অলিম্পিকে জলদানব মাইকেল ফেলপ্্স by এম এ মোমেন
মূর্র্খ মাঝি পড়তে জানে না, গুনতে জানে না, রসায়ন-দর্শন-অর্থনীতি কিছুই জানে না। সুতরাং তার নৌকায় আরোহী বাবু হিসেব করে দেখালেন দু’আনা চার আনা করে মাঝির জীবনটা চৌদ্দ আনাই মিছে। এমন সময় নদীতে ঝড় উঠল, নৌকা দুলতে শুরু করল, আতঙ্কিত বাবুর জীবন যায় যায় অবস্থা।
বাবু সাঁতার জানে কিনা মাঝির এ প্রশ্নে বাবু লা জবাব। মাঝি বলল, ‘তোমার দেখি জীবনখানা ষোলো আনাই মিছে।’ বাবু কাবু হয়ে গেলেন।
সাঁতারের আর একটি দৃশ্য আমাদের প্রায় সবারই মনে গাঁথা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তখন কৈশোর। মাকে দেখতে কলকাতা থেকে মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে যাচ্ছেন। পথে খরস্রোতা দামোদর নদী। অন্ধকার রাত, প্রচ- ঝড়, একটি নৌকাও নেই ঘাটে। ঈশ্বরচন্দ্র সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না। নৌকা না থাকে না থাক, সাঁতরেই নদী পার হবেন!
সাঁতার এ কালের কোন বিষয় নয়। একালে সাঁতারে বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে কেবল। প্রাগৈতিহাসিক আমলে, প্রস্তরযুগে ৭০০০ বছরেরও বেশি সময় আগের গুহা-ছবিতে সাঁতার কাটার ছবি খোদাই করা হয়েছে। তিন থেকে চার হাজার বছর আগে সাঁতার কাহিনী মানুষ প্রচার করতে শুরু করেছে। গিলগামেশ, বেওলফ-এ তো রয়েছেই, ইলিয়াড ও ওডেসিতে হোমার সাঁতারের বর্ণনা দিয়েছেন। সাঁতারের কথা বাইবেলেও রয়েছে। ১৮০০ সালের দিকে ইউরোপে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে সাঁতারের শুভযাত্রা। প্রথম আধুনিক অলিম্পিক ১৮৯৬ সালের এ্যাথেন্স অলিম্পিকে প্রতিযোগিতার ইভেন্ট হিসেবে সাঁতার শুরু হয়। ১৯০৮ সালে গঠিত হয় বিশ্ব সাঁতার ফেডারেশন ফিনা। সাধারণভাবে সাঁতারের স্টাইল : ফ্রন্ট ক্রল, ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্টস্ট্রোক এবং বাটারফ্লাই। সবশেষে গৃহীত হয় বাটারফ্লাই ১৯৫২ সালে।
নারী ও পুরুষের ফিনা-স্বীকৃত সাঁতার
সাঁতার নারী ও পুরুষের যে সমস্ত ইভেন্টে বিশ্বরেকর্ড স্বীকৃত সেগুলো হচ্ছে-
ফ্রিস্টাইল : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার, ৮০০ মিটার এবং ১৫০০ মিটার
ব্যাকস্ট্রোক : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার
ব্রেস্টস্ট্রোক : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার
বাটারফ্লাই : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার
ব্যক্তিগত মিডলে : ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার
রিলে : ৪ী১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ৪ী২১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ৪ী১০০ মিটার মেডলে।
এখন তো সাঁতারের সব ইভেন্টই সুইমিং পুলে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম চারটি অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় উন্মুক্ত সাগরে, নদীতে, খালে। ১৮৯৬ সালে প্রথম এ্যাথেন্স অলিম্পিকে সাঁতারে ভ্যানু ভূমধ্যসাগর। ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে সিন নদী। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুই অলিম্পিকে খাল। ১৯০৪ এর অলিম্পিকে ফ্রিস্টাইল সাঁতার মাপা হয় ১০০ গজ দৈর্ঘ্য। ১৯০৮ সালে প্রথম লন্ডন অলিম্পিকে নির্মাণ করা হয় ১০০ মিটার সুইমিং পুল। ১৯১২ সালের সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় স্টকহোম বন্দরে এবং সেবারই প্রথম ‘ইলেক্ট্রনিক টাইমিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
১৯৪০ দশক পর্যন্ত পুরুষ সাঁতারুদের পোশাকে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকতে হতো। ১৯২৪-এ দ্বিতীয় প্যারিস অলিম্পিকে প্রথম ৫০ মিটার সুইমিং পুল নির্মাণ করা হয়। সেবারই প্রথম সাঁতারের লেন চিহ্নিত করে দেয়া হয়।
৩০০ গজ, ১৩০০ গজ ফ্রিস্টাইলসহ ৪০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক, ৫০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক ১৯৪৮ সালে বাদ দেয়া হয়। ১৯৫২ সালে বাদ পড়ে ৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক এবং ৩ী১০০ মিটার মেডলে।
টেলিভিশনে অলিম্পিক
টেলিভিশন ৩০ দিনে বাজার পেয়েছে। সংবাদ, কথিকা ও নাটক ছাড়াও যে টেলিভিশনকে কাজে লাগানো যায় তাই দেখাতে চাইলেন ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকের আয়োজকরা। তারা টেলিভিশনে অলিম্পিক দেখাবেন। অমনি বাজারে কার্টুন নেমে এলো। এ্যাথলেটরা দৌড় শুরু করতে যাচ্ছেন। দর্শকের জায়গায় আসন নিয়েছে টেলিভিশন ও রেডিও। কার্টুনটি দেখুন।
অলিম্পিক দেখানো হলো, কিন্তু তা সীমিত থাকল স্থানীয় দর্শকের মধ্যেই। এর মধ্যে প্রযুক্তিও অনেকদূর এগিয়ে গেল, ১৯৫৬ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আন্তর্জাতিক সম্প্রচারের আয়োজন করা হলো। পরবর্তী শীতকালীন অলিম্পিক যুক্তরাষ্ট্রে দেখানোর একক স্বত্ব কিনে নিল সিবিএস টেলিভিশন। সিবিএস দিল ৯৪ হাজার ডলার আর ইউরোপে সম্প্রচারের জন্য ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন দিল ৬,৬০,০০০ ডলার। সুপার পাওয়ারগুলোর মধ্যে যখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, তেমনি অলিম্পিক গেমস দেখানোর স্বত্ব লাভের দ্বন্দ্বও তুঙ্গে। সুবিধা হলো আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির। দর বাড়াতে লাগল অলিম্পিকেরও। ১৯৯৮-র শীতকালীন অলিম্পিক যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রচারের জন্য সিবিএস দিল ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়ের জন্য এনবিসি অলিম্পিক স্বত্বের জন্য প্রদান করল ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৬০ থেকে অলিম্পিক টেলিভিশন দর্শকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলল। ১৯৬৪ সালে যোগ হলো স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টিং। গরিব দেশগুলোও পেতে শুরু করল সম্প্রচারের ভাগ। ১৯৬৮-তে যখন রঙিন টেলিভিশন এলো শুরু হলো আনন্দ ও রঙের বিপ্লব। ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিক টিভির পর্দায় দেখলেন ৬০ কোটি দর্শক। ১৯৮৪-র লস এ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে এই ধরনের দর্শক বেড়ে দাঁড়াল ৯০ কোটি। ১৯৯২-র বার্সিলোনা অলিম্পিক পৌঁছে গেল সাড়ে তিন শত কোটি দর্শকের কাছে। খেলার মাঠে ইন্টারনেটের এই প্রবেশ টেলিভিশনের কিছু দর্শক সরিয়ে নিল।
২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিক প্রমাণ করল ইন্টারনেট এবং কেবল অপারেটরদের দলাদলিতে দর্শক কমেনি, যতটা বাড়ার কথা ছিল হয়ত ততটা বাড়েনি। লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রায় ৪০০ কোটি মানুষের উপভোগ্য হয়েছে বলে আয়োজকরা জানিয়েছিল।
সামাজিক গণমাধ্যমে ২০১২ অলিম্পিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এবার অলিম্পিকে ফেসবুকে সংযুক্ত ভক্তের সংখ্যা ৯০ কোটি এবং টুইটারে ১৪ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। স্মার্ট মোবাইল ফোন, হালকা ল্যাপটপ এখন হাতে হাতে। ফুটবল চ্যাম্পিয়ন লীগে বার্সিলোনা ও চেলসির খেলায় প্রতি সেকেন্ডে ১২,৬৪৮ টুইট গৃহীত হয়েছে। লন্ডন অলিম্পিক সম্ভবত এই রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।
অলিম্পিককে সাগ্রহে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে স্পন্সররা। কোকাকোলা, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, ক্যাডবারি, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, বিএমডব্লিউ এবং আরও অনেকে নিজস্ব ব্যবসায়িক মাধ্যমে দর্শকদের প্ররোচিত করছে। অনেক স্পন্সর ফেসবুকে বড় পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।
অবশ্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির ৭০,০০০ কর্মচারীর মুখে কুলুপ আটার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা কিছুই বললেন না, বলতে পারবেন না।
এবার গণমাধ্যমে সাফল্য ও ব্যর্থতায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন সাঁতারু মাইকেল ফেলপ্্স।
ল্যারিসা ল্যাতিনিনার ৪৮ বছরের রাজত্ব
৭৮ বছর বয়সী ল্যারিসা সেমিওনোভনা ল্যাতিনিনা, এক সময়কার বিশ্বের সবচেয়ে ডাকসাইডে জিমন্যাস্ট, যার অলিম্পিক পদকের ভার ছিল সবচেয়ে বেশি, ৪৮ বছর ধরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অলিম্পিক পদকধারী হিসেবে যার ছিল একক রাজত্ব, তারই চোখের সামনে সেই রাজত্ব দখল করে নিলেন পানির প্রজাপতি মাইকেল ফেলপ্্স।
ইউক্রেনিয়ান ল্যারিসা ল্যাতিনিনা ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ মেলবোর্ন, রোম ও টোকিও অলিম্পিকে ১৪টি স্বর্ণসহ ১৮টি পদকের গর্বিত অধিকারী হলেন। ল্যারিফ হতে চেয়েছিলেন ব্যালে নৃত্যশিল্পী, নাচতে নাচতে হয়ে গেলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিমন্যাস্ট।
তিনিও প্রজাপতির চাঞ্চল্য নিয়ে মেলবোর্নে (১৯৫৬) জিতলেন ৪ সোনা ১ রূপা ও ১ ব্রোঞ্জ।
৪ সোনা : অল-রাউন্ড, টিম, ফ্লোর এক্সারসাইজ এবং ভোল্ট ইভেন্ট
১ রূপা : বার ইভেন্ট
১ ব্রোঞ্জ : অবজেক্ট এক্সারসাইজ ইভেন্ট
রোম অলিম্পিকে পেলেন ৩ সোনা, ২ রূপা ১ ব্রোঞ্জ।
৩ সোনা : অল-রাউন্ড, টিম ও ফ্লোর এক্সারসাইজ
২ রূপা : বার ও ব্যালেন্স বিম
১ ব্রোঞ্জ : ভল্ট।
টোকিও অলিম্পিকে জিতে নিলেন ২ সোনা, ২ রূপা ও ২ ব্রোঞ্জ।
২ সোনা : টিম ও ফ্লোর এক্সারসাইজ
২ রূপা : অল-রাইন্ড ও ভল্ট
২ ব্রোঞ্জ : বার ও ব্যালেন্স বিম
তিনি ডিঙ্গিয়েছেন পাভো নুর্মিকে। তাঁকে ডিঙ্গাতে পারেননি মার্ক স্পিৎজ কিংবা কার্ল লিউইস। তাঁকে ডিঙ্গিয়ে গেলেন মাইকেল ফেলপ্্স। তিনি লাইন ধরে টিকেট কেটেই মাইকেল ফেলপ্্সের সাঁতার দেখতে গিয়েছিলেন। ফেলপ্্স যখন ১৯তম পদকটি জিতে ৪৮ বছরের ‘নারী রাজত্বের’ অবসান ঘটালেন, ল্যারিসাই মনে মনে চাচ্ছিলেন তিনি যেন পদকটি তাকে পরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু অলিম্পিক কর্তৃপক্ষের মাথায় সেটি আসেনি। এ নিয়ে আফসোস নেই ল্যারিসার। মেয়ে হয়ে তিনি যে বিশ্বরেকর্ড ৪৮ বছর ধরে রেখেছেন এটাই তো তাঁর কাছে অনেক বড় সাফল্য। ফেলপ্্সের রেকর্ড ভাঙ্গার আগেই ল্যারিসা ক’মাস আগে নিউইয়র্কে এসে ফেলপ্্সকে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজের একটি পদক তাঁকে উপহার দিয়ে গেছেন। উদারতার দুর্লভ উদাহরণ। ল্যারিসা আপনাকে আমাদেরও অভিনন্দন।
মায়ের ছেলে মাইকেল ফেলপ্্স
বাবার ছেলে নন বলা হয়ত ঠিক হবে না, কিন্তু বাবার ভাগ সামান্যই। ফেলপ্সের জন্ম ৩০ জুন ১৯৮৫ যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সিটির মফস্বল শহর ম্যারিল্যান্ডের টাউসন নামের একটি এলাকাতে (১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাল্টিমোর সিটির লোকজন বাংলাদেশকে সমর্থন যুগিয়েছে, দ্য বাল্টিমোর সান বাংলাদেশের পক্ষে অনেক সংবাদ প্রতিবেদন ও ভাষ্য ছেপেছে।) মাইকেলের মা ডোরাহ স্যু, প্রিয় ডাকনাম ডেবি ‘সিঙ্গেল মাদার’। ফেলপ্্সের বয়স যখন নয় তখনই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। দু’টি মেয়ে এবং সবচেয়ে ছোট সন্তান ফেলপ্্সকে নিয়ে একাই জীবন সংগ্রামে নামেন। তার স্বামী ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়।
বড় দু’বোন সাঁতারু। সুতরাং ছোটটিকে নামতে হলো পানিতে। ১০ বছর বয়সে সেই বয়সী বালকদের সাঁতারে জাতীয় রেকর্ড করলেন। এর মধ্যে ধরা পড়ল পড়াশোনায় তার মনোযোগ নেই। রোগটির বেশ বড় একটি নাম ‘এ্যাটেনশন-ডেফিসিট হাইপারএ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)। কিন্তু পানিতে নেমে গেলে সাঁতারে তার মনোযোগের ঘাটতি নেই।
মা বললেন সাঁতারু হওয়া ছাড়া মাইকেলের সামনে আর কোন পথই খোলা ছিল না। মাইকেল ফেলপ্্স যখন প্রথম স্বর্ণপদক জিতলেন তার বয়স কেবল ১৫ বছর। ৬৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী সোনাজয়ী আমেরিকান পুরুষ।
এর অনেক বছর আগে রবার্ট ব্রুস ম্যাথিয়াস (বব ম্যাথিয়াস) ১৭ বছর বয়সে যখন সোনার পদক পেলেন কী ভাবে এই সাফল্য উদযাপন করবেন জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন ‘দাঁড়ি কামাতে শুরু করব।’
আর ফেলপ্্সের বেলায় সোনা জয়ের সময় দাঁড়ি গজাতে শুরু করেনি।
সেই প্রথম সোনাজয়ের সময় ডেবি পাশে ছিলেন না তিনি সারারাত কেঁদেছেন, তারপর থেকে তিনি ছেলের সাফল্যের মুহূর্তগুলোতে পাশেই থেকেছেন। ফেলপ্্স যে তারই ছেলে! ডেবির ছেলে মাইকেল ফেলপ্্স।
সাঁতারের সেরা ১০ জন
মাইকেল ফেলপ্্সই যে সাঁতারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তারপর কে?
অবশ্যই মার্ক স্পিৎজ।
মার্ক স্পিৎজ, জন্ম আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০। তাঁর পরিবার যখন হনলুলুতে বসত গাড়ল বালক মার্কের প্রতিদিনের কাজ ওয়াইকিকি সমুদ্র সৈকত পেরিয়ে বিক্ষুব্ধ জলতরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া। দেখলে যে কেউ মনে করবে অভিমানী বালক আত্মহত্যা করার জন্য ছুটছে। ১০ বছর বয়সে বালক সাঁতারে তার দখলে ১৭টি জাতীয় রেকর্ড এবং ১টি বিশ্বরেকর্ড। ততদিনে ১০টি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী মার্ক স্পিৎজ যখন ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিকে এলেন ২টি স্বর্ণপদক পেলেও নিজেকে মেলে ধরতে পারলেন না। অতৃপ্ত মার্ক স্পিৎজ নিজেই জলদানব হয়ে নামলেন ১৯৭২-এর মিউজিক অলিম্পিকে। তিনি ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ছাড়া ৬টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চাপের মুখে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলেও নাম লেখতে হলো তাকে। তিনি সুইমিং পুলের ডেকে দাঁড়িয়ে এবিসি টেলিভিশনকে বলেন, আমি যদি ৬টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৬টি সোনা জিতি তাহলে আমি হবো হিরো, কিন্তু ৭টিতে অংশ নিয়ে ৬টি সোনা জিতলে আমি হয়ে যাব ব্যর্থ।
কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে এমনকি অপছন্দের ইভেন্টে অংশ নিয়ে সোনা তো জিতলেনই, বিশ্বরেকর্ডও করলেন। এর আগে এক অলিম্পিকে ৭টি স্বর্ণপদক কেউ পায়নি, এটিও বিশ্বরেকর্ড। ৩৬ বছর পর বেইজিং অলিম্পিকে ৮টি স্বর্ণপদক জিতে এই রেকর্ড ভাঙলেন মাইকেল ফেলপ্্স।
মার্ক স্পিৎজ স্বর্ণ পেলেন যে সব ইভেন্ডে :
১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১০০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ মিটার বাটারফ্লাই, ৪ী১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে, ৪ী২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে, ৪ী১০০ মিটার মেডলে রিলে। সাঁতারে এর পরের নামটি ম্যাথিউ নিকোলাস বিয়োন্দি। ৮টি স্বর্ণসহ তাঁর অধিকারে ১১টি অলিম্পিক পদক। সবচেয়ে বেশি ৫টি স্বর্ণ জিতেছেন ১৯৮৮ সওল অলিম্পিকে।
তারপর জনি ওয়াইজমুলার। ৫টি স্বর্ণপদকের অধিকারী জনি পরবর্তীকালে আরো খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন ১২টি টারজান চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে।
শ্রেষ্ঠ দশের মধ্যে রয়েছেন আয়ান থর্প (৫টি স্বর্ণপদকসহ ৯টি পদক), জেনি থমসন তার স্বর্ণপদক ৮টি, ক্রিস্টিনা এগারসেজি (৫টি স্বর্ণসহ মোট ৭টি), অস্ট্রেলিয়ার ডন ফ্রেজার এবং অপর একজন অস্ট্রেলিয়ান শেইন গোল্ড।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অলিম্পিয়ান
পদকের হিসেবে মাইকেল ফেলপ্্সের কাছাকাছি যে আর কেউ নেই। সেবাস্টিয়ান কো মাইকেল ফেলপসের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যতই সন্দেহ করুন, তা যে ধোপে টেকার নয় তিনিও তা জানেন।
শুধু পদকের শ্রেষ্ঠত্ব নয় মানবতার কোন মাপকাঠি যদি নির্ধারণ করা যায় খেলোয়াড়দের মধ্যে শীর্ষস্থান তিনিই পাবেন। শিশুদের জাগরণের জন্য তিনি ১ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন। বেজিং অলিম্পিকে ৮ স্বর্ণের কৃতিত্বে তিনি যে ১ মিলিয়ন ডলার বোনাস পেয়েছেন তা-ই দিলেন শিশুদের। উদ্দেশ্য : শিশুরা স্বপ্ন দেখবে, পরিকল্পনা করবে এবং লক্ষ্যে পৌঁছবে। এখন থেকে তার সেবামূলক কাজ আরও বেড়ে যাবে।
ফেলপস একাই যদি একটি দেশ হতেন!
১৮টি স্বর্ণপদক নিয়ে ‘উড়ন্ত মৎস্য’ মাইকেল ফেলপসের অবস্থান দেশগুলোর ১২তম। ঐতিহ্যগত অলিম্পিক শক্তি রোমানিয়া, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস কিউবা এবং স্পেন থেকে বেশ এগিয়ে ফেলপসÑ একাই।
এ্যাথলেটিক্সে অন্যতম বিশ্বনেতা স্পেন। ২০০৪ থেকে এ পর্যন্ত স্পেন যত অলিম্পিক স্বর্ণপদক পেয়েছে, ফেলপসের স্বর্ণ তার চেয়ে ১০টি বেশি।
ফেলপস যদি একাই একটি দেশ হতেন লন্ডন অলিম্পিকে তার পাওয়া ৬টি পদক নিয়ে মোট পদক গণনায় তাঁর অবস্থান হতো ১৩তম; একই স্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ডস, ইউক্রেন এবং ২০১৬ অলিম্পিকের আয়োজক দেশ ব্রাজিল। লন্ডনে ফেলপস যে ক’টা স্বর্ণপদক পেয়েছেন মাত্র আটটি দেশ তাঁকে অতিক্রম করতে বা ছুঁতে পেরেছে।
তিনটি অলিম্পিকের (এ্যাথেস, বেজিং ও লন্ডন) সাঁতারের মোট ইভেন্ট ৪৮। তিনি পদক পেয়েছেন ২২টিতে। স্মরণ রাখবেন তিনি সবগুলোতে অংশগ্রহণ করেননি; করেছেন মাত্র ২৪টিতে।
ফেলপস যদি একাই একটি দেশ হতেন, সে দেশের জনসংখ্যা হতো ১; সেই ১ জনের দখলে ১৮টি স্বর্ণসহ ২২টি অলিম্পিক পদক। ১.২৪ বিলিয়ন জনগণের দেশ ভারত। সেখানে এ্যাথলেটিক্স চর্চা নেই এমন একটি মহকুমাও নেই। এত বছরে ভারতের পাওয়া পদকের মাথা পিছু ভাগ দাঁড়ায় .০০০০০০৫৪৫৪৫৫ (দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য পাঁচ চার পাঁচ চার পাঁচ পাঁচ)। অন্যদিকে ফেলপস নামক দেশের মাথাপিছু পদক ২২টি।
১১২ বছর ধরে আর্জেন্টিনা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছে। ক্রীড়াঙ্গনে আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনার মতো ফুটবল খেলোয়াড় দিয়েছে, গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি ও ডেল পর্তোর মতো গ্র্যান্ডসøাম বিজয়ী টেনিস তারকা দিয়েছে। ১১২ বছরে আর্জেন্টিনা ফেলপসের চেয়ে ১টি পদক কম পেয়েছে। এ কী মানব না দানব?
সাঁতারের আর একটি দৃশ্য আমাদের প্রায় সবারই মনে গাঁথা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তখন কৈশোর। মাকে দেখতে কলকাতা থেকে মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে যাচ্ছেন। পথে খরস্রোতা দামোদর নদী। অন্ধকার রাত, প্রচ- ঝড়, একটি নৌকাও নেই ঘাটে। ঈশ্বরচন্দ্র সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না। নৌকা না থাকে না থাক, সাঁতরেই নদী পার হবেন!
সাঁতার এ কালের কোন বিষয় নয়। একালে সাঁতারে বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে কেবল। প্রাগৈতিহাসিক আমলে, প্রস্তরযুগে ৭০০০ বছরেরও বেশি সময় আগের গুহা-ছবিতে সাঁতার কাটার ছবি খোদাই করা হয়েছে। তিন থেকে চার হাজার বছর আগে সাঁতার কাহিনী মানুষ প্রচার করতে শুরু করেছে। গিলগামেশ, বেওলফ-এ তো রয়েছেই, ইলিয়াড ও ওডেসিতে হোমার সাঁতারের বর্ণনা দিয়েছেন। সাঁতারের কথা বাইবেলেও রয়েছে। ১৮০০ সালের দিকে ইউরোপে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে সাঁতারের শুভযাত্রা। প্রথম আধুনিক অলিম্পিক ১৮৯৬ সালের এ্যাথেন্স অলিম্পিকে প্রতিযোগিতার ইভেন্ট হিসেবে সাঁতার শুরু হয়। ১৯০৮ সালে গঠিত হয় বিশ্ব সাঁতার ফেডারেশন ফিনা। সাধারণভাবে সাঁতারের স্টাইল : ফ্রন্ট ক্রল, ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্টস্ট্রোক এবং বাটারফ্লাই। সবশেষে গৃহীত হয় বাটারফ্লাই ১৯৫২ সালে।
নারী ও পুরুষের ফিনা-স্বীকৃত সাঁতার
সাঁতার নারী ও পুরুষের যে সমস্ত ইভেন্টে বিশ্বরেকর্ড স্বীকৃত সেগুলো হচ্ছে-
ফ্রিস্টাইল : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার, ৮০০ মিটার এবং ১৫০০ মিটার
ব্যাকস্ট্রোক : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার
ব্রেস্টস্ট্রোক : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার
বাটারফ্লাই : ৫০ মিটার, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার
ব্যক্তিগত মিডলে : ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার
রিলে : ৪ী১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ৪ী২১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ৪ী১০০ মিটার মেডলে।
এখন তো সাঁতারের সব ইভেন্টই সুইমিং পুলে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম চারটি অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় উন্মুক্ত সাগরে, নদীতে, খালে। ১৮৯৬ সালে প্রথম এ্যাথেন্স অলিম্পিকে সাঁতারে ভ্যানু ভূমধ্যসাগর। ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে সিন নদী। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুই অলিম্পিকে খাল। ১৯০৪ এর অলিম্পিকে ফ্রিস্টাইল সাঁতার মাপা হয় ১০০ গজ দৈর্ঘ্য। ১৯০৮ সালে প্রথম লন্ডন অলিম্পিকে নির্মাণ করা হয় ১০০ মিটার সুইমিং পুল। ১৯১২ সালের সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় স্টকহোম বন্দরে এবং সেবারই প্রথম ‘ইলেক্ট্রনিক টাইমিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
১৯৪০ দশক পর্যন্ত পুরুষ সাঁতারুদের পোশাকে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকতে হতো। ১৯২৪-এ দ্বিতীয় প্যারিস অলিম্পিকে প্রথম ৫০ মিটার সুইমিং পুল নির্মাণ করা হয়। সেবারই প্রথম সাঁতারের লেন চিহ্নিত করে দেয়া হয়।
৩০০ গজ, ১৩০০ গজ ফ্রিস্টাইলসহ ৪০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক, ৫০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক ১৯৪৮ সালে বাদ দেয়া হয়। ১৯৫২ সালে বাদ পড়ে ৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক এবং ৩ী১০০ মিটার মেডলে।
টেলিভিশনে অলিম্পিক
টেলিভিশন ৩০ দিনে বাজার পেয়েছে। সংবাদ, কথিকা ও নাটক ছাড়াও যে টেলিভিশনকে কাজে লাগানো যায় তাই দেখাতে চাইলেন ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকের আয়োজকরা। তারা টেলিভিশনে অলিম্পিক দেখাবেন। অমনি বাজারে কার্টুন নেমে এলো। এ্যাথলেটরা দৌড় শুরু করতে যাচ্ছেন। দর্শকের জায়গায় আসন নিয়েছে টেলিভিশন ও রেডিও। কার্টুনটি দেখুন।
অলিম্পিক দেখানো হলো, কিন্তু তা সীমিত থাকল স্থানীয় দর্শকের মধ্যেই। এর মধ্যে প্রযুক্তিও অনেকদূর এগিয়ে গেল, ১৯৫৬ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আন্তর্জাতিক সম্প্রচারের আয়োজন করা হলো। পরবর্তী শীতকালীন অলিম্পিক যুক্তরাষ্ট্রে দেখানোর একক স্বত্ব কিনে নিল সিবিএস টেলিভিশন। সিবিএস দিল ৯৪ হাজার ডলার আর ইউরোপে সম্প্রচারের জন্য ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন দিল ৬,৬০,০০০ ডলার। সুপার পাওয়ারগুলোর মধ্যে যখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, তেমনি অলিম্পিক গেমস দেখানোর স্বত্ব লাভের দ্বন্দ্বও তুঙ্গে। সুবিধা হলো আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির। দর বাড়াতে লাগল অলিম্পিকেরও। ১৯৯৮-র শীতকালীন অলিম্পিক যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রচারের জন্য সিবিএস দিল ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়ের জন্য এনবিসি অলিম্পিক স্বত্বের জন্য প্রদান করল ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৬০ থেকে অলিম্পিক টেলিভিশন দর্শকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলল। ১৯৬৪ সালে যোগ হলো স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টিং। গরিব দেশগুলোও পেতে শুরু করল সম্প্রচারের ভাগ। ১৯৬৮-তে যখন রঙিন টেলিভিশন এলো শুরু হলো আনন্দ ও রঙের বিপ্লব। ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিক টিভির পর্দায় দেখলেন ৬০ কোটি দর্শক। ১৯৮৪-র লস এ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে এই ধরনের দর্শক বেড়ে দাঁড়াল ৯০ কোটি। ১৯৯২-র বার্সিলোনা অলিম্পিক পৌঁছে গেল সাড়ে তিন শত কোটি দর্শকের কাছে। খেলার মাঠে ইন্টারনেটের এই প্রবেশ টেলিভিশনের কিছু দর্শক সরিয়ে নিল।
২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিক প্রমাণ করল ইন্টারনেট এবং কেবল অপারেটরদের দলাদলিতে দর্শক কমেনি, যতটা বাড়ার কথা ছিল হয়ত ততটা বাড়েনি। লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রায় ৪০০ কোটি মানুষের উপভোগ্য হয়েছে বলে আয়োজকরা জানিয়েছিল।
সামাজিক গণমাধ্যমে ২০১২ অলিম্পিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এবার অলিম্পিকে ফেসবুকে সংযুক্ত ভক্তের সংখ্যা ৯০ কোটি এবং টুইটারে ১৪ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। স্মার্ট মোবাইল ফোন, হালকা ল্যাপটপ এখন হাতে হাতে। ফুটবল চ্যাম্পিয়ন লীগে বার্সিলোনা ও চেলসির খেলায় প্রতি সেকেন্ডে ১২,৬৪৮ টুইট গৃহীত হয়েছে। লন্ডন অলিম্পিক সম্ভবত এই রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।
অলিম্পিককে সাগ্রহে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে স্পন্সররা। কোকাকোলা, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, ক্যাডবারি, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, বিএমডব্লিউ এবং আরও অনেকে নিজস্ব ব্যবসায়িক মাধ্যমে দর্শকদের প্ররোচিত করছে। অনেক স্পন্সর ফেসবুকে বড় পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।
অবশ্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির ৭০,০০০ কর্মচারীর মুখে কুলুপ আটার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা কিছুই বললেন না, বলতে পারবেন না।
এবার গণমাধ্যমে সাফল্য ও ব্যর্থতায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন সাঁতারু মাইকেল ফেলপ্্স।
ল্যারিসা ল্যাতিনিনার ৪৮ বছরের রাজত্ব
৭৮ বছর বয়সী ল্যারিসা সেমিওনোভনা ল্যাতিনিনা, এক সময়কার বিশ্বের সবচেয়ে ডাকসাইডে জিমন্যাস্ট, যার অলিম্পিক পদকের ভার ছিল সবচেয়ে বেশি, ৪৮ বছর ধরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অলিম্পিক পদকধারী হিসেবে যার ছিল একক রাজত্ব, তারই চোখের সামনে সেই রাজত্ব দখল করে নিলেন পানির প্রজাপতি মাইকেল ফেলপ্্স।
ইউক্রেনিয়ান ল্যারিসা ল্যাতিনিনা ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ মেলবোর্ন, রোম ও টোকিও অলিম্পিকে ১৪টি স্বর্ণসহ ১৮টি পদকের গর্বিত অধিকারী হলেন। ল্যারিফ হতে চেয়েছিলেন ব্যালে নৃত্যশিল্পী, নাচতে নাচতে হয়ে গেলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিমন্যাস্ট।
তিনিও প্রজাপতির চাঞ্চল্য নিয়ে মেলবোর্নে (১৯৫৬) জিতলেন ৪ সোনা ১ রূপা ও ১ ব্রোঞ্জ।
৪ সোনা : অল-রাউন্ড, টিম, ফ্লোর এক্সারসাইজ এবং ভোল্ট ইভেন্ট
১ রূপা : বার ইভেন্ট
১ ব্রোঞ্জ : অবজেক্ট এক্সারসাইজ ইভেন্ট
রোম অলিম্পিকে পেলেন ৩ সোনা, ২ রূপা ১ ব্রোঞ্জ।
৩ সোনা : অল-রাউন্ড, টিম ও ফ্লোর এক্সারসাইজ
২ রূপা : বার ও ব্যালেন্স বিম
১ ব্রোঞ্জ : ভল্ট।
টোকিও অলিম্পিকে জিতে নিলেন ২ সোনা, ২ রূপা ও ২ ব্রোঞ্জ।
২ সোনা : টিম ও ফ্লোর এক্সারসাইজ
২ রূপা : অল-রাইন্ড ও ভল্ট
২ ব্রোঞ্জ : বার ও ব্যালেন্স বিম
তিনি ডিঙ্গিয়েছেন পাভো নুর্মিকে। তাঁকে ডিঙ্গাতে পারেননি মার্ক স্পিৎজ কিংবা কার্ল লিউইস। তাঁকে ডিঙ্গিয়ে গেলেন মাইকেল ফেলপ্্স। তিনি লাইন ধরে টিকেট কেটেই মাইকেল ফেলপ্্সের সাঁতার দেখতে গিয়েছিলেন। ফেলপ্্স যখন ১৯তম পদকটি জিতে ৪৮ বছরের ‘নারী রাজত্বের’ অবসান ঘটালেন, ল্যারিসাই মনে মনে চাচ্ছিলেন তিনি যেন পদকটি তাকে পরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু অলিম্পিক কর্তৃপক্ষের মাথায় সেটি আসেনি। এ নিয়ে আফসোস নেই ল্যারিসার। মেয়ে হয়ে তিনি যে বিশ্বরেকর্ড ৪৮ বছর ধরে রেখেছেন এটাই তো তাঁর কাছে অনেক বড় সাফল্য। ফেলপ্্সের রেকর্ড ভাঙ্গার আগেই ল্যারিসা ক’মাস আগে নিউইয়র্কে এসে ফেলপ্্সকে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজের একটি পদক তাঁকে উপহার দিয়ে গেছেন। উদারতার দুর্লভ উদাহরণ। ল্যারিসা আপনাকে আমাদেরও অভিনন্দন।
মায়ের ছেলে মাইকেল ফেলপ্্স
বাবার ছেলে নন বলা হয়ত ঠিক হবে না, কিন্তু বাবার ভাগ সামান্যই। ফেলপ্সের জন্ম ৩০ জুন ১৯৮৫ যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সিটির মফস্বল শহর ম্যারিল্যান্ডের টাউসন নামের একটি এলাকাতে (১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাল্টিমোর সিটির লোকজন বাংলাদেশকে সমর্থন যুগিয়েছে, দ্য বাল্টিমোর সান বাংলাদেশের পক্ষে অনেক সংবাদ প্রতিবেদন ও ভাষ্য ছেপেছে।) মাইকেলের মা ডোরাহ স্যু, প্রিয় ডাকনাম ডেবি ‘সিঙ্গেল মাদার’। ফেলপ্্সের বয়স যখন নয় তখনই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। দু’টি মেয়ে এবং সবচেয়ে ছোট সন্তান ফেলপ্্সকে নিয়ে একাই জীবন সংগ্রামে নামেন। তার স্বামী ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়।
বড় দু’বোন সাঁতারু। সুতরাং ছোটটিকে নামতে হলো পানিতে। ১০ বছর বয়সে সেই বয়সী বালকদের সাঁতারে জাতীয় রেকর্ড করলেন। এর মধ্যে ধরা পড়ল পড়াশোনায় তার মনোযোগ নেই। রোগটির বেশ বড় একটি নাম ‘এ্যাটেনশন-ডেফিসিট হাইপারএ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)। কিন্তু পানিতে নেমে গেলে সাঁতারে তার মনোযোগের ঘাটতি নেই।
মা বললেন সাঁতারু হওয়া ছাড়া মাইকেলের সামনে আর কোন পথই খোলা ছিল না। মাইকেল ফেলপ্্স যখন প্রথম স্বর্ণপদক জিতলেন তার বয়স কেবল ১৫ বছর। ৬৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী সোনাজয়ী আমেরিকান পুরুষ।
এর অনেক বছর আগে রবার্ট ব্রুস ম্যাথিয়াস (বব ম্যাথিয়াস) ১৭ বছর বয়সে যখন সোনার পদক পেলেন কী ভাবে এই সাফল্য উদযাপন করবেন জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন ‘দাঁড়ি কামাতে শুরু করব।’
আর ফেলপ্্সের বেলায় সোনা জয়ের সময় দাঁড়ি গজাতে শুরু করেনি।
সেই প্রথম সোনাজয়ের সময় ডেবি পাশে ছিলেন না তিনি সারারাত কেঁদেছেন, তারপর থেকে তিনি ছেলের সাফল্যের মুহূর্তগুলোতে পাশেই থেকেছেন। ফেলপ্্স যে তারই ছেলে! ডেবির ছেলে মাইকেল ফেলপ্্স।
সাঁতারের সেরা ১০ জন
মাইকেল ফেলপ্্সই যে সাঁতারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তারপর কে?
অবশ্যই মার্ক স্পিৎজ।
মার্ক স্পিৎজ, জন্ম আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০। তাঁর পরিবার যখন হনলুলুতে বসত গাড়ল বালক মার্কের প্রতিদিনের কাজ ওয়াইকিকি সমুদ্র সৈকত পেরিয়ে বিক্ষুব্ধ জলতরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া। দেখলে যে কেউ মনে করবে অভিমানী বালক আত্মহত্যা করার জন্য ছুটছে। ১০ বছর বয়সে বালক সাঁতারে তার দখলে ১৭টি জাতীয় রেকর্ড এবং ১টি বিশ্বরেকর্ড। ততদিনে ১০টি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী মার্ক স্পিৎজ যখন ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিকে এলেন ২টি স্বর্ণপদক পেলেও নিজেকে মেলে ধরতে পারলেন না। অতৃপ্ত মার্ক স্পিৎজ নিজেই জলদানব হয়ে নামলেন ১৯৭২-এর মিউজিক অলিম্পিকে। তিনি ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ছাড়া ৬টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চাপের মুখে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলেও নাম লেখতে হলো তাকে। তিনি সুইমিং পুলের ডেকে দাঁড়িয়ে এবিসি টেলিভিশনকে বলেন, আমি যদি ৬টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৬টি সোনা জিতি তাহলে আমি হবো হিরো, কিন্তু ৭টিতে অংশ নিয়ে ৬টি সোনা জিতলে আমি হয়ে যাব ব্যর্থ।
কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে এমনকি অপছন্দের ইভেন্টে অংশ নিয়ে সোনা তো জিতলেনই, বিশ্বরেকর্ডও করলেন। এর আগে এক অলিম্পিকে ৭টি স্বর্ণপদক কেউ পায়নি, এটিও বিশ্বরেকর্ড। ৩৬ বছর পর বেইজিং অলিম্পিকে ৮টি স্বর্ণপদক জিতে এই রেকর্ড ভাঙলেন মাইকেল ফেলপ্্স।
মার্ক স্পিৎজ স্বর্ণ পেলেন যে সব ইভেন্ডে :
১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১০০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ মিটার বাটারফ্লাই, ৪ী১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে, ৪ী২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে, ৪ী১০০ মিটার মেডলে রিলে। সাঁতারে এর পরের নামটি ম্যাথিউ নিকোলাস বিয়োন্দি। ৮টি স্বর্ণসহ তাঁর অধিকারে ১১টি অলিম্পিক পদক। সবচেয়ে বেশি ৫টি স্বর্ণ জিতেছেন ১৯৮৮ সওল অলিম্পিকে।
তারপর জনি ওয়াইজমুলার। ৫টি স্বর্ণপদকের অধিকারী জনি পরবর্তীকালে আরো খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন ১২টি টারজান চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে।
শ্রেষ্ঠ দশের মধ্যে রয়েছেন আয়ান থর্প (৫টি স্বর্ণপদকসহ ৯টি পদক), জেনি থমসন তার স্বর্ণপদক ৮টি, ক্রিস্টিনা এগারসেজি (৫টি স্বর্ণসহ মোট ৭টি), অস্ট্রেলিয়ার ডন ফ্রেজার এবং অপর একজন অস্ট্রেলিয়ান শেইন গোল্ড।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অলিম্পিয়ান
পদকের হিসেবে মাইকেল ফেলপ্্সের কাছাকাছি যে আর কেউ নেই। সেবাস্টিয়ান কো মাইকেল ফেলপসের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যতই সন্দেহ করুন, তা যে ধোপে টেকার নয় তিনিও তা জানেন।
শুধু পদকের শ্রেষ্ঠত্ব নয় মানবতার কোন মাপকাঠি যদি নির্ধারণ করা যায় খেলোয়াড়দের মধ্যে শীর্ষস্থান তিনিই পাবেন। শিশুদের জাগরণের জন্য তিনি ১ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন। বেজিং অলিম্পিকে ৮ স্বর্ণের কৃতিত্বে তিনি যে ১ মিলিয়ন ডলার বোনাস পেয়েছেন তা-ই দিলেন শিশুদের। উদ্দেশ্য : শিশুরা স্বপ্ন দেখবে, পরিকল্পনা করবে এবং লক্ষ্যে পৌঁছবে। এখন থেকে তার সেবামূলক কাজ আরও বেড়ে যাবে।
ফেলপস একাই যদি একটি দেশ হতেন!
১৮টি স্বর্ণপদক নিয়ে ‘উড়ন্ত মৎস্য’ মাইকেল ফেলপসের অবস্থান দেশগুলোর ১২তম। ঐতিহ্যগত অলিম্পিক শক্তি রোমানিয়া, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস কিউবা এবং স্পেন থেকে বেশ এগিয়ে ফেলপসÑ একাই।
এ্যাথলেটিক্সে অন্যতম বিশ্বনেতা স্পেন। ২০০৪ থেকে এ পর্যন্ত স্পেন যত অলিম্পিক স্বর্ণপদক পেয়েছে, ফেলপসের স্বর্ণ তার চেয়ে ১০টি বেশি।
ফেলপস যদি একাই একটি দেশ হতেন লন্ডন অলিম্পিকে তার পাওয়া ৬টি পদক নিয়ে মোট পদক গণনায় তাঁর অবস্থান হতো ১৩তম; একই স্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ডস, ইউক্রেন এবং ২০১৬ অলিম্পিকের আয়োজক দেশ ব্রাজিল। লন্ডনে ফেলপস যে ক’টা স্বর্ণপদক পেয়েছেন মাত্র আটটি দেশ তাঁকে অতিক্রম করতে বা ছুঁতে পেরেছে।
তিনটি অলিম্পিকের (এ্যাথেস, বেজিং ও লন্ডন) সাঁতারের মোট ইভেন্ট ৪৮। তিনি পদক পেয়েছেন ২২টিতে। স্মরণ রাখবেন তিনি সবগুলোতে অংশগ্রহণ করেননি; করেছেন মাত্র ২৪টিতে।
ফেলপস যদি একাই একটি দেশ হতেন, সে দেশের জনসংখ্যা হতো ১; সেই ১ জনের দখলে ১৮টি স্বর্ণসহ ২২টি অলিম্পিক পদক। ১.২৪ বিলিয়ন জনগণের দেশ ভারত। সেখানে এ্যাথলেটিক্স চর্চা নেই এমন একটি মহকুমাও নেই। এত বছরে ভারতের পাওয়া পদকের মাথা পিছু ভাগ দাঁড়ায় .০০০০০০৫৪৫৪৫৫ (দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য পাঁচ চার পাঁচ চার পাঁচ পাঁচ)। অন্যদিকে ফেলপস নামক দেশের মাথাপিছু পদক ২২টি।
১১২ বছর ধরে আর্জেন্টিনা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছে। ক্রীড়াঙ্গনে আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনার মতো ফুটবল খেলোয়াড় দিয়েছে, গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি ও ডেল পর্তোর মতো গ্র্যান্ডসøাম বিজয়ী টেনিস তারকা দিয়েছে। ১১২ বছরে আর্জেন্টিনা ফেলপসের চেয়ে ১টি পদক কম পেয়েছে। এ কী মানব না দানব?
No comments