্বও দাবি করে রেখেছে ভারত। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নকশিকাঁথাকেও নিজস্ব পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র আরো জানায়, এর আগে বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির স্বত্বও নিয়ে নিয়েছে ভারত। অথচ চার বছর ধরে নিজেদের ভৌগোলিক পণ্যের মালিকানা স্বত্ব দাবি করার মতো আইনই তৈরি করতে পারেনি শিল্প মন্ত্রণালয়। আর এ সুযোগে সব দায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নির্বিকার রয়েছে মালিকানা স্বত্ব রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে জামদানি শাড়ির পর ফজলি আমের স্বত্বও আদায় করে নিয়েছে ভারত। এর আগে নিমগাছের স্বত্ব নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাসমতি চালের স্বত্ব নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। অন্য দেশের স্বত্ব নেওয়া পণ্যগুলো ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন এবং আমদানি-রপ্তানি করতে গেলে স্বত্ব পাওয়া দেশকে রয়্যালিটি দিতে হবে। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব পণ্য স্বত্ব পাওয়া দেশগুলোর নিজস্ব বলেই বিবেচিত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয় চার বছর ধরে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ) আইন প্রক্রিয়াধীন অবস্থায়ই রেখেছে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মালিকানা স্বত্ব রক্ষার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে এ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, 'যেহেতু শিল্প মন্ত্রণালয় আইন করতে পারেনি, তাই আমরাও এগোতে পারছি না।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. গোলাম হোসেন গত সপ্তাহে বলেন, 'ফজলি আমও বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেল। ভারতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ডাব্লিউটিও ফজলি আমের মালিকানা স্বত্ব ভারতকে দিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে আমরা ফজলি আম খেতে চাইলে ভারতকে ট্যাক্স (রয়্যালিটি) দিয়ে খেতে হবে। এর আগে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি ও নিমগাছের মালিকানা স্বত্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে। জামদানির পর এবার ফজলি আমের মালিকানাও ভারতের কাছে চলে গেছে।' তিনি আরো বলেন, 'এভাবে একের পর এক আমাদের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মালিকানা হাতছাড়া হলেও আইনের অভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছুই করতে পারছে না। ভৌগোলিক সূচক আইনের (জিআইএ) খসড়া তৈরি হয়েছে বহু আগে। এ আইন তৈরির দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে খসড়াটি পাঠিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছিল। আমরা অনেক আগেই মতামত দিয়েছি। তা সত্ত্বেও কেন আইনটি হচ্ছে না, তা জানা নেই। এ আইন ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নেই।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার জিআইএ আইন ১৯৯৯-এর ২২, ২৩ ও ২৪ ধারার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতিটি দেশের নিজেদের বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত পণ্য সংরক্ষণের অধিকার রয়েছে। এ জন্য নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত পণ্যকে নিজস্ব জিআইএ আইনের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের কোনো আইনই নেই। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় 'ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ-২০০৮' নামের একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে এতে তিনটি মৎস্য পণ্য, ১২টি ফল, ১১টি প্রক্রিয়াজাত খাবার, আটটি শাকসবজি, ১৪টি কৃষিজাত পণ্যসহ মোট ৪৮টি খাদ্যপণ্য এবং খাদ্য বাদে ১৮টি পণ্য মিলিয়ে ৬৬টি পণ্যকে বাংলাদেশের জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। খসড়া তালিকায় জামদানি শাড়ি, ফজলি আম এবং নকশিকাঁথাকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ডাব্লিউটিওর ট্রেড রিলেটেড আসপেক্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটসের (টিআরএআইপিআর) কাছে ভারত সরকারের জমা দেওয়া নিজস্ব পণ্যের তালিকায় বাংলাদেশি কিছু পণ্যও রয়েছে। এর মধ্যে জামদানি শাড়ির পর সম্প্রতি ফজলি আমের স্বত্ব পেয়েছে তারা। দেশটি ২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১১৭টি পণ্যকে নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নকশিকাঁথাও। এর আগে ভারত অন্ধ্র প্রদেশের উপ্পাদা কোথাপল্লি মণ্ডলের বেশ কিছু গ্রামের তাঁতি সমাজ, দুটি নিবন্ধিত তাঁতিদের সংগঠন ২০০৯ সালে 'উপ্পাদা জামদানি' নামের জামদানি শাড়িকে তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করে। পরে ডাব্লিউটিও থেকে জামদানির মালিকানা স্বত্বও পেয়ে যায় তারা। যদিও বাংলাদেশের জামদানি ও নকশিকাঁথা বিশ্বজুড়ে পরিচিত। অন্যদিকে রাজশাহীঘেঁষা ভারত সীমান্তের মালদহে ফজলি আম হলেও ফজলি বলতে রাজশাহীর ফজলিকেই বোঝায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, এ-সংক্রান্ত আইনটি চূড়ান্ত করার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আইন করা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, চাইলেই একটি আইন করা যায় না। এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে আলোচনা করে আইন চূড়ান্ত করতে হয়। আইনটি চূড়ান্ত করতে কত দিন লাগতে পারে তা জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

No comments

Powered by Blogger.