বালি দ্বীপে কয়েক দিন by রানা সুলতানা
দুই বছর আগের কথা । একটা সাশ্রয়ী প্যাকেজে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে যাবার হঠাৎই সুযোগ পেয়ে গেলাম । সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের প্যাকেজ। সুযোগটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল বলে আমরা সপরিবারে বালির উদ্দেশে রওনা দিলাম। বালি দ্বীপ ভ্রমণের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত।
পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা আসে বালি দ্বীপের প্রাকৃতিক রূপে নিজেদের সিক্ত করতে। আমরা যাবার আগে ভিসা সংগ্রহ করি ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাস থেকে। এই ভিসা পাবার বিষয়টি সহজ হয়েছিল কারণ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স আমাদের স্পনার করেছিল। তবে শুনেছি মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের জন্য কোন ভিসার প্রয়োজন হয় না । সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে করে আমরা প্রথমে পৌঁছালাম সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে। সেখানে বেশ কয়ক ঘণ্টা যাত্রাবিরতি ছিল। এয়ারপোর্টটি দারুণ জমকালো। তবে ক’ঘণ্টা ওখানে বসে থাকতেই আমরা বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্লেন পরিবর্তন করে ওই একই এয়ারওয়েজের আরেকটি ছোট প্লেনে চড়ে আমরা রওনা দিলাম বালির পথে। আমাদের প্লেন এগিয়ে চলেছে বালির দিকে আর প্লেনের জানালা দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছে কেবল সমুদ্র আর সমুদ্র। আমার মনে হতে লাগল ওয়েবসাইটে পড়েছি এই সমুদ্রেরই জাভা দ্বীপ আর লাম্বক দ্বীপের মাঝে অবস্থান বালি দ্বীপের। এই দ্বীপের উত্তর পাশের সমুদ্রকে বালি সমুদ্র বলেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। এর দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। ইন্দোনেশিয়ার বালি প্রদেশটি বালি দ্বীপ, নুসা লেমবোনগান দ্বীপ, নুসা কেনিনগান দ্বীপ এবং মেনজানগান দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর আয়তন ৫.৬৩২,৬ কিলোমিটার। বালি প্রদেশটি ৮টি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত। বালি দ্বীপটি আসলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। জানা যায় যে এখানে প্রধানত শুষ্ক ও আদ্র এই দুটি মৌসুম রয়েছে। তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করে। আমাদের প্লেন যখন বালি দ্বীপের এয়ারপোর্টের দিকে অবতরণের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যে আমরা যেন সমুদ্রের মধ্যেই অবতরণ করতে যাচ্ছি । প্লেনের অনেক যাত্রী বেশ হৈ চৈ করে উঠল। কিন্তু প্লেনটি ঠিকঠাক মতই সমুদ্রের কোল ঘেঁষা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। ছোট্ট একটি বিমানবন্দর কিন্তু টুরিস্টদের জন্য রয়েছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। আমরা বাইরে বেরিয়ে পড়তেই দেখি একজন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য । তার হাতের প্লেকার্ডে আমাদের নাম লেখা। আমরা পরিচয় দিতেই সে এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। পরে একটি গাড়িতে করে আমরা পৌঁছাই বিশাল এক হোটেলে। হোটেলের রিসেপশনে সব ফরমালিটিজ শেষ করে আমরা আমাদের রুমে চলে যাই। রুমটি বেশ বড় আর ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। সেদিন আমরা কেবল বিশ্রাম নিলাম। পরের দিন খুব সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের জন্য হোটেলের ডাইনিং হলে গেলাম। আমি তো অবাক ব্রেকফাস্টের জন্য প্রায় পঞ্চাশ ধরনের খাবার দেখে। যা হোক খাওয়া শেষ করে আমরা হোটেলের একটি গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের এই গাড়িটি আমাদের নিয়ে গেল বালির বিখ্যাত কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখানোর জন্য। আমাদের যিনি গাইড হিসাবে ছিলেন তিনি বয়সে তরুণ। জানালেন অনেক অল্প বয়স থেকেই তিনি এই পেশায় জড়িত। তার পরনে ছিল বালির ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি আর ফতুয়া, মাথায় বালির বিশেষ টুপি। তার কাছে থেকে জানলাম বালির অধিবাসীদের প্রধান পেশা পর্যটন শিল্প। কোন না কোনভাবে তারা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই এলাকার মানুষের প্রথাগত জীবন ও বৈচিত্র্যময় বসবাস দেখানোর জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বালির একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামে। গ্রামে যাবার পথের দু’ধারে ঠিক বাংলাদেশের মতো ফসলের ক্ষেত চোখে পড়ল। আমাদের গ্রামের যে বাড়িটিতে নিয়ে যাওয়া হলো সেটি ছিল একজন হস্তশিল্পীর বাড়ি। সেখানে দেখলাম বেশ কয়েকজন শিল্পী নানাধরনের জিনিস বানাচ্ছেন। বলে রাখা ভাল বালি জগত খ্যাত হস্তশিল্পের জন্য। দ্বীপবাসীর তৈরি কাঠের বা মেটালের বিভিন্ন ঘর সাজাবার দ্রব্যগুলো এক কথায় অসাধারণ। এছাড়াও পথে পথে সুভ্যেনিয়র শপে বিক্রি হচ্ছে আকর্ষণীয় সব হস্তশিল্প। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে শিল্পীদের হাতে আঁকা তেল ও জল রংঙের ছবি। আমি দুটি ছবি খুব শখ করে কিনে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। এখনও ছবি দুটি আমার ঘরে অতি যতেœ শোভা পাচ্ছে। যা হোক বালির গ্রামে শিল্পীদের বাড়ি ভ্রমণ শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো প্রথাগত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখি অনেক বাংলাদেশী ঢাকা থেকে বালিতে বেড়াতে গেছে । তাদের সঙ্গে সামান্য পরিচয় ও কথা হয় আমাদের। আমরা বসে যাই মঞ্চের পাশে, উপভোগ করি বালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা নৃত্যশিল্পীদের নাচ। ঠিক ইন্দোনেশিয়ার সিনেমায় যেমনটা দেখেছি তেমনই নাচ গান নিজের চোখে দেখলাম। তারপরে গাড়ি করে আবার রওনা দিলাম। ইন্দোনেশিয়া মুসলমান প্রধান দেশ হলেও বালি দ্বীপটি হিন্দুপ্রধান। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল একটি পুরনো সনাতনী মন্দির। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এই মন্দিরে আসে পূজা করতে। মন্দিরে একটি অদ্ভুদ বিষয় দেখলাম। প্রচুর বাদুর রয়েছে মন্দিরে এবং সকলে তাদের বেশ আদর করে। ওই এলাকাটির নাম টেনগানান। সেই দিনকার মতো বেড়ানো পালা শেষ করে আমরা হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যার দিকে আশপাশের দোকানপাটে ঘুরতে গেলাম । বেশ বড় বড় কয়েকটি শপিং সেন্টার আমরা কেনাকাটা করলাম। বালি দ্বীপটিতে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে প্রচুর পাব, ডিসকো আর নাইট ক্লাব। এখানে আসা বেশিরভাগ পর্যটকই অস্ট্রেলিয়ার বলে মনে হলো। এছাড়াও অন্যান্য দেশের পর্যটকও নজরে পড়ল। রাতে আমরা ছোট একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করলাম। আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎই রেস্টুরেন্টটা কেঁপে উঠল। আমরা বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ওখানকার লোকেরা বলল এই রকমের ছোটখাটো ভূমিকম্প প্রায়ই এ দ্বীপে হয়ে থাকে। এ নিয়ে তাদের কোন ভয় নেই। আমি জীবনে প্রথম ছোট ছোট টুকরা অক্টোপাসের মাংস খেলাম। খাওয়ার আগে একটু অস্বস্তি থাকলেও পরে তেমন কিছুই মনে হয়নি। স্বাদটা একটু ভিন্নধরনের। যাই হোক রাতে আমরা হোটেল লাগোয়া সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গেলাম। রুমে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। দ্বীপটি খুবই নিরাপদ। চুরি, ছিনতাই বা কোন কিছু হারাবার ভয়ই নেই। পরের দিন সকালে আমরা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। এই সমুদ্রের টেউয়ের সঙ্গে অনেক গাছপালা পাড়ে এসে ভেড়ে। অনেক দেশের পর্যটকদের সঙ্গে সমুদ্রে স্নান করার অভিজ্ঞতাটি দারুণ। দুপুরের পরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সূর্য অস্ত যাবার দৃশ্য দেখার জন্য। আমরা যেখানে পৌঁছালাম সেই জায়গাটি বালির শহর থেকে একটু দূরে। যাবার পাহাড়ি পথে চোখে পড়ল পাহাড়ের ধাপে ধাপে ধান ক্ষেত। যাই হোক সূর্য অস্ত দেখতে আমরা পৌঁছালাম সমুদ্র সৈকতে। আমার জীবনে এর আগে আমি কখনও এত সুন্দর প্রকৃতি দেখিনি। বিশাল সুনীল সমুদ্র, তার মাঝে একটা কালো পাথরকে কেটে বানানো হয়েছে বিখ্যাত তানাহ লট টেম্পল। সমুদ্রের হাঁটুজল ভেঙে সেই টেম্পলে আমরা গেলাম। উপরে নীল আকাশটা ক্রমেই লালচে হয়ে যাচ্ছে আর সূর্যটা এক সময় চারদিককে আঁধার করে ডুবে গেল সমুদ্রের বিশালতায়। আমার মনে হয়েছিল বালি না এলে আমি বঞ্চিত থাকতাম প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য থেকে। পরের দিন আমরা দেখতে গেলাম কিনতামানি বাতুর ভলকেনো। ইন্দোনেশিয়ার এই দ্বীপে আগে একবার এই অগ্নিগিরি থেকে অগ্নি উৎপাত হয়ে বহু মানুষ আর গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। এখন এই আগ্নেয়গিরিটি শান্ত। আমরা পাহাড়ী পথ ধরে গেলাম আগ্নেয়গিরিটি দেখতে। বেশ দূর থেকে গিরিটিকে দেখলাম। দেখতে দেখতে মনে হলো এই শান্ত সুবিশাল পাহাড়ের মুখ থেকে বের হওয়া লাভা কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে অথচ এখন এটি কত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কে জানে কবে আবার এটি অগ্নিমূর্তি ধারণ করবে! এর দু’দিন পরেই আমরা ঢাকা ফিরে আসি। বালির এই নয়নাভিরাম রূপ আমার স্মৃতিতে অম্লান থাকবে।
No comments