বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৮০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। গোলাম হোসেন, বীর প্রতীক অকুতোভয় এক বীর যোদ্ধা সিলেট জেলার জৈন্তাপুর থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত তামাবিল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। সীমান্তের ওপারে ভারতের ডাউকি। তামাবিলের পশ্চিমে জাফলং।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ অবস্থান নেন ডাউকিতে। তাঁরা বেশির ভাগ ছিলেন ইপিআর সদস্য। কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম হোসেন (গোলাম হোসেন মোল্লা)।
অন্যদিকে, তামাবিল ও জাফলংয়ে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে তামাবিল ও জাফলংয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল তামাবিলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এই আক্রমণে সার্বিক নেতৃত্ব দেন বি আর চৌধুরী (তখন সুবেদার মেজর)। একটি দলের নেতৃত্ব দেন গোলাম হোসেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। ব্যতিব্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা পেছনে সরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। গোলাম হোসেন তাঁর দল নিয়ে তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। তাঁর সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন ও তছনছ হয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। এরপর সেনারা পালাতে শুরু করে। যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। তারা ফেলে যায় সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রী। মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলো ডাউকিতে নিয়ে যান। এই যুদ্ধে গোলাম হোসেন অসাধারণ রণকৌশল ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মূলত তাঁর রণকৌশলের জন্যই পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
এর কয়েক দিন পর গোলাম হোসেন একদল মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে জৈন্তাপুরে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করেন। সহযোদ্ধাদের নিয়ে একদিন রাতে তিনি ডাউকি থেকে রওনা দেন। সীমান্ত অতিক্রম করে শেষ রাতে পৌঁছেন জৈন্তাপুরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের চলাচলপথের এক স্থানে তাঁরা গোপনে অবস্থান নেন। সকাল হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাদের টহল দল সেখানে হাজির হওয়ামাত্র তাঁরা আক্রমণ করেন। এতে হতাহত হয় অনেক সেনা।
গোলাম হোসেন চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিলেট সেক্টরে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট তাঁদের আক্রমণ করে। সেই আক্রমণ তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন।
৪ এপ্রিল সিলেট শহরের টিবি হাসপাতালে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন গোলাম হোসেন। এখানে অনেকক্ষণ যুদ্ধ হয়। পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে খাদিমনগরে পালিয়ে যায়। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরে যুদ্ধ করেন ৫ নম্বর সেক্টরের ডাউকি সাবসেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গোলাম হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭৭। তাঁর প্রকৃত নাম গোলাম হোসেন মোল্লা।
গোলাম হোসেন মোল্লা ১৯৮১ সালে সুবেদার মেজর হিসেবে চট্টগ্রাম বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সেক্টরে কর্মরত থাকাবস্থায় কক্সবাজার জেলার হিমছড়িতে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁকে কক্সবাজার বিমানবন্দর-সংলগ্ন মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলার তুলাতুুলি গ্রামে। বাবার নাম মো. আফসার উদ্দিন মোল্লা, মা মমিনজান বেগম। স্ত্রী জাহানারা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
গোলাম হোসেন মোল্লার ছেলে আবুল কালাম মোল্লা বললেন, ‘বাবা যখন মারা যান তখন আমরা ভাইবোন সবাই ছোট ছিলাম। মা পেনশন ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা এককালীন কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। মা আমাদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। এ জন্য দুঃখ করি না। বরং মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানের জন্য আমরা গর্ববোধ করি।’
সূত্র: মো. আবুল কালাম মোল্লা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৫।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
অন্যদিকে, তামাবিল ও জাফলংয়ে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে তামাবিল ও জাফলংয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল তামাবিলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এই আক্রমণে সার্বিক নেতৃত্ব দেন বি আর চৌধুরী (তখন সুবেদার মেজর)। একটি দলের নেতৃত্ব দেন গোলাম হোসেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। ব্যতিব্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা পেছনে সরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। গোলাম হোসেন তাঁর দল নিয়ে তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। তাঁর সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন ও তছনছ হয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। এরপর সেনারা পালাতে শুরু করে। যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। তারা ফেলে যায় সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রী। মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলো ডাউকিতে নিয়ে যান। এই যুদ্ধে গোলাম হোসেন অসাধারণ রণকৌশল ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মূলত তাঁর রণকৌশলের জন্যই পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
এর কয়েক দিন পর গোলাম হোসেন একদল মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে জৈন্তাপুরে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করেন। সহযোদ্ধাদের নিয়ে একদিন রাতে তিনি ডাউকি থেকে রওনা দেন। সীমান্ত অতিক্রম করে শেষ রাতে পৌঁছেন জৈন্তাপুরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের চলাচলপথের এক স্থানে তাঁরা গোপনে অবস্থান নেন। সকাল হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাদের টহল দল সেখানে হাজির হওয়ামাত্র তাঁরা আক্রমণ করেন। এতে হতাহত হয় অনেক সেনা।
গোলাম হোসেন চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিলেট সেক্টরে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট তাঁদের আক্রমণ করে। সেই আক্রমণ তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন।
৪ এপ্রিল সিলেট শহরের টিবি হাসপাতালে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন গোলাম হোসেন। এখানে অনেকক্ষণ যুদ্ধ হয়। পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে খাদিমনগরে পালিয়ে যায়। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরে যুদ্ধ করেন ৫ নম্বর সেক্টরের ডাউকি সাবসেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গোলাম হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭৭। তাঁর প্রকৃত নাম গোলাম হোসেন মোল্লা।
গোলাম হোসেন মোল্লা ১৯৮১ সালে সুবেদার মেজর হিসেবে চট্টগ্রাম বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সেক্টরে কর্মরত থাকাবস্থায় কক্সবাজার জেলার হিমছড়িতে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁকে কক্সবাজার বিমানবন্দর-সংলগ্ন মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলার তুলাতুুলি গ্রামে। বাবার নাম মো. আফসার উদ্দিন মোল্লা, মা মমিনজান বেগম। স্ত্রী জাহানারা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
গোলাম হোসেন মোল্লার ছেলে আবুল কালাম মোল্লা বললেন, ‘বাবা যখন মারা যান তখন আমরা ভাইবোন সবাই ছোট ছিলাম। মা পেনশন ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা এককালীন কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। মা আমাদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। এ জন্য দুঃখ করি না। বরং মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানের জন্য আমরা গর্ববোধ করি।’
সূত্র: মো. আবুল কালাম মোল্লা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৫।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments