চলতি পথে- ময়মনসিংহ শশী লজ by দীপংকর চন্দ
মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। অথচ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, সম্পত্তি সংরক্ষণে সক্ষম একটি পুত্রসন্তান ভীষণভাবে প্রয়োজন। কী করা যায়? জীবনের জটিল অঙ্ক কষতে কষতে দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তিনি।
হ্যাঁ, গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিলেন রঘুনন্দন। সময়ের এক বিশেষ লগ্নে দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পাড়ি জমালেন পরপারে।
জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রতিও সদয় ছিল না নিয়তি। সন্তানহীন অবস্থায় অকালপ্রয়াণ ঘটল তাঁরও। গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও। তাঁর বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন পৃথিবীর মায়া। তবে হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মী দেবী। পুনরায় দত্তক নিলেন তিনি। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কুলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন পুত্রের—সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।
সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করলেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশী লজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্যবর্ধনে তিনি সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কারকাজ। নবীন জমিদারের প্রাণান্ত প্রয়াসে শশী লজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর, অপরূপ।
শতবর্ষী এই ভবনের রূপ-সৌন্দর্য কি অটুট আছে আজও? অকৃত্রিম কৌতূহলে জানতে চাই রানার কাছে। চলন্ত রিকশায় পথ চলতে চলতে নেতিবাচক উত্তর দেন তিনি। জানান, ‘না, ভবনের রূপ-সৌন্দর্য অটুট নেই স্বাভাবিকভাবেই। কালের করালগ্রাসে শশী লজ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের ঔদাসীন্য ভীষণভাবে বিনষ্ট করেছে ভবনটির ভৌত কাঠামোকে। ১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ ব্যবহূত হচ্ছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। সুতরাং, অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক পরিবর্তনের ক্ষত নিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি।’ বিষণ্ন এই বাক্যসমষ্টি বিহ্বলতার মুখোমুখি করে আমাদের। তবে জীবন থেমে থাকে না। রিকশা এগিয়ে যায় যথানিয়মে। অসংখ্য পথের স্মৃতি পেছনে ফেলে দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে উদ্ভাসিত হয় উঁচু দেয়ালঘেরা শশী লজের প্রবেশদ্বার।
রিকশা থেকে নেমে ভেতরে প্রবেশ করি আমরা। শান বাঁধানো প্রবেশপথের সামনেই শশী লজের সাজানো বাগান। বিচিত্র প্রজাতির ফুলশোভিত সেই বাগানের মধ্যভাগে বৃত্তাকার জলফোয়ারা। ফোয়ারার কেন্দ্রস্থলে অনুচ্চ বেদির ওপর দণ্ডায়মান গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত স্বল্পবসনা নারীর মর্মর মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ।
সুপ্রাচীন এই ভবনের পূর্বপ্রান্তের ঘরটি বর্তমানে ব্যবহূত হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের সহযোগিতায় আমরা পা রাখি শশী লজের অন্দরে। গাড়ি বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি কক্ষের সঙ্গে পরিচয় হলো আমাদের। পরিচর্যাহীন, ধুলোমলিন সেই কক্ষগুলোর কোনোটি তালাবদ্ধ, কোনোটি নানা রকম অপ্রীতিকর আসবাবে ঠাসা। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ।
এলাকার প্রবীণ মানুষের ভাষ্যে, বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত শশী লজের চারদিকে নিকট অতীতেই ফুলবাগান ছিল, ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষবীথি। কিন্তু মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবহারিক উপযোগযুক্ত নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে ঐতিহাসিক এ ভবন ও তার পরিপাশের ফুল-বৃক্ষবীথির সৌন্দর্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। সৌন্দর্য বিলোপের পরবর্তী ধাপ কী? প্রৌঢ়ত্ব? তারপর? বার্ধক্য? তারপর? মৃত্যু? আমাদের নিয়তি আসলে কী? প্রতিটি অতীত স্মৃতির নীরব মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা? যদি তা-ই হয়, তাহলে কোন ভিত্তিমূলে পা রেখে গড়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ? কোন ঐতিহ্যের সঙ্গে বসবাস করে সমৃদ্ধশালী হবে পরবর্তী প্রজন্ম?
