বুদ্ধ নাটক- একটি নতুন পর্যবেক্ষণ by সাইমন জাকারিয়া

‘বুদ্ধ নাটক’ বাংলার প্রাচীনতম নাট্যধারা। এ ধরনের নাট্যধারায় মূলত গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন ধর্ম-দেশনা, জীবনী, এমনকি তান্ত্রিক বৌদ্ধদের সাধন-পদ্ধতির কথা সংগীত, নৃত্য, সংলাপ ও অভিনয়ের আকারে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন স্থানে পরিবেশিত হতো।


এই বুদ্ধ নাটক-এর পরিবেশনারীতি সম্পর্কে চমৎকার একটি বর্ণনা আমাদের হাতে আছে, আর তা হলো—
‘নাচন্তি বাজিল গায়ন্তি দেবী
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই\’
এর অর্থ, বজ্রাচার্য (যিনি সাধক) নাচছেন, দেবী (যিনি সাধিকা) গান করছেন। বুদ্ধ নাটক বিপরীতভাবে পরিবেশিত হয়। কেননা, সেকালের নাট্য পরিবেশনায় নৃত্যে সাধারণত নারীরা অংশ নিতেন আর পুরুষ কুশীলবেরা সংগীত পরিবেশন করতেন। কিন্তু বুদ্ধ নাটক যেহেতু ছিল ধর্ম-দেশনা তথা বৌদ্ধ সাধন-পদ্ধতির প্রচারণামূলক নাট্য, তাই এর পরিবেশনার ক্ষেত্রে প্রচলিত অন্যান্য নাট্য উপস্থাপনার বিপরীতরীতি অনুসৃত হতো। সম্ভবত এ কারণেই বুদ্ধ নাটক-এর পরিবেশনাকে ‘বিসমা’ বলা হয়েছে।
বুদ্ধ নাটক সম্পর্কে আমরা এই উত্তরটি সংগ্রহ করেছি, বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন চর্যার একটি পদ থেকে। এই পদটি বাংলা নাটকের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ও বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় বিশ্লেষণের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ঔপনিবেশীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারে বাংলার অধিকাংশ মানুষের মনে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আর তা হলো—বাংলা নাটকের জন্ম অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদে। অথচ এখানে আমরা, খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত চর্যায় বাংলায় প্রচলিত একটি বিশেষ ধরনের নাট্যরীতি সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছি। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চর্যা সমসাময়িককালের অন্য কিছু তথ্য, বিশেষ করে সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পুরাতাত্ত্বিক তথ্যকে কাজে লাগিয়ে আমরা এরই মধ্যে ‘প্রাচীন বাংলার বুদ্ধ নাটক’-এর স্বরূপ অন্বেষণ করতে সক্ষম হয়েছি।
এরপর আমাদের মনে আরেকটি জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে, তা হলো, কোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কোনো ভূখণ্ড থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে কি? নাকি তার সূত্রগুলো ভিন্ন কোনো ঐতিহ্যিক তৎপরতার মধ্যে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকে? চর্যা সংস্কৃতির বিবেচনার ক্ষেত্রে এসব প্রশ্নের সংগত কারণ আছে। কেননা, বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত চর্যা সংস্কৃতির পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায় নেপালে, তিব্বতে। বিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা তা সংগ্রহের মাধ্যমে প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, উপরন্তু ওই সব দেশে চর্চিত নতুন চর্যা সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য হাজির করেছেন। আমরাও নেপালে গিয়ে তার চলমান ধারা প্রত্যক্ষ করেছি। আবার এ কথাও তো সত্য, চর্যা সংস্কৃতির গূঢ় ও তান্ত্রিক সাধনার ধারা পরবর্তীকালে সহায়ক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নাথ ও সাধক-ফকির তথা বাউলদের ঐতিহ্যিক জাগরণে, গানে। এখনো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই ধারা চলমান রয়েছে। এসব কথা বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্ডিত-গবেষক দ্বারা বারবার স্বীকৃত।
