গ্রামীণ ব্যাংক-দারিদ্র্য জয়ের লড়াইয়ে সমঝোতা চাই by মামুন রশীদ
সময়টা ছিল ২০১০ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ, স্থান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি পাঁচতারা হোটেল। আমার পাশে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ও একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। আমরা দু'জনেই নিউইয়র্কে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর রোড শোতে অংশ নিতে গিয়েছিলাম।
ফোন করলাম দেশে আমার একাশি বছরের বাবাকে। অনেকটা শয্যাশায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৯৭১ সালে সিলেটে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সিপাহি-জনতার প্রথম প্রতিরোধে সংগঠকের ভূমিকা পালনকারী আমার বাবাকে 'কেমন আছেন' জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এলো_ 'বেশ ভালো আছি বাবা, মৃত্যুর আগে বঙ্গবল্পুব্দ হত্যার বিচার দেখে গেলাম।' আমার সেই বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। আরও বেশি বুড়িয়ে গেছেন, বালিশের পাশে একটি পত্রিকা, চোখে প্রায় দেখেনই না, শুধু শিরোনামগুলো পড়তে পারেন। কুশল বিনিময় এবং ওষুধপত্র নিয়ে আলাপের পরপরই জিজ্ঞাসা করলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের কী হবে? অধ্যাপক ইউনূসের কী হবে?' বৃদ্ধ বাবাটি আমার ভালো করেই জানেন, অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকও নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ১২ বছর পরে হলেও হঠাৎ বোধোদয়সাপেক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে বয়সের কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দিয়েছেন। ইংরেজিতে এটি যেন অনেকটা যা বলা হয় 'উই স্ট্যান্ড কারেক্টেড' অর্থাৎ আমরা সংশোধিত হলাম। হাইকোর্টও অধ্যাপক ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ৯ মহিলা পরিচালকের রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশকেই বহাল রেখেছেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং উপরোক্ত পরিচালকরা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।
এদিকে আশপাশে সবদিকে আলোচনা চলছে, অধ্যাপক ইউনূসের অনুপস্থিতিতে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কীভাবে চলবে? কীভাবেই-বা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। অধ্যাপক ইউনূস তার উত্তরসূরি তৈরি করেননি, তা বোধহয় সত্য নয়। যাকে তিনি তৈরি করছিলেন, 'শর্ষেতে ভূতের' মতো তিনি বিভিন্ন নৈতিকতা-সংক্রান্ত অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। যার ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। তিনি অব্যাহতি পেলেন বা অব্যাহতি নিলেন।
অধ্যাপক ইউনূস স্বভাবতই গ্রামীণ ব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন ধীরে ধীরে গ্রামীণ ব্যাংকের দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে। এ সংক্রান্ত পরিকল্পনাও পেশ করলেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে গত এক বছরেও আমরা এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি। সম্প্রতি অবশ্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহু আগে অব্যাহতি নেওয়া একজন মহাব্যবস্থাপক এবং অধ্যাপক ইউনূসের সমালোচককে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশেষ মহল কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছেন, তাই যথাযথই ইউনূসবিরোধী জটিলতার অংশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গণমাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের বিবৃতি বলে যা প্রচার হচ্ছে, তার সঙ্গে তিনি মোটেই সংশ্লিষ্ট নন। এর অর্থ হলো, বৃহত্তর গ্রামীণ ব্যাংক পরিবারের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। গ্রামীণ ব্যাংক চলছে অধ্যাপক ইউনূসের শুভানুধ্যায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বৃহত্তর সদস্যগোষ্ঠী এবং সংশ্লিষ্ট মহল দ্বারা। এর ব্যত্যয় ঘটলে হয়তো কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক, দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত তথা সামগ্রিক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
ইতিমধ্যেই খবর বেরিয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়েছে। তাই সরকার, গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, বোর্ড তথা বাংলাদেশ ব্যাংককে অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষার জন্য। অধ্যাপক ইউনূসবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য। অবশ্য অভিজ্ঞ মহল বলছে, আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরেও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। এমনকি প্রয়োজনে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের স্বার্থে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্য আনীত আইনি সংশোধনের মতো উদ্যোগও গ্রহণ করা যেতে পারে।