দীপংকর চন্দ
জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রতিও সদয় ছিল না নিয়তি। সন্তানহীন অবস্থায় অকালপ্রয়াণ ঘটল তাঁরও। গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও। তাঁর বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন পৃথিবীর মায়া। তবে হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মী দেবী। পুনরায় দত্তক নিলেন তিনি। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কুলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন পুত্রের—সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।
সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করলেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশী লজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্যবর্ধনে তিনি সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কারকাজ। নবীন জমিদারের প্রাণান্ত প্রয়াসে শশী লজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর, অপরূপ।
শতবর্ষী এই ভবনের রূপ-সৌন্দর্য কি অটুট আছে আজও? অকৃত্রিম কৌতূহলে জানতে চাই রানার কাছে। চলন্ত রিকশায় পথ চলতে চলতে নেতিবাচক উত্তর দেন তিনি। জানান, ‘না, ভবনের রূপ-সৌন্দর্য অটুট নেই স্বাভাবিকভাবেই। কালের করালগ্রাসে শশী লজ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের ঔদাসীন্য ভীষণভাবে বিনষ্ট করেছে ভবনটির ভৌত কাঠামোকে। ১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ ব্যবহূত হচ্ছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। সুতরাং, অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক পরিবর্তনের ক্ষত নিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি।’ বিষণ্ন এই বাক্যসমষ্টি বিহ্বলতার মুখোমুখি করে আমাদের। তবে জীবন থেমে থাকে না। রিকশা এগিয়ে যায় যথানিয়মে। অসংখ্য পথের স্মৃতি পেছনে ফেলে দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে উদ্ভাসিত হয় উঁচু দেয়ালঘেরা শশী লজের প্রবেশদ্বার।
রিকশা থেকে নেমে ভেতরে প্রবেশ করি আমরা। শান বাঁধানো প্রবেশপথের সামনেই শশী লজের সাজানো বাগান। বিচিত্র প্রজাতির ফুলশোভিত সেই বাগানের মধ্যভাগে বৃত্তাকার জলফোয়ারা। ফোয়ারার কেন্দ্রস্থলে অনুচ্চ বেদির ওপর দণ্ডায়মান গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত স্বল্পবসনা নারীর মর্মর মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ।
সুপ্রাচীন এই ভবনের পূর্বপ্রান্তের ঘরটি বর্তমানে ব্যবহূত হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের সহযোগিতায় আমরা পা রাখি শশী লজের অন্দরে। গাড়ি বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি কক্ষের সঙ্গে পরিচয় হলো আমাদের। পরিচর্যাহীন, ধুলোমলিন সেই কক্ষগুলোর কোনোটি তালাবদ্ধ, কোনোটি নানা রকম অপ্রীতিকর আসবাবে ঠাসা। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ।
এলাকার প্রবীণ মানুষের ভাষ্যে, বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত শশী লজের চারদিকে নিকট অতীতেই ফুলবাগান ছিল, ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষবীথি। কিন্তু মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবহারিক উপযোগযুক্ত নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে ঐতিহাসিক এ ভবন ও তার পরিপাশের ফুল-বৃক্ষবীথির সৌন্দর্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। সৌন্দর্য বিলোপের পরবর্তী ধাপ কী? প্রৌঢ়ত্ব? তারপর? বার্ধক্য? তারপর? মৃত্যু? আমাদের নিয়তি আসলে কী? প্রতিটি অতীত স্মৃতির নীরব মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা? যদি তা-ই হয়, তাহলে কোন ভিত্তিমূলে পা রেখে গড়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ? কোন ঐতিহ্যের সঙ্গে বসবাস করে সমৃদ্ধশালী হবে পরবর্তী প্রজন্ম?
দীপংকর চন্দ
No comments