আমাদের আগ্রহ চর্যার ধর্ম-দেশনা ও ভাব-শংকরের পাশাপাশি তার পরিবেশনারীতি নিয়ে। কেননা, চর্যার বিভিন্ন পদের ভেতর তার পরিবেশনারীতি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ইংগিত আছে। অথচ আমরা অবাক চোখে লক্ষ করি—বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোথাও চর্যার সাম্প্রতিক পরিবেশনারীতির ঐতিহ্য, এমনকি চর্যার পদে উল্লিখিত বুদ্ধ নাটক-এর সমসাময়িক অবস্থা সম্পর্কেও তেমন কোনো তথ্য পাই না। তাই আমরা ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী অনুসন্ধান শুরু করি এবং তারই ফলে সম্প্রতি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমাদের মাঝে ‘বুদ্ধ কীর্তন’ নামে বিশেষ এক ধরনের বুদ্ধ নাটক-এর সন্ধান পাই। এ ধরনের পরিবেশনারীতিতে চাকমারা সাধারণত ভগবান গৌতম বুদ্ধ তথা সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তবে, মাঝেমধ্যে রাজা অশোকের জীবনকাহিনিও চাকমাদের বুদ্ধ নাটকের আসরে পরিবেশিত হতে দেখা যায়।

বুদ্ধ নাটক-এর স্বরূপ অন্বেষণ ও চর্যার পরিবেশনারীতি
আগেই বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধ নাটক’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় চর্যার পদে। আসলে, বীণা পা রচিত চর্যার ১৭ সংখ্যক পদে বুদ্ধ নাটক-এর উল্লেখ রয়েছে। তাই এই নাটকের স্বরূপ অন্বেষণে প্রথমেই আমাদের চর্যার পদগুলোকেই আশ্রয় করতে হয়। চর্যার একাধিক পদে প্রাচীন বাংলার যে পরিবেশনারীতির পরিচয় পাওয়া যায়, তা মূলত এক ধরনের সাংগীতিক পরিবেশনা, যার সঙ্গে রাগ-রাগিণীর ব্যবহারের কথা যেমন জানা যায়, তেমনি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে চর্যার সমসাময়িককালের সাংগীতিক পরিবেশনার সঙ্গে নৃত্য ও নাট্যের সংশ্লিষ্টতার কথাও জানা যায়।
চর্যার সাংগীতিক পরিবেশনার প্রথম প্রমাণ মেলে প্রতিটি পদের শীর্ষে নির্দেশিত রাগ-রাগিণীর উল্লেখে। চর্যার সব পদের শীর্ষেই পটমঞ্জরী, রামক্রী, দেশাখ, কামোদ, ভৈরবী ইত্যাদি রাগ-রাগিণীর উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, চর্যার পদ অভ্যন্তরে এর সাংগীতিক উপস্থাপনায় ব্যবহূত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও তার সুরের ইন্দ্রজাল সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন—চর্যার ১৭ সংখ্যক পদে আছে—‘বাজই অলো সহি হেরুঅবীণা/সুন তান্তি ধনি বিলসই রুণা \’ অর্থাৎ ওলো সই, হেরুকের বীণা বাজছে, শূন্যতন্ত্রীর ধ্বনি মূর্ছিত হচ্ছে ক্ষীণ সুরে।
এর অর্থ চর্যার সমসাময়িককালের সাংগীতিক পরিবেশনার বাদ্যযন্ত্র ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল। এবার এর গায়কি সম্পর্কে তথ্য দেওয়া যাক।