বর্তমান চেয়ারম্যান দিয়ে যে শান্তিমতো গ্রামীণ ব্যাংক চালানো যাবে না, তা প্রায় দিব্যসত্য। তেমনটি যে-সে লোক দিয়েও যে গ্রামীণ ব্যাংকের পতন ঠেকানো যাবে না, তা-ও সত্য। এ ক্ষেত্রে যে কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে গ্রামীণ ব্যাংকের ৮০ লাখের বেশি সদস্য (যার অধিকাংশই মহিলা), ২৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র্য বিমোচন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, পরমতসহিষ্ণুতার পক্ষের লাখো-কোটি মানুষের কথাও ভাবতে হবে। আমরা চাই, প্রার্থনা করি সরকার ইংরেজিতে যাকে বলে 'ভ্যালু ইয়েস্টারডে' অর্থাৎ গতকালের ভিত্তিতে এ বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজে বৈষম্য, অবিচার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমরা আমাদের অবস্থার যুগান্তকারী কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। দারিদ্র্যবিরোধী লড়াই চলছে এবং হয়তো আরও বেশ কিছুকাল চালিয়ে যেতে হবে। সেই লড়াইয়ে সব কাণ্ডারির মধ্যে সহনশীলতা ও সমঝোতা দেশবাসীর কাম্য।
মামুন রশীদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
বাংলাদেশ ব্যাংক ১২ বছর পরে হলেও হঠাৎ বোধোদয়সাপেক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে বয়সের কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দিয়েছেন। ইংরেজিতে এটি যেন অনেকটা যা বলা হয় 'উই স্ট্যান্ড কারেক্টেড' অর্থাৎ আমরা সংশোধিত হলাম। হাইকোর্টও অধ্যাপক ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ৯ মহিলা পরিচালকের রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশকেই বহাল রেখেছেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং উপরোক্ত পরিচালকরা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।
এদিকে আশপাশে সবদিকে আলোচনা চলছে, অধ্যাপক ইউনূসের অনুপস্থিতিতে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কীভাবে চলবে? কীভাবেই-বা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। অধ্যাপক ইউনূস তার উত্তরসূরি তৈরি করেননি, তা বোধহয় সত্য নয়। যাকে তিনি তৈরি করছিলেন, 'শর্ষেতে ভূতের' মতো তিনি বিভিন্ন নৈতিকতা-সংক্রান্ত অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। যার ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। তিনি অব্যাহতি পেলেন বা অব্যাহতি নিলেন।
অধ্যাপক ইউনূস স্বভাবতই গ্রামীণ ব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন ধীরে ধীরে গ্রামীণ ব্যাংকের দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে। এ সংক্রান্ত পরিকল্পনাও পেশ করলেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে গত এক বছরেও আমরা এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি। সম্প্রতি অবশ্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহু আগে অব্যাহতি নেওয়া একজন মহাব্যবস্থাপক এবং অধ্যাপক ইউনূসের সমালোচককে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশেষ মহল কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছেন, তাই যথাযথই ইউনূসবিরোধী জটিলতার অংশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গণমাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের বিবৃতি বলে যা প্রচার হচ্ছে, তার সঙ্গে তিনি মোটেই সংশ্লিষ্ট নন। এর অর্থ হলো, বৃহত্তর গ্রামীণ ব্যাংক পরিবারের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। গ্রামীণ ব্যাংক চলছে অধ্যাপক ইউনূসের শুভানুধ্যায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বৃহত্তর সদস্যগোষ্ঠী এবং সংশ্লিষ্ট মহল দ্বারা। এর ব্যত্যয় ঘটলে হয়তো কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক, দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত তথা সামগ্রিক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
ইতিমধ্যেই খবর বেরিয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়েছে। তাই সরকার, গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, বোর্ড তথা বাংলাদেশ ব্যাংককে অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষার জন্য। অধ্যাপক ইউনূসবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য। অবশ্য অভিজ্ঞ মহল বলছে, আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরেও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। এমনকি প্রয়োজনে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের স্বার্থে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্য আনীত আইনি সংশোধনের মতো উদ্যোগও গ্রহণ করা যেতে পারে।
বর্তমান চেয়ারম্যান দিয়ে যে শান্তিমতো গ্রামীণ ব্যাংক চালানো যাবে না, তা প্রায় দিব্যসত্য। তেমনটি যে-সে লোক দিয়েও যে গ্রামীণ ব্যাংকের পতন ঠেকানো যাবে না, তা-ও সত্য। এ ক্ষেত্রে যে কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে গ্রামীণ ব্যাংকের ৮০ লাখের বেশি সদস্য (যার অধিকাংশই মহিলা), ২৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র্য বিমোচন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, পরমতসহিষ্ণুতার পক্ষের লাখো-কোটি মানুষের কথাও ভাবতে হবে। আমরা চাই, প্রার্থনা করি সরকার ইংরেজিতে যাকে বলে 'ভ্যালু ইয়েস্টারডে' অর্থাৎ গতকালের ভিত্তিতে এ বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজে বৈষম্য, অবিচার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমরা আমাদের অবস্থার যুগান্তকারী কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। দারিদ্র্যবিরোধী লড়াই চলছে এবং হয়তো আরও বেশ কিছুকাল চালিয়ে যেতে হবে। সেই লড়াইয়ে সব কাণ্ডারির মধ্যে সহনশীলতা ও সমঝোতা দেশবাসীর কাম্য।
মামুন রশীদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments