আবুল হোসেনের কবিতা আধুনিক জীবনের জয়গান
বাংলা কবিতা কার হাত ধরে আধুনিকতার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল প্রশ্নটার সরল উত্তর দেয়া অসাধ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার গতানুগতিক ধারা ভেঙ্গে ভিন্ন মেজাজের কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে তিরিশের কবি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন আধুনিক ধারার নব রূপায়ণ কবিতায় আরোপ করেন।
পাশ্চাত্য পৃথিবীর কল্লোল, উচ্ছ্বাস ও নিরীক্ষার প্রতিধ্বনি আমরা বাংলা কবিতায় শুনি।
নজরুল ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন। যে জাগরণ শুরু হয়েছিল আব্দুল কাদির, সুফিয়া কামাল, বেনজীর আহমেদ ও মহিউদ্দীনের মাধ্যমে তা চল্লিশে ভিন্ন মাত্রা পায় ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব ও আবুল হোসেনের কবিতার আধুনিক ধারায় এসে। অত্যুক্তি হবে না আবুল হোসেন (জন্ম ১৯২২) চল্লিশের কবিতার আন্যতম আধুনিক পথ পরিদর্শক।
১৯৪০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নব বসন্ত’ প্রকাশিত হয় হাবিবুল্লাহ বাহারের বুলবুল পাবলিশিং হাউজ থেকে। চল্লিশের অন্যান্য কবির আধুনিক কবিতা তখনো প্রকাশিত হয়নি। ফররখ আহমদের কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ ১৯৪৪ সালে, আহসান হাবীবের ‘রাত্রি শেষ’ কাব্যগ্রন্থ ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। চল্লিশ দশকের মনন্তর, রাজনৈতিক আবহ ও জাতিসত্তার অন্বেষণ কবি মানসে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কবিতা কর্মীরা কবিতায় স্বতন্ত্র্য অন্তস্বর আবিষ্কারে মগ্ন হন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় নবযুগকে আহ্বান করেন। সমর সেন খুবই স্পষ্ট অথচ তীক্ষè ভাষা ও বক্তব্যে পাঠককে আধুনিক কবিতার ভুবনে টেনে আনেন। কবি আবুল হোসেন উদ্দীপ্ত হয়ে তার কাব্যভাষা ও কাব্যরীতিতে পরিবর্তন আনেন। তার কবিতায় কয়েকটি প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি-
১. ছন্দ ভেঙ্গে তিনি সমিল কবিতা চর্চায় নিবেদিত থাকেন।
২. কবিতার ভাষা সাধারণ পাঠকের যাতে বোধগম্য থাকে তার চেষ্টা তিনি করেন।
৩. কবিতার বক্তব্য যেন সমকালীনতা অতিক্রম করে চিরকালের বাণীতে পরিণত হয় সেদিকে তিনি লক্ষ্য রাখেন।
কবিতার মেজাজ, বক্তব্য, রূপময়তা আবুল হোসেন গভীর মমতায় ধরে রেখেছেন। কবিরা যেন বিবৃতি, কাহিনীর বিস্তৃতি ও সেøাগান নির্ভর না হয়ে ওঠে, সেদিকে মনোযোগ রেখে কবি আবুল হোসেন কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন। তার কবিতায় চমক নিগূঢ় বক্তব্য ধারণ করে। কবিতা শুধুমাত্র কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতার মধ্য থেকে রহস্যময়তা ও নান্দনিক ভাবনার স্ফুরণ প্রকাশ করা সৎ, যোগ্য ও মেধাবী কবির স্বার্থক কর্ম; কবি আবুল হোসেন সে কাজটি নিখুঁতভাবে করেছেন। তিরিশের কবিরা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দিকে লক্ষ্য রেখে কবিতা নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের গদ্যভাষা আশা নিরাশার দোলাচালে দোদুল্যমান ছিল। আবুল হোসেন স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের সীমানা অতিক্রম করে মুক্ত ছন্দের ভুবনে নিজেকে জড়িয়ে নেন। ছন্দের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে তিনি সমিল কবিতা রচনায় নিবিষ্ট থাকেন। তার ‘বাংলার মেয়ে’ কবিতায় আমরা কাব্য নির্মাণ কৌশলের অভিনবত্ব অবলোকন করি। ছ’মাত্রার মাত্রা বৃত্তকে কথ্য রূপায়ণে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ধরা দিতে দেখা যায়। সৌন্দর্যহানি হয়নি বরং ঠিকরে পড়া অতুল জ্যোস্নার আলো তার কবিতায় প্লাবিত হয়। কবিতা নির্মাণের প্রকরণ ও বৈশিষ্ট্যতার অনেক কবিতায় (১৯৪০ এ রচিত) লক্ষ্য করি। কবিতা অনেকেই লেখেন। সবার কবিতা হৃদয়গ্রাহী ও বোধগম্য হয়ে ওঠে না। ব্যতিক্রম শব্দপ্রয়োগ, বক্তব্যের মাধুর্যতা, ভাব অলংকরণের মিশ্রণে কবিতাকে কিভাবে আকর্ষণীয় করা যায় আবুল হোসেন সার্থকভাবে তা করেছেন। তার চেনা ‘বাংলার মেয়ে’ অসাধারণ রূপময়তায় উদ্ভাসিত হয় :
‘আজকের দিনে রান্নাঘরে অন্ধকারের মাঝে যে মেয়েরা বসে টিনের বাসন মাজে; মসলা পিষতে চোখ ভরে আসে জলে তাদেরও অন্ধ জীবনের তলে ঝুঁকি মারে রাজকুমার।
পেঁয়াজ কাটার ফাঁকে মনের গহনে রবিঠাকুরের একটি লাইন
হয়ত চিত্র আঁকে, হয়ত কখনও মনে তোলা শেলীর
একটি কবিতা, আত্মভোলা কীটসের অমর ওদগুলো,
হয়তো পথের ধূলো সংবাদ আনে রাজকুমারের আগমনের;
সুপ্ত মনের আড়ালে দেয়া পর্দাটা যায় ফেঁসে একটি নিমেষে।
বোরখার বেড়া ভেঙ্গে ছুটে আসে মালবিকা মদনিকা
রাজকুমার টিকা কপালে তার : সে ও খুঁজে রাজকুমারী।’
আবুল হোসেন ‘নব বসন্ত’ কাব্য গ্রন্থে ১৯৪০-এ যে দীপ্ত ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন তা পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘বিরস সংলাপ’ (১৯৬৯), ‘তোমার দুঃসাহস’ (১৯৮২) -এ দুঃস্বপ্ন থেকে স্বপ্নে ক্রমাগত পরিণত ঋজু ও লক্ষ্যভেদী হয়েছেন। কবি, সময়ের বিভিন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেন। হোসেন আবহমান বাংলার পারিবারিক রূপচিত্র কবিতায় বন্দী করেছেন। তিনি যখন কবিতা চর্চা শুরু করেন, তার সামনে ছিল সামন্তবাদী সমাজ। এ সময়ে সমাজতন্ত্র বিশ্বের আকাক্সক্ষা কবি চিত্তে নতুন ভাবনার দ্যোতনা তৈরি করে। বাতাসে পরিবর্তনের হাওয়া অনুরিত হয়। কবি, সমাজ সংসারের প্রতিনিধি হিসাবে শান্তির পক্ষে অবস্থান নেন।
যুদ্ধ মানবজীবনের অপচয় শুধু করে না, বিনাশ করে সমগ্র মানব জাতির অগ্রগতি। কবি আকক্সক্ষা করেন যুদ্ধের সরঞ্জাম যদি সবুজ কচি ধানের বীজে অঙ্কুরোদ্গম ঘটাত কী ভালই না হতো!
আবুল হোসেন উচ্চারণ করেন :
‘আমরা বিদ্রোহী নই
আমরা ক্ষুধার্ত
ডাল ভাত রুটি আলো হাওয়া আরেকটু আশ্রয়
আপাতত আর কিছু নয়।’ [পটভূমি]
আবুল হোসেনের হৃদয়স্পর্শী কবিতা ডায়নামো, আমার সোনার দেশ, মেহেদীর জন্য কবিতা ইত্যাদি। নব বসন্ত কাব্যগ্রন্থে কবিতাকে গ্রহণীয় করতে যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর কাব্যিকতার পলেস্তরা ছিল তা ক্রমাগত নিরাভরণ ও সঙ্গত হয়েছে। আবুল হোসেন আবেগময় পঙ্ক্তি রচনায় মনোযোগী না হয়ে জগত সংসারের সমাজ পরিবর্তন, সচেতনতা যুক্ত করেছেন। তার কবিতায় পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ আগ্রহের বিষয়। দীর্ঘ কবিতা নয়, হ্রস্ব কবিতা কিংবা সাধারণ মানুষের ভাবনা ধারণ করে যতখানি ততটুকু ও তার বলার বিষয় নির্মাণে কুশলতা দক্ষ কবির পরিচয় দেয়। রোমান্টিক ভাবনায় কবিতা রচনায় তার সমসাময়িক কবিরা যখন ব্যস্ত তখন কবি আবুল হোসেন বাস্তবতার পথ ধরে দুস্তর হেঁটেছেন। সংগ্রহ করেছেন কবিতার উপাদান। কবিতার মৌখিক ভাষাকে কবিতার ভাষায় রূপান্তরিত করার কৃতিত্ব তার। তার রচিত সনেটে কথ্য ভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়।
কবি আবুল হোসেন কবিতা হৃদয়গ্রাহী করতে যতœশীল। ঘোড়সোয়ার কবিতায় কবি শব্দ ব্যবহার ও বর্ণনায় এক ধরনের মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণ শব্দ, বর্ণনার মাধুর্যতা অসাধারণ কাব্যময় হয়ে ওঠে তার কবিতায় :
‘দূরন্ত বেগে উড়ন্ত মেয়ে
শার্সির কাঁচে লেগে
চিনেমাটির টুনটুনে
পবন খানখান।
বারবার ছাড়বার নাম্বার
থামবার ঘূর্ণিত চক্রে
চক্ষে বক্ষে অন্তরীক্ষে
পর্বত ঘর্ঘর
পর্বত পর্বত পর্বত
বর্বর বর্বর বর্বর
বর্বর ঝকঝক ঝকঝক পাথর
ঝকঝক ঝিকমিক চিকচিক
কাঞ্চন ঝনঝন জংঘা’
আবুল হোসেন, অমিয় চক্রবর্তী ও সমর সেন প্রভাবিত কবিদের একজন। তার কবিতার ভাষা আকর্ষণীয়। এমনকি শব্দ নির্বাচনে তার পক্ষপাত সহজে পাঠককে আকর্ষিত করে। জটিল নয়, সাধারণের বোধগম্য ভাব ও ভাষা ব্যবহার করে হোসেন তার কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছেন। তিনি বলেন :
‘কোনদিকে যাব, ডাইনে না বাঁয়ে-
পথটা সোজা না বাঁয়ে না ডাইনে
জানিনে জানতে চাইনে
শুধু জানি এই সেটা নিজেকেই
নিতে হবে চিনে যথাসময়ে’ [ দিক নির্ণয় ]
কবির আমি শুধু তিনি নিজে নন, তার পাঠক। তার সমাজের মানুষ তার কাছে ধরা দেয়। তাদের পথ ও পথের সীমানা চিহ্নিত করার দায়িত্ব তার। ‘বিরস সংলাপ’ কাব্যগ্রন্থে মৌখিক ভাষাকে কবিতায় আপন করে নিয়েছেন কবি আবুল হোসেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি এ ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে মতামত তুলে ধরেছিলেন :
‘কবি অসাধারণ কিছু নয় বলেই তার ভাষা অসাধারণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ ভাষাকে বাছাই করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্যবহার করেন কবি। যে ভাষায় আমরা ঘরে বাইরে, পথে ঘাটে, বাজারে, অফিস আদালতের কথাবার্তা চালাই, আলাপ আলোচনা করি, সে ভাষাতেই কবিতা লিখতে চাই।’
সাধারণ ভাষায় যা বলা হয় তা সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে। পাঠক চারপাশের ঘটনা পরম্পরায় যুক্ত হতে পারেন সহজে। আবুল হোসেন একটি ছেলের বর্ণনা দেন যে, সমাজের মধ্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করে। তার পরিচিতি ব্যপ্ত হয় :
‘আমার ছেলেটা খেলে লনে রোদ্দুরে আপনমনে
শুনি তার নেই কেউ কেয়ারও করে না। দুই হাতে
বাগিয়ে পিস্তল ছুটে যায় কল্পিত ঘোড়ায় চড়ে
সম্মুখ সমরে। মারে শত্রু নির্বিচারে। কখনো বা
গুলি খেয়ে নিজেই মাটিতে পড়ে। সময়ের ধার
ধারে না সে।
খেলছে সমস্ত সকাল’ [ আমার ছেলেটা ]
কবি আবুল হোসেন ভাষার ভারি পোশাক খুলে ফেলেছেন। পরিয়েছেন সাধারণ আবরণ। চারপাশের দৃশ্যমান বস্তুর দিকে তাকিয়ে তিনি কথা বলতে চেয়েছেন। বহু ইংরেজী শব্দ বাংলা কবিতায় ব্যবহার করে তাকে মাধুর্য্যময় করে তুলেছেন। পথ চলাতে মগ্ন কবি, বাহন, প্রকৃতি ও বন্দনা নিয়ে অবিরাম চলার আনন্দে বিভোর থেকেছেন। হোসেন দীর্ঘশ্বাসে নয়, অভিজ্ঞতা ও অভ্যস্ততায় দিনরাত্রির গল্পকথা তুলে এনেছেন। পৃথিবী তার কাছে প্রশান্তির। তার চারপাশের অনেক বিষয় তার সৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে। হৃদয়ের আলোড়ন, চারপাশের দুঃসংবাদ, প্রকৃতির রুদ্র তরঙ্গ তার কবিতার ভূভাগে আছড়ে পড়ে। তিনি দৃষ্টিকে সামনে মেলে দিয়েছেন :
‘সবে যখন হাঁটতে বেরিয়েছি, কোত্থেকে এলো কালবৈশাখী
ছুটে এলো উপড়ে ফেলা লাইনের মধ্যে ব্রেক ভাঙ্গা
ট্রেনের মতো। এবং আমি সেই পাগলা গাড়ির
হামলা থেকে বাঁচবার জন্য ছুটছি।’ [দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে]
আবুল হোসেন নাগরিক কবি। নগরের দৃশ্যমান বস্তু তার কবিতায় অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হয়ে দেখা দেয়। তিনি চল্লিশ দশকে যে কবিতাসমূহ রচনা করেছেন আজো তা সমকালীন, উত্তর আধুনিক। তার কবিতা সমগ্র ও নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচরণের সংলাপ লিপিবদ্ধ হয়েছে।
রবার্ট ফ্রস্ট ও এজরা পাউন্ডের গদ্য কবিতায় যে মুক্তি অন্বেষণ আমরা প্রত্যক্ষ করি তার নবরূপায়ণ তার কবিতায় বরাবর উঠে আসে। আবুল হোসেন স্বপ্নচারী কবি নন। বর্তমান নিয়ে তার কাব্য ভুবনের অন্তর্ভাগ রচিত। বর্তমান সময় তাকে তাড়িত করে। সহিষ্ণু জীবন, চলিষ্ণু সময় ও যাপিত জীবন তাকে বারবার স্মৃতি, বাস্তবতা আর স্বপ্নময়তার কাছে নিয়ে যায়। ইতিবাচকতা তার কবিতার মৌল প্রবণতা। আমরা মানতে বাধ্য, যে সময় ধরে আমরা সামনে এগুচ্ছি তা দুঃস্বপ্ন, দুঃখকষ্ট ও ক্ষরিত বেদনাবোধে আক্রান্ত। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচায়, বর্তমান ভবিষ্যতকে শক্তিময় করে। বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। এত স্থির নিমগ্ন কবি বারবার চেনা পৃথিবীর দিকে তাকান :
‘সেই ঝরঝর করে আকাশে ব্যালেরিনারা
বাঙলার ঘাসের স্টেজে নরম নদীর কার্পেটে নামে
টাপুর টুপুর খিলখিল করে নেচে খেলে
সমস্ত দুপুর সকাল বিকেল কখনো সখনো সারারাত
সেই যারা বঙ্গোপসাগর থেকে বর্মী পাঠায়
বৎসারাম্ভে হাওয়া বদলাতে আসে সুনামগঞ্জের হাওড়ে
চিলমারির বিলে, ফুরুফুর করে বেড়ায়
কুয়াশার স্টোল গায়ে দিয়ে
এরা তারা নয়।
এই যে এগিয়ে আসা ট্রেনের মতো ব্যাংককের টালির ছাদে
কাঁচের দেয়ালে হড়হড় করে পড়ে নেমে যায়
ময়লা খোলা পানির ক্লথ দিয়ে অথবা
দুলে দুলে হিশ হিশ শব্দে লকলকে জিভে
কাটতে চায় খোলা মাঠে মোষের পিঠে বসা ছেলেটাকে
নয়তো পাড়াময় ট্রানজিস্টর রেডিওর সংগে পাল্লা দিয়ে
টিভির বক্সিং রিং ভেঙ্গে আসে
এরা কারো নির্জন দুপুরে নিঃসঙ্গ রাত্রীর সঙ্গী নয়’ [ব্যাঙ্ককে বৃষ্টি]
কবি যে মানুষদের কথা বললেন তাদের সাথে পাঠকদের চেনা জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সংগ্রামী মানুষ ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের কাছ থেকে স্বতন্ত্র। আবেগ ও জীবনবোধে উজ্জীবিত সে কথা স্বীকার করে নিয়েই কবি তার কবিতার আন্তর্জাতিক ভুবনে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তার কবিতা আজীবন অভিজ্ঞতা ধার করে। এক ধরনের নিরাসক্তি সবসময় প্রবল এমন কথা বলা যাবে না। কবির চোখে স্বদেশ, স্বজাতি, ঐতিহ্য, অন্বেষা তীব্রভাবে আলোড়িত। তিনি আধুনিক কবিতার দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মাঝে তাকিয়ে কবি আবুল হোসেন জীবনকে স্বপ্ন ও জাগরনে যুক্ত করেন। মধ্যবিত্ত নগর মানুষ আলাপচারিতায় মত্ত হয়। কবি এই আলাপচারিতার অভিধান ঘেটে শব্দ নির্বাচন করে কবিতার মালা তৈরি করেন। দৈনন্দিন জীবনে যা ঘটছে, আমরা যা করি, তা পুংখানুপুংখভাবে কবিতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করেছেন তিনি :
১. মাফ করবেন মিস-আপনার জন্য এ উপদেশ ইশ- এখনো রয়েছে [প্রেম অপ্রেমের কবিতা : বিরস সংলাপ]
২. সে যখন খবরটা প্রথম শুনেÑ তার মাথার উপর ফাঁসির দড়ি ঝুলছে - আসলে তার কাছে দিনরাতগুলো - এমন মাদকতা নিয়ে আসে অন্তঋণের কোন চিহ্ন সে দেখে নাÑ কোনখানে সে যখন যেখানে ইচ্ছেÑনির্বিবাদে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়ায়Ñ আর তখনই জল্লাদ এসে দাঁড়ায় দরজায়। [ফাঁসির কয়েদী : কালি ও কলম]
চল্লিশ দশকে আবুল হোসেন সাওয়ার হয়েছিলেন আধুনিক কবিতার সম্মেলনে। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার কবিতা জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষণ, আত্ম পরিচয় উন্মোচন ও যাপিত জীবনকে অবলম্বন করে এগিয়েছে।
সাইফুজ্জামান
নজরুল ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন। যে জাগরণ শুরু হয়েছিল আব্দুল কাদির, সুফিয়া কামাল, বেনজীর আহমেদ ও মহিউদ্দীনের মাধ্যমে তা চল্লিশে ভিন্ন মাত্রা পায় ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব ও আবুল হোসেনের কবিতার আধুনিক ধারায় এসে। অত্যুক্তি হবে না আবুল হোসেন (জন্ম ১৯২২) চল্লিশের কবিতার আন্যতম আধুনিক পথ পরিদর্শক।
১৯৪০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নব বসন্ত’ প্রকাশিত হয় হাবিবুল্লাহ বাহারের বুলবুল পাবলিশিং হাউজ থেকে। চল্লিশের অন্যান্য কবির আধুনিক কবিতা তখনো প্রকাশিত হয়নি। ফররখ আহমদের কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ ১৯৪৪ সালে, আহসান হাবীবের ‘রাত্রি শেষ’ কাব্যগ্রন্থ ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। চল্লিশ দশকের মনন্তর, রাজনৈতিক আবহ ও জাতিসত্তার অন্বেষণ কবি মানসে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কবিতা কর্মীরা কবিতায় স্বতন্ত্র্য অন্তস্বর আবিষ্কারে মগ্ন হন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় নবযুগকে আহ্বান করেন। সমর সেন খুবই স্পষ্ট অথচ তীক্ষè ভাষা ও বক্তব্যে পাঠককে আধুনিক কবিতার ভুবনে টেনে আনেন। কবি আবুল হোসেন উদ্দীপ্ত হয়ে তার কাব্যভাষা ও কাব্যরীতিতে পরিবর্তন আনেন। তার কবিতায় কয়েকটি প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি-
১. ছন্দ ভেঙ্গে তিনি সমিল কবিতা চর্চায় নিবেদিত থাকেন।
২. কবিতার ভাষা সাধারণ পাঠকের যাতে বোধগম্য থাকে তার চেষ্টা তিনি করেন।
৩. কবিতার বক্তব্য যেন সমকালীনতা অতিক্রম করে চিরকালের বাণীতে পরিণত হয় সেদিকে তিনি লক্ষ্য রাখেন।
কবিতার মেজাজ, বক্তব্য, রূপময়তা আবুল হোসেন গভীর মমতায় ধরে রেখেছেন। কবিরা যেন বিবৃতি, কাহিনীর বিস্তৃতি ও সেøাগান নির্ভর না হয়ে ওঠে, সেদিকে মনোযোগ রেখে কবি আবুল হোসেন কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন। তার কবিতায় চমক নিগূঢ় বক্তব্য ধারণ করে। কবিতা শুধুমাত্র কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতার মধ্য থেকে রহস্যময়তা ও নান্দনিক ভাবনার স্ফুরণ প্রকাশ করা সৎ, যোগ্য ও মেধাবী কবির স্বার্থক কর্ম; কবি আবুল হোসেন সে কাজটি নিখুঁতভাবে করেছেন। তিরিশের কবিরা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দিকে লক্ষ্য রেখে কবিতা নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের গদ্যভাষা আশা নিরাশার দোলাচালে দোদুল্যমান ছিল। আবুল হোসেন স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের সীমানা অতিক্রম করে মুক্ত ছন্দের ভুবনে নিজেকে জড়িয়ে নেন। ছন্দের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে তিনি সমিল কবিতা রচনায় নিবিষ্ট থাকেন। তার ‘বাংলার মেয়ে’ কবিতায় আমরা কাব্য নির্মাণ কৌশলের অভিনবত্ব অবলোকন করি। ছ’মাত্রার মাত্রা বৃত্তকে কথ্য রূপায়ণে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ধরা দিতে দেখা যায়। সৌন্দর্যহানি হয়নি বরং ঠিকরে পড়া অতুল জ্যোস্নার আলো তার কবিতায় প্লাবিত হয়। কবিতা নির্মাণের প্রকরণ ও বৈশিষ্ট্যতার অনেক কবিতায় (১৯৪০ এ রচিত) লক্ষ্য করি। কবিতা অনেকেই লেখেন। সবার কবিতা হৃদয়গ্রাহী ও বোধগম্য হয়ে ওঠে না। ব্যতিক্রম শব্দপ্রয়োগ, বক্তব্যের মাধুর্যতা, ভাব অলংকরণের মিশ্রণে কবিতাকে কিভাবে আকর্ষণীয় করা যায় আবুল হোসেন সার্থকভাবে তা করেছেন। তার চেনা ‘বাংলার মেয়ে’ অসাধারণ রূপময়তায় উদ্ভাসিত হয় :
‘আজকের দিনে রান্নাঘরে অন্ধকারের মাঝে যে মেয়েরা বসে টিনের বাসন মাজে; মসলা পিষতে চোখ ভরে আসে জলে তাদেরও অন্ধ জীবনের তলে ঝুঁকি মারে রাজকুমার।
পেঁয়াজ কাটার ফাঁকে মনের গহনে রবিঠাকুরের একটি লাইন
হয়ত চিত্র আঁকে, হয়ত কখনও মনে তোলা শেলীর
একটি কবিতা, আত্মভোলা কীটসের অমর ওদগুলো,
হয়তো পথের ধূলো সংবাদ আনে রাজকুমারের আগমনের;
সুপ্ত মনের আড়ালে দেয়া পর্দাটা যায় ফেঁসে একটি নিমেষে।
বোরখার বেড়া ভেঙ্গে ছুটে আসে মালবিকা মদনিকা
রাজকুমার টিকা কপালে তার : সে ও খুঁজে রাজকুমারী।’
আবুল হোসেন ‘নব বসন্ত’ কাব্য গ্রন্থে ১৯৪০-এ যে দীপ্ত ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন তা পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘বিরস সংলাপ’ (১৯৬৯), ‘তোমার দুঃসাহস’ (১৯৮২) -এ দুঃস্বপ্ন থেকে স্বপ্নে ক্রমাগত পরিণত ঋজু ও লক্ষ্যভেদী হয়েছেন। কবি, সময়ের বিভিন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেন। হোসেন আবহমান বাংলার পারিবারিক রূপচিত্র কবিতায় বন্দী করেছেন। তিনি যখন কবিতা চর্চা শুরু করেন, তার সামনে ছিল সামন্তবাদী সমাজ। এ সময়ে সমাজতন্ত্র বিশ্বের আকাক্সক্ষা কবি চিত্তে নতুন ভাবনার দ্যোতনা তৈরি করে। বাতাসে পরিবর্তনের হাওয়া অনুরিত হয়। কবি, সমাজ সংসারের প্রতিনিধি হিসাবে শান্তির পক্ষে অবস্থান নেন।
যুদ্ধ মানবজীবনের অপচয় শুধু করে না, বিনাশ করে সমগ্র মানব জাতির অগ্রগতি। কবি আকক্সক্ষা করেন যুদ্ধের সরঞ্জাম যদি সবুজ কচি ধানের বীজে অঙ্কুরোদ্গম ঘটাত কী ভালই না হতো!
আবুল হোসেন উচ্চারণ করেন :
‘আমরা বিদ্রোহী নই
আমরা ক্ষুধার্ত
ডাল ভাত রুটি আলো হাওয়া আরেকটু আশ্রয়
আপাতত আর কিছু নয়।’ [পটভূমি]
আবুল হোসেনের হৃদয়স্পর্শী কবিতা ডায়নামো, আমার সোনার দেশ, মেহেদীর জন্য কবিতা ইত্যাদি। নব বসন্ত কাব্যগ্রন্থে কবিতাকে গ্রহণীয় করতে যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর কাব্যিকতার পলেস্তরা ছিল তা ক্রমাগত নিরাভরণ ও সঙ্গত হয়েছে। আবুল হোসেন আবেগময় পঙ্ক্তি রচনায় মনোযোগী না হয়ে জগত সংসারের সমাজ পরিবর্তন, সচেতনতা যুক্ত করেছেন। তার কবিতায় পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ আগ্রহের বিষয়। দীর্ঘ কবিতা নয়, হ্রস্ব কবিতা কিংবা সাধারণ মানুষের ভাবনা ধারণ করে যতখানি ততটুকু ও তার বলার বিষয় নির্মাণে কুশলতা দক্ষ কবির পরিচয় দেয়। রোমান্টিক ভাবনায় কবিতা রচনায় তার সমসাময়িক কবিরা যখন ব্যস্ত তখন কবি আবুল হোসেন বাস্তবতার পথ ধরে দুস্তর হেঁটেছেন। সংগ্রহ করেছেন কবিতার উপাদান। কবিতার মৌখিক ভাষাকে কবিতার ভাষায় রূপান্তরিত করার কৃতিত্ব তার। তার রচিত সনেটে কথ্য ভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়।
কবি আবুল হোসেন কবিতা হৃদয়গ্রাহী করতে যতœশীল। ঘোড়সোয়ার কবিতায় কবি শব্দ ব্যবহার ও বর্ণনায় এক ধরনের মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণ শব্দ, বর্ণনার মাধুর্যতা অসাধারণ কাব্যময় হয়ে ওঠে তার কবিতায় :
‘দূরন্ত বেগে উড়ন্ত মেয়ে
শার্সির কাঁচে লেগে
চিনেমাটির টুনটুনে
পবন খানখান।
বারবার ছাড়বার নাম্বার
থামবার ঘূর্ণিত চক্রে
চক্ষে বক্ষে অন্তরীক্ষে
পর্বত ঘর্ঘর
পর্বত পর্বত পর্বত
বর্বর বর্বর বর্বর
বর্বর ঝকঝক ঝকঝক পাথর
ঝকঝক ঝিকমিক চিকচিক
কাঞ্চন ঝনঝন জংঘা’
আবুল হোসেন, অমিয় চক্রবর্তী ও সমর সেন প্রভাবিত কবিদের একজন। তার কবিতার ভাষা আকর্ষণীয়। এমনকি শব্দ নির্বাচনে তার পক্ষপাত সহজে পাঠককে আকর্ষিত করে। জটিল নয়, সাধারণের বোধগম্য ভাব ও ভাষা ব্যবহার করে হোসেন তার কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছেন। তিনি বলেন :
‘কোনদিকে যাব, ডাইনে না বাঁয়ে-
পথটা সোজা না বাঁয়ে না ডাইনে
জানিনে জানতে চাইনে
শুধু জানি এই সেটা নিজেকেই
নিতে হবে চিনে যথাসময়ে’ [ দিক নির্ণয় ]
কবির আমি শুধু তিনি নিজে নন, তার পাঠক। তার সমাজের মানুষ তার কাছে ধরা দেয়। তাদের পথ ও পথের সীমানা চিহ্নিত করার দায়িত্ব তার। ‘বিরস সংলাপ’ কাব্যগ্রন্থে মৌখিক ভাষাকে কবিতায় আপন করে নিয়েছেন কবি আবুল হোসেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি এ ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে মতামত তুলে ধরেছিলেন :
‘কবি অসাধারণ কিছু নয় বলেই তার ভাষা অসাধারণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ ভাষাকে বাছাই করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্যবহার করেন কবি। যে ভাষায় আমরা ঘরে বাইরে, পথে ঘাটে, বাজারে, অফিস আদালতের কথাবার্তা চালাই, আলাপ আলোচনা করি, সে ভাষাতেই কবিতা লিখতে চাই।’
সাধারণ ভাষায় যা বলা হয় তা সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে। পাঠক চারপাশের ঘটনা পরম্পরায় যুক্ত হতে পারেন সহজে। আবুল হোসেন একটি ছেলের বর্ণনা দেন যে, সমাজের মধ্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করে। তার পরিচিতি ব্যপ্ত হয় :
‘আমার ছেলেটা খেলে লনে রোদ্দুরে আপনমনে
শুনি তার নেই কেউ কেয়ারও করে না। দুই হাতে
বাগিয়ে পিস্তল ছুটে যায় কল্পিত ঘোড়ায় চড়ে
সম্মুখ সমরে। মারে শত্রু নির্বিচারে। কখনো বা
গুলি খেয়ে নিজেই মাটিতে পড়ে। সময়ের ধার
ধারে না সে।
খেলছে সমস্ত সকাল’ [ আমার ছেলেটা ]
কবি আবুল হোসেন ভাষার ভারি পোশাক খুলে ফেলেছেন। পরিয়েছেন সাধারণ আবরণ। চারপাশের দৃশ্যমান বস্তুর দিকে তাকিয়ে তিনি কথা বলতে চেয়েছেন। বহু ইংরেজী শব্দ বাংলা কবিতায় ব্যবহার করে তাকে মাধুর্য্যময় করে তুলেছেন। পথ চলাতে মগ্ন কবি, বাহন, প্রকৃতি ও বন্দনা নিয়ে অবিরাম চলার আনন্দে বিভোর থেকেছেন। হোসেন দীর্ঘশ্বাসে নয়, অভিজ্ঞতা ও অভ্যস্ততায় দিনরাত্রির গল্পকথা তুলে এনেছেন। পৃথিবী তার কাছে প্রশান্তির। তার চারপাশের অনেক বিষয় তার সৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে। হৃদয়ের আলোড়ন, চারপাশের দুঃসংবাদ, প্রকৃতির রুদ্র তরঙ্গ তার কবিতার ভূভাগে আছড়ে পড়ে। তিনি দৃষ্টিকে সামনে মেলে দিয়েছেন :
‘সবে যখন হাঁটতে বেরিয়েছি, কোত্থেকে এলো কালবৈশাখী
ছুটে এলো উপড়ে ফেলা লাইনের মধ্যে ব্রেক ভাঙ্গা
ট্রেনের মতো। এবং আমি সেই পাগলা গাড়ির
হামলা থেকে বাঁচবার জন্য ছুটছি।’ [দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে]
আবুল হোসেন নাগরিক কবি। নগরের দৃশ্যমান বস্তু তার কবিতায় অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হয়ে দেখা দেয়। তিনি চল্লিশ দশকে যে কবিতাসমূহ রচনা করেছেন আজো তা সমকালীন, উত্তর আধুনিক। তার কবিতা সমগ্র ও নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচরণের সংলাপ লিপিবদ্ধ হয়েছে।
রবার্ট ফ্রস্ট ও এজরা পাউন্ডের গদ্য কবিতায় যে মুক্তি অন্বেষণ আমরা প্রত্যক্ষ করি তার নবরূপায়ণ তার কবিতায় বরাবর উঠে আসে। আবুল হোসেন স্বপ্নচারী কবি নন। বর্তমান নিয়ে তার কাব্য ভুবনের অন্তর্ভাগ রচিত। বর্তমান সময় তাকে তাড়িত করে। সহিষ্ণু জীবন, চলিষ্ণু সময় ও যাপিত জীবন তাকে বারবার স্মৃতি, বাস্তবতা আর স্বপ্নময়তার কাছে নিয়ে যায়। ইতিবাচকতা তার কবিতার মৌল প্রবণতা। আমরা মানতে বাধ্য, যে সময় ধরে আমরা সামনে এগুচ্ছি তা দুঃস্বপ্ন, দুঃখকষ্ট ও ক্ষরিত বেদনাবোধে আক্রান্ত। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচায়, বর্তমান ভবিষ্যতকে শক্তিময় করে। বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। এত স্থির নিমগ্ন কবি বারবার চেনা পৃথিবীর দিকে তাকান :
‘সেই ঝরঝর করে আকাশে ব্যালেরিনারা
বাঙলার ঘাসের স্টেজে নরম নদীর কার্পেটে নামে
টাপুর টুপুর খিলখিল করে নেচে খেলে
সমস্ত দুপুর সকাল বিকেল কখনো সখনো সারারাত
সেই যারা বঙ্গোপসাগর থেকে বর্মী পাঠায়
বৎসারাম্ভে হাওয়া বদলাতে আসে সুনামগঞ্জের হাওড়ে
চিলমারির বিলে, ফুরুফুর করে বেড়ায়
কুয়াশার স্টোল গায়ে দিয়ে
এরা তারা নয়।
এই যে এগিয়ে আসা ট্রেনের মতো ব্যাংককের টালির ছাদে
কাঁচের দেয়ালে হড়হড় করে পড়ে নেমে যায়
ময়লা খোলা পানির ক্লথ দিয়ে অথবা
দুলে দুলে হিশ হিশ শব্দে লকলকে জিভে
কাটতে চায় খোলা মাঠে মোষের পিঠে বসা ছেলেটাকে
নয়তো পাড়াময় ট্রানজিস্টর রেডিওর সংগে পাল্লা দিয়ে
টিভির বক্সিং রিং ভেঙ্গে আসে
এরা কারো নির্জন দুপুরে নিঃসঙ্গ রাত্রীর সঙ্গী নয়’ [ব্যাঙ্ককে বৃষ্টি]
কবি যে মানুষদের কথা বললেন তাদের সাথে পাঠকদের চেনা জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সংগ্রামী মানুষ ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের কাছ থেকে স্বতন্ত্র। আবেগ ও জীবনবোধে উজ্জীবিত সে কথা স্বীকার করে নিয়েই কবি তার কবিতার আন্তর্জাতিক ভুবনে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তার কবিতা আজীবন অভিজ্ঞতা ধার করে। এক ধরনের নিরাসক্তি সবসময় প্রবল এমন কথা বলা যাবে না। কবির চোখে স্বদেশ, স্বজাতি, ঐতিহ্য, অন্বেষা তীব্রভাবে আলোড়িত। তিনি আধুনিক কবিতার দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মাঝে তাকিয়ে কবি আবুল হোসেন জীবনকে স্বপ্ন ও জাগরনে যুক্ত করেন। মধ্যবিত্ত নগর মানুষ আলাপচারিতায় মত্ত হয়। কবি এই আলাপচারিতার অভিধান ঘেটে শব্দ নির্বাচন করে কবিতার মালা তৈরি করেন। দৈনন্দিন জীবনে যা ঘটছে, আমরা যা করি, তা পুংখানুপুংখভাবে কবিতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করেছেন তিনি :
১. মাফ করবেন মিস-আপনার জন্য এ উপদেশ ইশ- এখনো রয়েছে [প্রেম অপ্রেমের কবিতা : বিরস সংলাপ]
২. সে যখন খবরটা প্রথম শুনেÑ তার মাথার উপর ফাঁসির দড়ি ঝুলছে - আসলে তার কাছে দিনরাতগুলো - এমন মাদকতা নিয়ে আসে অন্তঋণের কোন চিহ্ন সে দেখে নাÑ কোনখানে সে যখন যেখানে ইচ্ছেÑনির্বিবাদে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়ায়Ñ আর তখনই জল্লাদ এসে দাঁড়ায় দরজায়। [ফাঁসির কয়েদী : কালি ও কলম]
চল্লিশ দশকে আবুল হোসেন সাওয়ার হয়েছিলেন আধুনিক কবিতার সম্মেলনে। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার কবিতা জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষণ, আত্ম পরিচয় উন্মোচন ও যাপিত জীবনকে অবলম্বন করে এগিয়েছে।
সাইফুজ্জামান
No comments