চর্যার সাংগীতিক উপস্থাপনা কোনো শিল্পী তথা গায়ক কর্তৃক যে পরিবেশিত হতো তার প্রমাণ মেলে একাধিক পদে রচয়িতার ভণিতায় ‘গীত’, ‘গাইতু’, ‘গাইল’ ইত্যাদি শব্দ দেখে। যেমন— চর্যার ২ সংখ্যক পদে আছে—‘অইসন চর্য্যা কুক্কুরীপাএঁ গাইল’; ১৮ সংখ্যক পদে আছে—‘কাহ্নে গাইতু কামচণ্ডালী’; ৩৩ সংখ্যক পদে আছে— ‘ঢেন্ঢণ পাএর গীত বিরলে বুঝঅ’ ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় সাধারণত গীত পরিবেশনার সময় বা গীত পরিবেশনার জন্য রচিত পদের ভণিতাতে এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের একটি রীতি প্রচলিত রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের সাধনকেন্দ্রিক পদ-পদাবলির ভণিতা অংশে এ ধরনের শব্দ প্রযুক্ত হয়ে থাকে। চর্যা সমসাময়িক কালের সংগীত, নৃত্য ও নাট্য পরিবেশনার সামগ্রিক পরিচয় উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে চর্যার পদগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য কিছু উপাদান ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন চর্যা রচয়িতার জীবনী ও রেখাচিত্র, অন্যদিকে তেমনি চর্যার সমসাময়িককালে নির্মিত সোমপুর বিহার ও তার মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ টেরাকোটা চিত্র ব্যবহূত হয়েছে। আসলে, চর্যার পদে উল্লিখিত গীতি, নৃত্য ও সর্বোপরি বুদ্ধ নাটকের স্বরূপ বিচারের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসকারদের মধ্যে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেন, নীহারঞ্জন রায়, শশীভূষণ দাশ গুপ্ত, সেলিম আল দীন প্রমুখ গবেষক উল্লিখিত উপকরণ ব্যবহার করেছেন। প্রাচীন বাংলার বুদ্ধ নাটক গ্রন্থ প্রণয়নে আমি মূলত পূর্ববর্তী গবেষকদের কৃত পদ্ধতি অনুসরণেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োগ করি। আর ওই গ্রন্থ প্রণয়নের পর আমি নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠি চর্যার পরিবেশনারীতির সাম্প্রতিক রূপ পর্যবেক্ষণে। এর কারণ আর কিছু নয়, প্রাচীন বাংলার নাট্য পরিবেশনারীতির একটি সূত্র বাংলাদেশের সমসাময়িককালের পরিবেশনারীতির সঙ্গে যুক্ত করা। সেই লক্ষ্যে বর্তমানে নেপালে প্রচলিত চর্যার বিচিত্র সাংস্কৃতিক ধারা পর্যবেক্ষণ করি। নেপালের চর্যা সংস্কৃতি মূলত সে দেশের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।

সাম্প্রতিককালের নেপালে প্রচলিত চর্যা সংস্কৃতি
ক্ষেত্রসমীক্ষায় নেপালে আমরা অন্তত তিন ধরনের চর্যা পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করি। এক. বৌদ্ধমন্দির প্রাঙ্গণে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সমবেত কণ্ঠে চর্যার গানের পরিবেশনা, দুই. মন্দির প্রাঙ্গণে চর্যার হাতে লেখা পুঁথিপাঠ এবং তিন. চর্যার নৃত্যাভিনয়। উল্লেখ্য, নেপালের রাজদরবার গ্রন্থাগার (বর্তমান ন্যাশনাল আরকাইভ) থেকে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা ভাষার প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন চর্যার পুঁথি সংগ্রহ করেন। তিনি সেই পুঁথির সঙ্গে আরও তিনটি পুঁথি একত্রে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা নামে বিস্তৃত ভূমিকাসহ ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন—‘১৯০৭ সালে আবার নেপালে গিয়া আমি কয়েকখানি পুঁথি দেখিতে পাইলাম। একখানির নাম “চর্য্যাচর্য্য-বিনিশ্চয়”, উহাতে কতকগুলি কীর্তনের গান আছে...গানগুলি বৈষ্ণবদের কীর্তনের মত, নাম “চর্য্যাপদ”।... আমার বিশ্বাস, যাঁরা এই ভাষা লিখিয়াছেন, তাঁরা বাঙ্গালা ও তন্নিকটবর্তী দেশের লোক। অনেকে যে বাঙ্গালী, তাহার প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে।’ পরবর্তীকালে রাহুল সংকৃত্যায়ন আবিষ্কৃত ‘চতুরশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি’ বা চুরাশি সিদ্ধর কাহিনির বিবরণে পাওয়া যায় যে, চর্যাগীতির সর্বাধিক পদের রচয়িতা কাহ্নুপার বাড়ি ছিল সোমপুর তথা বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ-জয়পুরহাট অঞ্চলের পাহাড়পুরে। তিনি এবং চর্যাপদের অন্যান্য কবি-গায়ক ও নৃত্যশিল্পীরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের শাসনামলে নির্বিঘ্নে চর্যাগীতি-নৃত্য ও নাট্যের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দিতেন বলে জানা যায়। কিন্তু অচিরেই বাংলায় সনাতনধর্মাবলম্বী সেন রাজাদের রাজত্ব অধিগ্রহণের ফলে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চর্যার কবিরা বিপন্নতার মুখোমুখি হন। এ পরিস্থিতিতে একদিকে চর্যার ঐতিহ্য বাহকেরা চর্যার ঐতিহ্যকে কিছুটা বদলে নিয়ে ভিন্ন নাম-পরিচয়ে সাধারণ জনতার মধ্যে মিশে যান, অন্যদিকে চর্যার পাণ্ডুলিপিসহ চর্যাগীতি-নৃত্য ও নাট্যঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে বৌদ্ধধর্মানুসারী পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও তিব্বতে গমন করেন।
প্রথম দিকে আমাদের ধারণা ছিল—নেপাল থেকে যদি চর্যাগীতির পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হতে পারে, তবে সেখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভেতর চর্যা ও বুদ্ধ নাটক-এর পরিবেশনারীতিরও সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সেই আগ্রহ থেকে আমরা নেপালে গমন করি এবং চর্যা গীতি-নৃত্যের জীবন্ত ধারা প্রত্যক্ষ করি।
নেপালে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরের চূড়ায় নিত্য যেমন বৌদ্ধধর্মের উপাসনা সম্পাদিত হয়, তেমনি সমকালীন চর্যার গানও গীত হতে দেখা যায়। সেখানে দেখা যায়, একদল সংগীতরসিক হারমোনিয়াম, তবলা, করতাল বাজিয়ে সমকালীন নেওয়ারি ভাষায় নিরন্তর চর্যা পরিবেশন করেন, যার সুর বাংলা কীর্তনের মতো। এ পর্যায়ে আমরা স্মরণ করতে পারি, আজ থেকে শতাধিক বছর আগে চর্যাগীতির পরিবেশনারীতি সম্পর্কে এর আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য। তিনি লিখেছিলেন, চর্যার গানগুলো কীর্তনের মতো এবং সমকালীন কীর্তনের মতো তা আসরে গীত হতো। নেপালের স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে পরিবেশিত চর্যার সমকালীন আসরটি তার ব্যতিক্রম নয়। অতএব বুদ্ধ সংস্কৃতির গানের কীর্তনধারা প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি প্রবহমান রয়েছে বৈকি।
নেপালে চর্যা সংস্কৃতি মূলত বৌদ্ধধর্মানুসারী বজ্রাচার্যদের দ্বারা চর্চিত হয়। বজ্রাচার্যরা এখনো বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানে বা কৃত্যে হাতে লেখা চর্যার পুঁথিপাঠ ও গীত আকারে পরিবেশন করে থাকেন। আমরা সেখান থেকে নরেন্দ্রমুণি বজ্রাচার্য (৫১)-এর ১৭০টি চর্যাগীতির তেমনি একটি হাতে লেখা পুঁথি সংগ্রহ করি। মজার ব্যাপার হলো, নরেন্দ্রমুণি বজ্রাচার্যের কাছ থেকে সংগৃহীত ১৭০টি চর্যাগীতির পুঁথির বেশ কয়েকটি চর্যাগীতির সঙ্গে প্রাচীন বাংলার চর্যাপদের হুবহু সাদৃশ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংগৃহীত চর্যাগীতির পদগুলোর ওপরে রাগ-রাগিণীর উল্লেখ থাকলেও গীত-তালের উল্লেখ নেই। কিন্তু আমাদের সংগৃহীত চর্যাগীতির পাণ্ডুলিপিতে প্রতিটি চর্যাগীতির ওপরে সুর ও তালের উল্লেখ রয়েছে, যাকে আশ্রয় করে বিস্তৃত গবেষণার সুযোগ রয়েছে
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে পার্বত্য এলাকায় চাকমাদের বসবাস। এই জনগোষ্ঠী মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের বসবাসের নজির আছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে চাকমারা যেমন সর্ববৃহৎ নৃগোষ্ঠী, তেমনি এই জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য নৃগোষ্ঠী থেকে সমৃদ্ধ ও স্বতন্ত্র। নিজস্ব ভাষায় এই জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চিত হয়ে আসছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। এই জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রয়েছে দুটি ধারা—একটি মৌখিক এবং অন্যটি লিখিত।
চাকমা জনগোষ্ঠীর মৌখিকরীতির পরিবেশনার মধ্যে ‘গেংখুলী গীদ’ অন্যতম। এই রীতিতে চাকমা ভাষায় একাধিক পালা যেমন—‘রাধামন-ধনপুদি’, ‘সান্দবীর বারমাসী’ ইত্যাদি। মূলত একজন গায়ক কর্তৃক বর্ণনাত্মক সংগীত আকারে চাকমাদের ‘গেংখুলী গীদ’-এর পালাগুলো বিভিন্ন উৎসব-আমোদে পরিবেশিত হয়। অপরপক্ষে চাকমাদের মধ্যে একাধিক নাট্যশিল্পী কর্তৃক আঙ্গিক-অভিনয়, নৃত্য, গীত ও সংলাপ আকারে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ নামে ‘বুদ্ধ কীর্তনে’র ধারায় বুদ্ধ নাটক-এর এক ধরনের নাট্যপালার পরিবেশনা প্রচলিত। এ ধরনের নাট্য পরিবেশনা সাধারণত কৃত্যমূলক এবং তা সচরাচর শ্রদ্ধার অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।
আগেও একবার বলা হয়েছে, বুদ্ধ নাটক-এর ধারায় এ ধরনের নাট্যপালাতে সাধারণত গৌতম বুদ্ধের জীবন-কাহিনি ও জীবন-দর্শন উপস্থাপিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আসরে এই নাট্যপালা পরিবেশনামুহূর্তে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির দুটি সংস্করণ ব্যবহূত হয়। যার একটি ব্যবহার করেন মঞ্চের পাশে বসা প্রোম্টার এবং অন্যটি ব্যবহূত হয় গ্রিনরুমে দৃশ্য-অঙ্ক অনুযায়ী অভিনয়শিল্পীদের আগমন-নির্গমনের নির্দেশনার কাজে।
বাংলাদেশের চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত বুদ্ধ নাটক সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ-এর প্রধান প্রবণতা হলো, এটি মূলত এক ধরনের গীতিনাট্য। আসরের শুরুতে থাকে বাদ্যযন্ত্রীদের সমবেত বাদ্যবাদন। তার আগেই অবশ্য অভিনয়শিল্পীরা চরিত্র অনুযায়ী সাজ গ্রহণ করে থাকেন। অভিনয়শিল্পীদের সাজ গ্রহণের পর সমবেত বাদ্যযন্ত্র বাদনের মধ্যে পরিবেশনাস্থান ঘিরে বিভিন্ন বয়সী দর্শক-শ্রোতারা এসে বসেন। এরই মধ্যে চার-পাঁচজন কুশীলব এসে একটি প্রার্থনা গান পরিবেশন করেন। যেমন—
নম নম দয়াময় বুদ্ধ ভগবান
অহিংসা প্রচারিতে জন্ম লও অবনীতে
দয়া অবতার প্রভু কর না নিদান
জ্বরা ব্যাধি ভরা মৃত্যু দুঃখ হতে
মুক্ত কর আজি পতিত পাবন।
কর্ম রূপে ধর্ম শেখাতে জগতে
দেখাতে মানবে সুখময় নির্বাণ\
এই প্রার্থনা গানের ভেতর দিয়ে চাকমাদের কৃত বুদ্ধ নাটকের সামগ্রিক দর্শন প্রকাশিত হয়েছে। চর্যায় বর্ণিত বুদ্ধ নাটকের স্বরূপ বিবেচনায় এ কথা বারবার প্রকাশিত হয়েছে যে, বুদ্ধ নাটক-এর আসরে সাধারণত বৌদ্ধধর্মের সাধনার পদ্ধতি, গৌতম বুদ্ধের জীবন আখ্যান বা তাঁর মুখনিঃসৃত বিভিন্ন বাণী নৃত্য-গীত-অভিনয় আকারে পরিবেশিত হতো।
সমসাময়িককালে প্রচলিত চাকমাদের সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ নাট্যপালায় গৌতম বুদ্ধের জীবনাভিজ্ঞতা ও মানবজীবনের মুক্তির লক্ষ্যে জ্ঞান অন্বেষণে তাঁর সংসার ত্যাগ তথা সন্ন্যাস গ্রহণের কাহিনি বর্ণিত হয়।
এই নাট্যপালার ধারাবাহিক কাহিনিতে দেখা যায়—ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু ও বরুণ এসে বোধিসত্ত্বের কাছে বলেন—
‘প্রভু আসিয়াছি দেবলোক হতে জানাইতে মর্তের বার্তা। জীবগণ হিংসায় পরস্পরে ভাসে মহা দুঃখের সাগরে, মিছে সুখ আজি কোটি কোটি প্রাণী বধ করিতেছে দেবতার নামে।
যাগ যজ্ঞ বিশ্বধরা প্লাবিত হইল
ধর্ম কর্ম মনুষ্যত্ব লোকে ভুলে গেল।
ধর্ম প্রচারিতে লোকে জ্ঞান হারাইল
অহিংসা পরম ধর্ম লোকে ভুলে গেল
পশুত্ব পাইল ধরা, দেবত্ব ভুলিল
যজ্ঞ ধর্মে জীব রক্তে পৃথিবী ছাইল।’
‘প্রভু, জীব দুঃখ দূর করার জন্য শুভ সময় উপস্থিত। আপনি এ সময়ে মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হয়ে ধরার দুঃখ দূর করুন। প্রাণীগণ জ্বরা, ব্যাধি, মৃত্যু, দুঃখ সহ্য করতে না পেরে আপনার করুণা ভিক্ষা করিতেছে।’
তাঁদের কথার উত্তরে বোধিসত্ত্ব বলেন—‘দেবগণ, বাস্তবিক জীব দুঃখ বিমোচনের শুভ সময় উপস্থিত। কিন্তু আমি নৃসিংহ রাম ও পশুরামের মতো অস্ত্রের সাহায্যে পৃথিবী জয় করব না। আমি কেবল ভিক্ষা দেব প্রেম, প্রেমের দ্বারাই আমি পৃথিবী জয় করব।’
রাম আদি অবতারে ধনু অস্ত্র ধারণ করে
দৈত্য দানব করিল নাশন।
আমি কভু অস্ত্র না ধরিব, প্রাণে কারে না মারিব
প্রেমে করব জগৎ উদ্ধার।
প্রেমে জগৎ জয় করিব।
‘কিন্তু দেবগণ মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হওয়ার আগে আমাকে পাঁচটি বিষয় চিন্তা করতে হবে।’
কিন্তু সেই পাঁচটি বিষয়? চর্যার প্রথম পদে আছে, ‘কায়া তরু বর পাঞ্চ বি ডাল/চঞ্চল চিএ পইঠ কাল।’ অর্থাৎ ‘শরীর গাছে পাঁচখানি ডাল/অধীর মনে ঢুকে পড়ে কাল।’ চাকমাদের কৃত সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ শীর্ষক বুদ্ধ নাটকের আসরে বোধিসত্ত্ব সেই দেহতত্ত্বের ইংগিত দিচ্ছেন না তো?
আসলে, সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ নামে চাকমাদের কৃত এই বুদ্ধ নাটক-এর পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করলে প্রতীকী অর্থে চর্যার পদে বর্ণিত দেহতত্ত্বের সাক্ষ্য মেলে। কেননা, সিদ্ধার্থ রাজপুত্র হয়ে মানবদেহের অসারতাকে প্রত্যক্ষ করে নির্বাণ তথা জ্ঞান লাভের দিকে ধাবিত হয়েছেন এবং সংসার ত্যাগের মাধ্যমে তিনি সেই গন্তব্যে পৌঁছেছেন। চাকমা জনগোষ্ঠীর শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ নাট্যপালাটি পরিবেশনার দুটি কারণ থাকতে পারে, যার একটি হলো—এটি বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের পবিত্র জীবনকাহিনি, আর দ্বিতীয় কারণটি হলো—কেউ যখন মারা যায়, তার মূলত দুই ধরনের গৃহান্তর ঘটে—এক দেহ থেকে তার আত্মার গৃহত্যাগ ঘটে, অন্যদিকে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারবেষ্টিত সংসার থেকে তার গৃহত্যাগ ঘটে। তাই হয়তো গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগ ঘটনার সঙ্গে এই নাট্যপালা পরিবেশনার একটি গূঢ় ও কৃত্যমূলক সম্পর্ক যুক্ত করা হয়।
চাকমাদের বুদ্ধ নাটক পরিবেশনারীতির মধ্যে গীত চরিত্রের সংলাপাত্মক গানের কোনো বাণীর সঙ্গে অর্থগত দিক থেকে প্রাচীন চর্যার বেশ কিছু পদের সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়, অন্যদিকে মধ্যযুগের বাংলা বৈষ্ণব পদাবলিরও সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, অনেকটাই বাঙালিদের লোকচক্ষুর আড়ালে অবাঙালি চাকমাদের মাঝে এই নাট্যধারা (বুদ্ধ নাটক) বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যিক অভিযাত্রা চর্যা ও বৈষ্ণব গীতিকবিতার গীতল ধারাকে ধারণ করে নবরূপে উদ্ভাসিত হয়েছে।

* এই প্রবন্ধটি গত ৪ মে ২০১২ তারিখে আমেরিকার দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সংগীত বিভাগে এথনোমিউজিকোলজি কোর্সের আওতায় সাউথ এশিয়ান মিউজিকের ক্লাস লেকচার হিসেবে লেখক কর্তৃক উপস্থাপিত।

No comments

Powered by Blogger.